0 0
Read Time19 Minute, 20 Second

পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ

প্রফেসর ফার্নান্দেজের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। উনি মাত্র ঢুকেছেন ভেতরে। ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হচ্ছে। ঘর গুছাচ্ছেন নাকি? একটু পর ডাক দিলেন আমাকে, “রুথ, তুমি আসতে পার।” আমি এক পা ভেতরে দিতেই উনি বলে উঠলেন, ‘প্রথমেই বলে নিতে চাই, যদি ইউএবিতে সুযোগ নাও পাও, ধরে নিও না এটাই জীবনের শেষ। চেষ্টা চালিয়ে যেও।’ সাতসকালে এমন কথা শুনে দমে গেলাম। তার মানে কি আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হয়েছে? তবুও হাসি হাসি মুখে বললাম, ‘অবশ্যই! আমি অনেক আশাবাদী মানুষ। চেষ্টা চালিয়েই যাব।’ প্রফেসর আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝার চেষ্টা করছেন আমি সত্যি নাকি মিথ্যা বলছি? উনার রুমের ভেতরে আরেকটা রুম আছে। প্রথম রুমটা উনার অফিস। সেখানে আমাকে বসিয়ে উনি ভেতরের রুমে গেলেন। যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন চা, কফি কিছু খাব কিনা। বুঝলাম ঐ ঘরে উনার কফি বানানোর ব্যবস্থা। মাত্র কফি খেয়েছি। এখনই আবার খেতে ইচ্ছে করছে না। মানা করে দিলাম। প্রফেসর কফি বানাতে বানাতে ভেতরের ঘর থেকেই প্রশ্ন করলেন, কেন আমি পিএইচডি করতে চাই। এ ঘরে বসে উত্তর দেওয়া শোভন হবে কিনা বুঝতে পারলাম না। আবার ভেতরের ঘরে ঢুকে যাওয়া অভদ্রতা কিনা, কে জানে। তবুও ঝুঁকি নিলাম। ভেতরের ঘরে ঢুকে প্রফেসরের মুখোমুখি হয়ে উত্তর দিলাম। উনি টুংটাং করতে করতে কফি বানাচ্ছেন আর প্রশ্ন করছেন। খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গি। কিন্তু প্রশ্নগুলো অদ্ভুত। বললেন, ‘তোমার সম্পর্কে বল। একাডেমিক কিছু শুনতে চাই না। মানুষ হিসেবে তুমি কেমন, সেটা বল।’ এই প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কয়েক মুহূর্ত লাগল উত্তর গুছাতে। এরপর গবেষণার ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষার্থী খোঁজা হয়, সেসব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজের গুণাগুণ বললাম। মনে হল উনি সন্তুষ্ট নন। অন্যরকম কিছু শুনতে চাইছিলেন নাকি? সেটা কী হতে পারে?
.
নিজেই খোলাসা করলেন ফার্নান্দেজ। বললেন, ‘তোমার পরিবারে কে কে আছে? তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?’ এরপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কোনো সহকর্মীকে যদি তোমার সম্পর্কে কিছু বলতে বলি, তাহলে সে কী বলবে?’ এরপর এল সবচেয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন। ‘ধর, তোমার সামনে একটা কাঁচের গোলক আছে। সেটাতে ভবিষ্যৎ দেখা যায়। এই মুহূর্তে তুমি সেটায় চোখ রেখেছ। তো, দশ বছর পর নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে কী দেখতে পাচ্ছ?’ অদ্ভুত প্রশ্ন হলেও উত্তরের জন্য বেগ পেতে হল না। আমি শিক্ষক হতে চাই। তাই দশ বছর পর নিজেকে শিক্ষক হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি। প্রফেসর জানতে চাইলেন, শিক্ষক হিসেবে এই মুহূর্তে নিজেকে কোথায় দেখতে পাচ্ছি। বললাম, ‘ক্লাসরুমে, শিক্ষার্থীদের সামনে।’ কয়েক মুহূর্ত পর উনি বললেন, ‘ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তোমার ধারণা খুব স্পষ্ট দেখা যায়।’ মৃদু হেসে সায় দিলাম। তখনই দেখি দরজার বাইরে একজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে নিয়ে পরবর্তী প্রফেসরের অফিসে যাবে। এভাবে আরও পাঁচজনের সাথে ইন্টার্ভিউ হবে। বড় করে দম নিলাম। যদি আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েও নেওয়া হয়, তবুও ভাল একটা অভিব্যক্তি তৈরি করে যাব।
.
