(১৩)
গতকাল ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম কিছু কাজ সারতে। সেখানে গিয়েও আমি এপার্টমেন্টস.কম, যিলো.কম, এপার্টমেন্টফাইন্ডার.কম ভাজা ভাজা করেছি। এগুলো সব বাসা খুঁজে পাওয়ার ওয়েবসাইট। প্রিন্স বাসায় বসে বাসা খুঁজেছে, আমি ভার্সিটির লনে। এরপর দুজনে ক্রস চেক করে শর্ট লিস্ট বানিয়েছি। তালিকা বানানোর পর কল দেওয়া শুরু করেছি। একজন কল ধরলেন। তার সাথে বাৎচিত করে ঠিক করলাম আজ মিনেসোটা এভিনিউয়ে বাসা দেখতে যাব। মিনেসোটা এভিনিউ চেরোকি স্ট্রিটের আশেপাশেই। কিন্তু এজেন্সির অফিস বেশ দূরে। গ্র্যাভয় রোডে। আমাদের বাসা থেকে ৯.৭ মাইলের দূরত্বে। এজেন্সির অফিসে গিয়ে চাবি নিয়ে আসতে হবে। উনারা নিজেরা ভাড়াটিয়াদের নিয়ে টুর দেন না। ভাড়াটিয়ারা নিজ দায়িত্বে চাবি নিয়ে মিনেসোটা এভিনিউয়ের এপার্টমেন্ট দেখে। তারপর চাবি এজেন্সির অফিসে এসে ফেরত দিয়ে যায়। নিজেদের গাড়িতে করে গেলে হয়ত ৯.৭ মাইল কোনো দূরত্ব না, কিন্তু গণপরিবহনে করে যেতে চাইলে এটা বিশাল দূরত্ব। একে তো বাস আর ট্রেন সার্ভিস বাংলাদেশের মত ঘরের গোঁড়ায় নামিয়ে দেয় না, তার উপর বাস স্টপ আর ট্রেন স্টেশনগুলো বেশ দূরে দূরে। অনেকখানি হেঁটে পৌঁছাতে হয়। তাই হাঁটাহাঁটির সময়ও হিসেব করে ঘর থেকে বের হতে হয়। আমরা ঝলমলে রোদে বের হওয়ার সময় বুঝিনি সামনে কী দুরবস্থা অপেক্ষা করছে। তবে এবার ছাতা নিয়ে বের হয়েছি। ন্যাড়া বেলতলায় গিয়ে অবশেষে শিখেছে।
বেশ কিছুদূর হেঁটে বাসে উঠলাম। এক বাসেই যাওয়া যাবে কাছাকাছি পর্যন্ত। এরপর খানিক হেঁটে এজেন্সির অফিস। প্রায় এক ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে বাস আমাদের নামিয়ে দিল দে পিয়েরে নদীর কিনারে। আগেই বলেছি প্রাইভেট কারে করে এলে সোজা রাস্তায় বা চিপাচাপা দিয়ে বিশ পঁচিশ মিনিটে চলে আসা যেত। কিন্তু বাস এসেছে দুনিয়া ঘুরে, অনেকগুলো স্টপ পার হয়ে। এজন্য এত সময় লেগেছে। আমাদের অবশ্য খারাপ লাগেনি। নতুন শহরের গলি ঘিঞ্জি দেখতে দেখতে এসেছি। মূল শহর ছেড়ে বাস কখনো চুপচাপ ধরনের এলাকায় ঢুকেছে যেখানে মানুষজন তেমন নেই, কখনো হাটবাজারের মত এলাকায় ঢুকেছে। কখনো এমন এলাকায় ঢুকেছে যেখানে শুধু পরিত্যক্ত বাড়িঘর। দালানের গায়ে গ্রাফিতি আঁকা। প্রতিবাদী সব গ্রাফিতি। পুরানো সে দালানের সারি দেখে গা শিরশির করে উঠে। একসময় কতই না মুখর ছিল এসব এলাকা! এখন মানুষ ভুলে গেছে। আমাদেরও এভাবে ভুলে যাবে সবাই। কেমন যেন মন খারাপ করা অনুভূতি। কোনো একটা স্টপেজ থেকে দুটো আফ্রিকান আমেরিকান তরুণ উঠল। একজন উঠতে গিয়ে হাতে থাকা সাদা রঙের থিকথিকে তরল পদার্থ ফেলে দিল রাস্তার উপর। তারপর সেটা না পরিষ্কার করেই উঠতে গেল বাসে। বাস চালক ছিলেন একজন মধ্যবয়স্ক আফ্রিকান আমেরিকান মহিলা। উনি উঠতে দিলেন না। বললেন আগে ময়লা পরিষ্কার করতে। তরুণটা বাধ্য হয়ে টিসু দিয়ে যতটা সম্ভব রাস্তা পরিষ্কার করল। এরপর চালক তাকে উঠালেন। মুগ্ধ হলাম চালকের ব্যবহারে। ঠিকই তো! তোমার ময়লা আরেকজন কেন পরিষ্কার করবে? এখানে রাস্তাঘাটে টিসু, খাবারের প্যাকেট, বোতল কিছু ফেলা