Post Views:
332
Read Time14 Minute, 43 Second
পর্ব এক, দুই, তিন
বর্তমান পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক প্রশ্ন টুকে রেখেছিলাম। একেকজনকে একেকটা প্রশ্ন করতে লাগলাম। আমার মূল লক্ষ্য ছিল ইউএবির পিএইচডি প্রোগ্রামের প্রতি আমার আগ্রহ আর আকর্ষণের জায়গাটা সবাইকে বুঝানো। এখানে আসার আগে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ের সময় যাদের সাথে আলাপচারিতার সুযোগ দেওয়া হয়, তাদের থেকে ফিডব্যাক নেওয়া হয়। এ কথা শোনার পর আমি সচেতনভাবেই কেটি কিংবা জুলিয়েনের সাথে নিজের আগ্রহের জায়গাটা ভাগ করে নিতে চেয়েছি। একই কাহিনী বাকিদের সাথে। এই করতে গিয়ে ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ হিসেবে ধরা দেবে কিনা।
কিউয়ের সাথে কথা বলে জানলাম ও আন্ডারগ্র্যাড করেছে আমার স্বপ্নের ভার্সিটিগুলোর মধ্যে একটা, ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইনের পুষ্টি বিভাগ থেকে। আমি এখানকার পিএইচডি প্রোগ্রামে দুইবার আবেদন করেছিলাম। দুইবারই রিজেকশন খেয়েছি। যা হোক, আন্ডারগ্র্যাড শেষ করার পর কিউ রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হওয়ার জন্য ডায়েটেটিক ইন্টার্নশিপ শেষ করেছে। দুই বছর ডায়েটিশিয়ান হিসেবে চাকরি করেছে বিভিন্ন জায়গায়। এক পর্যায়ে ওর মনে হয়েছে, চাকরির চেয়ে ও পুষ্টির উপর গবেষণা করতে বেশি পছন্দ করে। তাই ফিরে এসেছে পড়াশোনার জগতে। থিসিস বেইজড মাস্টার্স করতে ঢুকেছে টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে দুই বছর গবেষণা করেছে। দুই বছর পর মাস্টার্স পাশ করে রিসার্চ ইন্টার্ন হিসেবে ঢুকেছে বিখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানে। সেখানে ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর আবার রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছে। এক বছর পর মনে হয়েছে, চাকরি ওর জন্য নয়। তাই আবারও পড়াশোনা আর গবেষণার লাইনে ফেরত আসার জন্য পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করেছে। ওর কাহিনী শুনে আমার চক্ষু ছানাবড়া। কত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েই না ও গবেষণার প্রতি ওর ভালবাসা টের পেয়েছে! আর আমি গবেষণা সংক্রান্ত কোনোকিছুর ভিতর দিয়ে না গিয়েই পিএইচডি করতে আগ্রহী হয়েছি। আদৌ কি আমি জানি পিএইচডি মানে কী? সবাই বলে পিএইচডি মানে কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্ট রাখা মোটেও সোজা ব্যাপার না। আমি কি নিজেকে যাচাই করে দেখেছি, এই কমিটমেন্টে ঢুকে সেটা চালিয়ে যাওয়ার মত ব্যাপক ইচ্ছা আমার আছে কিনা?
সবচেয়ে অবাক হলাম জেনে যে, কিউ মাস্টার্স করেছে প্রফেসর হলি রেইনরের অধীনে। ডঃ রেইনর ২০১৫ সালে আমার ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলেন। সেটাই ছিল উচ্চশিক্ষার পথে আমার প্রথম ইন্টার্ভিউ। স্কাইপে হয়েছিল ইন্টার্ভিউটা। কী খুশিই না হয়েছিলাম ইন্টার্ভিউ দিয়ে। ভেবেছিলাম পিএইচডিতে অ্যাডমিশন হয়েই গেছে। পরে দেখি বেদনার নীল খামে করে রিজেকশন লেটার এসেছে। যা হোক, ডঃ রেইনরের দিকে আমার নজর ছিল ২০১৮ সাল অব্দি। উনার সাথে কাজ করার খুব ইচ্ছা ছিল। এখন যখন উনার হাতে গড়া গবেষকের সাথে দেখা হল, অদ্ভুত এক নস্টালজিয়া কাজ করল। বারবার মনে হতে লাগল, কিউয়ের জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। কিউ খুবই প্রশংসা করল ডঃ রেইনরের, বিশেষত উনার মেন্টরশিপের। উনার সাথে কাজ করে কিউয়ের দুইটা পেপার পর্যন্ত সাবমিশন হয়ে গেছে। শুনে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। বলে কী? এই মেয়ের ধারেকাছেও তো আমি নেই। আমার গবেষণাই শেষ হয়নি এখনো। পেপার সাবমিশন তো দূর কি বাত। কিউয়ের সাথে একই দাঁড়িপাল্লায় নিজেকে মাপার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছি বলে লজ্জা পেলাম। তবে কিউ সান্ত্বনা দিল। বলল, ওর মাস্টার্স শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। এই দুই বছরের মধ্যে ও পেপার সাবমিট করেছে। আর আমার মাস্টার্স শেষ হবে এই বছর। আমার হাতে প্রচুর সময় আছে পেপার সাবমিশনের। ওর সাথে তুলনা করে মন খারাপের কিছু নেই। ঠিক বটে!
