(১)
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে। নির্দিষ্ট করে বললে আগস্টের নয় তারিখে। বাংলাদেশ থেকে উড়াল দিয়েছিলাম আগস্টের আট তারিখে। আসার উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা করা। ‘ছিল’ শব্দটা লেখা ঠিক না, গৌণ উদ্দেশ্য এখনো ওটাই আছে। তবে মূল উদ্দেশ্য ঘুরে বেড়ানো। আমেরিকায় আসার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল লেখাপড়ার জন্য আসা। তাই আমি এ পথেই এগিয়েছি। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক জানত, লেখাপড়া একটা অজুহাত মাত্র। আসল উদ্দেশ্য পঞ্চাশটা অঙ্গরাজ্যে ঢুঁ মারা। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৬৬ গুণ বড় দেশ আমেরিকা। আমার লেখায় আমেরিকা বলতে আমি ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা বা ইউএসএ বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝাব। কানাডা, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ (এরা বলে ‘হুয়াই’) বা মেক্সিকো এখনও ভ্রমণ করিনি। করলে “আমেরিকা” নামটা দিয়ে পুরো উত্তর আমেরিকাকে বুঝাব। তবে এখানে আসার পর থেকে চিন্তা হচ্ছে কানাডা, হাওয়াই দূরের কথা, যুক্তরাষ্ট্র দেখে শেষ করতে পারব তো? এখানে যে দেখার জিনিস অগুনতি, এ ধারণা পেয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের আত্মজীবনী পড়ে। ধারণাটা বদ্ধমূল হল এদেশে পা রেখে। আমি এসেছি সেন্ট লুইস শহরে, যেটা মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের একটা প্রধান বন্দর নগরী। এখন পর্যন্ত এ শহরই দেখে উঠতে পারিনি। দেখিনি বাংলাদেশেরও অনেক জায়গা। মন খারাপ হয় যখন ভাবি, সেন্ট মার্টিন দ্বীপও ঘুরা হয়নি। রবি ঠাকুর আমাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিলেন,
বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
আমি হাজার টাকা খরচ করে বালি দ্বীপ গিয়েছি, কলকাতা আর দার্জিলিং ঘুরেছি। অফিসের খরচে ইতালি গিয়েছি। কিন্তু শত টাকা খরচ করে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার সুযোগ পাইনি। যা হোক, কান্নাকাটি না করি। সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সুযোগ আমার বন্ধ হয়ে যায়নি। বুকে আশা মনে বল আছে যে, মরার আগে কপিলা হয়ে আমার কুবের মাঝিকে নিয়ে দ্বীপটাতে ঘুরে আসব।
উড়োজাহাজ ভ্রমণের একটা দিক বেশ মজার। বাংলাদেশ থেকে যত পশ্চিম দিকে যাওয়া যায়, দিনক্ষণ পিছিয়ে যায়। যখন ইতালিতে পা রাখতাম, বাংলাদেশ এগিয়ে যেত চার ঘণ্টা করে। আবার ইন্দোনেশিয়ায় যখন গিয়েছি, তখন বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে দুই ঘণ্টা। নিজ অক্ষে পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সময়ের এই পল্টি খাওয়া আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। তবে আমেরিকায় এসে যখন দেখলাম পাক্কা বারো ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়েছি, বেশ ধাক্কা খেলাম। আকাশপথে চব্বিশ ঘণ্টা ভ্রমণ করে জান কয়লা হয়ে গেল, অথচ ‘যশোহা বৃক্ষের দেশে’ পা দিয়ে দেখি সময় বলছে ভ্রমণ করেছি মাত্র পনেরো ঘণ্টা। দেশ থেকে উড়াল মেরেছি আট আগস্ট রাত ৯.৫০ মিনিটে আর প্রবাসে পৌঁছেছি নয় আগস্ট দুপুর বারোটায়। মাঝখানের নয় ঘণ্টা পুরো গায়েব। আমেরিকায় পৌঁছা পর্যন্ত তিনবার বিমান বদলাতে হয়েছে। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আবু ধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রাথমিক ভ্রমণ। আবু ধাবি থেকে এরপর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অবস্থিত ও’হেয়ার বিমানবন্দরে অবতরণ। এরপর ও’হেয়ার থেকে সেন্ট লুইস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকায় এবার তেমন উত্তেজনা বোধ করিনি। কিন্তু আমার কাঙ্ক্ষিত দেশে পদার্পণ করতে যাচ্ছি ভেবে কিছুটা উত্তেজিত হওয়া দরকার ছিল।
