Read Time30 Minute, 33 Second
গাড়ি দেখতে গিয়েছি, প্রাচীন আমলের এক টয়োটা সেডান। মাস দুই হল সিরিয়াসলি গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছি। এতদিন কিনব কিনছি করে ফ্যা ফ্যা ঘুরেছি। কিন্তু গত ক’মাসে খুব বেশি অনুভব করেছি গাড়ির অভাব। টুকটুক করে গত দশ মাসে যে ডলার জমেছে, তাই দিয়ে কিনে ফেলব ঠিক করলাম। তবে ঠিক করলেই তো হল না, গাড়ি পছন্দ করার ব্যাপার আছে। আমি গাড়ির অ আ ক খ কিছুই জানি না। বাইরের চাকচিক্য দেখে পছন্দ হলেই ভাবি, ভাল গাড়ি। ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে ঝা চকচকে সেডান দেখলে সেইভ করে রাখি। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন? প্রাথমিক কিছু তো জানতেই হয়, নাকি? নেট ঘেঁটে, বন্ধু ফরহাদ আর প্রতিবেশী আনজাম ভাইকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম গাড়ির বিজ্ঞাপনে দেওয়া কোন কোন ব্যাপার খেয়াল করতে হবে। কম মাইলেজ হলে গাড়ির দাম বাড়বে, বেশি মাইলেজ হলে কমবে – এটা ঐতিহাসিক সত্য। এরপর আছে কত সালের মডেল। যত সাম্প্রতিক, দাম তত বেশি। এরপর আছে মডেল আর কোম্পানির/ব্র্যান্ডের কারসাজি। আছে দুর্ঘটনার ইতিহাস, ট্যামা খাওয়া (dent), রঙ উঠে যাওয়া, দাগ বা আঁচড় লাগা, মালিকানা বদলের জারিজুরি। এক্সিডেন্টের রেকর্ড থাকলে সে গাড়িকে বলে স্যাল্ভেজ টাইটেলের গাড়ি। এগুলো সহজে বিকোতে চায় না। এজন্য গাড়ির দাম অনেক কমে যায়। কিন্তু আমরা স্যাল্ভেজ টাইটেলের কিছু কিনব না, আমাদের গাড়ি হতে হবে ক্লিন টাইটেল বিশিষ্ট। অবশ্য ফরহাদ আরও কিছু তথ্য দিল যেগুলো আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়াল। যেমন, দুর্ঘটনা ঘটলেই যে গাড়ির টাইটেল ক্লিন থেকে স্যাভেজ হয়ে যাবে, তা নয়। যদি দুর্ঘটনার পর গাড়ি রিপেয়ারের খরচ গাড়ির মোট মূল্যের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে টাইটেল স্যাল্ভেজ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া নয়। আবার গাড়ির মাইলেজ বেশি হলেও সেটা বড় ইসু নয় যদি সেই মাইলেজ আসে হাইওয়ের ড্রাইভিং থেকে। শহরের ভিতরে যে ড্রাইভিং করা হয়, সেটায় গাড়ির বেশি ক্ষতি হয় হাইওয়েতে করা ড্রাইভিঙয়ের তুলনায়। কারণ এক্ষেত্রে চালক বারবার ব্রেক কষে, বারবার গতি বাড়ায়, বারবার গাড়ি চালু করে বা বন্ধ করে।
.