বারোটার মধ্যে সবার সাথে ইন্টার্ভিউ শেষ হল। এখন দুপুরের খাবার খেতে খেতে ডঃ ফার্নান্দেজের প্রেজেন্টেশন দেখব। উনি পিএইচডি প্রোগ্রামের বিস্তারিত বর্ণনা করবেন। লাঞ্চ হিসেবে দেওয়া হয়েছে লাল চালের ভাত, গ্রিক সালাদ (টমেটো, শশা, ফেটা চিজ, জলপাই, আর পেঁয়াজের মিশ্রণ), মুরগীর কারি, ফোকাচা (এক ধরনের ইতালীয় রুটি), আর একটা মিষ্টি জাতীয় খাবার। সালাদটা এতই মজা যে, একবার খাওয়ার পর আবার নিয়ে এলাম। সালাদ খেয়েই পেট অনেকখানি ভরে গেল। এরপর অল্প ভাত দিয়ে মুরগীর বিশাল ব্রেস্ট চিবুতে চিবুতে প্রেজেন্টেশন দেখতে লাগলাম। ভাতের সাথে রুটি আমি কখনো খাইনি। কিন্তু অনেককে দেখলাম ভাত-রুটি দুটোই নিতে। যা হোক, মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েকের প্রেজেন্টেশন দেখতে দেখতে ঘুম চলে আসার যোগাড়। প্রশ্নোত্তর পর্বে আবার সবাই চাঙা হল।
.
দুপুর দুটো থেকে তিনটে অব্দি বিরতি। বিরতিতে হোটেলে যেতে পারি, এখানেও থাকতে পারি। কিউ বলল সে হোটেলে যাবে না। যেতে পনেরো মিনিট, আসতে পনেরো। আধা ঘণ্টা রাস্তায়ই নষ্ট। এর থেকে ডিপার্টমেন্টে বসে বসে ঝিমানো ভাল। আমারও একা একা যেতে ইচ্ছে করল না। তাই চারজন প্রার্থীর সবাই মিলে আড্ডা মারতে লাগলাম। সোয়া তিনটায় পুষ্টি অনুষদের একজন শিক্ষার্থীর পিএইচডি ডিফেন্স। সেটা দেখতে যেতে হবে। এই প্রথম আমি পিএইচডি ডিফেন্স দেখব। খুব কৌতূহল হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে।
.
