ছোটবেলায় ‘পরদেশ’ সিনেমার ‘ইয়ে দিল দিওয়ানা’ গানটা দেখতাম আর বিস্মিত হয়ে ভাবতাম, এটা কোন জায়গা? ছাদের মধ্যে ভিডিও দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে এত ক্যাসিনো, এত আলোর ঝলকানি! ইশ যদি একবার যেতে পারতাম এ জায়গায়…। যারা ‘ইয়ে দিল দিওয়ানা’ গানটা দেখার সময় সেক্সি শাহ্রুখ খান আর মাহিমা চৌধুরী বাদে আশেপাশের দৃশ্য দেখেছেন, তারা নিশ্চয় আমার মত যেতে চেয়েছেন জমকালো ঐ শহরে? বড় হয়ে জেনেছি, জায়গাটার নাম লাস ভেগাস। আরও বড় হয়ে জেনেছি, লাস ভেগাসকে বলে সিন সিটি আর ‘হ্যাংওভার’ মুভির বদৌলতে জানলাম ‘হোয়াট হ্যাপেন্স ইন ভেগাস, স্টেয়স ইন ভেগাস’ প্রবাদটা। এরপর তো প্রচুর মুভি আর টিভি সিরিজ দেখলাম যেখানে একবার হলেও ভেগাস দেখানো হয়। সেগুলো দেখতে দেখতে বেলাজ্জিও হোটেলের ওয়াটার শো কিংবা ফ্রেমন্ট স্ট্রিটের ছাদে দেখানো ভিডিও খুব পরিচিত হয়ে গেল। যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ পেলাম, ঠিক করলাম দেখেই ছাড়ব স্বপ্নের শহর ভেগাস, যার জন্য ইয়ে দিল দিওয়ানা। স্ট্যাটাস দেব ‘ভেগাস, ভেইবে!’
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম লেখাপড়ার পাশাপাশি ভ্রমণের আশায়। অথচ দেড় বছর পর হিসেবের খাতায় ওযার্ক পার্ক আর হা হা টংকা স্টেট পার্ক ছাড়া কিছু নেই। আসার ছয় মাস পর বুঝে গিয়েছিলাম, ভ্রমণ একটি সোনার হরিণ। গ্র্যাজুয়েট স্কুলের পড়াশোনার ফাঁকে সময় মেলে তো টাকা মেলে না, টাকা মেলে তো ছুটি মেলে না। ছুটি মেলে তো ভ্রমণসঙ্গী মেলে না। গ্র্যাড স্টুডেন্ট মাত্রই জানেন, দলবল ছাড়া একা বা দোকা ঘুরতে গেলে কী পরিমাণ ডলার খরচ হয়! তাই কিছুতেই ‘মেলে না… আজ কিছু মেলে না’ গাইতে গাইতে কেটে গেল দেড় বছর। মাঝে মধ্যে আমার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয় আর সেটা দেখে প্রিন্সের হৃদয় হয় চুরমার। তো, মার্চের প্রথম সপ্তাহের কোনো এক মাঝরাতে প্রিন্স ঠ্যালা দিয়ে বলল, ‘লাস ভেগাস যাবা নাকি?’ আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠ্যালা খেয়ে উঠে লাস ভেগাসের নাম শুনে চোখ পিটপিট করে বললাম, ‘হঠাৎ এই কথা কেন?’ প্রিন্স মোবাইলের পর্দা আমার চোখের সামনে ধরে বলল, ‘অনেক সস্তা একটা ডিল পাইলাম। একেকজনের আপডাউন প্লেন ফেয়ার মাত্র ১৬০ ডলার।’ মুহূর্তে আমার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। ফ্রন্টিয়ার নামের এয়ারলাইন্স এই অফার দিচ্ছে। বুঝতে বাকি রইল না এরা গরীবের এয়ারলাইন্স। নিশ্চয় তিন নাম্বার বাসের মত লক্কর ঝক্কর সিট থাকবে! কোণা ছিঁড়ে ফোম বের হয়ে গেছে ধরনের। তারপরও আমাদের জন্য এ এক সুবর্ণ সুযোগ। লুফে নেব কিনা চিন্তা করতে করতে ভাবলাম, আরেকটু ভেবে দেখি। সেটাই হল কাল। পরদিন ফ্রন্টিয়ারের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখি অফার এক লাফে ১৮৩ ডলার হয়ে গেছে। আর বেশি চিন্তা না করে দ্রুত ফ্লাইট বুক করে ফেললাম। গতকাল বুক করে ফেললে ৪৬ ডলার বাঁচানো যেত।