আমাকে প্রথম থেকেই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিলো টয়োটা বা হোন্ডা কোম্পানির গাড়ি কেনার। এগুলোর পার্টস সহজে পাওয়া যায় এবং সমস্যা হলে কম মূল্যে মেরামত করা যায়। টয়োটার মধ্যে ক্যাম্রি আর হোন্ডার মধ্যে অ্যাকর্ড কেনার উপদেশ পেয়েছিলাম। আমার নিজেরও প্রথম পছন্দ ছিল টয়োটা ক্যাম্রি কারণ ক্যাম্রির আকৃতি, চেহারা সবই সুন্দর। টয়োটা করলা ছিল দ্বিতীয় পছন্দ। কিন্তু ক্যাম্রির দাম আর মাইলেজ ব্যাটে বলে মিলছিল না। কয়েকমাস ধরে মার্কেটপ্লেস, কারগুরুস, কারফ্যাক্স, অটোট্রেডার, কার্স ডট কম ঘুরে ভাজা ভাজা করেছি স্বল্পমূল্যের একটা টয়োটা ক্যাম্রির জন্য। প্রচুর বিজ্ঞাপন আছে কম দামী গাড়ির কিন্তু মাইলেজ বলুন, সাল বলুন বা দুর্ঘটনার ইতিহাস বলুন, খাপে খাপ মিলেনি। পাঁচ হাজার ডলারে ২০১০ সালের টয়োটা ক্যাম্রি পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এক লাখ পঞ্চাশ থেকে দুই লাখ মাইলেজ বিশিষ্ট। এত মাইলেজের গাড়ি কিনব না। আমাদের লাগবে চার হাজার ডলারের মধ্যে একশো মাইলেজের গাড়ি। এত বায়নাক্কা নিয়ে সেন্ট লুইস শহরের বিশ মাইলের ভেতর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। যেসব গাড়ি ভাল লাগে, সেগুলোর ডিলার সব দূরে দূরে। জেফারসন কাউন্টি, ক্যানসাস সিটি, কিংবা ইলিনয়ে। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যেতাম। কয়েকবার বাদও দিয়েছি গাড়ির চিন্তা। ভেবেছি আরেকটু টাকা জমুক, তাহলে অন্তত বাজেট নিয়ে হাপিত্যেশ করতে হবে না। কিন্তু মধ্যবিত্তের ঘোড়ারোগ থাকতে নেই। বেশি টাকা জমলেই যে সে টাকার পুরোটা দিয়ে গাড়ি কিনতে হবে, তা কে বলেছে? তাই দু’দিন পর নতুন উদ্যমে চার হাজার ডলারেরই গাড়ি খুঁজতে লাগলাম। ফেসবুকের সেইভ অপশনে চল্লিশটা গাড়ি সেইভ করে ফেলেছি কিন্তু কোনোটার মূল্যই বাজেটের ভেতর নেই। সেইভ করে রেখেছিলাম এই ভেবে, যদি কয়দিন পর মূল্য হ্রাস পায়! একদিন দেখলাম কয়েকটার মূল্য কমিয়েছে কিন্তু চার হাজারের ভেতরে নামেনি। আমি ক্লাসে ঢুকার আগে একবার মার্কেটপ্লেসে ঢুঁ মারি, নতুন কোনো অফার এল কিনা দেখি, ক্লাস শেষ করে একবার। দিনে কমপক্ষে চারবার আমার মার্কেটপ্লেসে ঘোরাঘুরি হয়। এতবার আমি ব্ল্যাকবোর্ড লার্নেও ঢুকি না অ্যাসাইনমেন্টের গ্রেড এসেছে কিনা দেখতে।
.
