পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো
(২৯)
আজ খুব ফাস্ট ফুড খেতে মন চাচ্ছে। আমেরিকায় ফাস্ট ফুড বাংলাদেশের মত সস্তা নয়। দেশে যেমন পঞ্চাশ টাকায় একটা ছোটমোটো বার্গার কেনা যেত, এখানে সবচেয়ে সস্তা বার্গারটা কিনতে হলেও গুনতে হবে কমপক্ষে তিন ডলার। তবে দেশের সাথে তুলনা দিয়ে আমেরিকায় চলা যায় না, সত্য। গুণীজনেরা বলেন, ডলারে কামাই, ডলারে খরচ। ডলারে কামাই করে টাকায় খরচ করতে গেলে জীবন নরক হয়ে যাবে। তবে খরচের হিসেব ডলারে করলেও ফাস্ট ফুডের দাম আমাদের কাছে বেশিই লাগে। তাই পারতপক্ষে বাইরে খেতে চাই না। কিন্তু আজ দুজনেরই খুব হাবিজাবি খেতে ইচ্ছে করছে। আর সস্তার মধ্যে একটা রেস্তোরাঁ আমরা খুঁজে পেয়েছি, যার নাম ‘জ্যাক ইন দা বক্স’। এখানকার খাবারের স্বাদও অন্যান্য ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁর চেয়ে ভাল লেগেছে। বার্গারে যে গরুর মাংসের পেটিসটা দেয়, সেটা দারুণ রসালো হয়। এদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইটাও দারুণ। ফাইভ গাইস নামের আরেকটা দোকানের ফ্রাই খেয়ে দেখেছিলাম। আকারের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। একটা আইফেল টাওয়ার তো আরেকটা কুতুব মিনার। সাথে তেল চুপচুপে। তাই জ্যাক ইন দা বক্সেই আবার আসার জন্য প্রস্তুত হলাম।
প্রতিদিন এক রাস্তা ধরে যাতায়াত করতে ভাল লাগে না। তাই আজ মূল রাস্তা না ধরে ভেতরের অলিগলি দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে দোকানে যাচ্ছি। আমি চালাচ্ছি আমার রোড মাস্টার সাইকেল, প্রিন্স চালাচ্ছে লাইম বাইক। এটা একটা মজার জিনিস। সেন্ট লুইসে এসেই লাইম বাইকের সাথে পরিচয়। শাওন ভাই খোঁজ দিয়েছিলেন এটার। বলেছিলেন, এখানকার ফুটপাথে লাইম বাইক আর লাইম স্কুটার নামে দুই ধরনের যান দেখা যায়। বাইক হল প্যাডেল মারা বাইসাইকেল, আর স্কুটার হল ব্যাটারি চালিত যান। প্লে স্টোর থেকে অ্যাপ নামিয়ে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড দিয়ে রেজিস্টার করে ফেললে চালানো যাবে। এই কথা শোনার পর থেকে আমরা প্রতিদিন হাঁটতে বের হলে লাইম বাইক খুঁজতাম। একদিন সত্যি পেয়ে গেলাম সবুজ আর লেবু রঙের একটা দ্বিচক্রযান। গায়ে লেখা ‘লাইম’। বুঝলাম এটাই সেই কাঙ্ক্ষিত পঙ্খীরাজ। মোবাইলে যে অ্যাপ নামিয়েছি সেটা চালু করে বাইকের গায়ে সাঁটানো বারকোডের উপর ধরতে হয়। কোড রিড হলে বাইকের স্বয়ংক্রিয় তালা খুলে যায় আর বাইক চালানো সম্ভব হয়। আনলক করতে লাগে এক ডলার আর প্রতি মিনিটে পাঁচ সেন্ট করে কাটতে থাকে ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড থেকে। আমরা প্রায়ই লাইম বাইক আর রোডমাস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। অলিগলি ঘুরি, মজা লাগে।
