Read Time23 Minute, 3 Second
বাইরে হালকা অন্ধকার। চেহারা দেখানোর আগে সূর্য যে মৃদু আলো দেয়, সেটা দিচ্ছে। আমি জিন্সের প্যান্ট, টিশার্ট, আর একটা পার্কা পরে বের হয়েছি। বাইরে কত ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেটা নিশ্চিত হয়ে বের হয়েছি, কিন্তু বাতাসের গতিবেগ দেখিনি। এখানেই ভুল হল। প্রচণ্ড বেগে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এখানকার তুষারপাতে আমার ঠাণ্ডা লাগে না, লাগে হিম বাতাসে। এই মুহূর্তে গলায়-কানে মাফলার থাকা সত্ত্বেও ছুরির ফলার মত ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে যাচ্ছে। মাত্র তিনদিন আগে আমার ব্রংকাইটিস ধরা পড়েছে। এখনো স্টেরয়েড খাচ্ছি। এভাবে ঠাণ্ডা লাগলে ব্রংকাইটিস নিউমোনিয়ায় পরিণত হতে সময় লাগবে না। গত তিনদিন নিজের খুব যত্ন নিয়েছি যেন অ্যালাব্যামায় যাবার আগে সুস্থ হয়ে উঠতে পারি। কিন্তু উন্নতি হয়নি। হবে কীভাবে? ব্রংকাইটিস ভালো হওয়ার সাধারণ সময়সীমা হল সাত থেকে দশদিন। কিন্তু কাশি থাকতে পারে অনেকদিন। আমার সমস্যা মূলত এই কাশি। সারাদিন খুক খুক করে কাশছি। এটা অন্যদের কাছে যতটা না বিরক্তিকর, নিজের কাছে তারচেয়ে বেশি। গলায় সারাক্ষণ খুশখুশে অনুভূতি, কিছুতেই তাড়ানো যায় না। প্রেজেন্টেশনের মাঝেও কাশতে কাশতে অজ্ঞান হওয়ার দশা। এখনো কাশছি। ঠাণ্ডা বাতাসে উড়েও যাচ্ছি বারবার। পিছিয়ে পড়ছি প্রিন্সের চেয়ে। অবাক ব্যাপার হল, ঠাণ্ডায় আমার চেয়ে ওর এলার্জি বেশি। অথচ সে দিব্যি হাঁটছে। তার মানে ব্রংকাইটিসের কারণে আমার অস্বাভাবিক বেশি সমস্যা হচ্ছে। মনে হচ্ছে উবার নিলেই ভালো হত। মনে হচ্ছে অ্যালাব্যামা যেতে যেতে শরীর ঠিক থাকবে না।
.
আমাদের মত আরেকজনকে দেখলাম ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। পথিক নাকি জগার? এদের ঠিক নেই। এরা বৃষ্টির মধ্যে, তুষারপাতের মধ্যে, কিংবা দুপুরের ঠা ঠা রোদের মধ্যে জগিং করে। আমার কাছে বিশ মিনিটের পথকে মনে হচ্ছে এক ঘণ্টা। ভাবছি আর কষ্ট পাচ্ছি, আমরা কী গরীব! প্রতিটা পয়সা হিসেব করে খরচ করতে হয়। উবারে চড়লে যে পয়সা খরচ হত, সেটা ব্যালেন্স করতে হত অন্যকিছুতে ছাড় দিয়ে। অথচ দেশ ছাড়ার আগে ভেবেছিলাম, ডলারে কামাই করব, কত বড়লোক! হ্যাঁ, টাকার সাথে ডলারের তুলনা করলে বড়লোক মনে হয়, কিন্তু শুনেছি গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক। বেতন স্কেলে সবচেয়ে কম বেতন পাওয়া কর্মী। তার উপর সেন্ট লুইসের মত শহরে থাকতে গিয়ে বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়ায়। গাড়ি চালাতে পারি না বলে শহর থেকে দূরে সস্তা বাসা নিতে পারিনি। অবশ্য এসব চিন্তা করে কান্নাকাটির মানে হয় না। গ্র্যাজুয়েট জীবন আমাকে যে অভিজ্ঞতা দিচ্ছে, সেটার তুলনায় টাকার কষ্ট কিছুই না। আমি খুবই আনন্দিত যে, যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসতে পেরেছি। সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া, নতুন সংস্কৃতি, পড়াশোনার নতুন ধরন। যারা পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, তাদের প্রত্যেকের উচিৎ বাইরের দেশে গিয়ে অন্তত একটা ডিগ্রি নেওয়া। এ এক আজব অভিজ্ঞতা।
.
