পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়
(২৩)
আমাদের নতুন বাসাটা একদম খালি পড়ে আছে। রান্নাবান্নার কিছু তৈজসপত্র ছাড়া বাসায় আর কিছু নেই। না খাট, না টেবিল, না চেয়ার। খাট কেনার পরিকল্পনা আমাদের কখনই ছিল না। বাংলাদেশে থাকতেও ফ্লোরিং করেছি, এখানেও ফ্লোরিং করার ইচ্ছা। এজন্য লাগবে একটা জাজিম বা তোষক। আমেরিকার তোষকগুলো বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন। এখানে তুলার তৈরি তোষক পাওয়া যায় না। বদলে স্প্রিং ম্যাট্রেস নামে এক ধরনের তোষক পাওয়া যায় যেটার ভিতর তুলার বদলে স্প্রিং থাকে। যখন কেউ শোয়, তখন শরীরের চাপে স্প্রিং নিচের দিকে হালকা গেঁথে যায়, তুলার তোষকের মত শক্ত হয়ে থাকে না। ফলে শুয়ে আরাম লাগে। এছাড়া আছে ফোমের ম্যাট্রেস, যেটা আমাদের ভাল লাগে না। এগুলো খুব নমনীয় হয়ে থাকে। অত তুলতুলে কিছুতে ঘুমিয়ে শান্তি পাই না। আর আছে মেমোরি ফোম ম্যাট্রেস। এটাও ফোম দিয়ে তৈরি কিন্তু ফোমের ধরন আলাদা। উন্নত ধরনের এবং বেশ দামীও বটে। অ্যামাজন আর ওয়ালমার্টের ওয়েবসাইটে আমরা ঘাঁটাঘাঁটি করি, তোষকের দাম দেখি, হাপিত্যেশ করি। এত দাম দিয়ে তোষক কেনা পোষাবে না। প্রতি রাতে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শুই। ভাবি, এভাবে আর একটা বছর পার করি। এরপর টাকা জমলেই তোষক কিনে ফেলব। তিনটা বালিশ অবশ্য কিনে রেখেছিলাম, ফোমের বালিশ। দুটো মাথায় দিই, একটা কোলবালিশ হিসেবে ব্যবহার করি। প্রিন্স ফোমের বালিশে শুয়ে আরাম পায় না। ঘুমে ঝামেলা হয়। ওর জন্য দেশ থেকে তুলার বালিশ আনা উচিৎ ছিল। কিন্তু অত ভারী জিনিস দিয়ে লাগেজ ভর্তি করার উপায় ছিল না। তাই আশায় রইলাম একদিন অভ্যাস হয়ে যাবে ফোমের বালিশে।
আমি প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাই লোকাল বাসে চড়ে। আসতে যেতে চার ডলার খরচ হয়। হিসেব করে দেখলাম, প্রতি মাসে বাস বাবদ খরচ হবে কমপক্ষে ৭২ ডলার। খরচ বাঁচানোর জন্য হয় আমাকে বাৎসরিক পাস কিনতে হবে, নয় বাইসাইকেল। বাংলাদেশে থাকতে সাইকেল চালানোর প্রচণ্ড শখ ছিল কিন্তু অনিরাপদ রাস্তার জন্য চালাতে ভয় পেতাম। আমেরিকায় এসে সে শখ পূরণ করার সুযোগ পেয়েছি। শাওন ভাইদের বাসায় থাকার সময় উনার সাইকেলে চড়ে অনুশীলনও করেছি বেশ কয়েকবার। ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে খোঁজাখুঁজি করেছি সস্তা ডিলের। কিন্তু কোনো ডিল মনমত হয়নি বলে কেনা হয়ে উঠেনি। এবার আর দেরি করা চলে না। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। সপ্তাহের পাঁচদিন ভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে। সাইকেল কেনাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শখের দাম লাখ টাকা বলে একদিন আমরা ওয়ালমার্ট গেলাম সাইকেল কিনতে। ওখানে সাইকেলের জন্য আলাদা সেকশন আছে। ছোটদের সাইকেল, বড়দের সাইকেল, হেলমেট, গ্লাভস, গ্রিজ, সাইকেলে নেওয়ার জন্য পানির বিশেষ বোতল, হেডলাইট, টেললাইট, হর্ন, পাম্পার, লক ইত্যাদি সাজানো। আমি ভেবেছিলাম সাইকেল কিনলেই সারা। এখন দেখছি সাইকেলের সাথে সাথে আরও কিছু ডলারের ধাক্কা যাবে। তাই খুঁজে পেতে সস্তা একটা সাইকেল পছন্দ করলাম। রোডমাস্টার ব্র্যান্ডের। মূল্য ৭৮ ডলার। তবে কেনার আগে অন্তর্জাল থেকে সাইকেলের রিভিউ পড়ে নিয়েছি। পাঁচের মধ্যে চার পাওয়া সাইকেল। রিভিউয়ারের সংখ্যা তিনশো আশি। চোখ বন্ধ করে কেনার মত। আমেরিকার ভোক্তারা রিভিউ দেওয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন। ভালকে ভাল বলে, খারাপকে খারাপ। তাই যেকোনো জিনিস কেনার আগে রিভিউ যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন।