জুনের বারো তারিখ, রাত নয়টা। অভ্যাসবশত মার্কেটপ্লেসে ঢুকলাম, সাথে সাথে একটা তাজা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। এক মিনিট হয়েছে বিজ্ঞাপনটা এসেছে। ২০০৪ সালের টয়োটা করলা এল ই সেডান, দাম ৩৬০০ ডলার, মাইলেজ ৮১৯০০। বিজ্ঞাপনদাতার নোটে লেখা আছে সে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে গাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছে। আমি এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলাম। শহর পাল্টানোর সময় মানুষ কম মূল্যে ভাল গাড়ি ছেড়ে দেয়। সেরকম সুযোগ নিতে পারলে কেল্লাফতে। কিছুদিন আগে এরকম একটা সুযোগ হাত ফসকে গিয়েছে। তাই বিজ্ঞাপনটা দেখে মুহূর্ত পরিমাণ দেরি না করে বিজ্ঞাপনদাতাকে নক করলাম মেসেঞ্জারে। অন্য সব গাড়ির ব্যাপারে প্রিন্সের সাথে আলোচনা করে বিজ্ঞাপনদাতাকে নক দিয়েছি। কিন্তু এই অফার দেখে এমনই টান অনুভব করলাম যে, কারো সাথে আলোচনা না করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, “গাড়িটা দেখতে আসতে পারি?” বিজ্ঞাপন যে দিয়েছে, সে একজন মেয়ে। বিজ্ঞাপন দেওয়ার দুই মিনিটের মাথায় আমি নক করেছি কিন্তু সে আর উত্তর দেয় না। আমি ঘেমে একাকার। অন্য কেউ আমার আগে নক করে ফেলেনি তো? মেয়েটা কি অন্য কারো সাথে কথা বলছে গাড়ি নিয়ে? নাহ, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করেছি। আধা ঘণ্টা পর মেয়েটার উত্তর এল, “অবশ্যই!” কথায় কথায় জানলাম সে আমার থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে থাকে। খুব খুশি হলাম। এত কাছে গাড়ি পেয়ে যাব, কে জানত! হেঁটে দেখে আসা যাবে। অথচ এতদিন এমন সব গাড়ি দেখেছি যেগুলো দেখতে হলে বাস আর ট্রেন ভ্রমণ করতে হত। দ্রুত সেতু’দাকে টেক্সট করলাম আগামীকাল গাড়িটা দেখতে যেতে পারবেন কিনা জানতে চেয়ে। চেনাজানাদের মধ্যে উনিই গাড়ির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। গাড়ির টুকটাক মেকানিক্যাল ঝামেলা নিজেই সারান। দাদা রাজি হলেন। মেয়েটাকে নিশ্চিত করলাম কাল আসছি দেখতে। এই ধরনের অফার একদিনও থাকে কিনা সন্দেহ। যত দ্রুত পারা যায় ডিল চূড়ান্ত করে ফেলতে হবে।

আমরা থাকি লিন্ডেল বুলেভার্দে, মেয়েটা নর্থ টাইলর এভেনিউয়ে। সেতু’দার গাড়িতে করে আমি আর প্রিন্স গেলাম মেয়েটার এপার্টমেন্টের সামনে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল ও। আমার সমান উচ্চতার, খুবই হালকা পাতলা একজন মানুষ। মঙ্গোলীয় চেহারা তবে চৈনিক নয়। চোখগুলো চৈনিকদের মত অত চাপা না। হাতে হাত মিলিয়ে পরিচিত হলাম। ওর নাম চাউ মাই টা। ভিয়েতনাম থেকে এসেছে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট করছে শুনে ভালমত তাকালাম। বয়স আমার চেয়ে বেশি হবে না কিছুতেই, বরং কম হতে পারে। অথচ সে পোস্ট ডক করছে আর আমি কেবল মাস্টার্স। জিজ্ঞেস করলাম কীসের উপর কাজ করছে। বলল, স্থূলতা (ওবেসিটি) আর বিপাক ক্রিয়ার (মেটাবোলিজম) উপর। পুরো বিষয়টা বংশগতিবিদ্যার (জেনেটিক্স) সাথে সম্পর্কিত। ওদের ল্যাবে নাকি নতুন ধরনের আইডিয়া নিয়ে কাজ হচ্ছে, সফল হলে ‘গ্রাউন্ড ব্রেকিং’ গবেষণা হবে। গবেষণাগারেই বেশিরভাগ সময় কাটে চাউয়ের। গাড়ি দিয়ে কেবল বাসা থেকে ল্যাব, ল্যাব থেকে বাসা পর্যন্ত যাওয়া আসা হয়। হাইওয়েতেও ওর চালানো হয় না, দূরপাল্লার ভ্রমণ তো নয়ই। এজন্য মাইলেজ এত কম। চাউ গাড়িটার দ্বিতীয় মালিক। প্রথম মালিক ছিল ওর ল্যাবের এক প্রাক্তন সহকর্মী। বিজ্ঞাপন দেওয়ার একদিনের ভেতর নাকি প্রচুর লোকজন চাউকে নক দিয়েছে মেসেঞ্জারে। চাউ ভেবেছিল এত কম সময়ের ভেতর গাড়ি বিক্রি করতে পারবে না। তাই ন্যূনতম দাম ধরেছিল যেন দ্রুত বিক্রি হওয়ার সুযোগ থাকে। সে ভাবেইনি এত মানুষ আগ্রহী হবে ওর পুরনো গাড়ির প্রতি! বুঝতে পারলে নাকি দাম আরেকটু বেশি ধরত। আমার ধারণা সম্ভাব্য ক্রেতার মধ্যে আমিই প্রথমে নক দিয়েছি চাউকে। অ্যাডের বয়স এক মিনিটও হতে দিইনি, তার আগেই নক। এজন্য আমরাই প্রথম এসেছি গাড়ি দেখতে। আমাদের পর আরও তিনটা পার্টির আসার কথা। যারা নক দিয়েছে, তাদের প্রোফাইল ঘেঁটে চাউ ঠিক করেছে কাদের গাড়ি দেখাবে। কে ভণ্ড, কে ভাল সেটা তো ফেসবুকের চ্যাট থেকে সহজে বুঝা যায় না। তাই ফেসবুক প্রোফাইলকে ও ছাঁকনি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
.
গল্প করতে করতে চাউ ওর গাড়ির ইমিশন্স আর সেফটি ইন্সপেকশন রিপোর্ট এগিয়ে দিল। গাড়ি থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের (emit) হচ্ছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে কী ফলাফল পাওয়া গেল (পাশ না ফেইল) সেটা লেখা থাকে ইমিশন্স রিপোর্টে। আর সেফটি ইন্সপেকশন রিপোর্টে লেখা থাকে রাস্তায় চালানোর জন্য গাড়িটা কতখানি নিরাপদ। এরপর দেখাল টাইটেল আর রেজিস্ট্রেশন। এগুলো দেখতে দেখতে আমরা পার্কিং এরিয়ায় পৌঁছলাম। চাউয়ের এপার্টমেন্টে গ্যারেজ নেই বলে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে রেখেছে। রুপালি রঙের গাড়ি। দেখে বুক ধ্বক করে উঠল। এই গাড়ি কি আমাদের হতে যাচ্ছে? সেতু’দা চাউয়ের অনুমতি নিয়ে গাড়ির বনেট (আমেরিকায় বলে হুড) খুলে ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। যাওয়ার আগে নেট ঘেঁটে টুকটাক নোট নিয়ে গিয়েছিলাম কী কী পরীক্ষা করতে হবে। অয়েল কুল্যান্ট, ব্যাটারি, ব্রেক, সব ধরনের ফ্লুয়িড আর ফিল্টার। এছাড়া লিক আছে কিনা, কোথাও মরিচা পড়েছে কিনা, ট্রান্সমিশন কেমন, টায়ার ঠিক আছে কিনা, শেষ কবে তেল বদলেছে, গাড়ির ইন্টেরিওর আর এক্সটেরিওর ঠিক আছে কিনা; এফএম রেডিও, সিডি ড্রাইভ, এসি, হিটার কাজ করে কিনা ইত্যাদিও দেখতে হবে। আমি বা প্রিন্স অতশত বুঝি না। চিনিই না কোনটা কী। তাই দাদার উপর ভরসা করে রইলাম। যা যা নোট করে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেগুলো সম্পর্কে দাদাকে প্রশ্ন করতে লাগলাম। দাদা ধৈর্য ধরে উত্তর দিতে লাগলেন। ইঞ্জিন, অয়েল, ট্রাংক (বাংলাদেশে যাকে ডিকি বলি) ইত্যাদি চেক করার পর দাদা গাড়ি চালাতে চাইলেন। চাউ বলল, আমাদের আপত্তি না থাকলে সে সাথে যেতে চায়। আপত্তি কীসের? তাই পিছনের সিটে বসলাম আমি আর চাউ, ড্রাইভিং সিটে সেতু’দা, পাশে প্রিন্স।
.
ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শুনে আমার বুক ধুকপুক করতে লাগল। সবকিছু ঠিক পাওয়া যাবে তো? না পাওয়া গেলে ভীষণ কষ্ট পাব। বিজ্ঞাপন দেখার মুহূর্ত থেকে গাড়িটার প্রতি ভালোলাগা কাজ করছে। এমনটা আর কোনো গাড়ির জন্য হয়নি। মূল্য, মাইলেজ, ব্র্যান্ড সবকিছু খাপে খাপ মিলে গেছে বলেই শুরু থেকে টান অনুভব করছি গাড়িটার জন্য। তাই এই গাড়িই আমার চাই। এরকম একটা গাড়ি পেতে আবার কত মাস লাগে কে জানে। দাদা রেডিও চালু করলেন। শুরু হল এভা ম্যাক্সের ‘সুইট বাট সাইকো’। গানটা এর আগে যতবার শুনেছি, বিরক্ত লেগেছে। আজ যেন কানে মধু ঢেলে দিল। চাউ গানের সাথে লিপ্সিং করছে। দাদা এসি, হিটার চেক শেষ করে গাড়ি চালানো শুরু করলেন। আমরা যাব অটো যোনে। সেখানে Onboard Diagnostics II (OBD-II) নামক কোড রিডার দিয়ে বিনামূল্যে গাড়ির ব্যাটারি, অল্টার্নেটর, স্টার্টার আর ভোল্টেজ রেগুলেটর পরীক্ষা করা হয়। টাইলর থেকে দুই ব্লক পেছালেই আফ্রিকান আমেরিকানদের পাড়া, বিশাল এলাকা জুড়ে। আমরা ব্যাপারটা জানতাম না। কাছে পিঠে যে অটো যোন দেখাচ্ছে, সেটা এই পাড়ার ভিতর পড়েছে। পাড়া পছন্দ না হওয়ায় তালিকায় থাকা পরবর্তী অটো যোনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পুরো পাড়ায় যদি একটা দালান ঠিকঠাক থাকত! সবগুলো পুরনো আমলের ভাঙাচুরা, পলেস্তারা খসা, ভূতুড়ে চেহারার বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড় করানো গাড়ির চেহারাও দেখার মত। নিরানব্বই শতাংশ গাড়ি ট্যামা খাওয়া। এক শতাংশ যেগুলো ট্যামা খাওয়া নয়, সেগুলোর হয় জানালার কাঁচ ভাঙ্গা, বা আয়না নেই। আনজাম ভাই বলেছিলেন, ব্ল্যাকদের মনোভাব নাকি এমন যে, গাড়িতে যদি ডেন্ট না থাকে, তাহলে সে গাড়িই চালাতে জানে না। মানে, যত বেশি উড়াধুরা, তত ভাল চালক। দ্বিতীয় অটো যোনও ব্ল্যাক পাড়ার ভিতর, কিন্তু রাজপথের কাছাকাছি। ঝামেলা হলে দ্রুত রাজপথে উঠে পড়া যাবে। পার্কিং লটে পার্ক করার পর সবাই দোকানে ঢুকলাম কাস্টোমার কেয়ার কর্মকর্তার সাথে কথা বলার জন্য। কয়েক মুহূর্ত পরই প্রিন্স বাইরে বেরিয়ে গেল। গাড়ি একলা রাখাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না। আমি আর চাউও বেরিয়ে এলাম। স্যান্ডো গেঞ্জি আর ময়লা পাতলুন পরা, হাতে প্লায়ার্স ধরা এক ব্ল্যাক এসে জিজ্ঞেস করল আমাদের মেকানিক লাগবে কিনা। ব্যাটার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে আমি নিশ্চিত সে গাঞ্জা খাওয়া। বললাম, লাগবে না। দ্বিতীয়বার বিরক্ত না করে ছেলেটা চলে গেল। আশেপাশে অনেক দামী গাড়ি দেখা যাচ্ছে। এরকম পাড়ায় এরকম গাড়ি দেখে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জাগে, গাড়িগুলো চোরাই মাল কিনা।
.