ধুঁকতে ধুঁকতে পৌঁছলাম ট্রাম স্টেশনে। ট্রাম আসবে পাঁচ মিনিট পর। ঐ পাঁচ মিনিটকে মনে হল জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্ত। যাদের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া হয়েছে তারা জানেন, এসময় ঠাণ্ডা বাতাস ফুসফুসে ঢুকলে জ্বলে পুড়ে ছারখার করে দেয়। আমি মাফলার, গ্লাভস সবকিছু নাকে চেপে রেখেছি যেন বাতাসটা গরম হয়ে ঢুকে। তারপরও যথেষ্ট গরম হচ্ছে না। ফুসফুস প্রচণ্ড জ্বলছে। দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়, কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছি। জ্বর জ্বর লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্লাইট বাতিল করে দিই। বাসায় গিয়ে একটু শুয়ে থাকতে পারলে আর কিছু চাই না। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রিন্সকে বললাম আমাকে জড়িয়ে ধরতে। ওর ওমে যদি একটু কাজ হয়। বেচারা নিজেও পার্কা পরা। তার মধ্যেই যতটুকু সম্ভব জাপটে ধরল। কাজের কাজ কিছুই হল না। ওম পেলাম না, সেই ঠাণ্ডাই লাগতে থাকল। ভীষণ রাগ হচ্ছে কেন পার্কার ভেতরে সোয়েট শার্ট পরিনি। একটা আস্ত শীত পার করার পরও সেন্ট লুইসের আবহাওয়া সম্পর্কে যে মানুষটার ধারণা হয় না, তার কষ্ট পাওয়াই উচিৎ।
.
একটু পর হুইসেল শোনা গেল। আহ! ট্রাম এসেছে। পারলে উড়ে গিয়ে বসি ওটায়। কিন্তু না, আগে নামতে দিন। মানুষজন নামার পর ট্রামের ভেতর ঢুকলাম। আরামদায়ক উষ্ণতা ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। ওমঃ শান্তি। বার্মিংহ্যামের আবহাওয়া দেখলাম সেন্ট লুইসের চেয়ে গরম। চার ঘণ্টা পর ওখানে গিয়ে পড়লে আশা করি লাইফ জিঙ্গালালা। এখন বিমানবন্দরে যেতে লাগবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রিন্সের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুমিয়ে থাকলে কাশি আসবে না। কিন্তু জীবন প্যাঁড়াময়। ঘুম এল না বরং আমার কাশি শুনে অনেকে ফিরে ফিরে চাইতে লাগল। যক্ষ্মা রোগী ভাবছে নির্ঘাত।
.
বিমানবন্দর ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ভীতিকর। কোথায় কোন ধাপ সম্পন্ন করতে হবে, সবসময় গুলিয়ে ফেলি। মাথার উপর সবকিছু লেখা থাকে, তাও যেন গোলমেলে। তবে সেন্ট লুইসের ল্যাম্বার্ট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটা ছোট বলে সবকিছু সহজ হওয়ার কথা। ২০১৮ সালে সেন্ট লুইসে পা দেওয়ার পর আর বিমানে চরিনি। দুই বছর পর আবার চরছি। আবার সেই অস্বস্তি ফিরে এসেছে। প্রিন্স আমাকে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিল। এখান থেকে ওকে বিদায় নিতে হবে। আমি লাইনে ঢুকার পর পেছনে তাকালাম। চোখে চোখ পড়তেই প্রিন্স হাত নাড়ল। আমিও নাড়লাম। এরপর খানিকটা সামনে গিয়ে আবার তাকালাম। প্রিন্স নেই। হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। হায় রে মানুষ! একই দেশের এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক অঙ্গরাজ্যে যাচ্ছি, তাতেই এত মিস করাকরি। দুইজন দুই দেশে থাকলে কী হত? ভাবতে ভাবতে ইমিগ্রেশন অফিসারের দিকে এগিয়ে গেলাম।
.
