খেয়ে দেয়ে একটু আরামসে বসব, অথচ আমার হাঁসফাঁস লাগা শুরু হল। কিছুতেই মাথায় আসছে না, এমন লাগছে কেন। পাঁচ মিনিট পরপর আমি ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। সময় একদম যাচ্ছে না। চেষ্টা করছি ঘুমাতে, সেটাও পারছি না। এরকম ছটফট আমার কখনোই লাগেনি। প্রিন্স একটু ভয় পেয়ে গেল। মাত্রই আমি ব্রংকাইটিসে ভুগে উঠেছি। পুরোপুরি সারিনি, কাশি আছে এখনো। এর মধ্যে জার্নি করা কি খারাপ হয়ে গেল নাকি? কোনোমতে দুই ঘণ্টা পার হল। ছটফটানি ক্রমেই বাড়ছে। অনেক কষ্টে একটুখানি ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি মাত্র ত্রিশ মিনিট পার হয়েছে। কাহিনী কী? মন অন্যদিকে সরানোর জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। নিকষ কালো আঁধার ছাড়া কিছু দেখা যায় না। একটু আগে বড়সড় একটা চাঁদ দেখেছিলাম, এখন সেটাও দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কিছু শহর চোখে পড়ে। অন্ধকারে শহর বুঝা যায় আলোর ঝলকানি দেখে। প্লেনটা বেশি উচ্চতায় উঠেনি। তাই শহরের আলো দেখা যায়। কিছু শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অল্প অল্প আলো জ্বলছে। ধরে নিই ওগুলো ছোট শহর। কিছু শহরে আবার অনেকখানি জায়গা জুড়ে বেশি বেশি আলো জ্বলছে। ধরে নিই ওগুলো বড় শহর। এই প্লেনের সিটে কোনো টিভি স্ক্রিন লাগানো নেই যেখান থেকে বুঝা যাবে প্লেন এখন কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। তাই মানচিত্র দেখে আমরা অনুমান করার চেষ্টা করি এই মুহূর্তে কোন শহরের উপর আছি। একসময় আমি আশান্বিত হয়ে বললাম, ‘দেখ, ভেগাস! কী ঝলকানি আলোর! এটা ভেগাস না হয়ে যায়ই না।’ প্রিন্স হেসে ফেলল। বলল, ‘মাত্র আড়াই ঘণ্টা পার হয়েছে। এখনই ভেগাস পেলে কোথায়?’ শুনে আমার শরীর আবার গুলিয়ে উঠল।
অবশেষে ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষ হওয়ার ঘোষণা এল। ক্যাপ্টেন বললেন, আর আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হওয়ার পর একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট মাইক হাতে নিয়ে বলা শুরু করলেন, ‘আপনারা আজ এক রেকর্ডের সাক্ষী হয়েছেন। জানেন কী সেটা?… ড্রামরোল প্লিজ…! আজ আমাদের ক্যাপ্টেন তার একশোতম ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছেন!’
‘ইয়েই!’ যাত্রীরা চিৎকার করে উঠল।
অ্যাটেন্ডেন্ট জিজ্ঞেস করলেন, আজ কারো জন্মদিন কিনা। একজন পুরুষ হাত তুলল। অ্যাটেন্ডেন্ট ঠিক মেরিলিন মনরোর স্টাইলে হাত নাচিয়ে গাইলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার প্যাসেঞ্জার!’ আমরা হেসে উঠলাম। এরপর তিনি বললেন, ‘ফ্রন্টিয়ার এয়ারলাইন্স গর্ববোধ করে সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট এখানে কাজ করে বলে। কিন্তু আজকের ফ্লাইটে তারা কেউই উপস্থিত থাকতে পারেনি।” আরেক দফা হাসি সবার।
অ্যাটেন্ডেন্ট বক্তব্য শেষ করলেন এই বলে, “ফ্লাইট দুই ঘণ্টা লেট করেছে বলে আমরা খুব দুঃখিত। তবে লেট না হলে আমার সাথে দেখা হত না। আমি আরেকজনের সাথে শেষ মুহূর্তে শিফট পাল্টেছি। তো, লেট মাঝে মাঝে ভাল, কী বলেন?”