আমরা যে সাইকেল পছন্দ করলাম, সেটার মডেল হল Roadmaster Granite Peak Boys Mountain Bike, 24″ wheels । অন্তর্জাল ঘেঁটে জেনেছি, পাঁচ ফুট উচ্চতার চালকের জন্য ২৪ ইঞ্চির চাকাই উপযুক্ত। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট। তাই এই মডেল বেছে নিলাম। সাইকেলের মধ্যে ছেলে-মেয়ে ঢুকিয়ে বৈষম্য তৈরি করার মানে বুঝি না। যে রডের কারণে সাইকেলের নামে ‘Boys’ যোগ করা হয়, সে রডকে আমার কোনো ঝামেলাই মনে হয় না। অনেকে বলে, মেয়েরা যেন লম্বা স্কার্ট পরে সাইকেল চালাতে পারে, সেজন্য নাকি মেয়েদের সাইকেলে এই রড দেওয়া হয় না। অথচ তাতে সাইকেলের টেকনিক্যাল দিক কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়ে। শুধুমাত্র পোশাকের খাতিরে এরকম বৈষম্য আনা অদ্ভুত না? যা হোক, আমি মেয়ে হিসেবে ফালতু সুবিধা নেওয়ার পক্ষপাতী না। তাই রডওয়ালা সাইকেলই কিনব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু এটা কিনব কীভাবে? যেটা সাজিয়ে রেখেছে, সেটা ট্রায়াল দেওয়ার জন্য রেখেছে। আমাদের আগেও অনেকে ট্রায়াল দিয়েছে। দিয়ে নাট বল্টু ঢিলা করে ফেলেছে। চাকার হাওয়াও যাই যাই করছে। এই পিস তো আর নেয়া যায় না। একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করলাম তাদের ভাণ্ডারে আরেক পিস আছে কিনা। উনি খোঁজ নিয়ে বললেন, নেই। আমি যদি ওয়ালমার্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে অর্ডার দিই, তাহলে তিন-চারদিনের ভেতর সাইকেল আমার বাসায় চলে আসবে। ভেবে দেখলাম, এটাই ভাল। তাই বাসায় এসে অর্ডার দিয়ে দিলাম। সাইকেল আসবে খণ্ড খণ্ড হয়ে। মানে চাকা, হ্যান্ডেল সবকিছু খোলা অবস্থায় আসবে। আমাদের জোড়া লাগাতে হবে। প্রিন্স আশ্বস্ত করে বলল, সে জোড়া লাগিয়ে দেবে। এজন্য একটা টুল বক্সও কিনে ফেলল। টুল বক্স দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া। স্ক্রু লাগানোর ছোট ছোট জিনিস, আর তাদের হরেক রকম সাইজ। এখন শুধু সাইকেল আসার পালা। যথাসময়ে সেটাও চলে এল। বিশাল বাক্স। মনের আনন্দে খুলে দেখি, সব পার্ট আলাদা। মনের গহীনে হালকা আশা ছিল, এত বড় বাক্স… না জানি সাইকেল আস্তই এসেছে কিনা!
প্রিন্স বসে গেল কাজে। আমি সাহায্য করতে গিয়ে ভজঘট পাকিয়ে ফেলব এই ভয়ে সে একাই কাজ করতে লাগল। বাক্সের ভিতর ম্যানুয়াল দেওয়া আছে। সে ম্যানুয়াল দেখে কাজ করেও সফল হওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে প্রিন্স গালাগালি করে দুইবার হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমার বুক ধুকপুক করছে ওর কথা শুনে। এত সাধের সাইকেল কি এরকম খণ্ড খণ্ড অবস্থায়ই আবার ওয়ালমার্টে ফেরত যাবে? আমি নিজেও ম্যানুয়াল পড়ে বুঝার চেষ্টা করছি, পারছি না। প্রিন্সের নাকি ইচ্ছা করছে লাথি মেরে সাইকেল ভেঙে ফেলতে। লাথি মারলে ওর পা ভাঙার সম্ভাবনা বেশি বলে কোনোমতে ওকে নিবৃত্ত করেছি। একটু পর মাথা ঠাণ্ডা হলে আবার কাজ করতে বসল বেচারা। দুই ঘণ্টা টানা কাজ করল। অবশেষে সাইকেল দাঁড় হল। আমি যে একেবারেই কিছু করিনি, তাও নয়। হালকা পাতলা কিছু করেছি। সাইকেলকে জীবনদানের পেছনে আমারও হাত আছে।