যা হোক, ফ্লাইট বুক করার পর আসে কোথায় থাকব সে চিন্তা। ভেগাসে নাকি হোটেল ভাড়া খুব সস্তা। আমি চিরুনি তল্লাশি দিয়েও মনমত দামে ভালো হোটেল পেলাম না। সস্তা হোটেলগুলোর তিন অবস্থা। হোটেলের পাশাপাশি হোস্টেল নামক ব্যবস্থাও আছে। সেখানে ঢুঁ মেরে চমকে গেলাম। কোনোটায় দুইতলা বিছানা, কোনোটায় এক ঘরে পাঁচজন থাকার ব্যবস্থা। মনে পড়ল কুইন সিনেমার কথা। কঙ্গনা রানাউতও এরকম একটা হোস্টেলে ছিল। আবার প্রদীপ দেবের ‘আলবাকারকি থেকে হলিউড’ ভ্রমণ কাহিনীতেও যদ্দূর মনে পড়ে এরকম হোস্টেলের বর্ণনা পড়েছিলাম। অত্যন্ত সস্তায় থাকতে চাইলে এগুলোর বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা সস্তার মধ্যেই একটু আয়েশে থাকতে চাচ্ছিলাম। ফলে খোঁজ নিলাম এয়ার বিএনবিতে। বেশ ভালো একটা ডিল পেলাম ‘সানি প্রাইভেট হ্যাভেন’ নামের একটা বাসায়। একটা বেডরুম এবং প্রাইভেট বাথরুমের প্যাকেজ। পুরো বাসা ছিমছামভাবে সাজানো, সামনের উঠানে কিংবা ব্যাকইয়ার্ডে বসে হাওয়া খাওয়ার জায়গা আছে। নিজেদের রান্না করার সুযোগও আছে। বর্ণনায় বলা হয়েছে, বাসা থেকে লাস ভেগাস ডাউনটাউন মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা, বেলাজ্জিও হোটেল ১৫ মিনিট। বাস সার্ভিসও পাওয়া যাবে আশেপাশে। মনে হল, বুক করা উচিৎ। প্রতি রাতের চার্জ ৩৫ ডলার। আমরা থাকব দুই রাত। ক্লিনিং ফি, সার্ভিস ফি ইত্যাদি মিলিয়ে চার্জ হল ৯১ ডলার। সাধ্যের মধ্যেই। বুকিং দিতে গিয়ে দেখি আমার বর্তমান ছবি চায়, পাসপোর্টের ছবি চায়। দুটো মিলিয়ে দেখবে আমি একই মানুষ কিনা। আবার হোস্টকেও ‘হাই হ্যালো’ জানিয়ে দুটো কথা লিখতে হবে। এগুলো ছাড়া কনফার্ম করতে পারব না। কী জ্বালা! ২০১৭ সালে যখন বালি দ্বীপে গিয়েছিলাম, তখনও এয়ার বিএনবিতে ছিলাম। কিন্তু এমন জটিল ছিল না বুকিং। যা হোক, হোস্টকে লিখলাম, ‘আমি আর আমার জামাই আসছি ভেগাস দেখতে। আশা করি, দারুণ কিছু সময় কাটবে।’ হোস্ট হল ট্রেসি নামের এক মহিলা। সে স্বাগত জানিয়ে লিখল, তার বাসা সে খুব সুন্দর করে প্রস্তুত রাখবে আমাদের জন্য।
এরমধ্যে মনে পড়ল, ভেগাস থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বেশ কাছে। চাইলে ওখান থেকে ঘুরে আসা যায়। না ঘুরলে হয়ত আফসোস থেকে যাবে এত কাছে গিয়েও দেখলাম না বলে। তাই খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম বিভিন্ন ট্যুর প্যাকেজের। আমি সাধারণত প্যাকেজে কোথাও ঘুরতে চাই না। এতে স্বাধীনতা থাকে না। এজেন্সির ইচ্ছেমত ঘুরতে হয়। কিন্তু ভেগাস থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাওয়ার আর কোনো উপায় দেখলাম না। কোনো গণপরিবহন নেই। যদি আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকত, নিজেরা একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু লাইন্সেস নেই বলে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাকি থাকল প্যাকেজ ট্যুর। ট্রিপ অ্যাডভাইজরে ঢুঁ মেরে দেখলাম পর্যটকরা কোন কোন প্যাকেজের প্রশংসা করছে। অনেকেই দেখলাম ‘GC TOURS’ নামের এক ট্যুর কোম্পানিকে রেকোমেন্ড করছে। ওদের ওয়েবসাইটে (https://gc.tours/) গিয়ে দেখি হরেক রকম ট্যুরের বন্দোবস্ত। বাস ট্যুর আছে দুই ধরনের, আছে হেলিকপ্টার ট্যুরও। বাস ট্যুরের মধ্যে সস্তা যেটা, সেটা বেছে নিলাম। Grand Canyon South Rim Tour। মাথাপিছু ৭৮ ডলার। আরেকটা যেটা আছে, সেটা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কাইওয়াকে যায় আর মাথাপিছু মূল্য ১০২ ডলার। দুটো ট্যুরের মধ্যে পার্থক্য হল, ওয়েস্টের বাস ‘জশুয়া ট্রি ফরেস্ট’ নামের একটা জায়গায় যায় যেটায় সাউথ রিমের বাস যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন জায়গাটা বেশ কিছু অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে চারটা অংশ পর্যটনের জন্য বেশ বিখ্যাত – সাউথ রিম, নর্থ রিম, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কাইওয়াক, আর হাভাসুপাই ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশন। সাউথ রিম আর নর্থ রিম অংশ দুটো ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ওয়েস্ট নিয়ন্ত্রণ করে হুয়ালাপাই ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী আর হাভাসুপাই রিজার্ভেশন নিয়ন্ত্রণ করে হাভাসুপাই ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী। হাভাসুপাইয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা আছে। এদের মধ্যে বিখ্যাত হল Havasu Fall। পরে কখনো এলে ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর এলাকা ঘুরে দেখব, আপাতত সাউথ রিম ঘুরে যাই।
এক সপ্তাহ আগে ফ্লাইট, এয়ার বিএনবি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ট্যুর সব বুক করে বসে আছি। এখন শুধু যাওয়ার পালা। অবশ্য ভেগাসে গিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরব, সেটা এখনো পরিকল্পনা করা বাকি। সবার আগে খুঁজে দেখলাম বিনামূল্যে কী করার আছে। সবখানে পায়ে হেঁটে ‘দা স্ট্রিপ’ ঘুরার কথা লেখা। লাস ভেগাস বুলেভার্ডের অতি বিখ্যাত ডাকনাম ‘দা স্ট্রিপ’। স্ট্রিপের দুই পাশে নামকরা সব হোটেল অবস্থিত। দা মিরেজ, ফ্ল্যামিংগো, সার্কাস সার্কাস, এমজিএম গ্র্যান্ড, লুক্সোর, প্ল্যানেট হলিউড, নিউইয়র্ক-নিউইয়র্ক, প্যারিস, সাহারা, ট্রপিকানা, বেলাজ্জিও, সিজারস প্যালেস, ম্যান্ডেলে বে ইত্যাদি। বিভিন্ন হোটেল বিভিন্নভাবে মানুষকে আকর্ষণ করে। অনেকের নিজস্ব কিছু প্রদর্শনী আছে যেগুলো বিনামূল্যে দেখা যায় এবং খুব বিখ্যাত। যেমন, সার্কাস সার্কাস হোটেলের