আমরা চেঁচিয়ে সম্মতি দিলাম। এরকম মজার অ্যাটেন্ডেন্ট এই প্রথম পেলাম। ইউটিউবে মাঝে মাঝে ভিডিও দেখি ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা রসিকতা করছেন। কিন্তু বাস্তবে কখনো পাইনি এমন। ইনাকে পেয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভর্তি হল।
অ্যাটেন্ডেন্টের কথা শেষ হওয়ার পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। এ কী দেখছি? এ তো স্বর্গকেও হার মানাবে। কী সুন্দর! কী সুন্দর! বিশাল এলাকা জুড়ে খালি আলো আর আলো। উজ্জ্বল আলো, হরেক রঙের আলো। মিটিমিটি আলো বলে কিছু নেই এখানে। চোখ ধাঁধিয়ে যায় এমন আলো। অন্ধকারের মধ্যেও বুঝা যাচ্ছে কিছু দালান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। বুঝলাম, ওগুলোই বিশ্ববিখ্যাত ক্যাসিনো। তারমানে আমরা এখন লাস ভেগাসে? ওয়াও! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘ভেগাস, ভেইবে! হিয়ার আই কাম।’
প্লেন যেন হাজার বছর ধরে শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। এই রাস্তা থেকে ঐ রাস্তায়, এই বাঁক থেকে ঐ বাঁকে। মূল রানওয়ে থেকে তাকে যেতে হবে টার্মিনালের দিকে। কিন্তু সে রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না। এই মুহূর্তে উত্তম কুমার যদি গাইতেন, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হবে তুমি বল তো?’, বলতাম, ‘বমি করে দেবার মত জঘন্য হবে, দাদা।’ চিন্তা করে দেখুন, মনের মানুষ পাশে বসে আছে। একটুক্ষণের মধ্যে পা রাখব স্বপ্নের ভেগাসে। কেমন রোমান্টিক হতে পারত সময়টা! কিন্তু হঠাৎ করে আমার গলায় খুশখুশানি শুরু হয়েছে। যতবার দম নিচ্ছি, কাশির দমক আসছে। মানুষ ভয় পাবে ভেবে কাশি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। হাতে বমির জন্য বরাদ্দ প্লাস্টিকের প্যাকেট ধরা। যেকোনো মুহূর্তে বমি করে ফেলব। রোমান্টিকতা একদম প্লেনের এক্সিট দিয়ে বের হয়ে গেছে। আমাদের আসন বিন্যাস তিনজনের। কিন্তু তৃতীয় সিটটা ফাঁকাই পড়ে ছিল পুরো ভ্রমণে। এজন্য ঐ সিটে জ্যাকেট রেখে বেশ আরামসে বসতে পেরেছি। আমাদের ঠিক সামনের সিটে এক মা আর তার পুত্র-কন্যা বসেছে। দুজনই পিচ্চি। পুত্রের হাতে স্টাফড ডায়নোসোর ধরা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। আমি আর প্রিন্স নিশ্চিত, এই ছেলে রসের মত ডায়নোসোর পাগল। বড় হলে রসের মত প্যালেওন্টোলজিস্ট বা জীবাশ্মবিদ হবে। রস মানে ‘ফ্রেন্ডস’ টেলিভিশন সিরিজের রস গ্যালার (যারা এই চমৎকার কমেডি-ড্রামা দেখেননি, তারা এখুনি দেখতে বসুন)। পুত্রের হাতে ডায়নোসোর দিলেও পিতামাতা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন রাজকন্যা রঙ করার বই। মানে, বইটিতে বিভিন্ন রাজকন্যার সাদাকালো ছবি দেওয়া। মেয়েটাকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে রঙ করে তাদের রূপ ফুটিয়ে তুলতে। খুব ইচ্ছে করছিল মা’টাকে বলি, কেন এভাবে মেয়ের মাথা বিগড়ে দিচ্ছেন? কেন মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছেন রূপচর্চার বই? সে নিজের অজান্তেই মাথায় ঢুকিয়ে নিচ্ছে কীভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে হবে। কীভাবে নিজেকে রাজকন্যা বানাতে হবে। ওর মাথার ভেতর জীবনের বড় একটা সময় জুড়ে এসব চিন্তাই ঘুরবে। কোনো একদিন যদি মনে প্রশ্ন জাগে, ‘কেন আমি ছেলেদের মত স্রেফ প্যান্ট শার্ট গলিয়ে রাস্তায় নেমে পরি না? কেন আমি ফেস পাউডার, লিপস্টিক মেখে নিজের স্বাভাবিক চেহারাকে বাড়তি সুন্দর বানিয়ে বের হই?’, তখন হয়ত চিন্তা পাল্টাতে পারে। কিন্তু বাবা-মা যদি প্রথম থেকেই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকত, যদি রাজকন্যার বই হাতে না দিয়ে জীবজন্তু রঙ করার বই দিত, মেয়েটা বড় হত জীবজন্তু চিনে, তাদের জন্য কিছু করার আশা নিয়ে।