প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যাবার পর সাইকেল বাসায়ই পড়ে রইল। সাইকেলে করে ক্যাম্পাসে যাওয়া হচ্ছে না কারণ রাস্তায় সাইকেল চালানোর মত আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি না। প্রিন্স রোজ বলে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হতে, গলির ভিতর অনুশীলন করতে। এটা ছাড়া ভয় ভাঙবে না। কিন্তু আমি সাহস পাই না। আমি বাসে করেই যাওয়া আসা করি। রাগ করে প্রিন্স নিজেই সাইকেল নিয়ে বের হয়। এই গলি, সেই গলি, তস্য গলি ঘুরে। ঘুরে ঘুরে আমাদের পাড়া চিনে ফেলল। কোথায় ফার্মেসি আছে, কোথায় সুপার শপ আছে, জেনে গেল। একদিন এসে বলল, তিন ব্লক পরে সে অনেকগুলো ম্যাট্রেস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এপার্টমেন্টের নিচে কেউ সেগুলো জড় করে রেখেছে। শুনে আমার খুব আগ্রহ হল দেখার। ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ঐ জায়গায়। চারটা ম্যাট্রেস আর একটা সোফা সেট পড়ে আছে। কেউ হয়ত বাসা বদল করেছে বা সেন্ট লুইস থেকে চলে গেছে। ফেলে গেছে বড় বড় জিনিসপত্র। ম্যাট্রেসগুলো ভালমত লক্ষ্য করলাম। দুইটা টুইন, একটা কুইন আর একটা কিং সাইজের। কিং সাইজেরটা সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সুন্দর, আর নতুনের মত। প্রিন্সকে বললাম, ‘চল, এটা নিয়ে যাই।‘ একটু গাঁইগুইয়ের পর প্রিন্স রাজি হল। কিন্তু উঠাতে গিয়ে দেখলাম, ভীষণ ভারী। হাতে ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঠিক করলাম আনজাম ভাইকে অনুরোধ করব উনার গাড়িতে করে দিয়ে যেতে পারবেন কিনা।
আমরা প্রতি সপ্তাহে আনজাম ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে বাজার করতে যাই। আমাদের গাড়ি নেই বলে আনজাম ভাই ভরসা। উনি ব্যাপারটায় বিরক্ত হন না বরং সপ্তাহান্তে নিজেই টেক্সট করে জানতে চান, উনি গ্রোসারিতে যাচ্ছেন, আমরাও যাব কিনা। খারাপ লাগে উনাকে এভাবে জ্বালাতে কিন্তু সস্তা গ্রোসারি শপগুলো এত দূরে দূরে যে, না জ্বালিয়েও চলে না। এই সপ্তাহে উনি যখন এলেন, আমরা উনাকে ম্যাট্রেস দেখাতে নিয়ে গেলাম। উনি দেখে বললেন, এই জিনিস গাড়িতে আঁটবে না। অনেক বড়। যদি পিকআপ যোগাড় করা যায়, সবচেয়ে ভাল হয়। কিন্তু পিকআপ কোথায় পাব? আরেকটা ব্যবস্থা হল ইউহল (U-Haul) ভাড়া করা। ইউহল হল ঘণ্টা ভিত্তিতে ভাড়া করা গাড়ি, যেগুলো দিয়ে জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। বাংলাদেশে যেমন বাসা বদলের সময় আসবাবপত্র অনুযায়ী বড় ট্রাক, ছোট ট্রাক বা পিকআপ ভাড়া করা হয়, আমেরিকায়ও তেমনি বড় ইউহল, ছোট ইউহল, মাইক্রোবাস ইউহল ভাড়া পাওয়া যায়। সমস্যা হল, বাংলাদেশে চালকসহ ট্রাক সার্ভিস পাওয়া গেলেও ইউহল চালাতে হয় ভাড়াটেকেই। ইউহলের সাথে আপনি কোনো চালক পাবেন না। ফলে আমাদের জন্য এটা কোনো বিকল্প হতে পারছে না। দুজনের কেউই গাড়ি চালাতে পারি না। আবার ম্যাট্রেস বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যেখানে পনেরো মিনিটই যথেষ্ট, সেখানে ইউহল ভাড়া নিতে হবে কমপক্ষে এক ঘণ্টার জন্য। গুনতে হবে বিশ ডলার। তারপর আনজাম ভাই বা সেতুদাকে অনুরোধ করতে হবে সেটা চালানোর জন্য। বিশাল ঝামেলা। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের সস্তা শ্রম ব্যাপারটাকে মিস করি। কত সহজে শ্রম ভাড়া পাওয়া যায়! আর এখানে শ্রমের দাম এতই বেশি যে, চালক ভাড়া করাটা রীতিমত আর্থিক ক্ষতি বিবেচিত হয়। তাই নিজেকে চালিয়েই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে হয়। ঠিক করলাম ম্যাট্রেস আনারই দরকার নেই। থাকুক পড়ে।