বিরতি শেষ হবার মিনিট পনেরো আগে কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের নিয়ে একটা অডিটোরিয়ামের দিকে রওনা হল। এক দালান থেকে আরেক দালান, তারপর আরেক দালান, এভাবে অনেকগুলো দালান পার হয়ে অবশেষে এলাম ডিজার্টেশন ডিফেন্স দেখতে। মাস্টার্স আর পিএইচডির গবেষণাপত্রের যে আলাদা আলাদা নাম, সেটা জানতাম না। মাস্টার্সের গবেষণাপত্রকে বলে থিসিস, পিএইচডিরটাকে বলে ডিজার্টেশন। যে তরুণী ডিফেন্স করবে, সে বোধহয় অনুষদের বেশ নামকরা শিক্ষার্থী। সবাই ওকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। আমরা পেছন দিকের কিছু আসন দখল করলাম। সামনের দিকে শিক্ষকেরা বসলেন। শুধু পুষ্টির না, অন্যান্য অনুষদ থেকেও শিক্ষকরা এলেন। শুধু শিক্ষক না, অনেক শিক্ষার্থীও এল। আমি চিন্তাই করতে পারিনি, ডিফেন্স দেখার জন্য এত মানুষ আসবে। গবেষণার কচকচানি কার ভাল লাগে? কিন্তু এত মানুষ দেখে বুঝলাম, সবাই হয় মেয়েটাকে পছন্দ করে, নাহয় তার গবেষণা নিয়ে আগ্রহী। একটু পর মেয়েটা পোডিয়ামে গিয়ে দাঁড়াল। একজন শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে প্রস্তুত কিনা। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে সে জানাল, সে প্রস্তুত। মেয়েটার চেয়ে বোধহয় আমার হৃদপিণ্ডই ধুকপুক করছে বেশি। কেন জানি মনে হচ্ছে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি আমিই। শিক্ষকটা অল্প কথায় তরুণীর পরিচয় জানিয়ে তাকে আহ্বান জানালেন ডিফেন্স শুরু করার। প্রজেক্টর প্রস্তুত, মেয়েটা প্রথম স্লাইড চালু করে মাইক হাতে নিল, এন্ড… অ্যাকশন!
.
পাক্কা ত্রিশ মিনিট ধরে প্রেজেন্টেশন চলল। এই টপিক আমার পছন্দ না বলে কিছুক্ষণ পর আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু মেয়েটার ঝটপট উপস্থাপনা ভাল লাগল। প্রথমদিকে ওর গলা কাঁপছিল বটে, কিন্তু দশ মিনিটের মাথায় আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল। ফলে সুন্দর একটা স্লাইড শো হল। এবার প্রশ্নোত্তর পর্ব। এটা চলল আরও ত্রিশ মিনিট। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী নিয়ে সবাই প্রশ্ন করছে, মেয়েটাই বা কী উত্তর দিচ্ছে, সবকিছু ঝাপসা। তবে একের পর এক প্রশ্নের বাণ মেয়েটা সুন্দরভাবে সামলে নিচ্ছে। ওর সুপারভাইজারও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। মেয়েটা প্রেজেন্টেশনের শেষে বলেছিল, সুপারজার তাকে মেয়ের মত স্নেহ করেছেন। বলতে গিয়ে বেচারার গলা কেঁপে গিয়েছিল। কতটা আবেগপ্রবণ হলে এই কথা বলা যায়! যা হোক, তুমুল করতালির মাধ্যমে ডিফেন্স শেষ হল। এখন রুদ্ধদ্বার বৈঠক হবে। পিএইচডি কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন মেয়েটাকে ডক্টর উপাধিতে ভূষিত করা যাবে কিনা। বাকিদের তাই বের হয়ে যেতে হল।
.
বাইরে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার গন্তব্য রেসিডেন্স ইন হোটেল। সন্ধ্যা ছয়টায় প্রফেসর ফার্নান্দেজের বাসায় দাওয়াত। প্রতি বছর উনি নির্বাচিত প্রার্থীদের সৌজন্যে পার্টি দেন। সেখানে শুধু প্রার্থীরা আর শিক্ষকেরা থাকেন। খুব ক্যাজুয়াল পার্টি। কোনো একাডেমিক গপ্প নয়, নয় ফর্মালিটি। ঘরোয়া পরিবেশে আড্ডা। আমি কখনো ভার্সিটির শিক্ষকের দেওয়া ঘরোয়া পার্টিতে যাইনি। বুঝতে পারছি না সেখানে কেমন আচরণ করতে হবে। এটাও কি একটা পরীক্ষা, নাকি স্রেফ বিনোদন? পৌনে ছয়টায় মিশেল হোটেলে আসবেন আমাকে আর কিউকে নিতে। বাকি দুজন প্রার্থী নিজেদের গাড়িতে করে চলে যাবে। ওরা বার্মিংহ্যামের বাসিন্দা। পথঘাট চেনে।
.