.
এ তো গেল কিউয়ের কথা। বাকি যে দুজন আছে, ওদের সাথে কথা বলেও টাশকি খেলাম। একজন আন্ডারগ্র্যাড করেছে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিন থেকে, যেটা টাইমস র্যাংকিং অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের ৩৮-তম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। আরেকজন করেছে ওরেগন স্টেট থেকে। যে টেক্সাস থেকে পাশ করেছে, সে জড়িত ছিল টেক্সাস স্প্রাউটস নামের একটা গবেষণার সাথে। শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কারণ এই গবেষণার দিকেও আমার নজর ছিল। আমি যোগাযোগও করেছিলাম টেক্সাস স্প্রাউটসের পরিচালক ডঃ জেইমি ডেভিসের সাথে, উনার অধীনে পিএইচডি করার জন্য। উনি আমার স্কাইপ ইন্টার্ভিউ নিয়ে টের পেয়েছিলেন, আমি উনার দলের জন্য উপযুক্ত না। তাই মানা করে দিয়েছিলেন। হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল কিন্তু উনার সরাসরি সিদ্ধান্ত শুনে ভক্তিও বেড়ে গিয়েছিল। অনেক প্রফেসরই সরাসরি কিছু বলেন না। ঝুলিয়ে রাখেন। ফলে রিজেকশন লেটার আসার আগ পর্যন্ত আশা নিয়ে বসে থাকি। ডঃ ডেভিসের মত সরাসরি বলে দিলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজানো সহজ হয়।
.
খেয়াল করে দেখুন, দুনিয়া কত ছোট। পুষ্টির মত একটা নির্দিষ্ট বিষয় হলে দুনিয়া আরও ছোট। আমি যেসব প্রফেসরদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম কিংবা আছি, তাদের সাথে কাজ করা হোক বা না হোক, তাদের শিষ্যদের সাথে দেখা হয়ে গেল। যে প্রজেক্টে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেটায় যুক্ত হতে পারি বা না পারি, যুক্ত ছিল এমন কারো সাথে পরিচয় ঘটে গেল। ঘুরেফিরে দেখা যায় সবাই সবাইকে চেনে। দেশে থাকতে এরকম অভিজ্ঞতার কথা চিন্তাই করতে পারিনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসে অকল্পনীয় সব অভিজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে।
.
বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুইজন জিজ্ঞেস করল, কোন কোন প্রফেসরের সাথে আমার কাজ করার ইচ্ছা। চারজনের নাম বললাম। জানতে চাইলাম উনাদের সাথে কাজ করার ব্যাপারে ওদের কোনো ধারণা আছে কিনা। দুইজনই সব প্রফেসরের ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলল। কিন্তু নির্দিষ্ট একজনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। ঐ প্রফেসর নাকি ছাত্রদের চাপে রাখেন, খুব একটা সহযোগিতা করেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনাকে খুব পছন্দ হয়েছিল। তবে এটা ঠিক, আগাম সতর্কতা পেয়ে ভাল হল। যদি উনার সাথে কাজের সুযোগ পাই, নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারব।
.
আধা ঘণ্টা ধরে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপচারিতা চলল। এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল অ্যাডমিশন কমিটির আরেক সদস্যের দরবারে। উনার সাথে কাজ করার কথা আমি স্টেটমেন্টে লিখিনি। কিন্তু আমাকে যাচাই করার জন্য আট সদস্যের যে দল আছে, উনি সেটার একজন সদস্য। ছোটখাট মানুষ, মুখে হাসি লেগে আছে। মাই ডিয়ার ধরনের। আমি উনার অফিসে বসে খকখক করে কয়েকবার কাশার পর জানতে চাইলেন রঙ চা খাব কিনা। গরম গরম রঙ চা খেলে গলায় আরাম পাব। শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম। সাথে মানাও করে দিলাম। উনাকে কষ্ট করে চা বানাতে দেওয়ার দরকার দেখি না। কিন্তু উনি জোর করলেন। বললেন, কেতলিতে পানি গরম হয়ে আছে। দরকার শুধু চা-পাতা ঢেলে চিনি নেড়ে নেওয়া। বললাম, এত ঝামেলার দরকার নেই। উনি চাইলে আমাকে গরম পানি দিতে পারেন। ওটা খেলেই গলায় আরাম লাগবে।
.
