0 0
Read Time30 Minute, 5 Second
রিক্রিয়েশন সেন্টার শুনে বিনোদন কেন্দ্র মনে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিক্রিয়েশন সেন্টার মানে খেলাধুলা আর ব্যায়াম করার জায়গা। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের রিক্রিয়েশন সেন্টারের নাম ‘সাইমন রিক্রিয়েশন সেন্টার’। খুব সুন্দর আর বিশাল। অথচ আমি ওখানে একবারও ঢুকিনি, ব্যায়াম করা তো দূরের কথা। বাইরে থেকে দেখে আর ছবি দেখে বুঝেছি কত সুন্দর!
.
আমাদের চারজনকে নিয়ে কেটি হাঁটা ধরল। বার্মিংহ্যাম শহরের ডাউনটাউন জুড়ে ইউএবির ক্যাম্পাস ছড়ানো। তাই পুষ্টি বিভাগ থেকে রিক্রিয়েশন সেন্টারে যেতে লাগল পাক্কা বিশ মিনিট। আরও পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছতাম যদি কেটি পথ হারিয়ে না ফেলত। বেচারা গত এক বছরে এ মুখো হয়নি। তাই আরেক পিএইচডি শিক্ষার্থীকে কল করে পথ চিনে নিতে হয়েছে। এদিকে আমাদের মধ্যে একজন হাইহিল পরে ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছে। সে বেচারা বিশ মিনিট ধরে উষ্টা খেতে খেতে হাঁটছে। ওর জন্যও বারবার থামতে হচ্ছে। যখন এসে দাঁড়ালাম সেন্টারের মূল ফটকের সামনে, অ্যাস্টন নামের এক তরুণ অভ্যর্থনা জানাল। ও খেলাধুলার উপর পুষ্টির প্রভাব নিয়ে পিএইচডি করছে। দিনের বেশিরভাগ সময় ওর কাটে সেন্টারে। ওকেই কল করেছিল কেটি। অ্যাস্টনের হাতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে কেটি চলে গেল।
.
অ্যাস্টন আমাদের নিয়ে ঘুরতে লাগল বিশাল সেন্টারটা। একতলাই এত বড় যে, হাঁটতে হাঁটতে ঠ্যাং ব্যথা হয়ে গেল। বাকি আছে দুই আর তিনতলা। একতলাতে পুষ্টির শিক্ষার্থীদের গবেষণা কেন্দ্র। অ্যাস্টনের সাথে এক মেয়েও এখানে পিএইচডি করছে। ওর সাথে খানিকক্ষণ আড্ডা হল। তারপর গেলাম দুইতলায়। ওখানে বিভিন্ন ধরনের ইনডোর গেমস আর ব্যায়ামের ব্যবস্থা আছে। সাঁতার কাটার জন্য পুলও আছে। তিন ফ্লোর ঘুরে ভাল ব্যায়াম হল। ঠিক করলাম যদি ইউএবিতে সুযোগ পাই, স্লুর মত ভোঁতা হয়ে থাকব না। নিয়মিত ঢুঁ মারব ব্যায়ামাগারে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের গ্যাঁট থেকে প্রতি সেমিস্টারে জিমের জন্য পয়সা দেয়। না এলে আমাদেরই লোকসান। জেনে রাখা ভাল, আপনি অ্যাসিস্টেন্টশিপ পেলেও সেমিস্টার ফি দিতে হবে। এটায় কোনো ছাড় নেই। তবে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। ভার্সিটি ভেদে সেমিস্টার ফি দুইশ থেকে পাঁচশোর মধ্যে ঘুরাফিরা করে। এর বেশি হতে দেখিনি।
.
