Read Time26 Minute, 23 Second
আটলান্টার হার্টসফিল্ড-জ্যাক্সন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতি। তাই নেমেই দৌড় দিলাম বার্মিংহ্যামের ফ্লাইট যেখান থেকে ছাড়বে, সে গেটে। ওখানে গিয়ে বাথরুম সেরে লাউঞ্জে এসে বসলাম। হাতে নোটের তাড়া অথচ পড়তে ইচ্ছে করছে না। বার্মিংহ্যাম যত এগিয়ে আসছে, তত পেটের ভাত চাউল হয়ে যাচ্ছে। কী হবে যদি অ্যাডমিশন না পাই? কী হবে যদি আমার পারফরম্যান্স ভালো না হয়? আমাকে সেরা পাঁচে রেখে ওরা যে ভুল করেনি, সেটা কি প্রমাণ করতে পারব? ভাবতে ভাবতে প্লেনে উঠার সময় হয়ে গেল। উঠার আগে ফরহাদকে টেক্সট করলাম। “তোদের জর্জিয়ায় এসেছি। কিন্তু দেখা হচ্ছে না।” ফরহাদের তো মাথায় বাজ! ওকে কাহিনী বললাম। হয়ত অ্যালাব্যামা থেকে ফেরার পথে ওদের এখানে বেড়িয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তাহলে কি ইউএবি আমার ফিরতি পথের টিকেট কাটত? নাকি নিজেকেই কাটতে হত?
.
এবারের ভ্রমণ খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র এক ঘণ্টা। অদ্ভুত ব্যাপার হল, আটলান্টা থেকে প্লেনে উঠেছি দশটা পঁচিশে, বার্মিংহ্যামে গিয়ে নামব দশটা একুশে। কীভাবে সম্ভব? সময় পরিভ্রমণ করছি না তো? এক অর্থে, অবশ্যই। টাইম যোনের হিসেবে আটলান্টা থেকে বার্মিংহ্যাম এক ঘণ্টা পিছিয়ে। তাই পরে রওনা দিয়ে আগে পৌঁছে যাব। খালি চোখে যেটা এগারোটা একুশ, বার্মিংহ্যামের ঘড়িতে সেটা দেখাবে দশটা একুশ। এই ঢঙের জন্য কত যে ঝামেলা পোহাতে হয়! প্রফেসরদের সাথে ইন্টার্ভিউয়ের সময় হাজারবার দেখে নিতে হয় টাইম যোন ঠিক আছে কিনা।
.
বার্মিংহ্যাম বিমানবন্দরের বাইরে কেটি নামের এক পিএইচডি শিক্ষার্থী অপেক্ষা করবে। আমি পৌঁছার পর ওকে কল দিলে গাড়ি নিয়ে গেটের সামনে আসবে। সেখান থেকে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে রেসিডেন্স ইন হোটেলে। এভাবে লিফট দেওয়াকে আমেরিকায় বলে রাইড দেওয়া। আমার মুখে অবশ্য রাইড শব্দটা আসে না। খালি লিফট বলে ফেলি। কয়েকবার ধরাও খেয়েছি লিফট বলে। কেউ বুঝে না কী বলতে চাচ্ছি। তখন ভেঙে বলতে হয়। তাও রাইড শব্দটা মাথায় আসে না। আগেই বলেছি হোটেলে আমার নামে একটা রুম বুক করা আছে। ওখানে গিয়ে সময় পাব ঘণ্টাখানিক বিশ্রাম নেওয়ার। এরপর জুলিয়েন নামের আরেক পিএইচডি শিক্ষার্থী আমাকে হোটেল থেকে নিয়ে যাবে ইউএবিতে।
.