এখানকার আবাসিক এলাকা বা পাড়াগুলো খুব গোছানো। ছিমছাম, কোলাহল নেই। রাস্তা সবসময় পরিষ্কার করা হয় বলে পাতা পড়ে থাকে না। কেউ এখানে সেখানে থুথু, চুইংগাম ফেলে না, গেরস্থালী ময়লা তো দূরের কথা। প্রতিটা বাসার সামনে দুটো করে ট্র্যাশ ক্যান রাখা, একটা পচনশীল দ্রব্যের জন্য, আরেকটা রিসাইক্লেবল দ্রব্যের জন্য। এই ট্র্যাশ ক্যানও দেখার মত জিনিস। বিশাল আকারের ডাস্টবিন, কিন্তু ডাস্টবিনের গায়ে কোনো ময়লা লেগে নেই। লেগে নেই কারণ আপনি ময়লা সরাসরি এটার ভিতর ফেলতে পারবেন না। ময়লা প্রথমে প্লাস্টিকের থলিতে ঢুকিয়ে, থলি গিট্টু মেরে তারপর ক্যানে ফেলতে হবে। সপ্তাহে একদিন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আসেন বিশাল গার্বেজ ট্রাক নিয়ে। সেটা ক্রেনের মত কাজ করে। আংটার মধ্যে করে ক্যানকে তুলে ধরে নিজের পেটে ময়লা ঢেলে আবার যথাস্থানে ক্যানটা রেখে দেয়। যারা গার্বেজ ট্রাকের ক্রিয়াকলাপ দেখতে চান, তারা এই ইউটিউব লিংকে গিয়ে দেখতে পারেন।
পুরো ব্যাপারটা আমার জন্য বিস্ময়কর ছিল। কী পরিপাটি সব নিয়ম! তবে এ শহরে যে নোংরা জায়গা নেই, তা নয়। অবশ্যই আছে। স্বল্পশিক্ষিত আফ্রিকান-আমেরিকান পাড়ায় গেলে আপনি স্বর্গ থেকে ভূপতিত হবেন। ফুটপাথে ময়লা ছড়ানো, ডাস্টবিন উপচে পড়ছে ময়লায়। যা হোক, শান্ত, ছবির মত সুন্দর পাড়াগুলোয় ঢুকলে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এসব বাসায় কি বাচ্চাকাচ্চা নেই? থাকলে বাচ্চারা কি খেলতে বের হয় না? কোথাও তো দেখি না ওদের! দেশে যেমন বাসাবাড়ির সামনে খোলা জায়গা থাকত, আমরা সেখানে বউচি, কানামাছি, কুমির ডাঙা, এক্কা দোক্কা, ছোঁয়াছুঁয়ি, বরফ পানি, এলোনা বেলোনা, ফুল টোক্কা খেলতাম, এখানে কি এমন হয় না? পোলাপান বাসার সামনে খেলে না? ভাবতে ভাবতে চলে এলাম একটা ছোট পাঠাগারের সামনে। এটা কোনো দালান নয়, ফুটপাথের পাশে ঘাসের লনে তৈরি করা ছোট্ট একটা ঘর। ছোট হলেও সে বহন করছে অতি শক্তিশালী একটা অনুরোধ ‘পড়ুন’। বিস্ময়ে আমার চোখ ছানাবড়া। এরকম কিছু দেখব, ভাবিনি। পথচারীরা এখান থেকে বই ধার করতে পারে, অন্যদের পড়ার জন্য নিজের বই রেখেও যেতে পারে। আমি যখন এটার সামনে এসেছি, তখন এটা খা খা করছে। সব বই নিয়ে গেছে পড়ুয়ারা। প্রচণ্ড ভালোলাগায় মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সত্যিই তো। না পড়লে জানবেন কোথা থেকে? বুদ্ধি শানানোর জন্য, নতুনভাবে চিন্তা করার জন্য, মুক্তবুদ্ধি জাগানোর জন্য পড়ার বিকল্প নেই। ঠিক করলাম, পরের সপ্তাহে আরেকবার ঢুঁ মারব। যদি কেউ বই দিয়ে যায়!