প্রফেসর একটা মগে গরম পানি ঢেলে আমাকে দিলেন। এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুব মুগ্ধ করে। আমি বাংলাদেশী কারো মধ্যে এই আচার দেখিনি। যখন দেশে থাকতে ইতালিয়ান কোম্পানিতে কাজ করতাম, তখন ইতালিয়ান বসের বাসায় যাওয়ার পর উনি নিজে কফি বানিয়ে খাইয়েছিলেন। ইচ্ছা করলেই বলতে পারতেন, ‘সবকিছু দেওয়া আছে, বানিয়ে খাও।’ কিন্তু না, নিজেই বানিয়ে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রেও দেখেছি কারো অফিসে গেলে সে নিজে চা-কফি বানিয়ে খাওয়ায়। আমার রিসার্চ সুপারভাইজারের কথাই ধরুন না! যে সময়ের কথা বলছি, তখন উনি পুষ্টি বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। উনার সামনে গেলে আমি একটু তটস্থ থাকতাম। উচ্চপদের শিক্ষকদের থেকে সবসময় নিরাপদ দূরত্বে থেকেছি। সম্মান দিচ্ছি বলে নয়, ভয়ের চোটে। এখানেও সে ধারা বজায় ছিল। কিন্তু উনি একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘রুথ, তুমি কি আমাকে ভয় পাও নাকি? আমি তো কামড়াই না।’ এরপর থেকে কিভহুতা হলেও ভয় কেটে গিয়েছিল। তো, উনার অফিসে যখন সাপ্তাহিক মিটিং করতাম, উনি কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। ইলেকট্রিক কেতলিতে পানি গরম হতে বেশিক্ষণ লাগে না। এরপর শুধু ইনস্ট্যান্ট কফি মিশিয়ে নিলেই হল। যারা আরেকটু শৌখিন কফিখোর, তারা গুঁড়ো করা কোকো বীজ চোলাই করে কফি বানিয়ে খান। সুপারভাইজার ছিলেন দ্বিতীয় গোত্রের। আগুন গরম ধোঁয়া ওঠা কফি খেতেন। একদিন বললাম, ‘৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রার গরম পানীয় পান করলে সেটা অন্ননালীতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।’ প্রফেসর প্রমাণ দেখতে চাইলেন। হাতেই ছিল প্রিন্ট করা গবেষণা প্রবন্ধ। আমার গবেষণার জন্যে এসব বিষয়ে পড়তে হচ্ছিল। ঐ প্রবন্ধ পড়ে প্রফেসর বললেন, ‘আমার তো অন্ননালী পরীক্ষা করা উচিৎ। যুগ যুগ ধরে ধোঁয়া ওঠা কফি খেয়ে আসছি।’
.
গরম পানিতে চুমুক দিতে দিতে প্রফেসরের সাথে বাৎচিত করতে লাগলাম। উনি আমার গবেষণা নিয়ে জানতে চাইলেন। আমি মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সাথে অন্ননালীর ক্যান্সারের সম্পর্ক নিয়ে একটা রিভিউ করছি। বিষয়টা উনার বেশ মনে ধরল। নিজ থেকে বেশ কিছু পরামর্শও দিলেন। উনি এশিয়ান বলে এশিয়ান জনগণের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বেশ আলাপচারিতা চলল। এই করতে করতে দেখি আধা ঘণ্টা শেষ। দরজার বাইরে কেটি নামের (এই কেটি আর সকালের কেটি এক নয়) অপূর্ব সুন্দরী এক পিএইচডি শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে। নিয়ে যাবে ইউএবির রিক্রিয়েশন সেন্টারে। যারা ভাবেন সুন্দর মানুষের ঘটে বুদ্ধি থাকে না, তারা নিতান্তই স্টেরিওটাইপ চিন্তাভাবনা করেন। শুধু কেটিকে দেখে বলছি না, আমাদের পুষ্টি অনুষদের বর্তমান চেয়ারপার্সনকে দেখেও আমি মডেল ভেবেছিলাম। উনার উচ্চতা, ফিগার, স্টাইলিশ জামাকাপড়, আর সাজগোজ দেখে জিজি হাদিদের কথা মনে পড়ে যায়। একইভাবে, আমার চারপাশে প্রচুর সুন্দর মানুষ আছে যারা ঘটে প্রখর বুদ্ধি রাখে, যারা পিএইচডি করে, পোস্ট ডক করে, বিজ্ঞানী বা প্রফেসর হয়। তাই প্রচলিত একটা ধারণাকে আপ্ত করার আগে নিজে পর্যবেক্ষণ করুন।
পর্ব পাঁচ এখানে
Happy
1
100 %
Sad
0
0 %
Excited
0
0 %
Sleepy
0
0 %
Angry
0
0 %
Surprise
0
0 %