যায় না। সর্দি, থুথু, কফ তো পরের ব্যাপার। প্রতিটা রাস্তায় একাধিক ট্র্যাশ ক্যান থাকে যেন মানুষ এগুলো ব্যবহার করে। তারপরও আফ্রিকান আমেরিকানরা রাস্তায় জিনিসপত্র ফেলে। আমি ওদের আচার আচরণ দেখে যারপরনাই বিরক্ত এবং বিস্মিত হই। ধীরে ধীরে বুঝেছি ওরা সমাজের অবহেলিত অংশ। ভাল থাকা, খাওয়া, পড়ার সুবিধা নেই। যারা একটু পড়াশোনা করে, তারা ভদ্র হয়। কিন্তু কেন তারা এমন পিছিয়ে আছে, সেটা সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই।
বাস যখন আমাদের দে পিয়েরে নদীর এক পাশে নামিয়ে দিল, তখন মাথার উপর গনগনে সূর্য। নদীর উপর দিয়ে যে সেতু গেছে, সেটায় বাস উঠে না। তাই এই সেতু হেঁটে পার হতে হবে। জিপিএসে দেখাচ্ছে হাঁটা শুরু করলে মোটামুটি বিশ মিনিটে পৌঁছে যাব। ছাতা মেলে হাঁটা শুরু করলাম। এক ছাতার নিচে দুজনে হাঁটা যাচ্ছে না। প্রিন্স তাই টুপি পরে আলাদা হয়ে গেল। বুদ্ধি করে সানগ্লাস এনেছি। নতুবা চোখ ঝলসে যেত। এখানে সানগ্লাস কোনো ফ্যাশনের অংশ না, এটা অত্যাবশ্যকীয়। চোখের পাওয়ার অনুযায়ী দুজনে দুটো সানগ্লাস বানিয়ে এনেছিলাম বাংলাদেশ থেকে। আমেরিকার মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইস শহরের আর্দ্রতাহীন প্রখর রোদে সে সানগ্লাস আশীর্বাদ হয়ে এল।
দে পিয়েরে নদীটা এখন শুকনোর দিকে। দুই পাড়ের পাথর, সুরকি বের হয়ে আছে। কেমন হাড্ডিসার লাগছে। প্রচুর ময়লাও দেখলাম। বর্ষাকাল বলে যদি এখানে কিছু থাকে তখন হয়ত নদীটা পুনর্যৌবন পায়। আপাতত মরা গাঙ দেখতে দেখতে আমরা ব্রিজ পার হলাম। ব্রিজের ওই পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে জুতোর শুকতলি ক্ষয়ে গেল, অফিস দেখি না। ছাতার তলে থেকেও গরম লাগছে। উত্তপ্ত হাওয়ার হলকা এসে বাড়ি দিচ্ছে গায়ে। মরুভূমিতে না গিয়েও যেন থ্রিডি ইফেক্টের মাধ্যমে মরু হাওয়ার অনুভূতি দেওয়া হচ্ছে। সে এক অনুভূতি বটে। আমেরিকানরা কেন হাতে কয়টা টাকাকড়ি এলেই গাড়ি কিনে ফেলে, টের পেলাম। প্রায় দশ মিনিট, ফিলিং লাইক আধা ঘণ্টা, হাঁটার পর এজেন্সির অফিস পেলাম। পুরনো এক বিল্ডিংয়ের নিচ তলায়। জায়গাটা শহরের একদম শেষ প্রান্তে। শহরতলি বলা যেতে পারে। অফিসে ঢুকে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারলাম না। ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় ডেস্ক আর চেয়ার বসিয়ে কাউন্টার বানিয়েছে। মানুষজন ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে কথা সারে। অপেক্ষা করার জন্য সোফা নেই। ডেস্কের উপরে রাখা কম্পিউটারটাই শুধু আশ্বস্ত হওয়ার মত। কম্পিউটার দেখে বুঝলাম ইনারা একটু হলেও ডিজিটাল। কাউন্টারে দাঁড়ানো কিশোরীকে বললাম আমরা কেন এসেছি। সাথে সাথে চিপা একটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নেমে এলেন মধ্যবয়স্ক এক মহিলা। উনি না নামলে বুঝতে পারতাম না অফিসের দোতলাও আছে। মহিলাই আমাদের চাবি বুঝিয়ে দিলেন। আজকে বিকেল চারটার মধ্যে চাবি উনাদের ফেরত দিয়ে যেতে হবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা বাসা দেখতে পারব। এখন বাজে দুপুর বারোটা। এতক্ষণ পর্যন্ত বাসা দেখা মানে সেখানে গোসল করে, খেয়ে, ছোট্ট একটা ঘুম দিয়েও উঠা যাবে।