আমি হোটেলে ফিরে স্নান টান সেরে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। কে জানে পার্টি কখন শেষ হবে। একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই। মনটা খারাপ লাগছে। সকালে শোনা ডঃ ফার্নান্দেজের কথাটা সারাদিন কাঁটার মত বিঁধেছে। মনে হচ্ছে, আশা শেষ। কিন্তু যেন হতাশ না হয়ে যাই, সেজন্য মন এটাও ভাবছে – ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ।’ বাবা-মায়ের সাথে কথা বললাম। প্রিন্সের সাথে কথা হল। কাউকেই কাঁটার কথা বললাম না। কী দরকার? অযথাই সবার মন খারাপ হবে।
.
ঠিক পৌনে ছয়টায় নিচে গেলাম। মিশেল এসে পড়েছেন। সাথে উনার হাজবেন্ডও এসেছেন। দুজনেই যাবেন পার্টিতে। গাড়িতে আমি খুব একটা কথা বললাম না। আমার জায়গা কিউ পূরণ করে দিতে লাগল। ওর মা নাকি টাইগার মম। ব্যাপারটা বুঝলাম না। কিউ বুঝিয়ে দিল। যেসব বাবা-মা কড়া শাসনের ভেতর ছেলেমেয়েকে বড় করেন, সব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে প্রভাবিত করেন, তাদের টাইগার প্যারেন্টস বলা হয়। কিউয়ের মা ছিল এমন একজন ব্যক্তি। কিউকে ছোটবেলায় পিয়ানো শিখতে হয়েছে, গান গাওয়া শিখতে হয়েছে, লেখাপড়ায় ভাল করতে হয়েছে। এমন তো আমাদের দেশেও করে। সবার আগে পড়াশোনা, এরপর গান, নাচ, আবৃত্তি, ছবি আঁকাআঁকি, লেখালেখি। কোনো একটা গুণ চর্চা করতেই হবে। তাহলে কি আমাদের বাবা-মাকেও টাইগার প্যারেন্টস বলা যাবে?
.
কিউ ওর পিয়ানো দক্ষতা দেখাল প্রফেসরের বাসায় গিয়ে। সেখানে একটা পিয়ানো ছিল স্রেফ সাজসজ্জার অংশ হিসেবে। সেটা কেউ বাজাতে পারে না। কিউ মুহূর্তে ঝংকার তুলল দক্ষ হাতে। আমরা তন্ময় হয়ে শুনলাম। আরেকবার বুঝলাম, কিউয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় আমি অনেক পিছিয়ে। এত গুণী একজন মানুষকে না নিয়ে আমাকে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। হতাশ লাগছে বলে কারো সাথে কথা বলাতেও আগ্রহ পাচ্ছি না। অনুষদের সব প্রফেসর চলে এসেছেন। তারা একজন আরেকজনকে খোঁচা মেরে কথা বলছেন, পচাচ্ছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রায় সবার হাতে সুরার পেয়ালা। আমিও সাদা ওয়াইন নিলাম। লাল ওয়াইন কড়া লাগে। ওটা খেয়ে মাথা ঘুরালে লজ্জায় পড়ব। কিউ দেখি লাল পানি নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার এক পেগ চলতে চলতে ও দুই পেগ নিয়ে নিল। আট বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে মেয়েটা এইদেশের সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। আর আমার ‘miles to go before I sleep’।
.
একজন প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। বললাম। উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘আরে! নব্বইয়ের দশকে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম গবেষণা করতে। বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটসের একটা ফান্ড নিয়ে কাজ করছিলাম। ফান্ডটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর যাওয়া হয়নি।’ আমি তো অবাক! কীভাবে দূরদেশের একজন প্রফেসরের সাথে মোলাকাত হয়ে গেল যিনি আমার দেশে গিয়েছিলেন। প্রফেসরের স্মৃতি বেশ টনটনে। জানতে চাইলেন, এখনো ঢাকায় জ্যাম হয় কিনা। উনি যেসময় যেতেন, ঐ সময় ভয়াবহ জ্যাম হত ঢাকার রাস্তায়। আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘এখনো আছে।’ তার মানে কি ঢাকার এই জ্যাম চিরস্থায়ী? নব্বইয়ের দশকেও ছিল, এখনো আছে, আগামী বিশ বছরেও ফুরানোর অবকাশ নেই। ঐ দশকে যদি উনার মনে হয় ‘ভয়াবহ জ্যাম,’ এই দশকে গেলে নির্ঘাত হার্টফেল করবেন।
.