দুইদিন পর আমার আর সহ্য হল না। এই দুইদিন খালি ম্যাট্রেস নিয়েই ভেবেছি। এত সুন্দর একটা জিনিস এভাবে পেয়েও ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। ভয়ে ভয়ে প্রিন্সকে বললাম, ‘চল, হাতে ধরেই নিয়ে আসি ওটা।’ প্রিন্স অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। আমি জানতাম ও রাজি হবে না। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। শেষে এক সন্ধ্যায় দুজনে উপস্থিত হলাম ম্যাট্রেসের কাছে। কিছুক্ষণ ডেমো দিয়ে দেখলাম কীভাবে ধরলে অল্প আয়াসে তিন ব্লক পার হওয়া যাবে। তিন ব্লক মানে পাঁচশ মিটার। অনেক কসরত করে অবশেষে ম্যাট্রেস নিয়ে ঢুকতে পারলাম ফ্ল্যাটে। রাতের আঁধারে কাজ সারতে হল কারণ দিনের আলোয় কেউ দেখলে নির্ঘাত হাঁ হয়ে থাকত। এই জিনিস যে কেউ হাতে করে আনা নেওয়া করতে পারে, এটা আমেরিকানরা হজম করতে পারত না। এরা আরামপ্রিয় জাতি। অনেক বেশি শারীরিক পরিশ্রম হয়, এমন কাজ করতে চায় না। করার দরকারও পড়ে না। পরিশ্রম করার জন্য ওদের যন্ত্র আছে। কিন্তু আমাদের যন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই বলে কায়িক শ্রম দিতে হল। ম্যাট্রেস আনার আগেই দেখে নিয়েছিলাম ছারপোকা আছে কিনা। কোনো চিহ্ন পাইনি। কোনো ফুটোফাটাও নেই। দিব্যি একটা ম্যাট্রেস। এখানে সাধারণত দুই কারণে জিনিসপত্র বাতিল করা হয়। এক, দূরে কোথাও চলে গেলে, যেখানে এসব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে নতুন কেনাই সাশ্রয়ী; দুই, জিনিসপত্রে ছারপোকা বা অন্যান্য পোকার আক্রমণ ঘটলে। একটু চিন্তিত ছিলাম এই ম্যাট্রেসের ক্ষেত্রে কোন ঘটনা ঘটেছে ভেবে। কিন্তু বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও ছারপোকার টিকি পেলাম না। এজন্য নিয়ে এলাম। এনে মেঝেতে ফেললাম। চাদর বিছালাম। সুন্দর একখানা বিছানা হয়ে গেল। প্রিন্স বলল একটা ম্যাট্রেস কাভার কিনতে। ম্যাট্রেসের উপর বিছানোর জন্য ফোম ফোম ধরনের কাভার পাওয়া যায়। এতে ম্যাট্রেসও ভাল থাকল, আমরাও সরাসরি তোষকের উপর না শুয়ে একটু আরামদায়ক পৃষ্ঠে শুলাম।
পরের সপ্তাহে আবার গেলাম ওয়ালমার্টে। এটাই কাছেপিঠে থাকা সস্তা দোকান যেখানে ফার্স্ট হ্যান্ড জিনিসের দাম নাগালের মধ্যে পাই। এবার কিনতে এসেছি সাইকেলের জন্য হেলমেট, পাম্পার, আর তোষকের কাভার। কত নকশার যে হেলমেট দেখলাম! সাধারণ এক রঙা থেকে শুরু করে আগুনের হলকা হয়ে ভূত, পেত্নীর মুখ আঁকা হেলমেট পর্যন্ত আছে। এগুলো যে শুধু ছোটদের জন্য, তা না। বড়দের জন্যও বড় আকৃতির আছে। আছে সুপারহিরো আঁকা হেলমেট, মাই লিটল পনির গোলাপি ঘোড়া আঁকা হেলমেট, সজারুর কাঁটাওয়ালা হেলমেট। সবগুলো পরেই ট্রায়াল দিলাম। একটাতেও ভাল লাগল না। আমাদের মত বেরসিকদের এগুলোতে ভাল লাগবেও না। আমাদের জন্য মামুলি হেলমেটই সই। বেছে বেছে স্পোর্টি লুকওয়ালা একটা হেলমেট নিলাম। এবার পাম্পার কেনার পালা। পাম্পারও অনেক ধরনের। আমরা খুঁজছি কমদামী কিন্তু ভাল সেবা দেবে, এমন কিছু। লম্বা, ছোট, মাঝারি পাম্পারের ভিড়ে কোনটা ভাল হবে, বুঝা দায়। একটা দেখলাম হাতের তেলোয় এঁটে যাচ্ছে। এত ছোট পাম্পার দিয়ে পাম্প করে কীভাবে বুঝতে পারছি না। হঠাৎ প্রিন্স আবিষ্কার করল, পাম্পারের মাথায় হ্যান্ডেল জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে। ওটা ধরে টান দিলে ভেতর থেকে লম্বা ডাণ্ডা বের হয়ে আসে। ঐ ডাণ্ডায় চাপ দিয়েই পাম্প করতে হয়। পাম্পারটা খুব পছন্দ হল। ছোট জিনিস, সহজে বহন করা যাবে। রাখলাম শপিং কার্টে। এবার তোষকের ঢাকনি কিনব।