আমার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট। কিন্তু আশেপাশের অনেকের হাতে দেখছি কার্ডের মত কিছু একটা। হতে পারে ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ইউএস পাসপোর্ট কার্ড। অনেকে দেখি মোবাইলের পর্দায় কীসব বের করে দেখাচ্ছে আর ইমিগ্রেশন পার হয়ে যাচ্ছে। কত প্রযুক্তি বের হয়েছে অথচ আমি কিছুই জানি না। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর বেল্ট, ঘড়ি, ইত্যাদি খুলে ট্রেতে রাখার নিয়ম। সে ট্রে যাবে এক্স-রে মেশিনের ভিতর। এবার দেখি জুতা, মোজা অব্দি খুলাচ্ছে। সবকিছু খুললাম। ব্যাগ যদিও ট্রেতে দিবেন, কিন্তু সেটার ভিতর ল্যাপটপ থাকা যাবে না। ওটা ব্যাগ থেকে বের করে ট্রেতে রাখতে হবে। মোবাইলের জন্যেও একই নিয়ম। জুতা, মোজা আলাদা ট্রেতে দিতে হবে। দিলাম। সবকিছু সুন্দরমত মেশিনের ভিতর চলে গেল। এক অফিসার আমাকে পরীক্ষা করে পাশ মার্ক দিলেন। এতক্ষণে মূল এলাকার ভেতরে ঢুকলাম। ট্রের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় এক অফিসার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘এটা কার সুটকেস?’ দেখি, আমার সুটকেসের দিকে ইঙ্গিত করছেন। আত্মারাম খাঁচাছাড়া! অবৈধ কিছু এনেছি নাকি? নাকি কেউ আমার সুটকেসে কিছু পাচার করে দিয়েছে?
.
দ্রুত এগিয়ে গেলাম। বললাম, আমার। অফিসার বললেন, ‘প্লিজ ম্যাম, সুটকেসটা একটু খুলুন।’ সুটকেসে কম্বিনেশন লক দেওয়া। আমি কম্বিনেশন ভুলে গেলাম। আমাকে আঁতিপাঁতি হাতাহাতি করতে দেখে অফিসার সন্দেহজনক চোখে তাকালেন। উনি কি ভাবছেন, আমি সুটকেস খুলতে অনাগ্রহী? কী মুশকিলে পড়লাম! ওহ, মনে পড়েছে। কম্বিনেশন ইয়াদ আয়া। লক খুলে দিলাম। অফিসার বললেন, ‘প্লিজ, সুটকেসের ডালাটা খুলুন।’ খুললাম। তখন অফিসারও বসে পড়ে জামাকাপড় হাতড়াতে লাগলেন। আমার ইস্ত্রি করা জামা! একটু পর একটা প্যাকেট বের করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এগুলো কী?’ বললাম, ব্রংকাইটিসের ওষুধ। অফিসার জানালেন, একশো মিলিলিটারের বেশি তরল নিয়ে কেবিনে ঢুকা যায় না। আর আমার নাইকুইল সিরাপের বোতল ২৫০ মিলি। ইশ! একদম খেয়াল ছিল না ব্যাপারটা, নতুবা ছোট বোতলে করে নিয়ে আসতাম। একদম নতুন বোতল দেখে অফিসারের দয়া হল। বললেন, ‘এয়ারপোর্টে কি কেউ আছে যাকে আপনি বোতলটা দিয়ে আসতে পারবেন? নতুবা ফেলে দিতে হবে।’ ঐ মুহূর্তে বাইরে এসে প্রিন্সকে বোতল দিয়ে আবার একই ঝামেলা করে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ইচ্ছে হল না। বললাম, ‘ফেলে দিন।’ ভাগ্যে রোবাফেন ডিএম সিরাপের বোতলটা ১০০ মিলির মধ্যে পড়েছে! ওটাই আমার কাশির মূল ওষুধ। ওটা ফেললে বার্মিংহ্যাম গিয়ে আবার ওষুধ কেনার ঝামেলা পোহাতে হত।
.