নিজস্ব আকর্ষণ হল সার্কাস প্রদর্শনী। আবার ফ্ল্যামিংগো হোটেলের নিজস্ব আকর্ষণ ফ্ল্যামিংগো পাখির বাসস্থান। মিরেজের আকর্ষণ ‘দা ভল্কানো’ যা ‘মিরেজের আগ্নেয়গিরি’ নামে পরিচিত। বেলাজ্জিও হোটেলের ‘ওয়াটার শো’ বা ‘ফোয়ারা প্রদর্শনী’ আপনারা মুভিতে দেখেছেন। প্যারিস হোটেলের সামনে রাখা আছে আইফেল টাওয়ারের ছোট সংস্করণ, নিউইয়র্ক-নিউইয়র্কের আছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ভেনিশিয়ান হোটেলের ভেতর আছে ইতালির ভেনিস শহরের আদলে তৈরি খাল আর তাতে ভাসার জন্য গন্ডোলা। গন্ডোলায় চড়তে টাকা লাগবে, কিন্তু অন্যরা চড়ছে আর আপনি বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, সেটা ফ্রি।
আমরা তালিকায় উপরের সবকিছুই ঢুকালাম। এছাড়াও আরও কিছু জিনিস ফ্রি ফ্রি করা যায় বলে সেগুলোও জায়গা পেল। যেমন, বেলাজ্জিও হোটেলের ভেতর অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেন আর কনজারভেটোরি দেখা, সিজার্স প্যালেস হোটেলের ভিতরে ঢুকে সেটার স্থাপত্যশৈলী দেখা (রোমান স্টাইলে তৈরি), ওয়েলকাম টু ফ্যাবুলাস লাস ভেগাস সাইনবোর্ডের সামনে গিয়ে ছবি তোলা, আর ফ্রেমন্ট স্ট্রিটে ঘুরতে যাওয়া। দুইদিন ধরে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে, ইউটিউব ভিডিও দেখে নোট করেছিলাম জায়গাগুলো। কিন্তু যেদিন রওনা হব, সেদিন সকালে উঠে চূড়ান্ত তালিকা বানাতে বসলাম। আমাদের হাতে যেহেতু সময় মাত্র পনেরো ঘণ্টা থাকবে ভেগাস ঘুরার, তালিকা হতে হবে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। শেষমেশ তালিকায় ঠাই পেল নয়টা জায়গা। এসব জায়গার ভেতর আবার একাধিক জিনিস আছে দেখার। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব সেটা এখনই বুঝতে পারছি না। ভেগাস যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তো, আমাদের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা দাঁড়ালো, নয় মার্চ বিকেল পাঁচটায় উড়াল দিয়ে আমরা ভেগাসের ম্যাক্কারান বিমানবন্দরে নামব সন্ধ্যে সাতটায়। বিমানবন্দর থেকে দা স্ট্রিপে যাব। তিন ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে রাতের ভেগাস দেখে এয়ার বিএনবিতে চলে যাব রাত এগারোটার মধ্যে। এগারোটা হল চেকইন করার শেষ সময়। চেকইন করে, চাবি বাগিয়ে আবার বের হব খাবারের খোঁজে। খাওয়া শেষে এক ঘুমে রাত কাবার করে পরদিন অর্থাৎ দশ তারিখে ভোর পাঁচটায় উঠব। ছটা নাগাদ আমাদের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ট্যুরের বাসে উঠতে হবে। পরদিনই এই ট্যুর রাখার কারণ হল ট্যুরের স্থায়িত্ব সতেরো ঘণ্টা। যদি এটা এগারো তারিখে রাখি, তাহলে ট্যুর শেষেই আমাদের বিমানে উঠতে হবে যেটা শরীরের উপর অত্যাচার হয়ে যাবে। তাই দশ মার্চ ক্যানিয়ন ট্যুর শেষ করে এগারো মার্চ সারাদিন ভেগাস ঘুরার পরিকল্পনা করলাম।