যা হোক, এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে যখন বাংলাদেশী এক ভাইয়ের এপার্টমেন্টের দিকে ছুটছি, তখনও বিস্মিত হলাম না। এরকম ছিমছাম রাস্তাঘাট আর সুন্দর প্রকৃতি ইতালির রিমিনি শহরে দেখে এসেছি। কিংবা দার্জিলিংয়ে। একটু পর খেয়াল হল, আমি আমেরিকায়। আমেরিকার হাইওয়ে দিয়ে শোঁ শোঁ করে ছুটে চলছে আমেরিকান ট্যাক্সি। একদিনের ব্যবধানে বাবা-মা আর ছোট দুই ভাইকে ফেলে আমি চলে এসেছি আরেক মহাদেশে। এখান থেকে চাইলেই আর ছুটে যেতে পারব না তাদের কাছে। মাঝে যে ৮,২৩১ মাইলের দূরত্ব! ঠিক তখনই অনুভব করলাম, আমি এখন আমার স্বপ্নের দেশে। এই দেশে আসার জন্য গত পাঁচ বছর ধরে কম চেষ্টা করিনি। অবশেষে সাফল্য ধরা দিয়েছে। পাঁচ পাঁচটা বছরের সংগ্রাম শুধু আমাকে নয়, আমার বাবা-মা, ভাইদেরকেও বিচলিত করেছে। শেষ এক বছরে আমার হাজবেন্ড প্রিন্সও দেখেছে আমার মরিয়া চেষ্টা। তাই আমার আমেরিকায় আসা শুধু উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পাথেয় নয়, এটা জীবন যুদ্ধে জয়লাভের একটা চিহ্ন। এটা আমার গর্বের একটা অংশ।
(২)
প্রিন্স ওর বাবা-মায়ের বড় ছেলে। বাঙালি সমাজে বড় ছেলেকে একটু বিশেষ খাতির করা হয়। হাজার বছর ধরে চলে আসা অভ্যাস অনুযায়ী, বড় ছেলের উপর মা-বাবা আর্থিক আর মানসিক ভরসা করে থাকেন। তাই প্রিন্স যখন জানালো সে আমার সাথে আমেরিকায় চলে আসবে, আমার শাশুড়ি প্রচণ্ড মন খারাপ করলেন। ছেলে দূরে চলে যাচ্ছে বলে মন খারাপ। শ্বশুর অবশ্য এতটা ভেঙ্গে পড়েননি, বা পড়লেও বুঝতে দেননি। আমার বাবা-মায়েরও মন খারাপ হয়েছিল আমি সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে চলে যাচ্ছি বলে, কিন্তু তারাও বুঝতে দেননি। ঢাকা বিমানবন্দরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আম্মু (শাশুড়ি) কেঁদে দিলেন। খুব নরম মনের মানুষ তো! উনার কান্না দেখে এই প্রথম আমার বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠল। এ ক’দিন খুশির চোটে তাথৈ তাথৈ করেছি, শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা করেছি, ডাক্তারের কাছে দৌড়েছি, চশমা বানিয়েছি। ফলে দেশ ছেড়ে চলে যাব, এই অনুভূতি নাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়নি। জুনের এক তারিখে অ্যাসিস্টেন্টশিপের অফার চূড়ান্ত হওয়ার পর হাতে বেশি সময় ছিল না গোছগাছ করার। আগস্টের পনেরো তারিখ থেকে নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে আমার যোগ দেওয়ার কথা। তার মানে অন্তত আগস্টের বারো তারিখের ভেতর আমাকে ফ্লাই করতে হবে যদি আমেরিকা পৌঁছে একদিন বিশ্রাম নিতে চাই। হাতে সময় আছে মাত্র দেড় মাসের মত। বেশিরভাগ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টই উড়াল দেওয়ার তিন-চার মাস আগে জানতে পারে ফান্ড পেয়েছে কি পায়নি, কিন্তু আমি জেনেছি মাত্র দেড় মাস আগে। দেড় মাসের মধ্যে ভিসার জন্য আবেদন থেকে শুরু করে বিমানের টিকেট বুক করার কাজ সারতে হবে। মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। এ অবস্থায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুভূতি টের পাওয়া যায় না।
অফিস থেকে রিজাইন দেওয়ার আগেই আমাকে বিমানের টিকিট বুক করতে হয়েছে। ওড়ার দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে, টিকিটের মূল্য তত বাড়তে থাকে বলে আগেভাগে কিনে ফেলতে হয়। না কিনলে অন্তত বুক করে রাখতে হয়। কিন্তু আমার অবস্থা ছিল ‘না ঘর কা, না ঘাট কা’। না সময়মত বুক করতে পেরেছি, না কিনতে। অ্যাসিস্টেন্টশিপের অফার পাওয়ার সাথে সাথে টিকিট বুক করা উচিৎ ছিল। যদি ভিসা না হওয়ার কারণে বুকিং বাতিল করতে হত, অল্প কিছু টাকা গচ্চা যেত। কিন্তু দেরি করে টিকিট কিনতে গেলে বুকিং বাতিল করার চেয়েও অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের মনে ঐ সময় বুকিং দেওয়ার মত আত্মবিশ্বাস ছিল না। টিউশন ফি মাফ, হেলথ ইন্সুরেন্স পাওয়া আর মাসিক বেতন পাওয়ার পরও আমার আই-২০ ফর্মে নয় হাজার ডলারের ঘাটতি থেকে গেছে। ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অফিস এই ঘাটতি ধরেছে জীবনযাত্রার ব্যয়ের ভিত্তিতে। সেন্ট লুইস শহরে থাকতে গেলে নাকি আমার ট্যাঁক থেকে এক বছরে নয় হাজার ডলার অতিরিক্ত খরচ হবে! তার উপর আছে প্রিন্সের খরচ। ও যাবে এফ-২ ভিসায়, মানে আমার ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে। ওর জন্য দেখাতে হবে আরও ছয় হাজার ডলার। মোট ১৫০০০ ডলার দেখাতে হবে ব্যাংক একাউন্টে। সবকিছু মিলিয়ে ‘ভিসা হবে না’ চিন্তাটাই মাথায় ঘুরছিল বারবার। তাই বুকিং দেওয়া নিয়ে বিস্তর দ্বিধায় ছিলাম। ভেবেছিলাম ভিসা নিশ্চিত করে তবেই টিকিট কিনব। কিন্তু ভিসা ইন্টার্ভিউয়ের তারিখ ঠিক করতে গিয়ে দেখি জুলাইয়ের সতের তারিখের আগে কোনো স্লট খালি নেই। ফল সেশন ধরার জন্য বেশিরভাগ স্টুডেন্টই এসময় ভিসা ইন্টার্ভিউ স্কেজিউল করে বলে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে ভিসা অফিস। দেড় মাস পর ইন্টার্ভিউ যদিও অনেক দেরি হয়ে যায়, তবুও আরো দেরি হওয়ার চেয়ে শ্রেয় ভেবে তড়িঘড়ি আবেদন করে ফেললাম।
পুরো জুন মাস আমাদের গেল টাকা যোগাড় করা আর সাক্ষাৎকারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা নিয়ে। চাকরি বাকরি করে যা জমিয়েছিলাম, তাতে ১৫০০০ ডলারের এক তৃতীয়াংশ দেখানো সম্ভব। বাবা-মাকে জানানোর পর উনারা উনাদের সমস্ত সঞ্চয় মিলিয়ে একটা নিরাপদ সেভিংস তৈরি করে দিলেন। এরপর আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরল। ঠিক করলাম বিমানের টিকিট বুক করব। জুলাইয়ের এক তারিখে টিকিট বুক করার জন্য দৌড়ালাম পরিচিত এক ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। আগস্টের দশ থেকে বারো তারিখের মধ্যে কোনো টিকিট আছে কিনা জানতে চাইলাম। উনারা ইতিহাদ, টার্কিশ ইত্যাদি এয়ারলাইন্স ঘেঁটে বললেন আট তারিখের পর কোনো টিকিট অ্যাভেইলেবল নেই। কিনলে ছয়, সাত বা আট তারিখের টিকিট কিনতে হবে। আমার এক কাজিনের বাগদান হবে আগস্টের দশ তারিখে। আমাদের চলে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে ও সতের তারিখের অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে এসেছে দশ তারিখে। কিন্তু আট তারিখের টিকিট কাটলে তো এগিয়ে আনা অনুষ্ঠানেও যোগ দেওয়া সম্ভব হবে না! কী করি? অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখলাম টার্কিশ এয়ারলাইন্সে দশ তারিখে টিকিট অ্যাভেইলেবল দেখাচ্ছে। এজেন্সির লোকজন বললেন সরাসরি এয়ারলাইন্সের অফিসে গিয়ে টিকিট কাটতে। গেলাম সেখানে। কিন্তু কাস্টোমার কেয়ার থেকে জানতে পারলাম, সব টিকিট এজেন্সিরা কিনে নিয়েছে। উনাদের হাতে টিকিট অবশিষ্ট নেই। অগত্যা ফিরতে হল আগের এজেন্সিতে। বিরস বদনে আট তারিখের দুটো টিকিট বুক করলাম। কোন মুখে কাজিনকে ‘আসতে পারব না’ বলব ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরলাম। ভিসা ইন্টার্ভিউয়ের পাঁচদিন আগে অর্থাৎ জুলাইয়ের বারো তারিখে এজেন্সি থেকে কল করল। বলল, টিকিট কনফার্ম করে ফেলতে হবে। আজকের পর বুকিং ধরে রাখা সম্ভব না। প্রতি টিকিটের মূল্য এক লাখ সতের হাজার টাকা। যদি কেনার পর টিকিট বাতিল করতে চাই তবে ষোল হাজার করে বত্রিশ হাজার টাকা গচ্চা যাবে। উপায় না দেখে কনফার্ম করে ফেললাম। ভিসার নিশ্চয়তা নেই, টিকেট কিনে বসে রইলাম।