মোটামুটি আধা ঘণ্টার বাইসাইকেল ভ্রমণ শেষে জ্যাক ইন দা বক্সে উপস্থিত হলাম। এখান থেকে আগে বার্গার খেয়েছি বলে ঠিক করলাম আজ অন্য মেনু নেব। দেশে থাকতে টেরিয়াকি চিকেন, সুশি, প্যাড থাইয়ের নাম খুব শুনতাম। বনানীর অফিস থেকে কালাচাঁদপুরের বাসায় আসার সময় গুলশানের অলিগলি দিয়ে রিকশা চলত। সেখানকার রাস্তাগুলো ভর্তি ছিল বড়লোকি সব রেস্তোরাঁ দিয়ে। টেরিয়াকি, সুশি ছিল এসব রেস্তোরাঁর মেনু। এসব জায়গায় ঢুকে বিশাল টাকা গচ্চা দিয়ে ওগুলো খাওয়ার সাহস হত না। প্রিন্সের সাথে বসে পরিকল্পনা করতাম, যুক্তরাষ্ট্রে এসে এগুলোর স্বাদ লেহন করব। আমাদের দুজনের সব অপূর্ণতা ‘আমেরিকায় গিয়ে পূরণ করব’ বলে সান্ত্বনা নিতাম অথচ আমেরিকায় আসার কোনো নামগন্ধ ছিল না। ধরেই নিয়েছিলাম গত চার বছরের মত এ বছরও ব্যর্থ হবে। ফান্ডসহ অ্যাডমিশন হবে না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। হতাশ হয়ে থাকতাম প্রায়। প্রিন্স চেষ্টা করত চাঙা করতে। ওর জন্যই পুরোপুরি হতাশায় ডুবে যাইনি। ‘আমেরিকায় গেলে এই স্বপ্ন পূরণ হবে, ঐ স্বপ্ন পূরণ হবে’ বলে আমার ভিতরে আমেরিকায় পড়তে আসার ইচ্ছেটা জিইয়ে রাখত ও। এটাই ছিল আমাদের যাবতীয় না পাওয়ার হতাশা থেকে মুক্তির আশ্বাস। আর দেখুন, দেশে থাকতে যে জিনিস আমাদের নাগালের বাইরে ছিল, আমেরিকায় এসে সেটা হয়ে গেছে বাম হাতের খেল। রঙে ভরা দুনিয়া।
অর্ডার করলাম টেরিয়াকি চিকেন আর মুরগির পাখনা ভাজা। পাখনা অর্ডার করতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে গেলাম। ঢাকার গুলশান দুই চত্বরের বিএফসি কর্মী আমাদের চিনে ফেলেছিল। গেলেই হাসি দিত পরিচিতজনের মত। দুই সপ্তাহ পর পর আমরা বিএফসি থেকে মুরগি ভাজার সবচেয়ে বড় বাকেটটা কিনতাম। শেষদিকে আলসার প্রচণ্ড পরিমাণে বাড়ায় প্রতি মাসে একবার খাওয়া পড়ত। আরও অনেক জায়গা থেকে চিকেন ফ্রাই খেয়েছি। কিন্তু বিএফসিকে কেউ টেক্কা মারতে পারেনি। কী কেএফসি, কী এফএফসি। জ্যাক ইন দা বক্সও পারল না। চিকেন ফ্রাইকে সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করেছে যে কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন, সেও পারেনি। এখন পর্যন্ত আমার খাওয়া সবচেয়ে জঘন্য চিকেন ফ্রাই ছিল গ্র্যান্ড বুলেভার্দের কেএফসি থেকে কেনা আইটেমটা। স্বয়ং স্যান্ডার্স চাচার দোকানের মুরগি ভাজার যদি এই নমুনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের কেএফসির দোষ দিয়ে লাভ কী? টেরিয়াকি চিকেনও তেমন জাতের লাগল না। যে টেরিয়াকি সসের এত সুনাম, সেটার স্বাদ লাগল পুড়ে যাওয়া চিনির মত। পুডিং বানানোর সময় চিনি গলিয়ে যে টপিং দেওয়া হয়, সেটার মত। হতে পারে এটা আমার জিহ্বার দোষ। নতুন খাবার প্রথম চাখার বেলায় ভাল নাও লাগতে পারে। কিন্তু খেতে খেতে সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে খুব ভাল লাগে। মেনু চেখে আমরা ঠিক করলাম, বার্গারই সই। কুকুরের পেটে যেমন ঘি সয় না, আমাদের পেটেও অচেনা খাবার সইবে না।