চাবি নিয়ে দুজন বাইরে বের হলাম। আবার সেই রোদ, আবার সেই হাঁটা। উত্তম-সুচিত্রার ‘এ পথ যদি না শেষ হয়’ গানটার আমেরিকান ভার্সনে অভিনয় করছি আমি আর প্রিন্স। তফাৎ দুটো। আমাদের মোটর সাইকেল নেই, আর লিরিক সামান্য বদলে ‘এ পথ কেন শেষ হয় না’ হয়ে গেছে। এবার ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছতে আরও বেশি সময় লাগল। একে পা ব্যথা, তার উপর তেষ্টা। পানির বোতল আনার কথা কেন যে ভুলে যাই! ধুকতে ধুকতে যখন বাস স্টপেজে এলাম, একটা ভেন্ডিং মেশিন পেলাম। এটা থেকে কীভাবে পানীয় কেনে, জানি না। নেট ঘেঁটেও পদ্ধতি বুঝতে পারছি না। আশেপাশে মানুষ বলতে ওয়েটিং বেঞ্চে ঘুমিয়ে থাকা এক আফ্রিকান আমেরিকান বোহেমিয়ান। ইনি কি ঘুমাচ্ছেন, নাকি সিদ্ধি খেয়ে বেহুঁশ হয়েছেন কে জানে। একটু একটু বাথরুম পেয়েছে। ভাবলাম কাছেই গণ শৌচাগার, বাথরুমটা সেরে নিই। কিন্তু বাথরুমের দরজা খুলতে পারলাম না। ভেতরে কেউ আছে কিনা জানতে চাইলাম, সাড়া দিল না। সব কাজে বিফল হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দশ মিনিট পর বাস এল। সেটায় করে মিনেসোটা এভিনিউয়ের পাশে নামলাম। কিছুদূর এগিয়ে কাঙ্ক্ষিত বাসা পেলাম। পাশপাশি দুটো এপার্টমেন্ট। কোনোটার বাহ্যিক রূপই পছন্দ হল না। দুটো দরজায়ই কাঁচা হাতের আঁকিবুঁকি করা, দরজার রঙ এখানে সেখানে চটা। অবশ্য তালা খুলে ভেতরে ঢুকার পর মন ভাল হয়ে গেল। পুরো বাসা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। জানালার কাঁচ উঠিয়ে দেখলাম সুন্দর হাওয়া আসছে। চারদিক খোলামেলা। বাসায় ঢুকতেই প্রথমে লিভিংরুম, এরপর বেডরুম, এরপর রান্নাঘর। রান্নাঘর দেখে মুগ্ধ হলাম। বিশাল রান্নাঘর। বেডরুমের সমান। এত বড় রান্নাঘর আমাদের দরকার নেই। বদলে বেডরুমটা আরেকটু বড় হলে ভাল হত। রান্নাঘরের পেছনে ছোটখাট ব্যাকইয়ার্ড। টয়লেট একটাই। এতক্ষণ পর টয়লেট পেয়ে বাথরুম সেরে নিলাম। বাসা নিই আর না নিই, এটার সাথে একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি হয়ে গেল।
বাসাতে সমস্যা নেই কিন্তু পাড়াটা পছন্দ হচ্ছে না। চেরোকি স্ট্রিটে যে সমস্যা ছিল, এখানেও সে সমস্যা। পাশের এপার্টমেন্টেই আফ্রিকান আমেরিকান পরিবারের বাস। ব্যাকইয়ার্ড জুড়ে তাদের জিনিসপত্র ছড়ানো। বুঝতে পারছি না কী করা উচিৎ। কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি এরা সারাক্ষণ হল্লাচিল্লা করে। ধুপধাপ শব্দ করা, জোরে গান শোনা এসব নাকি ওদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এরকম হলে তো আবার আমাদের সমস্যা! আমার পড়াশোনার জন্য পিনপতন মার্কা না হলেও নীরবতা লাগে। হইচইয়ের মধ্যে পড়াশোনা, ঘুম কিছু হয় না। তার উপর বাসাটায় সরাসরি কাঠের মেঝে। এখানে শব্দ আরও বেশি হওয়ার কথা। চেরোকি স্ট্রিটের বাসাটায় অন্তত কার্পেট বিছানো ছিল। সব মিলিয়ে মন টানল না। চাবি দিতে গিয়ে মানা করে দিয়ে আসব। চাবি দেওয়ার জন্য আবার ব্রিজ পার হও, ফেরার জন্য আবার ব্রিজ পার হয়ে স্টপেজে আস। একটা দিন বটে!