এই দেড় মাস কীভাবে কেটেছে সে চিন্তা করলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। প্রতিদিন দুঃশ্চিন্তা হত ভিসা পাব কি পাব না। ফান্ড পাব কি পাব নার চেয়েও বীভৎস ছিল এই চিন্তা। প্রতিদিন প্রিন্সের সাথে ভিসা ইন্টার্ভিউ প্র্যাকটিস করি। নেট ঘেঁটে ভিসা ইন্টার্ভিউ সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্ন সংগ্রহ করেছি। বিভিন্ন হায়ার স্টাডি গ্রুপ আর ফোরামে চোখ রাখি, কেউ ভিসা ইন্টার্ভিউয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে সেটা কপি পেস্ট করে রেখে দিই কম্পিউটারে। পোস্টের নিচে করা মন্তব্য থেকেও অনেক কিছু শিখি। এভাবে বিশ ত্রিশ পৃষ্ঠার একটা প্রশ্নোত্তর বানিয়ে ফেললাম। ফুল ফান্ড, পার্শিয়াল ফান্ড, সেলফ ফান্ড – এমন কোনো পারস্পেক্টিভ নেই, যেখান থেকে প্রশ্ন জমাইনি। মোট কথা, ১০০% প্রস্তুত হয়ে তবেই যাব ইন্টার্ভিউ দিতে যেন ভাঙ্গা বুক নিয়ে ফিরতে না হয়। আমার টেনশন দেখে প্রিন্স হাসে। বলে, শুধু শুধু এত চিন্তা করছি। আমাদের কাছে সলিড সেভিংস আছে। এরপরও ভিসা না হলে সেটা হবে ব্যতিক্রম। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার পড়ে যা বুঝেছি তা হল, ভিসা অফিসাররা দুটো বিষয়ের উপর জোর দেন। তারা দেখেন, লেখাপড়া এবং জীবনযাত্রার খরচ বহন করার মত পর্যাপ্ত টাকা পয়সা আপনার আছে কিনা, এবং সে টাকাপয়সার উৎস কী। যারা ফুল ফান্ড পায়, তারা সহজেই এ দুটো বাধা উৎরে যায়। কিন্তু যারা আমার মত পার্শিয়াল ফান্ড পায়, বা সেলফ ফান্ড নিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করে, তাদেরকে মুখোমুখি হতে হয় অজানা আতংকের। এদিক দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম যে, আমার টাকা পয়সার উৎস একদম নিখাদ। নিজের সঞ্চয় এবং বাবা-মায়ের সঞ্চয়। উৎস যদি আপন ভাইবোনের টাকাও হয়, তাহলেও অনেক সময় ভিসা দিতে গড়িমসি করে। কারণ হিসেবে জানতে চায়, কেন ভাইবোনেরা তাদের জীবনের পিছনে টাকা খরচ না করে আপনার পেছনে করবে। কিন্তু বাবা-মা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের পিছনে টাকা ঢালতে চাইতে পারেন, এটা অদ্ভুত কিছু না। তারপরও বাবা-মা তাদের পাই পয়সা খরচ করে কেন আপনাকে পড়াবেন, সে ব্যাপারে ভিসা অফিসারকে আশ্বস্ত করতে না পারলে আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ার ইতিহাস আছে।
বাবা-মায়ের চাকরি বা ব্যবসা থেকে যে আয় হয়, সেটা যদি ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে আবেদন বাতিল হতে পারে। ধরুন, আপনার বাবা-মায়ের মাসিক আয় এক লাখ টাকা। সংসারের খরচ বাবদ মাসিক ব্যয় ত্রিশ হাজার টাকা। অর্থাৎ আপনার পড়াশোনার জন্য তারা সর্বোচ্চ খরচ করতে পারবেন সত্তর হাজার টাকা। কিন্তু যদি আপনি দেখান, তারা আপনার পেছনে আশি/নব্বই লাখ টাকা ব্যয় করতে সক্ষম, তাহলে ভিসা অফিসার এটা নিয়ে প্যাঁচাতে পারেন। তাদের ভালই ধারণা আছে, বাংলাদেশে জীবন যাত্রার খরচ কেমন। সুতরাং সবদিক দিয়ে সলিড গ্রাউন্ড তৈরি করে যেতে হবে। আমিও যতদূর পারি সবদিক নিয়ে চিন্তা করে, সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর সাজিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। ইন্টার্ভিউ অনুশীলন করতে করতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খেয়াল করছিলাম, কোনো আস্পেক্ট বাদ পড়ল কিনা। তাই যেদিন সাক্ষাৎকার দিতে গেলাম, বুক দুরুদুরু করছিল বটে, নার্ভাস হয়ে তালগোল পাকাইনি।
(৩)
জুলাইয়ের সতের তারিখ সকাল সাতটায় ইন্টার্ভিউ স্কেজিউল করেছিলাম। বিভিন্ন গ্রুপ থেকে জেনেছিলাম, যত দেরিতে স্কেজিউল করবেন, ইন্টার্ভিউ শুরু হতে তত দেরি হবে। এত দেরি করা আমার পোষায় না। অফিস থেকে অর্ধ বেলা ছুটি নিয়েছি। দুপুর দুটো পর্যন্ত। এর মধ্যে ইন্টার্ভিউয়ের ঝামেলা শেষ করতে হবে। সকাল সাতটার সাক্ষাৎকার শেষ হতে দুটো বাজবে এতটা লাগামহীন চিন্তা করিনি, কিন্তু সাবধানের মার নেই। আগের রাতে সমস্ত ডকুমেন্ট ক্লিয়ার ফাইলে ভরে প্রস্তুত করে রেখেছি। ফর্মাল জামা কাপড় ইস্ত্রি করে হাতের সামনে রেখেছি। সকালে উঠে যেন এক মিনিট সময় নষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করে