একদম শেষে দেখতে এলাম রিক্রিয়েশন সেন্টারের বিশাল মাঠ। এখানকার ভার্সিটিগুলোতে খেলাধুলার উপর অনেক জোর দেওয়া হয়। মূলত আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ছেলেমেয়েরা দল গঠন করে খেলে থাকে। বিভিন্ন ভার্সিটির মধ্যে আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতা হয়। শ্রেষ্ঠ দলগুলো চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় যায়। এই প্রতিযোগিতা আবার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। সে কী উত্তেজনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে! বাস্কেটবল, বেজবল, সকার (এটা নাকি আমেরিকান ফুটবল। তাহলে আমি এই খেলা দেখে ফুটবলের মত মজা পাই না কেন?), ভলিবল, ইত্যাদি মনে হয় আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। পরিসংখ্যান জেনে বলছি না। দুই বছরের ভার্সিটি জীবনে বাস্কেটবল আর সকার নিয়ে মাতামাতি দেখে বলছি। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিতে গলিতে উঠতি তারকা বা প্রতিষ্ঠিত তারকা খেলোয়াড়দের ছবি টানানো। এরা সবাই ভার্সিটির নিজস্ব দলের খেলোয়াড়। সাধারণ পোলাপানের কাছে এরা চরম আরাধ্য ব্যক্তি। কয়দিন পরপরই বিশাল বিশাল প্ল্যাকার্ডে খেলোয়াড়দের বিজ্ঞাপন দেখি। অমুক খেলোয়াড় আজ খেলবে, চলে এস দলবল নিয়ে। দর্শককে আকর্ষণ করার জন্য টিকিটে ছাড় দেওয়া থেকে শুরু করে ফ্রি টিশার্ট, মগ, মোবাইল, জার্সি পর্যন্ত দেওয়া হয়। অনেক সময় ফ্রি টিকিটও দেয়। কতবার ভেবেছি ফ্রি টিকিট নিয়ে খেলা দেখতে যাব আর বিনামূল্যে বিলিকেনদের টিশার্ট বা জার্সি নিয়ে আসব, কিন্তু হয়ে উঠেনি।
.
বিলিকেন হল সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলিটদের ডাক নাম। প্রত্যেক ভার্সিটির অ্যাথলিট দলের নির্দিষ্ট ডাক নাম থাকে। প্রত্যেক ভার্সিটির নিজস্ব স্টেডিয়ামও থাকে। সবসময় স্টেডিয়ামে কোন না কোন খেলা চলছেই। এ থেকেই বুঝা যায়, ভার্সিটিগুলো খেলাধুলাকে কতটা গুরুত্ব দেয়। স্লুর পুরুষ বাস্কেটবল দলের সাথে আমি কাজ করেছি। একমাস ওদের পুষ্টি শিক্ষা দিয়েছি। কমবয়সী ছেলেগুলো মাত্র আন্ডারগ্র্যাডে ঢুকেছে। এখনো মানসিক পরিপক্কতা আসেনি। আমার উচ্চারণ শুনে মুচকি হাসছে, কিংবা প্রেজেন্টেশন না দেখে পাশেরজনের সাথে আড্ডা মারছে। কিছুটা হলেও ওদের মধ্যে ‘মুই কী হনু’ ধরনের অহংকার দেখতে পাচ্ছি। ওরা জানে, ওদের নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভেতর কেমন উত্তেজনা। সবাই ওদের গার্লফ্রেন্ড হতে চায়। সব মিলিয়ে এই বয়সে অহমিকা জন্মানো অস্বাভাবিক কিছু না।
.
কিমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করে না?’ কিম আমার আমেরিকান ক্লাসমেট। ওর সাথে পুষ্টি শিক্ষা দেওয়ার এই প্রজেক্টে কাজ করছি। ও জানাল, গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে মানুষ লেখাপড়ার উপরই ফোকাস করে বেশি। তাই খেলাধুলার জন্য সময় পায় না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই যে ছেলেমেয়েগুলো দিনরাত অনুশীলন করছে, ব্যায়াম করছে ভাল পারফর্মেন্সের জন্য, এরা লেখাপড়া করার সময় পায় কখন?’ কিম বলল, এদের লেখাপড়া নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এদের পুরো ধ্যানধারণা খেলা নিয়ে। জানতে চাইলাম, কয়জন খেলোয়াড় ভবিষ্যতে খেলাকে পেশা হিসেবে নেয়? হাজার হাজার ভার্সিটি থেকে হাজার হাজার খেলোয়াড় বের হচ্ছে। এরা কি সবাই ভবিষ্যতে খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়? কিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, হয় না। আমি নিজেও বুঝি না লেখাপড়াকে পাশে রেখে খেলাধুলাকে প্রধান বানানোর কারণ কী।’ কোথায় যেন পড়েছিলাম, ব্যাচেলর পাশ করার পর অনেক খেলোয়াড় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের চারপাশে আলোর ঝলকানি থাকে না, থাকে না শয়ে শয়ে ভক্ত। জীবন নিয়ে কী করবে, সেটা বুঝে উঠতে পারে না অনেকেই। একাডেমিক রেজাল্ট ভাল না হওয়ার কারণে ভাল চাকরিও জুটে না। বেশ সঙ্কটাপন্ন অবস্থা।
.