(১৪)
ভাইদের বাসায় থাকছি মোটামুটি তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে। এখনো নিজেদের জন্য বাসা খুঁজে পাইনি। একবার চিন্তা করলাম এয়ারবিএনবি-তে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব যতদিন নতুন বাসা না পাই। সে অনুযায়ী এডভান্সও দিয়ে দিলাম একটা বাসার জন্য। এরপর শাওন ভাইয়ের কাছে গেলাম বলতে। উনি খুব আহত হলেন আমাদের পরিকল্পনা শুনে। ঝাড়ি দিয়ে বললেন যেখানে আমাদের টাকা জমানোর কথা, সেখানে আমরা টাকা জলে ফেলছি। উল্টো জিজ্ঞেস করলেন কেন এয়ারবিএনবি-তে যেতে চাই। উনারা কি কোনো কারণে আমাদের কষ্ট দিয়েছেন কিনা। কী মুশকিল! ভাইকে বুঝাতে পারলাম না যে, উনাদের পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা আমাদের দুজনের। এভাবে এতদিন থেকে উনাদের ঝামেলায় ফেলতে মন চাচ্ছে না। শাওন ভাই গেলেন আনজাম ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। একটু পর দুজনে এসে বললেন, আমরা যেন এখনই এয়ারবিএনবির বুকিং বাতিল করি। যে ডলার এডভান্স দিয়েছি, সেটা যেন ফেরত নিই। নতুন বাসা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। শুনে চোখে পানি চলে এল। আমেরিকায় আসার পর একবারও দেশের জন্য মন কাঁদেনি। সঙ্গী আছে সাথে তাই পরিবারকেও তেমন মিস করিনি। কান্নার কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু ভাইদের কাজকর্ম দেখে আবেগ সামলানো গেল না। এত ভাল মানুষও হয়?
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে ঘোষণা দিলাম, আমরা বাসা পেয়ে গেছি। বাসা পাওয়ার ঘটনাটা বেশ চমকপ্রদ। আমি আর প্রিন্স গ্র্যাভয় এভিনিউয়ে বাসা দেখতে গিয়েছি। এই এভিনিয়ের আশেপাশে যে স্ট্রিটগুলো আছে, সেগুলোর নাম অনেক মজার। আলাস্কা, লুইজিয়ানা, টেনেসি, নর্থ ডাকোটা, নেব্রাস্কা, অরিগন, ক্যালিফোর্নিয়া, আইওয়া। আমেরিকার কোনো স্টেটের নাম মনে হয় বাদ পড়েনি। বাংলাদেশে যেমন দুটো মির্জাপুর পেয়েছি, এখানে তেমন একের অধিক আলাস্কা, লুইজিয়ানা, টেনেসি পেলাম। দুনিয়ায় কি নামের এতই অভাব যে একই নাম ঘুরে ফিরে ব্যবহার করা হয়? হ্যাঁ, অভাবই বটে। নতুবা নির্ঝর নামে আরও হাজার খানেক বান্দা কীভাবে থাকে? ফিরে আসি মূল আলোচনায়। এতগুলো স্ট্রিট ঘুরেও কোনো বাসা পছন্দ হয়নি। মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টপেজ পর্যন্ত এসেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল হাতের ডানদিকে ফরেস্ট গ্রোভ এজেন্সির একটা অফিস। সেটার জানালায় লাগানো ‘টু রেন্ট’ বিজ্ঞাপন। পারলে দৌড়ে অফিসে ঢুকি আর কি! অফিসে একজন প্রৌঢ় আফ্রিকান আমেরিকান মহিলা বসা। কথা বলে বুঝলাম উনি কাস্টোমার সামলান। বললাম কীজন্য এসেছি। উনি একজন সাগরেদকে ডেকে বললেন খালি ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে দেখাতে। যদি আমাদের পছন্দ হয় তবে এপ্লিকেশন করতে পারি। মহা খুশি হয়ে আমরা ফ্ল্যাট দেখতে গেলাম। বাসাটা ছোট হলেও আধুনিক। দেওয়ালে মাইক্রোওয়েভ ওভেন সেট করা, মেঝেতে কার্পেট বিছানো, ফ্যান আর এসি দুটোই আছে, বাথরুমের সবকিছু ঝকঝকে তকতকে, রান্নাঘরটা ছোট হলেও ছিমছাম। এক রেফ্রিজারেটর দিয়েই রান্নাঘরের অর্ধেক শেষ। তবুও দেওয়ালে মিটসেফের অভাব নেই। খুব পছন্দ হল বাসাটা। এখানে আমাদের যেকোনো মূল্যে ভাড়া নিতে হবে। বাসা থেকে বের হলেই বাস স্টপ। এক বাসে ভার্সিটি। চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। আশেপাশে অনেক রেস্তোরাঁ, গ্রসারি শপ। অথচ ফ্ল্যাটের ভাড়া মাত্র পাঁচশ ডলার। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ময়লা আমাদেরই দিতে হবে কিন্তু তারপরও যথেষ্ট কম মনে হল।