বিমানবন্দরের ঝামেলা শেষ করে গেট দিয়ে বাইরে বের হলাম। এতক্ষণ ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থেকে ভুলেই গিয়েছিলাম বাইরে ঠাণ্ডা! গেট দিয়ে বের হতেই শীতল হাওয়া রোম খাড়া করে দিল। কনকনে ঠাণ্ডা। এরা বলে চিলিং কোল্ড। চিলিং কোল্ডের মধ্যে আমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আর হাতে লাগেজ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। যারা লাগেজ নিয়ে ভ্রমণ করেছেন, তা যত ছোটই হোক, জানেন যে কী পরিমাণ ঝামেলা হয়। চাকাওয়ালা লাগেজ টেনে টেনে হাঁটাও প্রচুর ঝামেলা। তাই আমি টানাটানির মধ্যে না গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কেটি নিশ্চয় আমাকে খুঁজে বের করবে! দুইবার ওকে কল করেছি। একবার বলেছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়, আরেকবার রিং হয়েছে কিন্তু কেউ ধরেনি। বিশ মিনিট অপেক্ষা করব। এরপরও যদি কেটিকে না পাই, কল দেব মিশেলকে। উনি যদি বলেন উবার ধরে চলে আসতে, তাই করব।
.
দেখতে দেখতে অনেক গাড়ি আসল, গেটের সামনে থামল, লোক উঠাল, চলেও গেল। আমাকে কেউ ডাকল না। হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে গাড়ির ভিতর থেকে হাত নাড়াচ্ছে। এ কেটি না হয়ে যায়ই না। আমিও হাত নাড়ালাম। গাড়িটা এসে থামল কার্বের কাছে। কার্ব হল মূল রাস্তা থেকে উঁচু অংশ। এই উঁচু অংশ ফুটপাথ হতে পারে, নাও পারে। ড্রাইভিং পরীক্ষার সময় দেখা হয় আপনি কার্বসাইড পারকিং করতে পারেন কিনা। কার্বে গাড়ি উঠিয়ে দিলে নাম্বার কাটা। গাড়ি থামিয়ে কেটি বেরিয়ে এল। এসেই দুঃখ প্রকাশ করে বলল, আমার কলটা আননোন নাম্বার হিসেবে এসেছে। তাই ও ধরেনি। কিন্তু যখন মনে পড়ল এটা আমি হতে পারি, ততক্ষণে কল কেটে গেছে। তারপর তড়িঘড়ি গেটের সামনে এসেছে। এসে দেখে বিশাল মোটা মাফলার মাথায় জড়িয়ে আর পারকা পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। লাগেজ দেখে কেটির মনে হল এটা আমি না হয়ে যাইই না। আমিও ধন্যবাদ দিলাম রাইডের জন্য। তারপর গাড়ির ট্রাংকে লাগেজ রেখে বসলাম চালকের পাশের আসনে।
.
কেটির প্রোফাইল দেওয়া আছে অনুষদের ওয়েবসাইটে। সেটা পড়েছি। ও যা নিয়ে গবেষণা করছে, সেটার প্রতি আমারও আগ্রহ আছে। তাই আড্ডা জমাতে বেশিক্ষণ লাগল না। কেটির কাছ থেকেই জানলাম যাকে আমি প্রফেসর গোয়ার হিসেবে জানি, উনার নামের উচ্চারণ আসলে গাওয়ার। আমি গত পাঁচ বছর ধরে এই নারীকে গোয়ার বলে এসেছি আর মনে মনে হেসেছি। এক দেশের বুলি (গোয়ার), অন্য দেশের গালি (গোঁয়ার)। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে আমার কাশির বহর দেখে কেটি চমকে গেল। জিজ্ঞেস করল কোনো ঔষধালয়ে থামতে হবে কিনা। বললাম, প্রয়োজনীয় ওষুধ আছে। কিন্তু ব্রংকাইটিস হয়েছে বলে কাশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
.