এখানে আসার পর থেকে চাউয়ের অস্বস্তি চোখে পড়ছে। মুখে কিছু বলছে না কিন্তু হাবভাবে সেটা ফুটে উঠছে। অনিরাপদ বোধ করছি আমরাও। খুন খারাপি, ছিনতাই, চুরি চামারি যা কিছু শুনেছি এ পর্যন্ত, সবকিছুর সাথে কালোরা জড়িত ছিল। ফলে নিজেরা কোনোকিছুর শিকার না হলেও একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে। একটু পর অটো যোনের একজন কর্মী এলেন হাতে রিডার নিয়ে। ভেতরে উঁকি দিয়ে ড্যাশবোর্ডে কিছু একটা দেখে বললেন, আমাদের গাড়ির চেক ইঞ্জিন লাইট জ্বলছে না। এই লাইট না জ্বললে উনার রিডার কিছু পরীক্ষা করতে পারবে না। ড্যাশবোর্ডে ‘চেক ইঞ্জিন লাইট’ নামের একটা অপশন থাকে। ইঞ্জিন যখন সমস্যাহীনভাবে চলে, তখন এই অপশন অফ থাকে। কিন্তু ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা হলে এটা জ্বলে উঠে। তখন আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে ইঞ্জিনে কী সমস্যা হচ্ছে। যখন এই অপশন জ্বলে উঠে, তখন যদি Onboard Diagnostics পোর্টে Onboard Diagnostics II রিডার লাগান, রিডারে কিছু কোড দেখা যাবে। এই কোডগুলো নির্দেশ করে কোথায় কী ঝামেলা হচ্ছে। আমাদের গাড়িতে যেহেতু ‘চেক ইঞ্জিন লাইট’ অপশনটা জ্বলছে না, তার মানে ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা নেই। শুনে সবাই আশ্বস্ত হলাম। দ্রুত আবার চাউয়ের বাসার দিকে রওনা দিলাম। মেয়েটা বেশ মিশুক। রসবোধও ভাল। কথা বলে মজা লাগছে। গল্পের এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম, পিএইচডি কি ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে করেছে কিনা। উত্তরে বলল, না, পিএইচডি করেছে ইংল্যান্ড থেকে। জিজ্ঞেস করলাম ইংল্যান্ডের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। উত্তর এল, “অক্সফোর্ড।” আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। একজন অক্সফোর্ড পড়ুয়ার সাথে এতক্ষণ ধরে বসে আছি? টাইমস হায়ার এডুকেশনের র্যাংকিং অনুযায়ী বিশ্বের এক নাম্বার বিশ্ববিদ্যালয় হল অক্সফোর্ড। সেখান থেকে পিএইচডি করে এসেছে চাউ? বাপ রে! আমি থম মেরে বসে আছি দেখে চাউ কথা চালিয়ে যেতে লাগল। ইংল্যান্ডে পিএইচডি করা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের মত কষ্টকর না। এখানে যেমন গবেষণার পাশাপাশি কোর্সওয়ার্কের ঝামেলা আছে, ওখানে নেই। ওখানে পুরো আলোকপাত করা হয় গবেষণার উপর। চাউয়ের কথা শেষ হলে আমি বিড়বিড় করলাম, “অক্সফোর্ড? সত্যি? ওখানে পড়তে পারা তো স্বপ্নের মতই, ওখানকার একজন স্টুডেন্টের সাথে কথা বলাও স্বপ্নের মত।” চাউ হিহি করে হেসে দিল। বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, এটা এমন কিছু না।
.