গেলাম বিছানা বালিশের সেকশনে। এখানে এলে সবসময় আমার চোখ আটকে যায় মেইনস্টেস নামক ব্র্যান্ডের বেডিং সেটের দিকে। কী যে সুন্দর একেকটা সেট! এক সেটে থাকে চাদর, বালিশ, কুশন, কম্বল, আর বালিশের কভার। এই সেটের ব্যাপারে আগে জানতাম না। জানলে বালিশ, কম্বল আলাদাভাবে কিনতাম না। সেট কিনে ফেলতাম, এক সেটেই বাজিমাত। এখন কেনা মানে অতিরিক্ত জিনিসে ঘর বোঝাই করা, যেটা আমরা চাই না। এত জিনিস গুছাবে কে, ময়লা হলে ধুবে কে? ধোয়ার ঝামেলা যদিও এখন কমেছে কারণ বেসমেন্টে ওয়াশিং মেশিন আছে, তারপরও… মেশিনে কাপড় দিতে যাওয়াও ঝামেলা। ভাবছেন, বাঙালিরা বসতে দিলে খেতে চায়, খেতে দিলে শুতে চায়? ভুল কিছু না। তবে বিশাল ব্যাগে একমাসের কাপড় নিয়ে বেসমেন্টে যেতে বিরক্ত লাগে। এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে ডিটারজেন্ট। আবার মেশিনে কাপড় দিলেই সমস্যার শেষ নয়। ধোয়ার একটা চক্র শেষ হতে লাগে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আপনার মনে যদি ফুর্তি থাকে, আপনি মেশিনের পাশে রাখা চৌপায়াতে বসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাটাতে পারেন। একদিন দেখেছিলাম এক বুড়ো কাপড় ধুতে দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিল। কিন্তু আমাদের এরকম ধৈর্য নেই। আমরা বাসায় চলে আসি। নির্দিষ্ট সময় পর বেসমেন্টে যাই মেশিন থেকে কাপড় তুলতে। কাপড় ধুতে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাপাত্তা হয়ে যাবেন, তা হবে না। অন্যদের জন্য মেশিন খালি করতে হবে।
ধোয়ার পরের ধাপ কাপড় শুকানো। এখানে কাপড় শুকানোর জন্য ছাদে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। কেউ দড়ি টাঙিয়ে ক্লিপ মেরে কাপড় শুকায় না। হতে পারে গ্রামের দিকে এখনো এই চল আছে কিন্তু শহরে এরকম দেখিনি। দেখার আশাও করি না। শহরে মানুষ কাপড় শুকায় ড্রায়ারে। ওয়াশিং মেশিন থাকলে ড্রায়ার থাকবেই। ড্রায়ারও পঁয়তাল্লিশ মিনিট নেয়। তাই কাপড় ড্রায়ারে দিয়ে আবার বাসায় চলে আসি। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর গিয়ে শুকনো কাপড় নিয়ে আসি। এবার বুঝলেন তো, কেন যন্তর থাকার পরও কাপড় ধোয়া এত প্যাঁড়াময়? এই ধোয়া আর শুকানোর সুবিধাটা অবশ্য মাগনা নয়। আমাদের এখানে ধুতে লাগে পাঁচ কোয়ার্টার, শুকাতে পাঁচ। এক কোয়ার্টার মানে পঁচিশ সেন্ট। সেন্টকে বাংলায় পয়সা বলা যেতে পারে। ডলারের রেট যদি পঁচাশি টাকা ধরি, তাহলে এক কোয়ার্টার মানে একুশ টাকা। পাঁচ কোয়ার্টার মানে একশো পাঁচ টাকা। ধুতে-শুকাতে মোট লাগে দুইশ দশ টাকা। এই মূল্য এপার্টমেন্ট ভেদে কমবেশি হতে পারে, কিন্তু খুব একটা পার্থক্য পাবেন না। ডলারকে বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করা বহু আগেই ছেড়েছি। কিন্তু ডলারের হিসেবেও এক ডলার পঁচিশ সেন্ট দিয়ে ধোয়া, আবার এক ডলার পঁচিশ সেন্ট দিয়ে শুকানো বেশ ব্যয়বহুল লাগে। তাই মেশিন ভর্তি হওয়ার মত কাপড় জমিয়ে ধুতে যাই।
বেলাইনে চলে যাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারছি না। তোষকের কাভার কেনা দিয়ে শুরু চলে গিয়েছি কাপড় ধোয়ায়। চলুন ফিরে যাই তোষকে। টুইন, টুইন এক্সএল, ফুল, কুইন, কিং, ক্যালিফোর্নিয়া কিং আকৃতির কাভারের সম্ভার এখানে। মোড়কের গায়ে লেখা আছে কাভারটা কত ইঞ্চি লম্বা আর কত ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট। দেখে ধারণা করতে পারছি না আমাদের তোষকের সাথে মিলবে কিনা। আমাদের তোষক কিং, নাকি ক্যালিফোর্নিয়া কিং? কাভারের ইঞ্চির হিসাব দেখে তো মনে হচ্ছে তোষকটা কুইন আকৃতির। কী ঝামেলা! বুদ্ধি করে তোষকের মাপ নিয়ে আসা দরকার ছিল। তোষকটা যে কোন সাইজের, কেউ মেপে দেখিনি। কোথাও কোনো সাইজ ট্যাগও পাইনি। শুধু বিশাল দেখে ধরে নিয়েছি কিং। আদতে সেটা কুইনও হতে পারে। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে তাই কুইন সাইজের কাভারই কিনলাম। কার্ট নিয়ে কাউন্টারের দিকে যাচ্ছি, পথে পড়ল বিশাল এক টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন মানে টেলিভিশনের আস্ত প্যাকেট রাখা, আর মাথার উপর বিশাল বোর্ডে টিভির দাম লেখা। ফিলিপ্স ব্র্যান্ডের টিভি। পঁচাত্তর ইঞ্চি আকৃতির, ২১৬০ পিক্সেলের ফোর-কে রেজোলিউশনের স্মার্ট লেড টিভি। এত বড় ফোর-কে টিভি প্রথম দেখলাম বলে মনে হচ্ছে। দাম লেখা ১৬৯৮ ডলার, তাও ছাড় দেওয়ার পর। আসল দাম ২২১০ ডলার। টিভির প্রতি আগ্রহ নেই দুজনের কারো। কিন্তু এই টিভিতে বিবিসির লাইফ সিরিজ বা আর্থ সিরিজের ডকুমেন্টারিগুলো দেখতে কেমন লাগবে ভেবে জিভে জল চলে এল। কাভার তো কিনলাম, বাসায় এনে দেখি সেটা তোষকে আঁটছে না। টানাটানি করে ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম তবুও আঁটাতে পারছি না। রাগে মাথা টনটন করতে লাগল। এই কাভার বদলানোর জন্য আবার ওয়ালমার্ট যেতে হবে। ওয়ালমার্টে আসা যাওয়া করতে করতে আমরা গণ পরিবহনকে বড়লোক বানিয়ে দিচ্ছি। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো কারণে যেতে হচ্ছে। আমাদের সম্মান করে সেন্ট লুইস মেট্রোর উচিৎ বিশেষ ছাড় দেওয়া।
(২৪)
নতুন বাসায় উঠার সাথে সাথে আমাদেরকে অ্যামেরেনে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। অ্যামেরেন হল মিজৌরি আর ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ফ্ল্যাটের সাবেক বাসিন্দা মূর্তি চলে যাওয়ার সময় বলেছিল, যেদিন থেকে আমরা বাসায় উঠেছি, ঐদিন থেকে যেন হিসেব করে অ্যাকাউন্ট খুলি। আমরা উঠেছিলাম আগস্টের ঊনত্রিশ তারিখে। বেখাপ্পা একটা সময়। না মাসের শেষ, না শুরু। তবুও অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্মে ২৯ আগস্টকেই বিলিং সাইকেল শুরুর দিন হিসেবে উল্লেখ করলাম। অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আমাকে কোথাও যেতে হল না। বাসায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ সেরে ফেললাম। অ্যামেরেনের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফর্ম পূরণ করে জমা দিলাম। কিছুক্ষণ পর ইমেইলে একটা লিংক এল। লিংকে ক্লিক করার পর একটা ওয়েবপেইজে নিয়ে গেল যেখানে একটা ফোন নাম্বার দেওয়া। ঐ নাম্বারে কল করে আমার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। মনে হচ্ছে অ্যামেরেনের কাস্টোমার কেয়ার। দিলাম কল। এক সুকণ্ঠী মহিলা কল ধরলেন। বললাম কাহিনী। উনি বললেন, ‘তথাস্তু। আপনাকে এখনই নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছি। তবে জানিয়ে রাখি, নিরাপত্তার খাতিরে আমরা আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে একশো পঞ্চাশ ডলার কেটে রাখব। একেবারে কাটব না, পঞ্চাশ ডলার করে তিন কিস্তিতে কাটব। প্রথম তিন মাসের বিলের সাথে বাড়তি পঞ্চাশ ডলার করে যোগ হবে। রাজি আছেন?” ভয় পেয়ে গেলাম। একশো পঞ্চাশ ডলার কি ফাউল দিতে হবে, নাকি ফেরত পাব আবার? জিজ্ঞেস করায় মহিলা বললেন, লাইন বিচ্ছিন্ন করলে এই ডলার ফেরত দেওয়া হবে। তবে মাসিক বিল দিতে যদি গড়িমসি করি, তারা সেফটি ডিপোজিট থেকে জরিমানা করবেন। আর যদি লক্ষ্মী গ্রাহক হয়ে থাকি, তাহলে পুরো ডলার ফেরত পাব। যদি টানা এক বছর অ্যামেরেনের সদস্য হিসেবে কাটাই, তাহলে চার শতাংশ হারে সুদসহ ডলার ফেরত পাব। একশো পঞ্চাশ ডলারের সাথে ফেরত আসবে ছয় ডলার। খারাপ কী? কবুল বলার পর সুকণ্ঠী বললেন, ‘অভিনন্দন। আপনি এখন থেকে অ্যামেরেনের সদস্য।’