একশো মিলিলিটার দ্রব্য নিয়ে এটাই প্রথম কাহিনী নয়। এর আগে যখন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে গিয়েছিলাম, একই ঘটনা ঘটেছিল। বিমানবন্দরে আসার কিছুক্ষণ আগে শপিং শেষ করেছি। চেক-ইন লাগেজে জায়গা হচ্ছে না বলে শ্যাম্পুর বোতল, ফেসওয়াশ, বডি স্প্রে, আর একটা পেস্ট ছোট ভাই অঝরের কাঁধ ব্যাগে ঢুকিয়েছিলাম। তো, চেকিংয়ের সময় অফিসার অঝরকে ধরলেন। ‘ব্যাগে কী আছে?’ অঝর আকাশ থেকে পড়ল। জামাকাপড় ছাড়া আর কী থাকবে? অফিসার খুলে দেখাতে বললেন। অঝর খুলল। উনি জিনিসগুলো বের করলেন। বললেন, নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হওয়ায় এগুলো নেওয়া যাবে না। ফেলে দিতে হবে। আমার তো মাথা নষ্ট! এত পছন্দ করে কেনা…। এদিকে অঝর আমার উপর জ্বলন্ত দৃষ্টি হানছে। জিনিসগুলো যে ওর ব্যাগে ভরেছি, এটা ওকে বলিনি। শুধু শুধু অফিসারের সামনে বেচারাকে বোকা হতে হল।
.
ইমিগ্রেশন পার হয়ে নির্দিষ্ট গেটের দিকে এগোলাম। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে আমার ট্রানজিট। ওখান থেকে পরের ফ্লাইটে মূল গন্তব্য। জর্জিয়ার এথেন্সে বন্ধু ফরহাদ থাকে। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় বলেছিলাম, প্রথম বড়দিনটা ফরহাদ আর তাসনিয়ার সাথে করব। কীসের কী! দুই বছর হয়ে গেল, ওদের ওখানে যাওয়া হয়নি। ওদেরও সেন্ট লুইসে আসা হয়নি। গেটের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখি যাত্রীরা ঢুকতে শুরু করেছে। আমি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ানোর আগে এয়ারলাইন্সের বুথ থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে নিয়েছিলাম। এখানে বোর্ডিং পাস নিজে নিজে বের করতে হয়। মেশিনে পাসপোর্ট স্ক্যান করলে বোর্ডিং পাস বেরিয়ে আসে। সেটা দেখিয়ে বিমানে উঠতে হয়। আমার বোর্ডিং পাস হল এক টুকরো কাগজ। অথচ বেশিভাগ মানুষের হাতে দেখছি মোবাইল ধরা। মোবাইলে এরা বোর্ডিং পাস নিল কীভাবে? আবার আমার পাসের উপর লেখা ‘ক্লাস সি’। এর মানে কী? ঠিক করলাম সবার শেষে উঠবো। তাহলে আর ক্লাস বুঝার ঝামেলা রইল না। একটু পর শুনি ক্লাস ডির প্যাসেঞ্জারদের ডাকছে। তাদেরকে উঠাবে। তার মানে ক্লাস ধরে ধরে বিমানে উঠায়। আমার ক্লাসের সবাই কি উঠে গেছে? হায় হায়! আমাকে আর উঠাবে না? প্লেন মিস হলে আমি কী জবাব দেব ইউএবিকে?
.