ডঃ ফার্নান্দেজ নিজ হাতে পাস্তা রান্না করছেন। এটাই মূল খাবার। এখানকার দাওয়াতে খুব বেশি পদ রাখা হয় না। হয়ত দুটো মূল খাবার দেওয়া হয়, একটা মিষ্টান্ন। শুরুতে থাকে বেশ কিছু অ্যাপেটাইজার। ব্যস, এই। এখানে দাওয়াত মানে আড্ডাবাজি, খাওয়া নয়। আমাদের দেশের বিপরীত। পাস্তা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে উনি গল্প করে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই উনাকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘরে যাচ্ছেন। দেখে মনে হল, এই বাসার সাথে সবাই খুব পরিচিত। কোন ক্যাবিনেটে হুইস্কি আছে, কোনটায় পেয়ালা, সবাই জানেন। প্রথমে আমরা চারজন একসাথে থাকলেও হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পাশে কেউ নেই। সবাই আলাদা হয়ে নিজেদের মত করে প্রফেসরদের সাথে গল্পে মত্ত। এই সংস্কৃতির সাথে আমার খুব একটা পরিচয় নেই। প্রফেসরদের সাথে কত কথা বলা যায়? তাছাড়া দুই বছর পরও আমার মনের দেওয়াল ভাঙেনি। শিক্ষকদের আশেপাশে গেলেই ভয় কাজ করে। তাই আমি কিউয়ের সাথে যোগ দিলাম। ও কথা বলবে, আমি মাথা নাড়ব।
.
কেউ একজন জানতে চাইলেন, কখন খাওয়া শুরু হবে। ডঃ ফার্নান্দেজ বললেন লিজ আসার পর। লিজ হল ঐ মেয়েটি যে আজ পিএইচডি ডিফেন্স করেছে। রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর ওকে ডক্টর লিজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। শুনে রোম সব দাঁড়িয়ে গেল। যাকে কয়েক ঘণ্টা আগে দেখলাম একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, সে একজন একজন ডক্টর? ওয়াও! একটু পর হইচই শোনা গেল বসার ঘর থেকে। লিজ এসেছে ওর ফিঁয়সেকে নিয়ে। সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘ওয়েলকাম ডঃ লিজ!’ লিজ লজ্জা পেয়ে হেসে দিল। একজন জানতে চাইলেন, ‘কেমন লাগছে?’ লিজ বলল, ওর কোনোরকমই লাগছে না। এখনো মনে হচ্ছে ও পিএইচডি ক্যান্ডিডেট। হয়ত এক সপ্তাহ সময় লাগবে বুঝতে যে, গবেষণার পাট চুকেছে।
.
এবার সবাই পাস্তা নিয়ে খাওয়ার ঘরে গিয়ে বসলাম। বাফে সিস্টেম। যে যত পার, খাও। আমার ঠিক পাশে এসে লিজ বসল। আমি ওর থেকে চোখ সরাতে পারছি না। হালকা গড়নের মেয়েটা কী যে মাসুম দেখতে! চোখের উপর চিকমিক আইশ্যাডো দিয়ে সেজেছে। ওর ফিঁয়সের চোখেও গর্বিত দৃষ্টি। দুজনে হাত ধরাধরি করে বসে আছে। জানি না, এমন মুহূর্ত আমার জীবনে কখনো আসবে কিনা। এত চেষ্টা করছি, শিঁকে ছিঁড়ছে না।

পর্ব সাত এখানে

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামের স্মৃতিঃ পর্ব পাঁচ
Next post ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামের স্মৃতিঃ পর্ব সাত