পরদিন বিকেলে মন চাইল পাড়া ঘুরতে। প্রতিদিন বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে থাকি। বের হওয়া হয় না কোথাও। কিন্তু কাহাতক এই চক্রের মধ্যে আটকে থাকা যায়? তাই হুট করে বেরিয়ে পড়লাম। সেন্ট লুইস শহরে পা দিয়েছি মাস দুই হল অথচ নিজেদের পাড়াই ঘোরা হয়নি। আমাদের এপার্টমেন্ট থেকে এক ব্লক দূরে ইউক্লিড এভেনিউ। ভীষণ জমজমাট! বিকেলে জমকালো ভাব আরও বাড়ে। সেন্ট লুইসের দুটো জমজমাট পাড়া হল ইউক্লিড এভেনিউ আর ডেলমার বুলেভার্দ। ডেলমারটা একটু দূরে। যেতে হলে বাস ধরতে হবে বা সাইকেল চালাতে হবে। হেঁটেও যাওয়া যায়, সময় লাগবে ঘণ্টা খানেক। তাই কাছের ইউক্লিডে যাওয়াই স্থির করলাম। এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে দেখি সূর্যের আলোয় চারদিক আলোকিত। গরমকাল বলে ছয়টার দিকেও দুপুরের রোদের মত আলো, তবে কড়া নয়। আলো গায়ে মাখতে মাখতে চলে গেলাম ইউক্লিডে।
আমরা যে বুলেভার্দে থাকি, তাকে আড়াআড়িভাবে ছেদ করে ইউক্লিড এভেনিউ চলে গেছে। ফলে তৈরি হয়েছে একটা চৌরাস্তার মোড়। ছোটবেলায় চৌরাস্তার মোড় বলতে জয়দেবপুর চৌরাস্তা বুঝতাম যেখানে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্যটা অবস্থিত। দুনিয়াতে আরও চৌরাস্তা আছে, সেটা ভাবা অসম্ভব ছিল। বড় হয়ে যখন সমাস পড়লাম, জানলাম চার রাস্তার সমাহারকে চৌরাস্তা বলে এবং দুনিয়ায় কোটি কোটি চৌরাস্তা বিদ্যমান। বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম ছোটবেলার ফ্যান্টাসিকে ধাক্কা খেতে দেখে। আপনারা যারা এভেনিউ, বুলেভার্দ, স্ট্রিট, লেন, কোর্ট, প্লাযা ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য জানতে চান, তারা ঘুরে আসতে পারেন সহজ এই ভিডিও থেকে।
চৌরাস্তার একদম মোড়ে সেন্ট লুইস গণ গ্রন্থাগারের একটা শাখা আছে। শাখাটি Schlafly শাখা নামে পরিচিত। বলুন তো, এই শব্দের উচ্চারণ কী হবে? আমি গুগল না ঘেঁটে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। যা ভেবেছি, ঠিক হয়েছে (ইঙ্গিতঃ শব্দটা জার্মান উচ্চারণ রীতি অনুসরণ করেছে)। গ্রন্থাগারটা রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে। হাতে সময় আছে দেখে ভেতরে ঢুকলাম। বেশি বড় নয় তবে সুন্দর, ছিমছাম পরিবেশ। শিশু, তরুণ, বুড়ো, সব বয়সী পাঠকই এসেছে পড়তে। পাঠকদের জন্য কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ আছে। আছে শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার। ভাড়া নেওয়ার জন্য ভিডিও এবং অডিও সিডির সেকশনও আছে। সেখানে একটা ডিভিডি দেখে চক্ষু চড়কগাছ! হিন্দি আইটেম সংয়ের সংকলন। কিন্তু এখন কি এসব কেউ ব্যবহার করে? টরেন্ট থেকে মুভি, সিরিজ নামানো জনপ্রিয় হওয়ার পর ডিভিডি ব্যবসায় ধ্বস নামতে দেখলাম। এরপর ফ্রি স্ট্রিমিং সাইট, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ইত্যাদির সৌজন্যে সিডি ব্যবসা যাদুঘরে চলে গেল। মনে পড়ে ২০০৬-০৭ সালের দিকে দেশে ভিডিও সিডির বিপ্লব বয়ে গিয়েছিল। তখন হোস্টেলে থাকতাম। প্রতি বুধবার দুপুরে অনুমতি পেতাম সিডি ভাড়া করে নিয়ে আসার। সে সময় জিত ছিল উঠতি নায়ক। ‘সাথী’ সিনেমা করে সব মেয়ের ক্রাশে পরিণত হয়েছিল। সাথীর পর এল সঙ্গী। জিতের ভোলাভালা চেহারা দেখে মেয়েরা ধপাধপ প্রেমে পড়ে গেল। আমার ওকে লাগত হাবলু ধরনের। চেহারা সুন্দর কিন্তু ভাবসাব গাধা টাইপ। ওর থেকে আমার দেবকে জটিল লাগত। যখন জিত ওর ক্যাবলা চরিত্র থেকে বেরিয়ে এল, তখন আমি পল্টি মেরে দেব থেকে জিতে চলে গেলাম। যা হোক, একনাগাড়ে অনেকগুলো জিত আর দেব গিলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। একদিন নিয়ে এলাম ‘মাই ব্লাডি ভ্যালেন্টাইন’ মুভিটা। এটা আমি আগেই দেখেছিলাম বাসায় থাকতে। এবার সবাইকে নিয়ে নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখব। যখন ঐসব দৃশ্য এল, আমরা সবাই টেলিভিশন ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হোস্টেল ইনচার্জ এলে যেন দেখতে না পান আমরা কী দেখছি। হায়! সেসব কী দিন ছিল।