মহিলাটিকে বললাম বাসা পছন্দ হয়েছে। উনি চাইলে কালকেই উঠতে পারি। উনি একটা এপ্লিকেশন ফর্ম ধরিয়ে দিয়ে বললেন পূরণ করে নিয়ে আসতে। এটা পূরণ করে ফি জমা দিলে উনি আমাদের ব্যাপারে যাচাই বাছাই শুরু করবেন। ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে মনে হল আমাদের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। ধরে নিলাম ভাড়া আমরা পাবই। বয়সের তুলনায় মহিলা কথা কম বলেন। তবে যখন বলেন, বেশ রসিয়েই বলেন। আমি যতজন আমেরিকান বৃদ্ধ মহিলা দেখেছি, একজন বাদে সবাইকেই রসিক পেয়েছি। কারণ বুঝতে পারছি না। বাঙালি বুড়িদের মত আমেরিকান বুড়িরা কাঠখোট্টা নয় কেন? উনাকে জিজ্ঞেস করলাম বাইসাইকেল রাখার গ্যারেজ আছে কিনা। বললেন, নেই। গাড়ি পার্ক করতে হয় রাস্তায়। সেখানে সাইকেল পার্ক করার জায়গা নেই। মন খারাপ হল। সাইকেল কেনার পরিকল্পনা করছি আমরা। সাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা করলে অনেকগুলো টাকা বেঁচে যায়। কিন্তু এই সাইকেল নিয়ে যদি তিনতলায় উঠানামা করতে হয় তাহলে বাসই সই। বৃদ্ধা বললেন উনার ছেলে যে এপার্টমেন্টে থাকে, যেখানে সাইকেল রাখার গ্যারাজ আছে। আমরা চাইলে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন ওখানে বাসা খালি আছে কিনা। আমরা হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই উনি মোবাইল টেপা শুরু করলেন। ছেলের বউকে কল করে কিছুক্ষণ ‘হানি, সুইটহার্ট’ ডেকে আসল কথা জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাঁ, ওখানে বাসা ভাড়া দেওয়া হবে কিন্তু ভাড়া বারোশ’ ডলার। সাথে সাথে নাকচ করে দিলাম। বাস দিয়ে যাওয়া আসা এর চেয়ে সস্তা। মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফর্ম নিয়ে সেদিনের মত বাসায় চলে এলাম। এসেই ঘোষণা দিলাম, আমরা বাসা পেয়ে গেছি।
কয়েকদিন পর ফরেস্ট গ্রোভ থেকে প্রৌঢ় মহিলা কল করলেন। দুরুদুরু বুকে কল ধরলাম। নিশ্চয় সুখবর? মহিলা বললেন, তিনি অত্যন্ত দুঃখিত যে বাসাটা আমাদের দিতে পারছেন না। আমাদের মাসিক আয় তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। শুনে প্রচণ্ড হতাশ হলাম। প্রতিটা জায়গা থেকে এভাবে রিজেকশন আসতে থাকলে রাস্তায় খুঁটি গাড়া ছাড়া উপায় থাকবে না। ভাইদের জিজ্ঞেস করলাম, উনারা আমাদের কো-সাইনার হতে রাজি কিনা। তাহলে উনাদের বেতনের সাথে আমাদের বেতন মিলিয়ে মাসিক আয় বেশি দেখানো যাবে। ভাইয়েরা রাজি হলেন। এখন এটাই একমাত্র উপায়। এত ঝামেলা হত না যদি বাংলাদেশ থেকে বাসা ঠিক করে আসতে পারতাম। কিন্তু আমরা ভিসা পেয়েছিলাম আসার মাত্র সতের দিন আগে। সতের দিনের ভেতর বাসা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। তবুও আমরা দিনরাত বাসা খুঁজতাম নেটে। আনজাম ভাই বলেছিলেন বাসা দেখার ব্যাপারে নেটের ছবি আর তথ্যকে বিশ্বাস না করতে। আমরা যদি বাসা পছন্দ করে উনাকে জানাই, উনি গিয়ে সেটা দেখে আসতে পারেন। আমরা ক্যাম্পাস লোকেশন আর ভাড়া মিলিয়ে ‘সম অ্যান্ড হাচিন্সন’ নামক এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙয়ের একটা ফ্ল্যাট পছন্দ করলাম। আনজাম ভাই সেটা চর্মচক্ষে দেখতে গেলেন। দেখে এসে বললেন পাড়াটা খুব সুন্দর, কাছেই ঘোরাফেরার জন্য পার্ক আছে। কিন্তু ফ্ল্যাটটা জাতের নয়। অনেক প্রাচীন বিল্ডিং। এমনই প্রাচীন যে ফ্ল্যাটের দেওয়ালে চুনকাম করা। উনার তেমন পছন্দ হয়নি। তবু আমরা যখন আসব, আরেকবার চেক করে দেখতে পারি। পছন্দ হলে এপ্লিকেশন করব। ভাইয়ের কথায় দমে গেলাম। এমনিতে বেতন অনুযায়ী বাসা পাচ্ছি না, তার উপর যেটা পেলাম সেটার এই অবস্থা। কয়েকদিন পর লজ্জার মাথা খেয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম উনাদের ফ্ল্যাটে সপ্তাহ খানিক থাকা যাবে কিনা। যদি যায় তাহলে সেখানে থেকে আমরা বাসা খুঁজলাম। ভাই ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানালেন, এটা সম্ভব। যেহেতু ভাইয়েরা চারজন একসাথে থাকেন এবং তিনজনই ফল সিজনে দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন, তাই আমাদের জন্য একটা রুম বরাদ্দ করা সম্ভব। বাসায় শাওন ভাই একা থাকবেন। উনিই আমাদের সবকিছু চিনিয়ে দেবেন। শুনে বিরাট শান্তি পেলাম। প্রাথমিকভাবে থাকার একটা বন্দোবস্ত হল। কিন্তু এরপরের কাহিনী বড় করুণ। কিছুতেই বাসা খুঁজে পাচ্ছি না, কেউ ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছে না।