কেটি আমাকে রেসিডেন্স ইনের সামনে নামিয়ে দিল। বছর দুই আগে ওকেও ইন্টার্ভিউয়ে ডেকেছিল। তখন এই হোটেলেই থাকতে দিয়েছিল। আমাকে দিতে এসে ও নাকি নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছে। কেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিসেপশনে গেলাম। রিসেপশনিস্ট আমার নাম জানতে চাইল। নাম ধরে ডাটাবেসে খুঁজে বের করল কত নাম্বার রুম। তারপর চাবি দিল। চাবি মানে কার্ড। এই কার্ড সোয়াপ করে বা আড়াআড়ি টান দিয়ে দরজা খুলতে হয়। আমি লিফটে উঠতেই দেখি আরেক লোক বিশাল দুটো কুকুর নিয়ে এগিয়ে আসছে। মনে হয় আমার লিফটেই উঠবে। কুকুর আমি খুবই ভয় পাই। ইচ্ছা হল অপেক্ষা না করে লিফটের বোতাম টিপে দিই। কিন্তু সেটা হবে চরম অভদ্রতা। তাই জান হাতে নিয়ে এক কোণায় সরে গেলাম। লোকটা এসে ঢুকল লিফটে। কুকুর দুটো হাঁপাচ্ছে। মনে হয় বাইরে থেকে হাঁটাহাঁটি করে এসেছে। আমার চেহারা দেখে লোকটা বুঝল ভয় পাচ্ছি। তাই কুকুর দুটোকে অন্যপাশে সরিয়ে নিল।
.
চারতলা আসার পর আমি নেমে গেলাম। লিফট থেকে নেমেই আমার রুম। রুমে ঢুকে লা জওয়াব অবস্থা। এত সুন্দর সুইট! আগের এক পোস্টে রুমের ছবিসহ বর্ণনা দিয়েছি বলে এখানে আর লিখলাম না। রুমে বিশ্রাম নেব কি, চেহারা দেখেই ক্লান্তি চলে গেল। ধীরে ধীরে লাগেজ, কাঁধব্যাগ গুছালাম। নতুন জামা বের করলাম। এগুলো পরে ইন্টার্ভিউ দিতে যাব। স্নান করার সময় নেই। ভালমত হাতমুখ ধুয়ে তাজা হলাম। তারপর বসলাম ল্যাপটপ নিয়ে। শেষবারের মত আজকে যাদের সাথে ইন্টার্ভিউ, তাদের প্রোফাইল চোখ বুলালাম। সোয়া বারোটায় জুলিয়েন আসবে, লবি থেকে আমাকে নিয়ে যাবে। বারোটা নাগাদ প্রস্তুত হয়ে নিচে নামলাম। একটু আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, সমস্যা নেই। কিন্তু যেন দেরি না হয়। লবিতে গিয়ে মূল দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে মোবাইল টিপছে। হালকা পাতলা চেহারা, চশমা পরা। জুলিয়েনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চোখ বারবার মেয়েটার দিকে চলে যাচ্ছে। মেয়েটাও বেশ ক’বার আমার দিকে তাকাল। হঠাৎ সন্দেহ হল, এটাই জুলিয়েন নয় তো?
.
এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি যেতে মেয়েটা মোবাইল থেকে চোখ তুলল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি জুলিয়েন?’ মেয়েটাকে একটু নার্ভাস মনে হচ্ছে। পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি রুথ?’ মাথা নাড়লাম। বলল, ‘হ্যাঁ, আমি জুলিয়েন। তোমাকে নিতে এসেছি।’ হাসি পেল। এতক্ষণ ধরে দু’জন দু’জনকে দেখছি অথচ বুঝতে পারিনি কিছু। কথা বলে বুঝলাম, এই মেয়ে মহা বিস্ময়কর বস্তু। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে পিএইচডি শুরু করে দিয়েছে। ব্যাচেলর শেষ করে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি, সোজা পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছে। ইউএবিতে ওর সুযোগ পাওয়ার কাহিনীও বিচিত্র। এখানকার একজন নির্দিষ্ট প্রফেসরের সাথেই ওর কাজ করার ইচ্ছা ছিল। ডঃ জেমস হিল। উনি স্থূলতা এবং ওজন হ্রাসের জগতে বেশ বিখ্যাত গবেষক। গত বছর যখন জুলিয়েনকে ইন্টার্ভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছিল, একটা কথাই ও বলেছিল, ‘ডঃ হলের সাথে কাজ করতে চাই।’ জুলিয়েন জানত না কোন বিষয়ের উপর ওর আগ্রহ, বা ভবিষ্যতে ও কী করতে চায়। ও শুধু জানত ডঃ হলের কাজকর্ম ওর কাছে ব্যাপক লাগে, আর উনার সাথেই সে কাজ করতে চায়, অন্য কারো সাথে নয়। ওর গোঁ দেখে ডঃ হিল ওর সাথে কথা বললেন। বলে মুগ্ধ হলেন, আর জুলিয়েনের অ্যাডভাইজর হওয়ার জন্য রাজি হলেন। এই কাহিনী শুনে আমি মুগ্ধ। কে, কীভাবে পিএইচডি কমিটিকে মুগ্ধ করতে পারবে, তার ছক বাঁধা কোনো নিয়ম নেই। আমি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি কোন টপিকে কাজ করতে চাই, সেটা বের করার জন্য। এরপর জোর দিয়েছি ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, সেটা বের করতে। অথচ এ দুটোর কোনোটা সম্পর্কেই জুলিয়েনের ধারণা ছিল না। তবুও ওর আগ্রহ আর ডঃ হিলের কাজের প্রতি ওর একাগ্রতা দেখে কমিটি ওকে ভর্তি করেছে।
.
জুলিয়েন হড়বড় করে কথা বলে। একটু আউলা ঝাউলাও। কেটি যেমন ধীর সুস্থির, জুলিয়েন তার উল্টো। অবশ্য এত কম বয়সে যে পিএইচডি শুরু করে, তাকে নর্মাল ডিস্ট্রিবিউশনে ফেলা যায় না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ধরনের গুণাবলী থাকলে একজন প্রার্থীকে ইউএবি পিএইচডিতে অ্যাডমিশন দেয়?’ জুলিয়েন মাথা চুলকে বলল, ‘ঠিক জানি না। আমার তো কোনো গুণাবলী ছিল না। তবুও অ্যাডমিশন পেয়েছি।’ কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
.
ইউএবি বার্মিংহ্যামের ডাউনটাউনে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে ডাউনটাউন মানে একটা শহরের জমজমাট জায়গা, যেখানে ব্যবসায় ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে। মানুষজন অফিস আদালত করতে ডাউনটাউনে আসে। শুনতে একটু অদ্ভুত লাগে কারণ আপটাউন বললে জমজমাট মনে হয়, ডাউনটাউন বললে মনে হয় যেন শহরতলি। অথচ এখানে আপটাউন মানে হল আবাসিক এলাকা।
.
দুজন হাঁটছি তো হাঁটছিই। হোটেল থেকে বের হয়েছি দশ মিনিট হবে। আর কতদূরে পুষ্টি ভবন? জুলিয়েন বোধহয় টের পেল। বলল, ‘এই তো এসে গেছি। আর পাঁচ মিনিট…।’
.