পাঠাগারের বইগুলো নন-ফিকশন, ফিকশন ইত্যাদি সেকশনে ভাগ করে রাখা। আমরা সবগুলো সেকশন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। হ্যারি পটারের বই পেলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা। কিন্তু ফিকশন অংশে ওগুলো পেলাম না। বাচ্চাদের অংশে পাওয়া যাবে হয়ত। কিন্তু আজ আর সময় নেই খোঁজার। তাছাড়া ভার্সিটি থেকে অনেক বই ইসু করে এনেছি। গুডউইল থেকেও এক ডলার দিয়ে বই কিনে কিনে শেলফ ভরে ফেলেছি। এ মুহূর্তে আর বই নেওয়ার দরকার নেই। তার উপর বই ইসু করতে গেলে আমাকে পাঠাগারের সদস্য হতে হবে, ফি দিতে হবে ইত্যকার ঝামেলা। এই মুহূর্তে যেহেতু বই ইসু করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই বের হয়ে এলাম। বই দেখলে ঢুঁ না মেরে শান্তি পাই না বলে এখানে ঢুকা। বই দেখা শেষ, এখন শান্তিমত পুরো এলাকা ঘুরব।
লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করলাম ফুটপাথ ধরে। একটু পরই শুরু হল জাঁকালো এলাকা। পাশাপাশি অনেক রেস্তোরাঁ দাঁড়ানো। মেক্সিকান, লেবানিজ, থাই, চাইনিজ, আমেরিকান, প্রাচ্যদেশীয়। হুক্কা বারও দেখলাম একটা। আছে পানশালা, আইসক্রিমের বিশাল দোকান, ইন্টেরিয়র ডেকরেশনের ছোট্ট দোকান ইত্যাদি। সব রেস্তোরাঁয়ই মানুষের ভিড় তবে মেক্সিকানটা বোধহয় একটু বেশি জনপ্রিয়। রেস্তোরাঁর বাইরের অংশটা ‘কোকো’ সিনেমার মত রঙচঙে করে সাজানো, একটা কংকাল ঝুলানো, আর বাজছে লাইভ মিউজিক। এই এভেনিউ ধরে বাসে করে ওয়ালমার্টে যাওয়ার সময় একটা বুকশপ দেখেছিলাম। দরজার সামনে একটা বোর্ডে লিখে রেখেছিল ‘এক ডলারে পুরনো বই’। বাসে থাকায় ঠিকমত বুঝিনি দোকানের নাম কী, বা কোন জায়গায় ছিল। শুধু এটুকু মনে আছে, জায়গাটা ছিল একটা চৌরাস্তার মোড়। প্রিন্সও আমার মত বই পাগলা। তাই বইয়ের দোকান খোঁজা, সেখানে ঘুরে বেড়ানো ওর জন্যও মজার ব্যাপার। দুজনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে একটু পর পেয়ে গেলাম দোকানটা। নাম ‘লেফট ব্যাংক বুকস’। দোকানের বাইরে একটা শেলফ রাখা যেখানে অনেকগুলো বই আছে, আর শেলফের পাশে রাখা বোর্ড। এই বোর্ডেই লেখা পেপারব্যাকের দাম এক ডলার আর হার্ডকভারের দাম দুই ডলার। কোনো বই পছন্দ হল না। দোকানের ভেতরে কেমন বই আছে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকলাম। দোকানের জানালায় পোস্টার সাঁটিয়ে রেখেছে ‘আজ বইয়ের লেখক এসেছেন এখানে’। এই ফাঁকে লেখককেও দেখে আসা যাবে।
ঢুকতেই সামনে পড়ল একটা শেলফ যেখানে বিভিন্ন লেখকের স্বাক্ষর সম্বলিত বিভিন্ন বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাশের কক্ষে একজন লেখক তার বইয়ের পরিচিতি দিচ্ছেন, অনেক দর্শক বসে বসে দেখছেন। আমরা দুজন ওখানে না গিয়ে দোকান ঘুরা শুরু করলাম। দোকানটা দুই তলা। মাটির নিচের তলায় দুটো সেকশন আছে, ব্যবহৃত পুরনো বই এবং শিশুতোষ সাহিত্য। একতলায় আছে প্রাপ্তবয়স্কদের বই এবং নতুন বইয়ের সেকশন। আমাদের যেহেতু বাজেট কম তাই পুরনো বইয়ের ভাণ্ডারে গেলাম। শিল্পকলা, ইতিহাস, জীবনীর উপর দারুণ সব বই। বেশিরভাগ বই সচিত্র এবং পেট মোটা, তবে পুরনো বই হিসেবে দাম একটু বেশি। মূল দামের থেকে অনেক কম দাম, কিন্তু আমাদের বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি। গুডউইল থেকে এক ডলার দিয়ে বই কিনতে কিনতে এখন দুই ডলার দেখলেও বেশি দাম লাগে। কেনার নিয়তে ঢুকলেও কেনা আর হল না। চক্ষের তৃষ্ণা মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। ব্যাক টু দা প্যাভিলিয়ন করতে হবে। ফিরতে ফিরতে ঠিক করলাম পরেরবার এলে মেক্সিকান আর থাই কুইজিন চেখে দেখব।