মন ভাল করার জন্য ভার্সিটিতে ঘুরতে গেলাম। ক্লাস শুরু হবে আগস্টের সাতাশ তারিখ থেকে। এর আগে ভার্সিটিতে যাওয়া মানে এক প্রকার বেড়ানোই। পুরো ভার্সিটিতে অসংখ্য ভাস্কর্য ছড়ানো। নব্বই শতাংশ ভাস্কর্য ধাতু দিয়ে বানানো। ঢাকায় দেখতাম সিমেন্টের ভাস্কর্য, এখানে দেখি ধাতবের। বেশিরভাগ ভাস্কর্যই মানুষের। কেউ খেলছে, কেউ বই পড়ছে, কেউ বসে আছে, কেউ সন্তানের সাথে সময় কাটাচ্ছে, কেউ আকাশ দেখছে, কেউ শুয়ে আছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগে। ভার্সিটির পুরনো দালানগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। নতুন দালানকোঠা আমাকে টানে না। সব একরকম লাগে। কিন্তু পুরনো ধাঁচের দালান একেকটা একেক রকম মনে হয়। যেমন ভার্সিটির প্রথম দালান হিসেবে খ্যাত ‘ডুবোর্গ হল’ সেই ১৮৮৮ সালে নির্মিত। এটার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ পার করা যায়। কিন্তু পায়াস পাঠাগার নির্মিত হয়েছে ১৯৫৯ সালে। এর চেহারা আধুনিক। আমি এটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে পারি না। কেমন একহারা গড়নের। তবে ব্যতিক্রম আছে। ডইজি রিসার্চ সেন্টার, যেটার নির্মাণ শেষ হয়েছে ২০০৭ সালে, সেটা দেখতে খুব ভাল লাগে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিল্ডিং এবং পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তিতে তৈরি। গড়নটাও অদ্ভুত।
ভার্সিটির লনগুলোয় ছড়িয়ে আছে কিছু হ্যামক। আপনি দোল খেতে খেতে বিশ্রাম নিতে পারবেন কিংবা পড়তে। আর আছে অনেক বেঞ্চ। কাঠ এবং ধাতু, দুই ধরনের উপাদান দিয়েই তৈরি। লনে যেগুলো সাজানো, সেগুলো ধাতব। রাস্তার পাশে যেগুলো রাখা, সেগুলো কাঠের। আর আছে প্রচুর গাছপালা। গাছের ছায়ায় অনেকে শুয়ে আছে, অনেকে বসে আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ধুপ করে রাস্তায় বসে পড়া যায়। জায়গায় জায়গায় ট্র্যাশ ক্যান রাখা। সবাই সেগুলোর সদ্ব্যবহার করছে। একটা স্টারবাক্স কফি শপও আছে। সেটায় সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকে। মানুষজন স্টারবাক্সের কফি এত পছন্দ করে, বলার বাইরে। অনেকে আছে এই ব্র্যান্ডের বাইরে কফিই খায় না। অনেকে আছে দিনে অন্তত একবার স্টারবাক্সের কফি খাওয়া চাই।
(১৫)
আমেরিকার রাস্তাঘাটে চলাচল করে খুব আরাম। কি গাড়ি চালান, কি সাইকেল, কি হাঁটাহাঁটি, সবকিছুতেই আরাম। আমরা যেদিন প্রথম বের হয়েছিলাম হাঁটতে, সেদিন অনেকটা সময় গিয়েছিল নিয়ম বুঝতে বুঝতে। এখানে মানুষজন খুব একটা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে না। প্রায় সবার গাড়ি আছে। নতুবা বাস, ট্রেনে যাতায়াত করে। মাঝে মাঝে পুরো রাস্তায় আমি একাই পথচারী থাকি। যে দেশ থেকে এসেছি, তার সাথে এত বৈপরীত্য যে চমকে যেতে হয়। এখানে রাস্তা পার হবার নিয়ম খুব সুন্দর। যেকোনো চৌরাস্তার শেষ সীমায় একটা বাটন দেওয়া থাকে পথচারীদের জন্য (ছবি দ্রষ্টব্য)। ওই বাটনে চাপ দিয়ে রাস্তা পার হবার জন্য আবেদন করতে হয়। এই চাপ অনুযায়ী কিছুক্ষণ পর পর পথচারী পারাপারের সিগন্যাল আসে, মানে সিগন্যাল বক্সে একটা সাদা রঙের পথচারীর অবয়ব উঠে। এর মানে এখন রাস্তা পার হতে পারবেন। কয়েক মুহূর্ত পর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়। এই কাউন্টডাউনের মধ্যে আপনাকে রাস্তা পার হতে হবে। কাউন্টডাউন শেষ হলে গাড়ি চলার সিগন্যাল পড়বে। তখন সিগন্যাল বক্সে লাল রঙের হাত দেখায়। এর মানে এখন পারাপার হওয়া যাবে না। এই কাউন্টডাউন আবার রাস্তা ভেদে বিভিন্ন রকম। যেখানে গাড়ির দৌরাত্ম্য বেশি, সেখানে রাস্তা পার হওয়ার কাউন্টডাউন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। সবচেয়ে কম পেয়েছি দশ সেকেন্ড। আবার যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি খুব একটা চলাচল করে না, সেখানে কাউন্টডাউন বাইশ সেকেন্ড পর্যন্ত পেয়েছি।