ইউএবির রিক্রিয়েশন সেন্টার থেকে বের হলাম বিকেল চারটার দিকে। আজকের মত ছুটি। এখন হোটেলে গিয়ে সোজা বিছানা। অবশ্য সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ভার্সিটির পক্ষ থেকে একটা ডিনার আছে হিল্টন হোটেলে, সেখানে যেতে হবে। তার আগে একটু গা এলানো দরকার। বিমান ভ্রমণের পর একবারও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয়নি। অ্যাস্টন আমাদের চারজনকে রাইড দিতে চাইল। কিন্তু ইউএবির দুই শিক্ষার্থী বলল, তারা নিজেরাই চলে যেতে পারবে। দরকার শুধু আমাকে আর কিউকে রাইড দেওয়া। অ্যাস্টনের পিএইচডি জীবন নিয়ে গপসপ করতে করতে চলে এলাম হোটেলে। অ্যাস্টনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিউয়ের সাথে মোবাইল নাম্বার আদান প্রদান করলাম। ও আমার ঠিক নিচের ফ্লোরে উঠেছে। একটু পর জুলিয়েন আসবে আমাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিউ বলল, সে নিচে নামার আগে আমাকে টেক্সট করবে। টেক্সট পেলে যেন আমিও নেমে যাই।
.
রেসিডেন্স ইন হোটেলের ঠিক উল্টো পাশেই হিল্টন হোটেল। জুলিয়েনের সাথে ওখানে যাওয়ার পর কেউই বুঝতে পারছিলাম না কোনদিকে যেতে হবে। সাধারণত বড় কোনো অনুষ্ঠান থাকলে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয় কোনদিক দিয়ে হলঘরে পৌঁছা যাবে। সেই তীর চিহ্নও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখি পুষ্টির আরও কিছু পিএইচডি শিক্ষার্থী এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ওরাও এসেছে ডিনার উপলক্ষ্যে। ওদের মধ্যে একজন জানত বলরুমটা কোথায়। ওর পিছু পিছু সবাই গেলাম। গিয়ে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! এ কি ভার্সিটি ডিনার, নাকি রোমান্টিক ডিনার? পুরো রুম আলোআঁধারি, প্রতিটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। বিশাল সেই বলরুমে বসে আছে অন্তত একশো মানুষ। একেকটা গোলটেবিলে দশজন করে বসেছে। সবার সামনে উল্টানো গ্লাস, প্লেট। সবচেয়ে অবাক হলাম সুপ গরম রাখার ব্যবস্থা দেখে। টেবিলের ঠিক মাঝখানে একটা নকশা করা পাত্র। সেটার উপর রাখা সুপের পাত্র। নকশা করা পাত্রটা সুপকে গরম রাখছে। ওটা থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে।
.
একটু পর অনুষ্ঠান শুরু হল। ইউএবির বায়োমেডিকেল সায়েন্স প্রোগ্রামের অধীনে যেসব প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে, তাদের জন্য এই ডিনার। হলে ঢুকার মুখে একটা লিফলেট দেওয়া হয়েছিল। সেখানে অনুষ্ঠানসূচী লেখা। চোখ বুলিয়ে দেখি গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের বক্তৃতা শেষে ‘থ্রি মিনিট থিসিস’-এর আয়োজন আছে। তিনজন পিএইচডি ক্যান্ডিডেট তাদের থিসিস বর্ণনা করবে মাত্র তিন মিনিটে। এই প্রজেক্টের কথা অনেক শুনেছি। আজ প্রথম দেখব। এরপর আরও কিছু মান্যগণ্য ব্যক্তি তাদের প্রেজেন্টেশন দেবেন। এরপর শেষ। পুরো অনুষ্ঠান ঘণ্টা দুয়েকের। এখানে বক্তৃতা মানে বিরক্তিকর বকবক নয়। সবার চেষ্টা থাকে অল্প সময়ে রসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা। তাই খুব একটা খারাপ লাগে না প্রফেসরদের কথা শুনতে। আজও মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। আবার মনোযোগ দিয়ে না শুনলে অন্যরা কী ভাববে, সেটাও মাথায় ছিল। কিন্তু একটু পর দেখি কিউ উশখুশ শুরু করল। একবার মোবাইল বের করে টিপে, তো একবার পাশেরজনের সাথে কথা বলে। পাশেরজনও দেখি উত্তর দেয়। একটু পর পুরো টেবিল জুড়ে কানাকানি শুরু হল। কারো মাথায় বক্তৃতা ঢুকছে না। সবাই সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে ক্লান্ত। দুটো খাওয়ার আশায় এখানে এসেছে। খিদে পেটে প্রফেসরের উৎসাহমূলক কথাও পানসে লাগছে।
.