বিভিন্ন রাস্তা পার হয়ে অবশেষে যে দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম, সেটাই নাকি পুষ্টি অনুষদ। আমি হা হয়ে গেলাম। ছয়তলা দালানের পুরোটাই পুষ্টির? আমাকে পাঁচতলায় নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে মিশেল অপেক্ষা করছেন। উনার সাথে আমার মোলাকাতের পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে ডঃ গাওয়ারের কাছে। প্রথম ইন্টার্ভিউটা ডঃ গাওয়ারের সাথে। কেটি আর জুলিয়েন দুজনকেই জিজ্ঞেস করেছি ডঃ গাওয়ারের ব্যাপারে। দুজনেই বলেছে উনি নিজের গবেষণা নিয়ে কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। খুব আগ্রহ নিয়ে ব্যাখ্যা করেন নিজের কাজ কারবার। আমারও আগ্রহ উনার গবেষণা নিয়ে। তাই আলাপ জমাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
মিশেলের সাথে যখন দেখা হল, বেশ মজা পেলাম। এতদিন ইমেইলে কথা চালাচালি হয়েছে, এবার সামনাসামনি। ছবির সাথে বাস্তবের মিশেলের বেশ পার্থক্য। আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি মিশেল এসে সামনে দাঁড়িয়েছেন। যা হোক, উনার সাথে হাই হ্যালো করার পর আমাকে নিয়ে গেলেন কমন রুমে। রুমটা খাবার ঘর হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এক কোণায় দেখি রেফ্রিজারেটর আর ওভেন রাখা। বসার জন্য চেয়ার-টেবিল পাতা। মিশেল জানতে চেয়েছিলেন দুপুরের খাবার হিসেবে আমি কী খেতে চাই। খাবার কেনা হবে প্যানেরা ব্রেড থেকে। এটা বেকড আইটেমের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটা জনপ্রিয় চেইন স্টোর। আমি প্যানেরার ওয়েবসাইট থেকে মেনু দেখে টুনা স্যান্ডউইচ পছন্দ করেছিলাম। মিশেল ফ্রিজ থেকে সেটাই বের করে আনলেন।
.
ফ্রিজ থেকে স্যান্ডউইচ বের হল শুনে অবাক লাগছে? আমারও লাগত। প্রথম যেদিন এই ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম, মুখ থেকে রা বের হচ্ছিল না। সেই আমার ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচের সাথে পরিচয়। এর মত আজব খাবার কীভাবে ওদের মুখে রুচে, জানি না। দেশে সবসময় গরমাগরম স্যান্ডউইচ, বার্গার খেয়ে অভ্যস্ত আমার জিভে ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচের স্বাদ বুঝতে পারি না। যদি জানতাম টুনা স্যান্ডউইচ ঠাণ্ডা আইটেম, তাহলে অন্য খাবার পছন্দ করতাম।
.
আমি খাচ্ছি আর মিশেল কী একটা গেট টুগেদারের জন্য যেন কমন রুমে খাবার সাজাচ্ছেন। জানতে চাইলাম কোনো সাহায্য লাগবে কিনা। মিষ্টি হেসে মানা করলেন। একটু পর ‘’আমি আসছি’ বলে মিশেল কোথায় যেন গেলেন। আমি একা বসে রইলাম। আচমকা রুমে ঢুকলেন ডঃ ফারনান্দেজ। হেলেদুলে এগোলেন খাবার রাখা টেবিলের দিকে। আমাকে খেয়াল করেননি। কিন্তু পেছন ফিরে যখন দেখলেন, চমকে গেলেন। আমিও কী বলব বুঝতে না পেরে গাল ভর্তি টুনা স্যান্ডউইচ নিয়ে বেকুবের মত বসে রইলাম। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব খাবার কার জন্য রাখা, বলতে পার?’ বললাম, ‘সঠিক জানি না। মিশেল রেখেছেন।’ ডঃ ফারনান্দেজ ইতিউতি তাকিয়ে কী যেন খুঁজলেন। তারপর শীষ দিতে দিতে বের হয়ে গেলেন। উনার চালচলন কেমন ধীরগতির। উদাস ভঙ্গীতে হাঁটেন, তাকান। উনি চলে যাওয়ার পর খেয়াল হল, বিশাল ভুল করেছি। উনার সাথে হাই হ্যালো করিনি। চরম অভদ্রতা হয়েছে। উনি নিশ্চয় বুঝেছেন আমি চারজন প্রার্থীর মধ্যে একজন! আমার কাছ থেকে এরকম ঠাণ্ডা আচরণ পেয়ে উনার ফার্স্ট ইম্প্রেশন কেমন হল? হায় হায়! প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে গেলাম।
.