তারপর চাউয়ের সাথে রাজ্যের আড্ডা শুরু হল। এক পর্যায়ে ও জিজ্ঞেস করল আমার বাসা কত বেডরুমের। বললাম, ওটা স্টুডিও এপার্টমেন্ট। প্রিন্সকে দেখিয়ে বললাম, ও আমার হাজবেন্ড। ঐ ছোট স্টুডিওতেই আমরা দুজনে মিলে থাকি। চাউ বলল, সে বিয়েশাদি করেনি। কিন্তু তার প্রেমিক শিকাগো শহরে থাকে বলে সে ওখানে চলে যাচ্ছে। “ব্লাডি বয়ফ্রেন্ড!” হাসতে হাসতে বলল চাউ। আমরাও হেসে দিলাম। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর পোস্ট ডক শেষ হয়নি। কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যেতে হচ্ছে ব্লাডি বয়ফ্রেন্ডের কাছে। বয়ফ্রেন্ড শিকাগোতে চাকরি পেয়েছে। তাই চাউ নতুন করে পোস্ট ডক হিসেবে জয়েন করেছে শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্বের প্রথম ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি। বাবারে বাবা! কথায় কথায় চাউ জানাল, জামাই বউ বা প্রেমিক প্রেমিকা এক পেশার না হওয়াই ভাল। দুজনের পেশা এক হলে প্রতিযোগিতা চলে আসে। একজনের উপর আরেকজনের খবরদারি বেড়ে যায়। একজন আরেকজনকে বলে, “তুমি এটা এভাবে করলে না কেন? এই কাজ এখনো শেষ করতে পারো নাই? আমি হলে কবেই করে ফেলতাম!” ইত্যাদি। হয়ত চাউ দেখেছে এমন প্রতিযোগিতা, তাই মনে ভয় ঢুকে গেছে। কিন্তু আমার মতে, সবসময় এমন হয় না। দুজনে এক পেশার হলে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়াও ভাল হওয়ার কথা। চাউ সমর্থন দিয়ে বলল, ওর সুপারভাইজর আর উনার বউ একই ফিল্ডে গবেষণা করে। কিন্তু কেউ কারো গবেষণা নিয়ে ঘাঁটায় না। তারা সুখেই আছে। কিন্তু সবাই এরকম হতে পারে না। ঘাঁটাঘাঁটি চলে আসে। আর এরকম বাজে পরিস্থিতি বেশ ক’বার হতে দেখেছে চাউ। এজন্য ওর বয়ফ্রেন্ড ওর মত বায়োমেডিকেল সায়েন্সের গবেষক নয়, অন্য পথের পথিক।
.
গল্প করতে করতে ফিরে এলাম চাউয়ের বাসার সামনে। যথাস্থানে গাড়ি পার্ক করে সেতু’দা চাউকে জিজ্ঞেস করলেন, দাম আরেকটু কমানো যায় কিনা। চাউ বলল, আর একশো ডলার কমানো সম্ভব। এর বেশি পারবে না। আমরা বললাম, আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা জানাচ্ছি আমাদের সিদ্ধান্ত। চাউ বিদায় নিয়ে বাসায় ঢুকে পড়ল। আমরা তিনজন শলা পরামর্শ করতে লাগলাম। দাদা বললেন, সবদিক দিয়েই গাড়িটা ভাল। এত কম মূল্যে এত কম মাইলেজের গাড়ি কেনা মানে উইন উইন সিচুয়েশন। চাউ বলেছিল পরবর্তী পার্টি আসবে দুপুর দুটোর দিকে। এখন বাজে পৌনে দুটো। এই গাড়ি দেখলে পরের পার্টি নগদে কিনে নিতে পারে। তাই ঝুঁকি নিলাম না। চাউকে জানালাম, গাড়িটা আমরা কিনব। পাঁচশো ডলার বায়না দিলাম। ঠিক হল, চাউ সাতদিন পর গাড়িটা বুঝিয়ে দেবে। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে দেখি ফেসবুকে গাড়ির যে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছিল, সেখানে লেখা ‘সোল্ড’। ও হুজুর… বিখ গ্যায়া মেরা খাজুর। এতদিন একের পর এক পছন্দের গাড়ি ‘সোল্ড’ হয়ে যেতে দেখেছি। এবার আমাদেরই কারণে একটা গাড়ির বিজ্ঞাপনে সোল্ড তকমাটা লাগল।
.