একটু পর বিশাল ট্রে হাতে নিয়ে ওয়েটাররা ঢুকা শুরু করল। সবাই নড়েচড়ে বসল। ওয়েটার ঢুকার সাথে সাথে খাবারের গন্ধে পেট মোচড় দিল। মনে হল, কতদিন খাই না। দুপুর সাড়ে বারোটায় খেয়েছি, এখন বাজে সাড়ে ছয়টা। আমাদের টেবিলটা সবার শেষে পড়েছে। ওয়েটাররা দেওয়া শুরু করেছে একদম সামনের সারি থেকে। আমাদের টেবিলে যেন আসছেই না কেউ। আমরা দশজন গোনা শুরু করলাম কয়টা টেবিল পরে আমাদের এখানে আসবে। একসময় ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম’। কিন্তু এ কী! এ তো স্টার্টার। মূল খাবার এখনো আসেনি। সেটা আসার আগে রুচি বাড়ানোর জন্য এক থাল ভর্তি সালাদ দিয়ে গেছে। এরা আবার আমাদের মত শশা-টমেটো দিয়ে সালাদ বানায় না। এদের সালাদ মানে হুলুস্থূল কাণ্ড। এই যেমন, এখানে দিয়েছে বাঁধাকপি কুঁচি, খুবানি (almond), ক্রুটোন (টোস্ট করা পাউরুটি চারকোণা করে কাটা), চেরি টমেটো (সালাদে ব্যবহারের জন্য খুব ছোট আকৃতির টমেটো), কাঁচা বেবি স্পিনাচ (পালংশাকের বাচ্চা রূপ, যেটা আমি দেশে দেখিনি), ক্যাপ্সিকাম, কালো জলপাই, পেঁয়াজ, অ্যাভোকাডো, আর ফেটা চিজ (এক ধরনের গ্রিক পনির)। এই সালাদ আবার আপনি ড্রেসিং মিশিয়ে খেতে পারবেন। যেমন, এখানে ড্রেসিং হিসেবে আছে র‍্যাঞ্চ আর বালসামিক ভিনেগার। আমি র‍্যাঞ্চ নিলাম। বালসামিক আমার কোনোকালেই ভাল লাগেনি। ২০১৪ সালে প্রথম খেয়েছিলাম ইতালি গিয়ে। খাওয়ার পর দুর্গন্ধে বমি এসে পড়ে আর কি।
.
সালাদ পরিবেশনের মিনিট পনেরো পর মূল খাবার এল। আমি চাচ্ছিলাম না সালাদ খেয়ে পেট ভরাতে। তাই দুই তৃতীয়াংশ খেয়ে থালা সরিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম মূল খাবারের পর সালাদ শেষ করব। কিন্তু সালাদ রাখলে মূল খাবার রাখার জায়গা হয় না। ফলে দিয়ে দিতে হল। মূল খাবারের চেহারা দেখে বুঝলাম না, খেয়ে পেট ভরবে কিনা। থালার ঠিক মাঝখানে একটা বেক করা মুরগীর ব্রেস্ট রাখা। তার পাশে ম্যাশড পটেটো আর বেক করা বরবটি। ব্যস, এটুকুই। এই হল আমেরিকান ডিনারের মেইন কোর্সের নমুনা। তবে হতাশ হবেন না। এরা সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। এজন্য প্রথমে অ্যাপেটাইজার, মাঝে মূল কোর্স, শেষে মিষ্টি খাবার দেয়। সাথে পানি বা কোমল পানীয় থাকে। এটা ভার্সিটি ডিনার বলে সুরার আয়োজন নেই। নতুবা অনেক জায়গায় ওয়াইনও রাখে।
গত দুই বছরে আমি কাঁটাচামচ আর ছুরি দিয়ে খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। খুব একটা অসুবিধা হল না খেতে। শুধু একবার মাংস কাটার সময় ছিটকে কোলে এসে পড়ল। সেটা দেখে পাশে বসা কেটি মৃদু হেসে বলল, ‘ইট’স ওকে!’ খেতে খেতে থ্রি মিনিট থিসিস দেখলাম। প্রথমে এল একজন আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণী। সাধারণ মানুষের ভাষা ব্যবহার করে খুব সহজে বুঝিয়ে দিল ওর গবেষণা। কিন্তু পরের দুজন সাদা আমেরিকান এত বেশি একাডেমিক শব্দ ব্যবহার করল যে, কিছুই বুঝলাম না। এদেশে আফ্রিকান-আমেরিকানরা চরম বৈষম্যের শিকার। কী স্বাস্থ্যখাতে, কী পড়াশোনায়, কী অর্থনৈতিকভাবে। তাই কোনো আফ্রিকান-আমেরিকানকে ভাল করতে দেখলে আনন্দ লাগে। এজন্য নির্দিষ্ট করে আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণীর কাহিনী বলা।
.
আটটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হল। ততক্ষণে পেটে চিজ কেক চালান করে সবাই ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত। জুলিয়েন আমাদের দিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু রাস্তার ঐ পারেই হোটেল বলে আমি আর কিউ একা একা চলে এলাম। পরদিন সকাল নয়টায় ক্রিস্টিয়ান নামের এক পিএইচডি শিক্ষার্থী আমাদের নিতে আসবে। ওর সাথে নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টে যাব। সেখানে টানা ছয়জন প্রফেসরের সাথে আমার ইন্টার্ভিউ চলবে। বাকি তিনজনেরও একই অবস্থা। আজ রাতে তাই ভাল ঘুম হতে হবে যেন তাজা শরীর আর মন নিয়ে উঠতে পারি। ঠিক হল, সাড়ে আটটার মধ্যে দুজনে লবিতে নামব। লবির পাশেই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জায়গা। সেখানে দেখা হবে।
.
ঘরে এসে স্নান করলাম। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেল। হোটেল থেকে ছোট ছোট শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, আর সাবান দিয়েছে। এসব দিবে জানতাম। তাই বাসা থেকে কিছু আনিনি। ওগুলো দিয়েই কাজ সারলাম। এমনিতে হোটেলের দেওয়া শ্যাম্পু মাখলে আমার চুল শনের মত খড়খড়ে হয়ে যায়। কিন্তু এখন চুলে কদমছাঁট দেওয়া বলে শ্যাম্পুতে কিছু গেল আসল না। অবাক হলাম এদের তোয়ালের বাহার দেখে। চার ধরনের তোয়ালে দিয়েছে। গুনে দেখি বারোটা। কোনোটা স্নান করার পর গা মুছার জন্য, কোনোটা মুখ মুছার জন্য, কোনোটা স্নান শেষে গায়ে জড়িয়ে বের হওয়ার জন্য, কোনোটা শুধু হাত মুছার জন্য। মাথা নষ্ট অবস্থা। ব্যবহৃত তোয়ালে আবার প্রতিদিন বদলানো হয়। যদি সব কক্ষে এরকম বারোটা তোয়ালে থাকে এবং কেউ যদি একাধিক তোয়ালে ব্যবহার করে, তাহলে প্রতিদিন সেগুলো ধুতে কত পানি খরচ হবে? এভাবে পানি নষ্ট করলে চলে? আমার এসব অদ্ভুত বিলাসিতা ভাল লাগে না। এখন পর্যন্ত যতবার হোটেলে থেকেছি, প্রতিবার একটা করে তোয়ালে ব্যবহার করেছি। পরদিন ঐ একটা তোয়ালেই বদলে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো যেই কে সেই রয়ে গেছে।
.