নার্ভাস অবস্থায় জুলিয়েনের সাথে ডঃ গাওয়ারের অফিসে গেলাম। অফিসের দরজা বন্ধ। দুইবার নক করার পরও ভেতর থেকে সাড়াশব্দ পেলাম না। জুলিয়েন একটু অপ্রস্তুত। কী করবে, বুঝতে পারছে না। ইন্টার্ভিউ শুরু হওয়ার এখনো দুই তিন মিনিট বাকি। বললাম, ‘আমি একাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারব। তুমি চলে যাও।’ জুলিয়েন গেল না। গাওয়ার যেখানেই থাকুন, ইন্টার্ভিউ নেওয়ার জন্য তো অবশ্যই অফিসে আসবেন। উনার কাছে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবেই জুলিয়েনের ছুটি। একটু পর দেখি করিডোর ধরে কালো স্কার্ট আর টপ পরিহিত ডঃ গাওয়ার এগিয়ে আসছেন। চোখে মুখে চিন্তিত ভাব। আমাদের দেখে যেন কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন, ‘ও, হ্যাঁ তোমরা। চল, কনফারেন্স রুমে বসি।’ জুলিয়েন বিদায় নিল, আমি প্রফেসরের পিছে পিছে কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম। যেইমাত্র ডঃ গাওয়ার দরজা বন্ধ করলেন, আমার হৃদপিণ্ড লাফানো শুরু করল। ওরে বাবা রে! এত বড় একজন গবেষকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বিপাক ক্রিয়া এবং ডায়াবেটিসের উপর উনি অনেক বছর ধরে গবেষণা করছেন।
.
গাওয়ারের সাথে কথাবার্তা খুব একটা জাতের হল না। ভুল আমারই। আগের নার্ভাসনেস কাটাতে গিয়ে এবার ওভারস্মার্টগিরি দেখিয়ে ফেলেছি। যে জিনিস জানি না, সেটা জানার ভাব ধরেছি আর ফেঁসে গেছি। ফরহাদ বলেছিল, কোনোকিছু না জানলে যেন সরাসরি বলে দিই ‘জানি না।’ এখানকার শিক্ষাঙ্গনে ‘জানি না’ বলা দোষণীয় নয়। কেউ আপনার নামে বিচার বসাবে না ডাবল মাস্টার্স থাকার পরও ‘কেন জানেন না?’ বলে। কিন্তু আমি সবাইকে মুগ্ধ করতে হবে নীতিতে বিশ্বাস করে বিপদ ডেকে আনলাম। আমার ভুলভাল উত্তর শুনে ডঃ গাওয়ার হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘উত্তর আসলে এটা।’ উনার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যেটা শুনে আমার কান ঝা ঝা করতে লাগল। আর মন বসল না ইন্টার্ভিউয়ে। বারবার মনে হতে লাগল, কী বাজে একটা ছাপ ফেললাম প্রফেসরের মনে! উনার সাথে কাজ করার ইচ্ছে ছিল। সেটা আর হল না।
.
প্রত্যেক প্রফেসরের সাথে ত্রিশ মিনিট করে ইন্টার্ভিউ। গাওয়ারের সাথে ইন্টার্ভিউ যখন শেষের দিকে, তখন দেখি দরজার বাইরে জুলিয়েন উপস্থিত। আমাকে নিয়ে যাবে বর্তমান পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় করাতে। বলে রাখা ভাল, চারজন প্রার্থীর প্রত্যেককেই বিভিন্ন পিএইচডি শিক্ষার্থী গাইড করছে। এই যেমন জুলিয়েন আমাকে নিয়ে কমন রুমে উপস্থিত হতেই দেখি অন্য তিনজন প্রার্থীকে অন্য তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে এসেছে। এখন সুযোগ বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে পিএইচডির পরিবেশ বুঝে নেওয়া। সবটুকু বুঝা সম্ভব না হয়ত, কিন্তু অনেকটাই আঁচ করা যাবে।
.