‘খক খক! খক খক!’ আর পারলাম না আটকে রাখতে। জ্যাকেটের হাতায় মুখ চেপে তুমুল কাশি দিলাম। মা’টা সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেমেয়েকে আড়াল করে ফেলল। ব্রংকাইটিসে ভুগার সময় অমানুষের মত কেশেছি। ওষুধের ডোজ শেষ হওয়ার পর কাশি মোটামুটি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্লেন জার্নি করার পর আবার উদয় হল। প্লেন থামানোর পর থেকে প্রিন্সের সাথে ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, ভালো লাগছে না, গা গুলাচ্ছে। হয়ত প্লেনের ভেতরকার বদ্ধ জমাট বাঁধা পরিবেশ আমার শরীর আর মনের উপর চাপ ফেলছে। যদি অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আগেভাগে নেমে পড়তে পারতাম, ভালোই হত। কিন্তু প্লেনে উঠা আর প্লেন থেকে নামার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেগুলো মেনে চলা আবশ্যক। যেমন, প্লেনে যখন যাত্রীদের উঠানো হয়, তখন সেসব যাত্রীদের সবার আগে উঠানো হয় যারা চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল। এরপর ফার্স্ট ক্লাস, বিজনেস ক্লাস, উচ্চবিত্ত ইকোনমি (যাকে বলে প্রিমিয়াম ইকোনমি), নিম্নবিত্ত ইকোনমি (যার দাপ্তরিক নাম ইকোনমি), ইত্যাদি। আবার যখন নামবেন, তখন ফার্স্ট ক্লাস থেকে নামানো শুরু হয়। ধীরে ধীরে সিরিয়াল অনুযায়ী বিভিন্ন সারির মানুষজন নামতে থাকে। সবশেষে নামে হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল যাত্রীরা। সে হিসেবে আমার সিরিয়াল আসতে মোটামুটি দশ মিনিট লাগবে। এই দশ মিনিট আমি যেন নরক গুলজারে বসে রইলাম। কাশি দিলেই মা’টা অচ্ছুৎ চোখে আমার দিকে তাকায় আর ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে।
কাশতে কাশতেই বের হলাম মহাপতঙ্গের পেট থেকে। আমার দরকার ছিল বাইরের বাতাস। কিন্তু বের হয়ে সেই টার্মিনালের ভেতরেই পড়লাম। পুরো বিমানবন্দর এয়ার টাইট। আমার নাকে খালি বদ্ধ বাতাসের গন্ধ লাগছে। অসুস্থ হলে কি ঘ্রাণশক্তি বেড়ে যায়? দুই কদম আগাতেই প্রিন্সকে আঁকড়ে ধরলাম। হঠাৎ শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠেছে। এবার প্রিন্স সত্যিই ভড়কে গেল। আমার দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। জ্যাকেট, মাফলার ভেদ করে কে যেন ঠাণ্ডা বাতাস ঢেলে দিচ্ছে গায়ে। প্রিন্সকে ধরে ধরে কোনোমতে এক গেট থেকে আরেক গেটে যাওয়ার ট্রামের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এগুলোকে বলে অটোমেটেড পিপল মুভার (ছবি দ্রষ্টব্য)। বড় বড় বিমানবন্দরে এই সার্ভিস দেখা যায়, কারণ সেখানে পায়ে হেঁটে এক গেট থেকে আরেক গেটে যেতে অনেক সময় লাগে। জীবনে প্রথমবার এরকম ট্রাম দেখেছিলাম মালয়শিয়ার কুয়ালা লামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে যাওয়ার পথে ট্রানজিট ছিল ওখানে। আমরা এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে কীভাবে যাব, খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। হারিয়ে গিয়েছিলাম। পরে এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম অটোমেটেড পিপল মুভারের কথা। সে এক কাহিনী বটে। ওটা ছিল দুনিয়ার বাইশতম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। তাতেই এই অবস্থা। এরপর পৃথিবীর ছয় নাম্বার ব্যস্ত এয়ারপোর্টে (শিকাগোর ও’হেয়ার) ট্রানজিট পাওয়ার সুযোগ ঘটেছে। একমাস আগে পা রেখে এলাম পৃথিবীর এক নাম্বার ব্যস্ত এয়ারপোর্টে (জর্জিয়ার হার্টসফিল্ড-জ্যাক্সন)। সব জায়গায়ই এসব ট্রাম ব্যবহার করতে হয়েছে। মালয়শিয়া থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটা কাজে লাগিয়ে আর হারিয়ে যাইনি। ভেগাসের ম্যাককারান আঠাশতম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। কিন্তু আমরা যখন নামলাম, খুব একটা ব্যস্ত দেখলাম না। করোনার ভয়েই কি ফাঁকা? যা হোক, অটোমেটেড পিপল মুভারে ঢুকে দেখি বসার সিট নেই। সবাইকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র অসুস্থ ব্যক্তি আর হুইলচেয়ার নির্ভরশীলদের জন্য অল্প কিছু জায়গা বরাদ্দ। আমি একটা স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়ালাম। মাথা সোজা রাখতে পারছি না, বারবার হেলে পড়ে যাচ্ছে। তাই নিচু করে রাখাটাই শ্রেয় মনে হল। কিন্তু ঐ যে, কাশির দমক তো থামছে না। আমার কাশি দেখে আশেপাশের দুইজন ছিটকে সরে গেল। এটা দেখে প্রিন্সের মাথার তার গেল ছিঁড়ে। ট্রাম থেকে বের হওয়ার পর একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘তোমার অবস্থা দেখে সবাই ভয়ে পালাচ্ছে।’ এবার আমার তার ছিঁড়ে গেল। ‘তো আমি কী করব? আমার প্রচণ্ড গা কাঁপছে। জ্বর আসছে কিনা বুঝতে পারছি না। কাশি আসছে নাড়িভুঁড়ি উল্টে দিয়ে।’