চৌরাস্তা বাদে ছোটখাট গলির মুখে আপনি পথচারী পারাপারের বাটন পাওয়া যাবে না। তখন আশেপাশে দেখতে হবে গাড়ি আসছে কিনা। গাড়ি না থাকলে রাস্তা পার হবেন। আমি আর প্রিন্স প্রথমদিন বেশ কিছু গলির মুখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলাম কী করবো বুঝতে না পেরে। তখন ড্রাইভাররা হাত ইশারা করে বলেছিল রাস্তা পার হতে। আমরা পার হবার পর তারা গাড়ি নিয়ে এগিয়েছে, কারণ এখানে পথচারীর প্রায়োরিটি সবচেয়ে বেশি, এরপর বাইসাইকেল চালকদের। ইতালিতে গিয়েও এই কাণ্ড দেখেছি। আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি দেখে গাড়ি থামিয়ে চালক ইশারা করেছে রাস্তা পার হতে। এরপর সে গাড়ি টান দিয়েছে। একবার তো এক চালক ক্ষেপে গেল আমাদের উপর। সে গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছে আমাদের দেখে কিন্তু তবু আমরা রাস্তায় নামছি না। ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে আছি। আমরা বাঙাল দেশের মানুষ। গাড়ির গতি কমিয়ে দেওয়ার অর্থ বুঝিনি। ওই লোকের পিছে আরও দুই তিনটা গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। কিন্তু কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না কারণ সবাই ভাবছে আমরা রাস্তা পার হব। প্রথম গাড়ির চালক তখন অধৈর্য হয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে “স্কুযা মি” “স্কুযা মি” বলা শুরু করল। ইংরেজিতে যাকে বলে “এক্সকিউজ মি।” ব্যাটা “কাতসো” বলার আগেই আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমাদেরকে সম্মান করে যেতে দিচ্ছে কিন্তু যাচ্ছি না, ব্যাপারটা গাড়িওয়ালাদের জন্য বিভ্রান্তিজনক। এরকম সময় ইতালীয়রা কাতসো, পর্কা পুত্তানা, পর্কা মিসেরিয়া, পর্কা ত্রইয়া ইত্যাদি বলে গালি দেয়। পাঁচ বছর ইতালিয়ান বায়িং হাউজে কাজ করার সুবাদে অনেক ইতালীয় গালি শিখেছি। কিন্তু ভদ্র সেজে থাকতাম বলে এগুলো ব্যবহার করিনি। যা হোক, উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটের যেসব নিয়ম কানুন, সেগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোথা থেকে কোথায় এলেম? তবে আমাদের দেশের মত স্টুপিডও আমেরিকায় আছে। এরা লাল সিগন্যালের মধ্যে দৌড়ে রাস্তা পার হয়, বাটনে প্রেস না করেই রাস্তা পার হয়।
আমেরিকা, ইতালি, দার্জিলিং কোথাও হর্ন বাজাতে দেখিনি গাড়ি চালকদের। একেবারেই দেখিনি, তা না। কিন্তু কালে ভদ্রে। একবার আমার সহকর্মী কাম বড় ভাই বলেছিলেন, উন্নত বিশ্বে হর্ন বাজানো হয় পশুদের সতর্ক করার জন্য। রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছ, হঠাৎ একটা হরিণ বা খরগোশ চলে এল বনের ভিতর থেকে। তখন হর্ন বাজিয়ে ওদের তাড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে হর্ন বাজায় অপদার্থ মানুষদের সতর্ক করার জন্য। উল্লেখ্য, ভাইয়া মোটর বাইক চালাতেন এবং পথচারীসহ অন্য গাড়িওয়ালাদের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলেন। উনার শালী কী একটা প্রজেক্ট করছিল হর্ন বাজানোর উপর। সে ভাইয়াকে অনুরোধ করেছিল একমাস হর্ন না বাজিয়ে বাইক চালাতে। মাস শেষে সে রিপোর্ট নেবে কেমন চলল ব্যাপারটা। ভাইয়া এক সপ্তাহের মাথায় হাল ছেড়ে দিলেন। ঢাকায় হর্ন ছাড়া চলা অসম্ভব। এক পথচারী নাকি বেমক্কা ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে কোনোরকম সিগন্যাল দেওয়া ছাড়া। ভাই হার্ড ব্রেক করে ধমক দিলেন, “এইটা কী করলেন আপনি?” পথচারী উল্টো ধমক লাগাল, “আপনার হর্ন নাই নাকি? হর্ন দিলেই তো আমি সইরা যাইতাম।” হর্ন না দিয়ে আপনি যাবেন কোথায়? তারপরও ভাইয়া শালীর অনুরোধে একমাস হর্ন ছাড়া বাইক চালিয়েছিলেন। চালিয়ে যা বুঝেছিলেন সেটা লিখলে বাংলাদেশী হিসেবে রেগে যেতে পারি। কিছু কথা থাক না গোপন!