নরম বিছানায় গা ছেড়ে দিতেই হুড়মুড় করে ঘুম নেমে এল। বিছানার পাশে বিশাল জানালা। ছাদ থেকে মেঝে অব্দি। সেটার ব্লাইন্ড নামিয়ে, পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে দিলাম। খাটের দুই পাশে দুটো বেডসাইড টেবিল। একটায় কাশির ওষুধ, আরেকটায় মোবাইল রাখলাম। এত আসবাব দিয়েছে যখন, সবকিছুই ব্যবহার করব। খাটের মাথার দিকে যে দেওয়াল, সেখানে দুটো ল্যাম্প লাগানো। সেগুলোর সুইচ বন্ধ করে, কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনী ‘মে ফ্লাওয়ার’-এর একটা কাহিনী মনে পড়তে লাগল। হুমায়ূন প্রাচীন একটা হোটেল কক্ষে নিশিযাপন করছেন। পুরনো সেই ঘরে ভেসে আসছে নানারকম শব্দ, ঘটছে ভৌতিক সব কাণ্ড। মনে হল আমিও যেন ঐ কক্ষে শুয়ে আছি। এখনই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে টাট্টিখানার দরজা খুলবে। থপথপ পায়ে কেউ হেঁটে আসবে বিছানার দিকে। মুহূর্তে সটান দাঁড়িয়ে গেলাম। ধড়াস ধড়াস হৃদপিণ্ড নিয়ে ল্যাম্প জ্বালিয়ে শান্তি মিলল। কিন্তু মাথার উপর বাতি জ্বললে ঘুমাব কীভাবে? তাই বাথরুমের বাতি জ্বালিয়ে শুলাম। হাসছেন? আমার সবসময় এমন হয়। হোটেলে একা একা রাত কাটাতে গেলেই হুমায়ূনের এই কাহিনী মনে পড়ে। যত ক্লান্তই থাকি না কেন, চোখ বন্ধ করলেই ‘মে ফ্লাওয়ার’। লোকটা একটা জিনিয়াস বটে!
.
এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। সকাল আটটায় সেটার কান ফাটানো শব্দে পুরো হোটেল জেগে গেল। দ্রুত ব্রাশ করে, প্রস্তুত হয়ে নিচে নামলাম। ব্যাগ নিয়ে নেমেছি যেন খাওয়া শেষ করেই বের হয়ে যেতে পারি। এসে দেখি কিউ ব্যাগ ট্যাগ ছাড়াই নেমে গেছে। খাওয়া শেষে ব্যাগ নিয়ে আসবে। ওর জন্য আবার দেরি হয়ে যায় কিনা, কে জানে। বাফে সিস্টেমের নাস্তা। যেমন খুশি নিয়ে খাবেন। আমেরিকায় আসার পর জেনেছি শব্দটা বুফে নয়, বাফে। আশ্চর্য এই যে, ব্রিটিশ ইংরেজি বা আমেরিকান, কোনোটাতেই উচ্চারণ বুফে নয়। তাহলে এই উচ্চারণ আমরা পেলাম কোত্থেকে? পুরো এলাকাটা পাঁচ ভাগে ভাগ করা। এক জায়গায় বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল (cereal) রাখা, এক জায়গায় ফলমূল, এক জায়গায় কেক আর রুটি জাতীয় খাবার, এক জায়গায় পানীয় (চা, কফি, ফলের রস), আর এক জায়গায় ভাজা খাবার (স্ক্র্যাম্বল্ড এগ, বেকন, সসেজ)। স্ক্র্যাম্বল্ড এগ বলতে আগে ডিমের ঝুরিভাজা বুঝতাম। কিন্তু ইতালি ভ্রমণের সময় টের পেয়েছি এটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। মাখনের মধ্যে ডিম ছেড়ে গোলমরিচের গুঁড়ো আর লবণ ছিটিয়ে মৃদু নাড়াচাড়ার মাধ্যমে ডিম ভাঙ্গা হয়। সে ডিম হয় নরম তুলতুলে। এটা পাশ্চাত্যের অতি জনপ্রিয় নাস্তা কিন্তু আমার তেমন ভাল লাগে না। আমার জিভ কড়া ডিম ভাজা খেয়ে অভ্যস্ত। তাই মৃদু ভাজা ডিম খেতে গেলে অরুচি আসে। তারপরও খাই। খেতে খেতেই না অভ্যস্ত হব!
.
একটা বাটিতে কর্নফ্লেক্স নিয়ে তাতে দুধ আর কিসমিস মেশালাম। আমরা কিসমিস বলতে শুধু শুকনো আঙ্গুর বুঝি। কিন্তু এরা অনেক ধরনের কিসমিস খায়। সেটা হতে পারে শুকনো আঙ্গুর, ক্র্যানবেরি, ডুমুর বা পিচ। আমিও বিভিন্ন ধরনের কিসমিস নিলাম। একটা থালায় নিলাম স্ক্র্যাম্বল্ড এগ আর সসেজ। শেষে নিলাম কমলার রস। সবকিছু নিয়ে টেবিলে বসলাম। মনে হল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, এত খায় মেয়েটা! একটু পর কিউ এসে বসল পাশে। ওর থালা দেখে আমি সান্ত্বনা পেলাম। সবকিছু আমার দ্বিগুণ, বাড়তি হিসেবে আছে দুটো রুটি। বিশ্বাস হল না চিকন চাকন এই মেয়ের পেটে এতকিছু ঢুকবে। কিন্তু বিশ মিনিট পর কিউয়ের থালা ফাঁকা হয়ে গেল। আবার উঠে ও নিয়ে এল আপেল আর কলা। আমি তখনও প্রথম দফা খাচ্ছি।
.