দুইদিন পর চাউ নক দিয়ে বলল, সে নতুন করে গাড়ির ইমিশন্স আর সেফটি ইন্সপেকশন্স করিয়েছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ভেবেছিলাম এই পরীক্ষা দুটো আমরা করাব গাড়ি হাতে পাওয়ার পর। কিন্তু না, কষ্ট করে চাউই করে ফেলেছে। অনেক ধন্যবাদ দিলাম। দুইদিন পর আবার নক করে চাউ জানাল, সে গাড়ি ওয়াশ করে নিয়ে এসেছে। এবারও আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ভেবেছিলাম, কেনার পর আমাদেরই ওয়াশ করতে যেতে হবে। এটাও চাউ করে দেওয়ায় ঝামেলা থেক বেঁচে গেলাম। যথাসময়ে আনজাম ভাইকে নিয়ে প্রিন্স গেল গাড়ি নিয়ে আসতে। আমি যেতে পারলাম না ডিপার্টমেন্টের কাজে আটকে গেছি বলে। কিছু ফর্ম চাউয়ের পূরণ করে রাখার কথা ছিল। সেগুলোতে আবার আমার স্বাক্ষর লাগবে কারণ গাড়ি আমার নামে কেনা হচ্ছে। যেহেতু আমি যেতে পারছি না, ঠিক হল ফর্মগুলো নিয়ে প্রিন্স বাসায় চলে আসবে। আমি ভার্সিটি থেকে ফিরে সেগুলোতে স্বাক্ষর দিয়ে রাখব আর চাউ সন্ধ্যায় এসে সেগুলো নিয়ে যাবে। গাড়ি এনে রাস্তার ধারে পার্ক করতে হল কারণ গ্যারেজে জায়গা পাইনি। সন্ধ্যায় যখন চাউ এল, ওর গাড়ির সামনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই গাড়ি আমি আর চালাব না।” বললাম, “দুঃখ কোরো না। তোমার গাড়িকে অনেক যত্নে রাখব।” চাউ বলল, এটা ওর জীবনেরও প্রথম গাড়ি ছিল। এখন আমার জীবনের প্রথম গাড়ি হল। ভাবসাবই আলাদা। তারপর কাষ্ঠ হেসে বলল, গাড়ির জন্য খারাপ লাগলেই ও এখানে এসে গাড়ি দেখে যাবে। বললাম, তথাস্তু!

.
এই হল আমাদের জীবনের প্রথম গাড়ির গল্প। বাংলাদেশে থাকতে কখনো যে গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখিনি, তা নয়। অবশ্যই দেখেছি। আমার ছোট খালা আর খালু টয়োটা করোলা এক্স কেনার পর সে স্বপ্ন আরও জোরদার হয়েছিল। উনারা যখন গাড়ি নিয়ে আমাদের বাসায় আসতেন, আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আদৌ কি আমার সামর্থ্য হবে গাড়ি কেনার? হয়ত হবে একদিন… কিন্তু সামর্থ্য হতে হতে পঞ্চাশ ষাট পার হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তাই যখন থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা শুরু করলাম, বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করার আগে আমার গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করা শেষ। ভেবেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে পা দিয়েই বুঝি গাড়ি কিনে ফেলতে পারব! কিন্তু না, বাস্তবতা বড় কঠিন। মধ্যবিত্তদের জন্য সেটা দ্বিগুণ কঠিন। দেশ থেকে আনা টাকাপয়সা খরচ করে গাড়ি কেনাটা বিলাসিতা হয়ে যাবে। আমাদের উচিৎ একটু একটু করে টাকা জমিয়ে সেটা দিয়ে গাড়ি কেনা। সেই টাকা জমাতে লেগে গেল দশ মাস। একটা সময় মনে হচ্ছিলো, নাহ… মাস্টার্স করাকালে গাড়ি কেনা হচ্ছে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। মাস্টার্স করাকালেই গাড়ি কিনে ফেললাম।