(৩০)
আমার সুপারভাইজার ডাঁটাশাক নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক। এজন্য তিনি ডিপার্টমেন্টের বাগানে ডাঁটা গাছ বুনেছেন। সেখানে সুন্দর ফলনও হয়েছে। উনার সাথে কাজ করতে গিয়ে জানলাম ডাঁটা শাকের মোটামুটি ষাটটি প্রজাতি খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে আমরা যেসব প্রজাতির ডাঁটাশাক খাই, সেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম জানতে পারলে ভাল হত। আমি শুধু চেহারা চিনি। প্রফেসর যেটা বুনেছেন সেটা নাকি উনার আদি নিবাস জ্যামাইকার অন্যতম জনপ্রিয় খাদ্য। দেখে মনে হচ্ছে এই প্রজাতি আমাদের দেশেও জনপ্রিয়। ভারতীয় একজন ব্যক্তি প্রফেসরকে ভারতীয় খানা হিসেবে পুঁইশাক উপহার দিয়েছিল। উনি সেটারও বীজ লাগিয়ে বসে আছেন। ছোট ছোট চারা গজিয়েছে। আমেরিকানদের মধ্যে বাগান প্রীতি প্রবল। সুযোগ পেলেই এরা বাসার পেছনে সবজি চাষ করে, ফুলের গাছ লাগায়। যারা এপার্টমেন্টে থাকে, তারা ছোট টবে বীজ বুনে ঘরের ভেতরে আবাদ করে। আমার ক্লাসমেট মলি এভাবে গাজর ফলিয়েছে। গাজরগুলো স্বাভাবিক আকারে না বেড়ে বেঁটে হয়ে রয়েছে কিন্তু তাতে ওর থোড়াই কেয়ার। বেঁটে গাজর দিয়ে নাস্তা করে মলির সে কী আনন্দ! প্রফেসরও তেমনি বাগান ভর্তি করে বেগুনী, লাল, সবুজ আর কমলা রঙের বেল পিপার (আমরা যাকে ক্যাপ্সিকাম বলি) গাছ লাগিয়েছেন। ফল ধরে গাছ একেবারে নুইয়ে পড়েছে।
গর্বিত প্রফেসর আমাকে বললেন ইচ্ছেমত পিপার নিতে, যদি খেতে মন চায়। আমরা পিপার দিয়ে পাস্তা বা ফ্রায়েড রাইস বানাই। সবজির মত তো আর তরকারি রেঁধে, ভাজি করে খাই না। তাই বললাম, পিপারের বদলে ডাঁটাশাক নেওয়া যাবে কিনা। প্রফেসর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশেও আমরা এসব শাক খাই? বললাম, খাই মানে? এগুলোর উৎপত্তি তো ভারতীয় উপমহাদেশেই! উনি জানতে চাইলেন অ্যামারান্থের পাতা, কাণ্ড আর বীজের মধ্যে কোন অংশ আমরা খাই। বললাম, পাতা আর কাণ্ড। উনি আফসোস করে বললেন, জ্যামাইকা-সহ আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় পাতাটাই খাওয়া হয়। কাণ্ড কেউ খায় না। অথচ কাণ্ডেও প্রচুর ভিটামিন আর খনিজ লবণ আছে। সুযোগ বুঝে আমি ঝেড়ে দিলাম, ‘তুমি যাকে অ্যামারান্থ বলছ, সেটার বাংলা নাম ডাঁটাশাক। মানে এই শাকের প্রধান অংশই ডাঁটা। আমরা ডাঁটা খাওয়ার জন্য শাকটা কিনি। পাতাটা বাহুল্য। যার মন চায় খায়, যার মন চায় না ফেলে দেয়।’ এই ডায়ালগ মারার সময় জানতাম না ডাঁটাশাকের পাতাপ্রধান আর ডাঁটাপ্রধান প্রজাতি আছে। যেটা পাতাপ্রধান, সেটার ডাঁটাগুলো খাওয়ার জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয়, পাতাগুলোই মূল খাদ্য। আমার ডাঁটাশাকের কাহিনী শুনে প্রফেসর একগাদা ডাঁটাশাক কেটে দিলেন। নাচতে নাচতে সেগুলো বাসায় নিয়ে এলাম। এই প্রথম আমেরিকায় এসে শাক খাব। রান্না করতে গিয়ে দেখি ডাঁটাগুলো প্রচণ্ড শক্ত আর মোটা। খাওয়ার যোগ্য নয়। অথচ পাতাগুলো বড় বড়, সরেস। বুঝলাম এটা পাতাপ্রধান ডাঁটাশাক।