কিউ বলল, কলা আর আপেল ও নাস্তা হিসেবে ব্যাগে রাখবে। ভাল বুদ্ধি। কিন্তু এই বুদ্ধি আমার মাথায় এল না কেন? আমি কেন কিউয়ের মত স্মার্ট নই? কিউ থালা ভর্তি খাবার নিয়ে এসে কাউকে পরোয়া না করে খেয়ে ফেলল। আর আমি থালা আনার সময় চিন্তা করছিলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার খাওয়া হতে হতে কিউ রুম থেকে ওর ব্যাগ নিয়ে এল। এত দ্রুত খেল কীভাবে মেয়েটা? আমার আবার রসিয়ে না খেলে চলে না। নয়টার দিকে ক্রিস্টিয়ানের আসার কথা। ও আসার আগে আমরা কফি নিয়ে বসলাম। কিউয়ের নাকি শুধু কফিতে হয় না, এক দুই কাপ ভেষজ চা-ও পান করতে হয়। এই ভেষজ চায়ের ব্যাপারটা আমি চৈনিকদের মধ্যে অনেকবার দেখেছি। ওরা বিভিন্ন ধরনের পাতা শুকিয়ে চা-পাতা বানায়, এমনকি ফুল শুকিয়েও। এটাকে চা-ফুল বলে কিনা কে জানে! অফিসের কাজে একবার ইতালি যাওয়ার পর এক চৈনিক সহকর্মীকে এই জিনিস করতে দেখেছি। সারাদিনে সে দু’তিনবার করে ভেষজ চা খাচ্ছে। এটা ওর খাওয়ার রুচিকে কমিয়ে দেয়, ফলে দুপুরে আর রাতে ও কম খায়। কিউয়েরও কি একই কাহিনী? অবশ্য ওকে চৈনিক বলার উপায় নেই। ওর জন্ম হংকংয়ে। হংকং নিজেদেরকে আর চীনের অংশ হিসেবে মানে না। তবে খাওয়া খাদ্যির ধরনে চীন আর হংকংয়ের মিল থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
.
গতকাল রাতে নাকি চা বানানোর জন্য কিউ লাউঞ্জে নেমেছিল। ভেবেছিল চুলায় পানি গরম করতে পারবে, কিন্তু কোনো পাত্র পায়নি। চা খেতে না পেয়ে রাতে তার ঘুমও হয়নি। বললাম, কলের নব ঘুরালেই যেখানে গরম পানি পড়ে, সেখানে ওকে লাউঞ্জে আসতে হবে কেন? কিউ বলল, কলের পানিতে ওর বিশ্বাস নেই। চুলায় সিদ্ধ করা গরম পানি দিয়ে ও চা বানায়। অবাক হলাম। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকে আমি কলের পানি সরাসরি খাচ্ছি। অথচ কিউ নাকি ফুটিয়ে খায়। জীবন যেখানে আমাকে ঝামেলাহীন হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, সেখানে কেন একজন যেচে ঝামেলা নিয়ে আসবে, মাথায় ঢুকল না। ঠিক পৌনে নয়টায় ক্রিশ্চিয়ান চলে এল। ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। নয়টার দিকে আমার ইন্টার্ভিউ ডঃ ফারনান্দেজের সাথে। খুব নার্ভাস লাগছে। গতকাল কয়েকজন বলেছে, উনি নাকি আধ্যাত্মিক প্রশ্ন করেন। উনার কাছ থেকে একাডেমিক প্রশ্ন আশা করলে ভুল হবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক প্রশ্ন ব্যাপারটা কী, সেটা কেউ বুঝিয়ে বলেনি।
.
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামের স্মৃতিঃ পর্ব চার
Next post ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামের স্মৃতিঃ পর্ব ছয়