দুর্বল মুহূর্তে এসব উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে। অথচ আপনি যদি বোর্ডিং পাস নিয়ে থাকেন, প্লেন আপনার জন্য কিছুক্ষণ হলেও দাঁড়াবে। মাইকে আপনার নাম ধরে ঘোষণা দেবে – ‘নির্ঝর ঘোষ, দয়া করে গেট নাম্বার সাতে চলে আসুন। আটলান্টাগামী বিমানে চড়ার জন্য এটাই লাস্ট কল…।’ যেমনটা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময়। আমি আর প্রিন্স গেটের সামনে বসে ছিলাম যেন প্লেন মিস না করি। তবুও টের পাইনি কখন শিকাগো থেকে সেন্ট লুইসগামী বিমানে যাত্রী উঠিয়ে ফেলেছে। আমরা তখন দেশে ভিডিও কল দিয়ে ও’ হেয়ার বিমানবন্দর দেখাচ্ছি। এদিকে মাইকে বলে চলেছে – ‘নির্ঝর ঘোষ, রিজওয়ানুর রহমান। দয়া করে গেট নাম্বার অমুকে চলে আসুন…।’ এরচেয়েও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল আমার এক চেনা পরিচিতর সাথে। সে ছিল সদ্য বিশের এক তরুণ। সমবয়সী আরও কিছু বন্ধুর সাথে ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা আসবে। তো, অপেক্ষা করার সময় গেটের কাছাকাছি এক চিপায় বসে তারা হুইস্কির বোতল খুলল। বয়সটা সবার এমন যখন এসব কাজ করলে খুব নায়ক নায়ক লাগে। এদিকে দলের সবার নাম মাইকে ডেকেই চলেছে – ‘লাস্ট কল… লাস্ট কল…।’ কারো হুঁশ নেই। এক অফিসার জটলা দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কলকাতাগামী ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার কিনা। তখন হুঁশ এল। ঐ অফিসার না এলে বিমান মিস হয়ে যেত।
.
এতকিছু জানার পরও নার্ভাস হয়ে গেলাম। ধুকপুক বুক নিয়ে ক্লাস ডির লাইনে দাঁড়ালাম। তবে চেহারায় নার্ভাস ভাব প্রকাশ পেতে দিলাম না। কিছুই হয়নি এমন চেহারা করে অফিসারকে বোর্ডিং পাসটা দেখালাম। উনার সামনে একটা স্ক্যানার রাখা। আমাকেই ওখানে পাসটা চেপে ধরে বারকোড স্ক্যান করতে হবে। করলাম। অফিসার নিশ্চিত হলেন, আসলেই আমি টিকেট কেটেছি কিনা। তারপর ভেতরে ঢুকার ইশারা দিলেন। ভেতরে ঢুকে দেখি ক্লাস ডিয়ের প্যাসেঞ্জাররা সিট খুঁজছে। সিয়ের সবাই ইতোমধ্যে বসে পড়েছে। এর মধ্যে আমি আবার সি জোনের যাত্রী। ডিয়ের প্যাসেঞ্জারের ভিড়ে আমার সিটে পৌঁছানো দায়। যা হোক, সময় নিয়ে সিট বের করলাম। আমার পাশে বসেছে এক কেতাদুরস্ত যুবক। দেখে মনে হচ্ছে অফিসিয়াল মিটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে বিমানে উঠেছে। নেমেই দৌড় দেবে। আমি মাথার উপরের তাকে কেবিন লাগেজ ভরে পায়ের নিচে কাঁধের ব্যাগ রাখলাম। ব্যাগ থেকে ডায়েরি আর কিছু ডকুমেন্ট বের করলাম। তিন ঘণ্টায় ডকুমেন্টগুলো পড়ে নোট টুকতে হবে। পরে সেগুলো থেকে প্রশ্ন করব প্রফেসরদের।
.