আজই প্রথম বাইসাইকেল চালিয়ে বাসা থেকে দেড় মাইল দূরে নর্থ ক্যাম্পাসে এসেছি। এটা ট্রায়াল। ট্রায়ালে পাশ করলে প্রতিদিন আসব। গন্তব্যে এসে বুঝলাম পাশ করেছি, কিন্তু পুরো শরীর জুড়ে ব্যথা। এলাকাটা এমন উঁচু নিচু যে, দম ফুরিয়ে যায় সাইকেল চালিয়ে। আমার ক্যাম্পাস অবশ্য নর্থ ক্যাম্পাস থেকে আরও দেড় মাইল দূরে। ওটাকে বলে সাউথ ক্যাম্পাস। এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে সাইকেল চালিয়ে আসার মত ফিটনেস আমার নেই। দেখা যাবে অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছি। তাই সোজা পথ খুঁজে বের করলাম। নর্থ ক্যাম্পাসে সাইকেল রেখে শাটলে উঠতে হবে, শাটল নিয়ে যাবে ‘ক্রেভ’ নামক চত্বরে, ওখানে নেমে মিনিট খানেক হাঁটলেই আমার অনুষদ। ক্রেভ চত্বরের নাম এসেছে ক্রেভ কফি হাউজ থেকে। এই কফি হাউজ একইসাথে কফি খাওয়ার জায়গা, আবার গির্জাও। ‘ক্রাইস্ট মেমোরিয়াল’ নামক একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রার্থনা করার জায়গা এটা। দালানের উপর খোদাই করা ‘লুথেরান চার্চ’ কথাটা। আবার পাশের দেওয়ালে টাঙানো বিশাল আকারের পোস্টার ‘ক্রেভ কফি হাউজ’। কফি হাউজের সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় বিকেল পাঁচটার মধ্যে। এরপর সম্ভবত মানুষ এটাকে প্রার্থনার কাজে লাগায়। ব্যাপারটা বেশ মনে ধরেছে। প্রথা ভেঙে বাইরে আসার চেষ্টা। প্রচলিত ধর্মগুলো বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে ডাকার জন্য আলাদা একটা ঘর লাগে যেটা পবিত্র রাখার জন্য অন্য সব কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু এই সম্প্রদায় সেটার ধার ধারেনি। জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘খাওয়াদাওয়া’র সাথে সম্পর্কিত ঘরকে ঈশ্বরের ঘর হিসেবে বেছে নিয়েছে।
ক্রেভ চত্বরে নামলে সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত অনেকগুলো স্কুল পাওয়া যাবে। মেডিকেল স্কুল, নার্সিং স্কুল, ডইজি কলেজ অফ হেলথ সায়েন্স ইত্যাদি। পুষ্টি এবং পথ্য অনুষদ পড়েছে ডইজি কলেজের অধীনে। ডইজি কলেজের দালানটা ‘অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনস বিল্ডিং’ নামেও পরিচিত কারণ এখানে ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষক, ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট, পথ্যবিদ, ওকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ল্যাব সায়েন্স টেকনিশিয়ান, হেলথ ইনফরমেশন স্পেশালিস্ট, ফিজিশিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট, মেডিকেল ইমেজিং টেকনিশিয়ান তৈরির অনুষদগুলো অবস্থিত। এগুলোকে সাধারণভাবে অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশন বা সহযোগী পেশা বলে কারণ এগুলো মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে (নার্সিং, মেডিসিন এবং ফার্মেসি) সফলকাম হওয়ার জন্য সহযোগিতা করে। এই বিল্ডিঙয়ের তিনতলায় পুষ্টি এবং পথ্য অনুষদ।