ঘুমুতে গিয়েছি। সে রাতে আমার ঘুমের কী হাল হয়েছিল, মনে নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত। মানুষ বড় বড় ঘটনার কথা সহজে ভুলে না। কিন্তু কেন আমার মস্তিষ্ক এই স্মৃতি মুছে ফেলল, জানি না। সকালে উঠে হালকা নাস্তা করে সোয়া ছয়টা নাগাদ আমি আর প্রিন্স বের হলাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা থাকতাম বারিধারা ডিওএইচএস-এর পাশে, কালাচাঁদপুর নামক জায়গায়। সেখান থেকে রিকশায় করে আমেরিকান এম্বাসিতে যাওয়া যায়। এত সকালে বৃষ্টির মধ্যে রিকশা পাব কিনা ভাবতে ভাবতে দুজনে এপার্টমেন্টের বাইরে এলাম। দেখি ফটকের ঠিক বাইরে একজন রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে। দরদাম করে উঠে পড়লাম রিকশায়। ছাতা ধরে রেখেছি মাথার উপর যেন জামাকাপড় ভিজে না যায়। তারচেয়েও বড় কথা, ফাইল ভেজানো যাবে না। এই ফাইলে আমার সবগুলো অরিজিনাল সার্টিফিকেট, ভার্সিটির অ্যাডমিশন লেটার, অ্যাসিস্টেন্টশিপের কন্ট্রাক্ট লেটার, আই-২০ ফর্ম, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি আছে। এগুলো নষ্ট হলে আবার ইস্যু করার যে ঝামেলা, তার চেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমার নিউমোনিয়া বাঁধানো ভাল। আবার সেভিস ফিয়ের রশিদ, ইন্টার্ভিউয়ের কনফার্মেশন, ভিসার জন্য তোলা নির্দিষ্ট আকৃতির ছবি, বিয়ের ছবি, DS-160 কনফার্মেশন পেইজ যদি নষ্ট হয় তাহলে আজকের ইন্টার্ভিউ দিতে পারব কিনা, সন্দেহ।
একটু পর দেখি মামা চেনা রাস্তায় না গিয়ে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করেছেন। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি আমেরিকান এম্বাসি চিনেন তো?” মামা এ কান ও কান ছড়ানো হাসি দিয়ে বললেন, “চিনি আপা। কতজনরে নিয়া গেছি এরকম সকাল বেলায়!” শুনে শান্তি পেলাম। মনে হচ্ছে অভিজ্ঞ চালকের হাতে পড়েছি। রিকশায় যেতে যেতেই বৃষ্টির বেগ বাড়ল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর মামা আমাদেরকে যে গেটের সামনে নিয়ে এলেন, সেটা আমেরিকান এম্বাসি না। সেটা ক্যানাডিয়ান হাই কমিশন। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন গার্ডও আমাদের রিকশা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। একজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন আমরা কী চাই। জিজ্ঞেস করলাম, আমেরিকান এম্বাসিতে যাওয়ার রাস্তা কোনদিকে? উনি দেখিয়ে দিলেন। রিকশাওয়ালা মামা ভুল বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হাসি দিলেন। আমি ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে গিয়েছি। সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। যদি আমাকে ঢুকতে না দেয়? যদি বলে আমি স্কেজিউল মিস করে ফেলেছি? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সাতটা বাজার আগেই এম্বাসির গেটে এসে থামলাম। গেটের পাশে আমার মত আরও কয়েকজন প্রার্থীকে দেখা যাচ্ছে। প্রিন্স মামাকে একশো টাকা দিল, যদিও মুলোমুলি হয়েছিল পঞ্চাশ টাকায়। মামা খুশি হয়ে চলে গেলেন, আর আমরা বাকি প্রার্থীদের সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবাই কার্নিশের তলে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে কার্নিশ খুব একটা সাহায্য করছে না। আমরা ছাতা মাথায় দিয়েও ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছি। অন্যদের অবস্থাও একই। কিন্তু সবাই তাদের হাতে ধরে রাখা ফাইল নিয়ে চিন্তিত। ওটাকে সামলে রাখতে হবে, যায় যদি যাক প্রাণ।
মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছি গেটের বাইরে। সময় কাটানোর জন্য সামনে দাঁড়ানো শার্ট আর টাইট জিন্স পরা এক তরুণীর সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। সেও মাস্টার্স করতে যেতে চায়। ফান্ডের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা শোভন না বলে সেটা অজ্ঞাত থেকে গেল। কিন্তু পোশাক দেখে যা বুঝলাম, ও ভার্সিটি থেকে ফান্ড না পেলেও সেলফ ফান্ডে চলে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। মেয়েটা খুব স্মার্ট। ইংরেজি উচ্চারণ একদম আমেরিকানদের মত। এ মেয়ে ভিসা না পেয়ে যায়ই না! দেখতে দেখতে লাইনে একশজনের উপর লোক জমে গেল। সকাল সাতটার তো বটেই, দশটার প্রার্থীরাও চলে এসেছে। পৌনে আটটার দিকে একজন গার্ড এসে সাতটার প্রার্থীদের আগে বাড়তে বললেন। অবশেষে! সকালবেলা যে নার্ভাস ভাব নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম, গত এক ঘণ্টায় তার অনেকটাই কেটে গেছে। বৃষ্টি পড়ে ভাল হয়েছে। চিন্তা ভাবনা বৃষ্টির দিকে ঘুরে গেছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই বাম দিকে একটা রুম দেখা গেল যেখানে প্রাথমিক যাচাই বাছাই চলছে। ইন্টার্ভিউয়ের কনফার্মেশন ফর্ম আর পাসপোর্ট দেখিয়ে নিশ্চিত করলাম যে, আমিই নির্ঝর রুথ আর সাথে আমার হাজবেন্ড রিজওয়ানুর প্রিন্স। ওখান থেকে বের হয়ে সামনে আগাতে আগাতে হাতের ডান পাশে পড়ল মূল বিল্ডিং। ঢুকলাম সেখানে। এই দরজা সেই দরজা পার হয়ে একটা ওয়েটিং রুমে এলাম। সেখানে আবার লাইন। তিনজন সুট, টাই পরা তরুণ আমাদের কাগজপত্র দেখে দ্বিতীয় দফা নিশ্চিত হল। এরপর ঢুকতে পারলাম আসল কক্ষে, যেখানে ইন্টার্ভিউ নেওয়া হবে।
কক্ষটা বেশ বড় আর দুই ভাগে বিভক্ত। ডানপাশে আছে পাঁচটা কাউন্টার, বাম পাশে পাঁচটা। ডানপাশের কাউন্টার এক, দুই, তিনে চলছে পাসপোর্ট চেকিং, আর চার আর পাঁচে নিচ্ছে ফিঙ্গার প্রিন্ট। বাম পাশের কাউন্টার ছয়, আট, দশে চলছে ইন্টার্ভিউ। পাসপোর্ট চেকিং আর ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য আরেক দফা লাইন ধরতে হল। যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করে যখন ওয়েটিং বেঞ্চে এসে বসলাম, তখন খুব সম্ভবত আটটা বিশ বাজে। বিভিন্ন কাউন্টারের দিকে তাকাচ্ছি। খেয়াল করিনি কেমন হারে এপ্রুভাল আর রিজেকশন চলছে। একটা ফ্যামিলিকে দেখলাম ভিসা পেয়েছে, একটা ফ্যামিলি পায়নি। একজন স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েছে, আরেকজন পায়নি। আমার হাজবেন্ড বেশ ভয় পাচ্ছিলেন আট নাম্বার কাউন্টারের ব্লন্ড ভিসা অফিসারকে নিয়ে। উনি নাকি ভীষণ কড়া! হায়ার স্টাডি গ্রুপের কয়েকটা পোস্টে সেরকমই পড়েছেন। আমি নার্ভাস হয়ে বসে আছি। কে কড়া, কে নরম, সেটা মাথায় ঢুকছে না। গত একমাস ধরে কী কী উত্তর সাজিয়েছি, সেগুলোও বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে স্মৃতি থেকে। হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবছি, ইনস্ট্যান্ট যা মনে আসে, তাই বলব। আমাদের পালা যখন এলো, দেখলাম পাঁচ আর আট নাম্বার কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমান মানুষ দাঁড়ানো। ফলে আমাদেরকে যেতে বলা হল দশ নাম্বার কাউন্টারে। আমি প্রথম থেকেই দশ নাম্বার কাউন্টারের ভিসা অফিসারকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। তিনজনের মধ্যে উনাকে আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ লাগছিল। তাই উনার কাউন্টারে আসতে পেরে বুকে একটু বল পেলাম।
আমরা যখন হলুদ দাগের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি, তখন যিনি দশ নাম্বার কাউন্টারে ইন্টার্ভিউ দিচ্ছিলেন, তিনি একজন ছোটখাট ব্যবসায়ী (পোশাক পরিচ্ছদ ভাল ছিল না, যেটা ইউএস এম্বাসিতে খুব বেশি বেমানান লাগছিল)। ব্যবসায়িক কাজে হয়ত আমেরিকা ভ্রমণে ইচ্ছুক। কিন্তু VO কোনো উত্তর শুনেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। ‘আপনি আগে কোনো দেশ ভ্রমণ করেছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে লোকটি বলল, ‘না। তবে আমি ইন্ডিয়ার ভিসা পেয়েছি। কিছুদিনের মাঝে যাব।’ VO-র চেহারা দেখে লোকটা যোগ করল, ‘আমি নতুন নতুন মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করি। তাই আমেরিকা যেতে চাই।’ VO খুব একটা ইম্প্রেসড হলেন না। যা হোক, ৩/৪ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলাম লোকটাকে ভদ্রভাবে রিজেকশন দিয়ে দিলেন। আমরা কখন এগোবো, সেটা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর VO আমাদের দিকে তাকালেন। বিশাল একটা হাসি দিয়ে ইশারায় ডাকলেন। পূর্বোক্ত অ্যাপ্লিক্যান্টের পর আমাদের দেখে হয়ত একটু খুশি হয়েছিলেন, কে জানে! আমরা দুজনও বিশাল হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। প্র্যাকটিস করে রাখা ‘হ্যালো, গুড মর্নিং’ সম্বোধনটা উচ্চারণ করার আগেই দেখি VO হাসি মুখে বলছেন, “Hi! Good morning.” আমি খুব খুশি হয়ে গেলাম। আইস ব্রেক হয়ে গেল উনার এক সম্বোধনে। এতদিন যেসব ইন্টার্ভিউ পড়েছি, বেশিরভাগ জায়গায় দেখেছি VO আগ বাড়িয়ে সম্বোধন করেন না। এমনকি অ্যাপ্লিক্যান্টের সম্বোধনের পর উত্তরও দেন না। সেসব পড়ে আমরাও ওভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এমন উলট পুরাণের কারণে খুব আনন্দিত হলাম।
আমরা যেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম, সেভাবেই ভিসা অফিসার প্রশ্ন করতে লাগলেন। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি, কোন সাবজেক্টে মাস্টার্স করতে যাচ্ছি, আই-২০ ফর্মে ডেফিসিট কত, কতদিন থাকব আমেরিকায় ইত্যাদি সাধারণ প্রশ্ন শেষ করে ঢুকলেন গভীর বিষয়ে। ঠিক যেন গা গরম করা শেষে মূল ব্যায়ামের শুরু। এবার VO প্রশ্ন করতে লাগলেন ডেফিসিটের টাকা কোত্থেকে আসবে, বাবা-মা যে টাকা দিবেন তারা কে কী করেন, মাসিক আয় কত, আমরা কয় ভাইবোন, ভাইয়েরা কী করে ইত্যাদি। যখন শুনলেন আমার দুই ভাই আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেলেছে, আশ্বস্ত হলেন। কারণ বাবা-মায়ের এখন আর তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পিছে খরচ করার দরকার পড়বে না। এখন খরচ বলতে শুধু আমার লেখাপড়া। আর এই খরচটুকু বহন করার সামর্থ্য যে বাবা-মায়ের আছে, সেটা ভিসা অফিসার তাদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট থেকে বুঝে নিলেন। প্রায় পঁচিশ মিনিটের সাক্ষাৎকার শেষে VO আমার হাতে “আপনার ভিসা অনুমোদন করা হয়েছে!” লেখা নীল লিফলেট তুলে দিলেন। আমার হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। এই ক্ষণটার জন্য আমি কী আগ্রহেই না অপেক্ষা করেছি পাঁচ পাঁচটা বছর! কাঁপা কাঁপা হাতে লিফলেটটা নিয়ে অফিসারকে ধন্যবাদ দিলাম। এরপর যত দ্রুত সম্ভব কাগজপত্র ফোল্ডারে ভরতে লাগলাম। আমাকে এখুনি এখান থেকে বের হতে হবে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হবে।
সবকিছু গোছানোর পর কোনোদিকে না তাকিয়ে আমি হনহন করে হাঁটা দিলাম। উত্তেজনার চোটে হাঁটার গতি কমাতে পারছি না। এক হাঁটায় দালানের বাইরে। মুক্ত পরিবেশে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। সত্যিই তাহলে আমেরিকার ভিসা পেয়েছি? প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসলাম। প্রিন্সও হাসল। বুঝলাম, ঘটনা সত্যি। খুশিতে গার্ডের সামনেই প্রিন্সকে জড়িয়ে ধরলাম। প্রিন্স একটু থতমত খেল, কিন্তু পাল্টা জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ কোত্থেকে একগাদা কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমরা তাহলে আমেরিকা যাচ্ছি? কান্না মোটেই থামছে না। প্রিন্স কী করবে বুঝতে পারছে না। এ তো কষ্টের কান্না নয় যে সান্ত্বনা দেবে। এ হল আনন্দাশ্রু। কান্না করতে করতেই আমি এম্বাসি থেকে বের হলাম, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। মানুষজন দেখে হয়ত ভাবছে ভিসা রিজেক্টেড হয়েছে। ব্যাপারটা কল্পনা করে কান্নার মাঝেও মজা লাগল। রিকশায় উঠে অবশেষে নিজেকে সামলাতে পারলাম। প্রচণ্ড চাপ মন থেকে নেমে গেলে যেমন ফুরফুরে লাগে, তেমন হালকা লাগল নিজেকে। আমেরিকায় পড়তে যাওয়া নিয়ে আমার যত ফ্যান্টাসি আছে, সব এখন পূরণ হবে। ভাল না লাগলেও শুধু পয়সা উপার্জনের জন্য যে চাকরিতে পাঁচ বছর ধরে শ্রম দিয়েছি, সে চাকরি আর করতে হবে না। এ এক অদ্ভুত শিহরণ।