বাকি তিনজন প্রার্থীও মেয়ে। পুষ্টির জগতে মেয়েদের আধিপত্য চোখে পড়ার মত। কী বাংলাদেশে, কী বিদেশে। পঞ্চম যে প্রার্থী, সে ইউএবির মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করা একজন চিকিৎসক। তাকে নাকি আগেই নির্বাচিত করে ফেলা হয়েছে। তাই আসার দরকার পড়েনি। একে একে বাকিদের সাথে পরিচিত হলাম। আমি আর কিউ এসেছি ইউএবির বাইরে থেকে। বাকি দুজন ইউএবিরই মাস্টার্স শিক্ষার্থী। দুজনেই মাস্টার্স প্রথম বর্ষে। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে না পড়েই ওরা সরাসরি পিএইচডিতে ঢুকে যেতে পারবে। এই সুযোগ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই দেয়। কানাঘুষা শুনলাম, এ বছর চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে পিএইচডি পজিশনে নেওয়া হবে। যদি চারজন হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা হবে আমার আর কিউয়ের মধ্যে। কারণ নিজেদের শিক্ষার্থী বাদ দিয়ে কোনো ভার্সিটি বহিরাগত নিতে চাইবে না। তাই ইউএবির তিনজনকে অবশ্যই নির্বাচিত করা হবে, কাঠগড়ায় দাঁড়াব আমি আর কিউ।
.
আমার মন প্রথম থেকেই কু ডাক ডাকছে। এর পেছনে শক্ত কারণও আছে। ডঃ ফারনান্দেজ আর ডঃ গাওয়ারের সাথে প্রাথমিক সাক্ষাৎ ভাল হয়নি। একটু হলেও মানুষের চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা আছে বলে বুঝে গেছি, দুজনে যেমনটা আশা করেছিলেন, আমাকে তেমনটা পাননি। এসব ইন্টার্ভিউয়ে আপনার প্রোফাইল বিচার করার চেয়েও বেশি খুঁটিয়ে দেখা হয় আপনার দলগত কাজ করার মানসিকতা আছে কিনা, সবার সাথে মিশতে পারছেন কিনা, অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়া কেমন, ইত্যাদি। পিএইচডিতে ঢুকলে আপনাকে শেখানো হবে গবেষণা কীভাবে করতে হয়। বিভিন্ন বিষয় পড়িয়ে পণ্ডিত বানানো হবে। কেউ আশা করে না আপনি বিজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে পিএইচডি করতে আসবেন। সবাই জানে, আপনি হালকা কিছু জ্ঞান নিয়ে এসেছেন, ধীরে ধীরে পণ্ডিত হবেন। তাই সবার নজর থাকে অন্য বিষয়গুলোর দিকে। গবেষণার প্রতি আপনার আকর্ষণ বা ভাল লাগা আছে কিনা, থাকলে কতটুকু; বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার মত মানসিক দৃঢ়তা আছে কিনা, নাকি চাপের মুখে ভেঙে পড়বেন; দলগত তো বটেই, একা একা কাজ করার মত সক্ষমতাও আছে কিনা – এসব বুঝার চেষ্টা করা হয়। এগুলো কিন্তু শুধু পিএইচডি নয়, চাকরির ইন্টার্ভিউয়ের সময়ও লক্ষ্য করা হয়। ওহ! পিএইচডি তো চাকরিই। হ্যাঁ, পিএইচডিকে চাকরি বলে। বেতন পাবেন, বিনিময়ে গবেষণা করবেন। তবে এই চাকরি আটটা-পাঁচটা অফিসের মত নয়। প্রচুর খাটনি, আবার বেতনও কম। কম বেতনে দিনে আট ঘণ্টার চেয়ে বেশি খাটার ইচ্ছে সবার থাকে না। অথবা থাকলেও একসময় উড়ে যেতে পারে। আপনি কোন ক্যাটাগরিতে পরেন, সেগুলোই হয়ত প্রফেসররা অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে যাচাই করতে চান।
.