সারাদিন অনুষদে কাটিয়ে বিকেলে আবার ক্রেভ চত্বরে এসে দাঁড়ালাম শাটলের অপেক্ষায়। সাধারণত শাটলগুলো পনেরো মিনিট বাদে বাদে আসা যাওয়া করে। কখনো বা পাঁচ, দশ মিনিট এদিক ওদিক হয়। কিন্তু কতক্ষণ দেরি হবে সেটা কীভাবে জানব? প্রথম প্রথম আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতাম। মেজাজ খুব গরম হত। আমেরিকায় সবকিছু ঘড়ি ধরে চলে, এই ধ্রুব বাক্যকে ভুল প্রমাণ করে শাটলগুলো মাঝে মাঝে পনেরো, বিশ মিনিটও দেরি করে। এরকম একদিন পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর শাটল এল, উঠে বসলাম। আমার পর উঠল ফর্ম হাতে একটা মেয়ে। কীসের ফর্ম সেটা বুঝিনি কিন্তু টিক চিহ্ন দেওয়ার বক্স দেখে বুঝেছি এটা একটা ফর্ম। আমরা দুজন ছাড়া শাটলে কোনো যাত্রী নেই। আমার সাথেই নর্থ ক্যাম্পাসে এসে নামল মেয়েটা। নামার পর হঠাৎ আমার পাশে এসে বলল, ‘তুমি কি প্রায় শাটল ব্যবহার কর?’ আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এ ধরনের প্রশ্নে গেলাম ঘাবড়ে। আমতা আমতা করে বললাম, ‘কেন?’ মেয়েটা উত্তর দিল, ‘তোমার সাথে শাটল নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। আমি শাটল সার্ভিস মূল্যায়নের জন্য একটা জরিপ চালাচ্ছি।’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বল। আমি প্রতিদিন শাটলে চড়ি।’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল শাটল আমাকে ঠিকমত সার্ভিস দিচ্ছে কিনা, প্রতিটা স্টপেজে যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করছে কিনা ইত্যাদি। তারপর জানতে চাইল শাটল নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ আছে কিনা। বললাম, ‘আছে। শাটল ঠিক সময়মত আসে না। এমনও হয়েছে নির্ধারিত সময়ের পর আমি বিশ মিনিট অপেক্ষা করে শাটল পেয়েছি।’ মেয়েটা দুঃখ প্রকাশ করে বলল, শাটলের গতিবিধি জানার জন্য একটা অ্যাপ আছে। প্লে স্টোর থেকে সেটা নামিয়ে যেন ইন্সটল করে নিই। অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে শাটল এই মুহূর্তে রাস্তার কোথায় আছে। জিপিএসের কারিকুরি আর কি। ফলে অযথা অপেক্ষা করতে হবে না। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে সাথে সাথে অ্যাপটা নামিয়ে নিলাম। সেই থেকে শাটল আসতে কতক্ষণ লাগবে হিসেব করে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াই।
আজও দাঁড়ালাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাটল চলে আসবে ক্রেভ চত্বরে। আমার সাথে অপেক্ষা করছে আরও তিনজন মেয়ে। খেয়াল করলাম সবাই হাতে মোবাইল নিয়ে সেটার উপর মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে। রবি ঠাকুরের কাছ থেকে ধার নিয়ে বলা যায়,
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি (কিংবা সুখে সুখী),
আকাশে রোদ জ্বলে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে মুঠোফোনের সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে সামাজিক মাধ্যম অনুভব–
অন্তর্জালে মিশে গেছে আর সব॥
একটু পর আমিও শামিল হলাম ওদের সাথে। সময় কাটানোর জন্য এ মুহূর্তে মোবাইল গুঁতাগুঁতিই প্রধান উপায়। একটু পর শাটল এলে চড়ে বসলাম। নর্থ ক্যাম্পাস থেকে সাইকেলে চড়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। প্রখর রোদ, কিন্তু দ্রুতবেগে সাইকেল চালানোর জন্য গায়ে তাপ লাগছে না। শাঁই শাঁই করে হাওয়া কেটে বেরোচ্ছি বলে ফুরফুরে লাগছে। ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় যেহেতু উঁচু জায়গা পাড়ি দিতে হয়েছে, আসার সময় পাড়ি দিলাম ঢালু জমি। ফলে প্যাডেল মারতে হল না তেমন। একটানে চলে এলাম বাসায়।
পর্ব চৌদ্দ এখানে