বিমান যখন যাত্রা শুরু করে, তখন সিটবেল্ট বেঁধে রাখতে হয়। রানওয়ে দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মহাপতংগ যখন সাঁই করে আকাশে উড়াল মারে, তখন জড়তার কারণে মনে হয় কেউ যেন আমাকে আসনের সাথে চেপে রেখেছে। এরপর বিমান সোজা হয়ে যায়। তখন মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু না। এরপরই শুরু হয় তার বাঁক নেওয়ার পালা। বিশাল বিমান একবার ডানে হেলে, তো পরক্ষণেই বামে। এভাবে হেলেদুলে তাকে নির্দিষ্ট পথে উঠতে হয়। এজন্য যাত্রীদের বেল্ট পরে থাকাটা জরুরী। বেল্ট পরে থাকলে আসন থেকে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা কম। গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধার মতই। একবার মাঝ আকাশে উঠে গেলে বেল্ট খোলার অনুমতি মেলে। কারণ তখন হেলাহেলি নেই, ঝাঁকুনিও নেই। সোজা পথে ভ্রমণ।
.
আমি কম করে হলেও দশবার বিমান ভ্রমণ করেছি। কিন্তু তবুও এই ডানে বামে হেলার কাহিনীতে অভ্যস্ত হতে পারিনি। বিমান যখন হেলে, তখন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় মাটিতে পড়ে যাচ্ছি। জানালার পাশে বসলে অনুভূতি হয় আরও মারাত্মক। তখন চোখ থাকে মাটির দিকে। যদি আপনাকে আকাশের উপর উঠিয়ে মাটির দিকে তাক করা হয়, সেটা ভালো লাগার মত কিছু নয়। যারা স্কাই ডাইভিং করেন, তারা কী ধাতুতে তৈরি জানি না। মাটির দিকে তাকিয়ে নিচে নামার আনন্দ আমার জন্য নয়। যা হোক, হেলে চলার সময় আমি ভাবতাম বিমান পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে বেঁকে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, এটা মাত্র পঁচিশ ডিগ্রি। এটাকে খুব সম্ভবত স্ট্যান্ডার্ড রেট টার্ন বলে। পঁচিশ ডিগ্রি হেলতেই এত বিচ্ছিরি ভয় লাগে। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেললে তো আমি ওখানেই শেষ।
.
অনেক সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে প্লেন ঝাঁকুনি খায়। টার্বুলেন্স আর কি। তখন পাইলট বেল্ট পরা বাধ্যতামূলক করে দেন। এরকম এক টার্বুলেন্সে পড়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময়। বিমান থরথর করে কাঁপছে আর আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছে। আজব ব্যাপার এই যে, এতে আশেপাশের কারো ভাবান্তর হচ্ছে না। অনেকে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, কেউ কেউ মাথার উপরে আলো জ্বালিয়ে বই পড়ছে, বা সিটে লাগানো পর্দায় সিনেমা দেখছে। যেন এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার! অথচ আমি ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছি। প্রিন্সেরও হেলদোল নেই। বুঝলাম না, আমি বেশি ভীতু, নাকি অন্যরা বোকা?
.
এবারও মাঝ আকাশে উঠার পর বেল্ট খোলার অনুমতি পাওয়া গেল। আমি খাবারের ট্রে খুলে সেখানে ডায়েরি আর কাগজগুলো রাখলাম। পাশের যুবক হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে কিছু দেখছে। খুব গম্ভীর চেহারা। আমি খসখস করে নোট টুকে চলেছি। সাবধানে কোমর বাঁকিয়ে, পা উঠিয়ে-নামিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি কীভাবে বসলে আরাম লাগবে। ছেলেটা এতে বিরক্ত হচ্ছে কিনা কে জানে। তার পোকার ফেইস দেখে বুঝার উপায় নেই। নোট টুকতে টুকতে ফুড়ুৎ করে সময় চলে গেল। একসময় শুনি পাইলটের গমগমে কণ্ঠ, “আর কিছুক্ষণের মাঝে আমরা আটলান্টায় অবতরণ করতে যাচ্ছি…।”
.