সদস্য হওয়ার ছয়দিনের মাথায় পয়লা বিল চলে এল। পঁচাত্তর ডলার পনেরো সেন্ট। বিল দেখে আমার মাথায় হাত। পঞ্চাশ ডলার সিকিউরিটি ফি মানি, কিন্তু বাকি পঁচিশ ডলার? আটদিনে পঁচিশ ডলারের বিদ্যুৎ খরচ করে ফেলেছি? এ তো মগের মুল্লুকের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। মাথা গরম করে মোবাইল হাতে নিলাম। সুকণ্ঠীকে কল দেব। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এ কি কাণ্ড? তারপর খেয়াল হল, ওদের ওয়েবসাইট যাচাই করা দরকার। হয়ত আমার প্রশ্নের উত্তর ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। গিয়ে দেখি, ঠিক। বেশ কিছু নিয়ম কানুন লেখা যেগুলো আগে দেখিনি। যেমন, প্রতি মাসে গ্রাহক ফি হিসেবে নয় ডলার কাটবেই। বিদ্যুৎ ব্যবহার করুন আর নাই করুন, বাসায় সংযোগ থাকলে নয় ডলার দিতে হবে। আবার জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল বলে এ চারমাসে প্রতি কিলোওয়াটে চার্জ বেড়ে যায়। এই চার্জ আবার পিক, অফপিক আওয়ার ভেদে ভিন্ন। পিক আওয়ার হল দুপুর দুইটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত। এসময় কিলোওয়াট প্রতি ৩১.৫ সেন্ট খরচ হয়। আর সন্ধ্যে সাতটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হল অফপিক আওয়ার। এসময় কিলোওয়াট প্রতি চার্জ ধরা হয় ৭.৮৭ সেন্ট। শীতকালের হিসেব অন্য। তখন পিক আর অফপিক আওয়ার বলে কিছু নেই। মাসের প্রথম ৭৫০ কিলোওয়াটের জন্য কিলোওয়াট প্রতি খরচ হয় ৮.৭৬ সেন্ট, আর ৭৫০ কিলোওয়াটের বেশি খরচ করলে তখন কিলোওয়াট প্রতি খরচ ধরা হয় ৬ সেন্ট।
পড়াশোনা করে বুঝতে পারলাম কেন আমাদের পঁচিশ ডলার বিল এসেছে। পঁচিশের মধ্যে নয় ডলার হল সংযোগ ফি, বাকি ষোল ডলার হল প্রকৃত বিল। ষোল ডলার বিল উঠার মত অনেক কিছুই করেছি গত আটদিনে। সবচেয়ে মারাত্মক হল, পিক আওয়ারে ধুমসে রান্না করেছি আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রক ছেড়ে রেখেছি। তবে মানুষ মাত্রই ভুল। বুদ্ধিমানেরা সে ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। আমরা দুই বুদ্ধিমান শিখে গেলাম কীভাবে বিদ্যুৎ খরচ কমাতে হবে। পিক আওয়ারে রান্না করা যাবে না, এবং বাসায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রক থাকলেই সেটা ছেড়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরা যাবে না।
এরপরের কাজ হল ব্রডব্যান্ড সংযোগ নেওয়া। মূর্তি আগেই পরামর্শ দিয়ে রেখেছিল স্পেকট্রাম নামের কোম্পানি থেকে সংযোগ নিতে। এটা নাকি সেন্ট লুইসের সবচেয়ে ভাল ইন্টারনেট সেবাদানকারী কোম্পানি। কম খরচে ভাল গতি। কয়দিন ধরেই ভাবছি কল দিয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করব কিন্তু ভার্সিটিতে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে হয়ে উঠছে না। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ মনে হল, অনেক হয়েছে। নেট ছাড়া আর থাকা যাচ্ছে না। মোবাইলের নেট দিয়ে কতক্ষণ ব্রাউজ করা যায়? তার উপর ল্যাপটপ কিনে ফেলে রেখেছি, নেটের অভাবে কিবোর্ডে ঝড় তুলতে পারছি না। তাই প্রিন্সকে বললাম সকালের দিকে স্পেকট্রামের অফিসে কল দিয়ে কোন প্যাকেজের কী সুবিধা জেনে নিতে। মূর্তি আমাদের প্যাকেজ সম্পর্কেও বলে রেখেছিল। পঞ্চাশ ডলারের যে প্যাকেজ আছে, সেটা নিতে বলেছিল। এটায় ২০০ এমবিপিএস গতি পাওয়া যাবে। পরিকল্পনামাফিক আমি যখন ভার্সিটিতে গেলাম, প্রিন্স ওদের কল দিল। আমি ক্লাস করে বের হচ্ছি, এমন সময় প্রিন্স কল করে বলল ডেবিট কার্ড যেহেতু আমার নামে তাই আমার সাথে ওরা সরাসরি কথা বলে অর্ডার নিশ্চিত করতে চায়। কল দিলাম স্পেকট্রামে। এক মহিলা ধরল। যখন ঘটনা খুলে বললাম, সে উত্তর দিল, ‘তোমাদের অর্ডার তো কনফার্ম হয়ে গেছে! আমাদের সার্ভারে দেখাচ্ছে তোমার কার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।’ যাচ্চলে! কোথা থেকে কী হয়ে গেল? কবে থেকে সংযোগ পাব জানতে চাইলাম। মহিলা বলল, তারা লোক পাঠিয়ে লাইন, রাউটার আর মডেম সেট করে দিবে। এরপরই ইন্টারনেট পেয়ে যাব। মূর্তি এটার ব্যাপারেও সাবধান করে দিয়েছিল। কোম্পানি থেকে লোক পাঠালে বাড়তি কতগুলো ডলার খরচা যাবে। এরচেয়ে কুরিয়ারে ওরা রাউটার আর মডেম পাঠিয়ে দিলে নির্দেশনা দেখে আমরাই সেট করে নিতে পারব। মূর্তি যাওয়ার সময় তার টার কিছু সরায়নি, শুধু রাউটার আর মডেম খুলে নিয়ে গেছে। তাই ঝুলতে থাকা তারের সাথে নতুন রাউটার, মডেম লাগিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। মহিলাকে বললাম, ‘লোক পাঠানোর দরকার নেই। তুমি শুধু রাউটার আর মডেম পাঠিয়ে দাও।’ মহিলা জানাল, কোয়ি বাত নেহি। এখনই সে কাজে নেমে পড়ছে। আমার কার্ড থেকে একশ দশ ডলার চার্জ কাটার পর যখন সেটা তাদের সার্ভারে আপডেটেড হবে, তখন আমার ঠিকানায় রাউটার আর মডেম চলে যাবে।
মাথা ঘুরান্টি দিয়ে উঠল। একশো দশ ডলার? বলে কী! ভার্সিটির লবিতে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম। ‘কী বল? একশ দশ ডলার কেন চার্জ কাটবে?’ মহিলা সান্ত্বনা দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘আমরা রাউটার আর মডেম পাঠানোর জন্য বাড়তি দশ ডলার চার্জ রাখি।’ আমি অবাক। দশ ডলার চার্জ কাটলে বিল আসার কথা ষাট ডলার। একশ দশ কেন? এবার মহিলা অবাক। ‘তুমি প্যাকেজ নিয়েছ নিরানব্বই ডলারের। এর সাথে দশ ডলার যোগ করলে একশ দশ হয়।’ আমি দ্বিগুণ অবাক। ‘নিরানব্বই ডলারের প্যাকেজ কবে নিলাম? আমি নিয়েছি পঞ্চাশ ডলারের প্যাকেজ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমার হাজবেন্ড পঞ্চাশ ডলারের প্যাকেজ সম্পর্কে জানতে চাইল, তোমরা বললে আমাকে কল করতে। আমি কল করলাম, বললে প্যাকেজ নাকি কনফার্ম। এখন বলছ নিরানব্বই ডলারের প্যাকেজ কনফার্ম করেছ অথচ সেটার কথা আমরা কেউ বলিইনি।’ মহিলা খটাখট টাইপ করে যাচ্ছে কিবোর্ডে, শুনতে পাচ্ছি। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘দুঃখিত, তোমাদের সাথে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমরা ভেবেছি তোমরা টেলিভিশন, ইন্টারনেট আর ল্যান্ডফোনের মিলিত প্যাকেজ নিতে চাচ্ছ। ওটার মূল্য নিরানব্বই ডলার।’ আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি ধৈর্য ধরে রাখার। বললাম, ‘আমার বাসায় টিভিও নেই, ল্যান্ডফোনও নেই। আছে খালি ল্যাপটপ। আমি শুধু ইন্টারনেটের প্যাকেজ চাই।’ মহিলা দ্বিতীয়বার নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইল, ‘তার মানে তুমি নিরানব্বই ডলারের প্যাকেজ বাতিল করে পঞ্চাশ ডলারের প্যাকেজ নিতে চাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। মেহেরবানী করে তাড়াতাড়ি বদলে দাও।’
কিছুক্ষণের ভেতর পঞ্চাশ ডলারের প্যাকেজের কনফার্মেশন চলে এল। আগামী তিনদিনের মধ্যে তারা ফেডেক্সের মাধ্যমে রাউটার, মডেম পাঠিয়ে দেবে। পৌঁছাতে হয়ত দুইদিন লাগবে। বড় করে একটা শ্বাস ফেললাম। সব ঝামেলা কি আমাদের ঘাড়েই এসে পড়ে?
পর্ব এগারো এখানে