বাসায় যেতে যেন হাজার বছর লাগছে। এম্বাসির নিয়ম অনুযায়ী কোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ভেতরে ঢুকা যাবে না। তাই মোবাইল ফোন বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। এখন বাসায় গিয়ে সবাইকে ফোন দিতে হবে। এত বড় সুখবর সবাইকে না জানানো পর্যন্ত শান্তি নেই। বাঙালি খুব কমই অন্যের প্রশংসা করে। তাই নিজের ঢোল নিজের পিটানো ফরয। এই প্রথম আমার পিতৃ এবং মাতৃ গোষ্ঠীর ভাইবোনদের (আপন এবং কাজিন) মধ্যে কেউ ফান্ড নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার জন্য ঢোল পিটিয়ে ভেঙে ফেলার মত আনন্দের। বংশের ‘ট্রেন্ড সেটার’ হয়ে গেলাম। এর আগে আমার সেজো খালা আমেরিকা থেকে মনোবিজ্ঞানের উপর মাস্টার্স করেছেন। কিন্তু তাকে তো আর ভাইবোনের কাতারে ফেলা যায় না। তাই এক্ষেত্রে আমি অগ্রদূত হিসেবে নাম কামিয়ে নিলাম। অবশ্য আরেক দিকেও আমি বংশের ‘ট্রেন্ড সেটার’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছি। ভাইবোনদের মধ্যে সবার আগে আমিই বিয়ে করেছি। এরপর থেকে বিয়ের চ্যানেল খুলে গেছে আর একের পর এক ভাইবোন বিয়ে করে ফেলছে।
বাসায় পৌঁছে এবারও প্রিন্স রিকশাওয়ালাকে একশো টাকা দিল। একশো কেন, সামর্থ্য থাকলে আজ আমি হাজার টাকা দিতাম। আজ যে আমার কী খুশির দিন, কাউকে বুঝানো যাবে না। বাসায় ঢুকে প্রথমেই ফোন দিলাম মাকে। বললাম, আমার ভিসা হয়ে গেছে। মা খুব উচ্ছ্বসিত হলেন, কিন্তু কণ্ঠে সেটা প্রকাশ পেল না। আমার মা কঠোর একজন মানুষ। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। কষ্টের কোনো ঘটনায় উনাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি, আনন্দের কোনো ঘটনায় আহামরি উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করতে দেখিনি। উনি হলেন সেই গোত্রের মানুষ যারা আবেগ ঠিকমত দেখাতে পারেন না। অন্যদেরকে কষ্ট করে বুঝে নিতে হয়। আমিও বুঝে নিলাম উনার আনন্দ। এরপর কল দিলাম বাবাকে। বাবার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ শোনালো। উনি খুব নরম মনের মানুষ, এবং একমাত্র মেয়ে হিসেবে আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন। আমার যেকোনো সাফল্যে বাবা সবচেয়ে বেশি খুশি হন। অষ্টম শ্রেণীতে যখন জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় পুরো জেলায় ট্যালেন্টপুলে প্রথম হয়েছিলাম, তখন বাবা কেঁদে দিয়েছিলেন। অথচ মা আদিগন্ত বিস্তৃত হাসি দিয়েই খালাস। বাবা-মায়ের সাথে কথা শেষ করে কল দিলাম ছোট দুই ভাইকে। অঝর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আর অংকন রোবোটিক গলায় বলল, “অভিনন্দন।” এই ছেলের আবেগ বুঝা দায়। সব ঘটনায় পাথুরে অনুভূতি। মায়ের থেকে জিন তো পেয়েছেই, মা যার কাছ থেকে কঠোরতার জিন পেয়েছেন, সেই দাদুর আছরও অংকনের ডিএনএতে আছে। ডাবল অ্যাকশন। এরপর ধীরে ধীরে কাজিনদের জানানো শুরু করলাম। বাবা-মায়ের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলাম খালা, খালু, ফুফু, ফুফা, চাচা, চাচীদের জানানোর।
এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দিলাম অফিসে। ওখানেও বিষয়টা জানাতে হবে। আগস্টের এক তারিখ থেকে যেন রিজাইন নিতে পারি সে ব্যবস্থা করতে হবে। মাত্র ষোল দিনের নোটিশে আমাকে রিজাইন দিতে দিবে কিনা, বুঝতে পারছি না। একমাস আগে জানানোর নিয়ম। কিন্তু না দিলেই বা উপায় কী? আমার তো দেশ ছাড়তেই হবে আগস্টের বারো তারিখের মধ্যে। দেখি কী হয়।
পর্ব দুই এখানে