এতদিন যেসব গাড়ি নিড ফর স্পিড গেইম অথবা হলিউডের মুভিতে দেখেছি, সেগুলো এখন চোখের সামনে দিয়ে ভুসভুস করে চলে। বাংলাদেশে যেসব গাড়ি দেখলে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকতাম, সেসব গাড়ি এখানে মধ্যবিত্তরা চালায়। আর টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো গরীবদের সম্বল। আমার ধারণা, এখানে একটু টাকা হলে মানুষ ফোর্ড, হোন্ডা, শেভ্রোলে, ফিয়াট, ফোক্সভাগেন কেনে। আরেকটু বেশি টাকা থাকলে কেনে বিএমডাব্লিউ, মার্সেডিজ বেঞ্জ, পোর্শে, মাযদা, আউডি। অনেক টাকা থাকলে কেনে ফেরারি, ল্যাম্বর্গিনি, টেসলা। তাই শেষোক্ত তিন ব্র্যান্ডের গাড়ি সেন্ট লুইসের রাস্তায় কম দেখা যায়। বাকিগুলো অহরহ দেখি। আমাদের গ্যারাজেও এসব ব্র্যান্ডের গাড়ি পড়ে থাকে। ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে বেশ কিছু মজার তথ্য দিতে পারি। যেমন, যেটাকে আমরা ডাকি ‘ভোক্সওয়াগেন’ বলে, সেটা কিন্তু সঠিক উচ্চারণ নয়। আসল উচ্চারণ হবে ফোক্সভাগেন কারণ গাড়ির এই ব্র্যান্ডটা জার্মানির। জার্মান ভাষায় ‘ভি’ অক্ষরের উচ্চারণ ইংরেজি ‘এফ’ আর ‘ডাব্লিউ’ অক্ষরের উচ্চারণ ইংরেজি ‘ভি’-এর মত। Volkswagen শব্দটাকে ভাঙলে পাওয়া যায় Volk আর wagen। Volk অর্থ folk (মানুষ/জাতি)। তাই Volkswagen দিয়ে বুঝায় জনসাধারণের গাড়ি। কোম্পানির স্লোগানও এটাই। আবার আমরা যাকে বলি অডি বা অদি (Audi), সেটাও ভুল উচ্চারণ। এটাও জার্মান ব্র্যান্ড এবং খাঁটি জার্মান উচ্চারণে একে বলে আউডি।
যদি তাকাই মাযদার দিকে, তাহলে জেনে রাখা ভাল জাপানে গেলে এই জাপানী ব্র্যান্ডের উচ্চারণ শুনতে পারেন ‘মাতসুদা’। কেন? কারণ ব্র্যান্ডটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জুজিরো মাতসুদা নামের এক ভদ্রলোক। জনসাধারণের কাছে মাযদা নামটা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, সে আরেক কাহিনী। ইরানী ধর্ম প্রচারক জরাথুস্ট্র যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, সেটা ছিল একজন ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ একেশ্বরবাদ। এর আগে সনাতন ধর্ম অনুযায়ী দেবদেবী ছিল সংখ্যায় অনেক। অর্থাৎ বহু ঈশ্বরবাদ। জরাথুস্ট্রের ঈশ্বরকে ডাকা হয় আহুরা মাযদা বলে। আদি ইরান বা পারস্যের প্রাচীন ভাষা থেকে আগত হয়েছে আহুরা এবং মাযদা শব্দ দুটি। আহুরা অর্থ ঈশ্বর, মাযদা অর্থ জ্ঞান। জরাথুস্ট্রের প্রবর্তিত ধর্মে স্বর্গ, নরক, মৃত্যুর পর বিচার হওয়ার ব্যবস্থা, মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য নবীদের আগমন, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বিষয়গুলো পরবর্তীতে প্রচারিত হওয়া অনেক ধর্ম নিজেদের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছে। যেমন ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম ইত্যাদি ধর্ম। যা হোক, জুজিরো মাতসুদার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি আহুরা মাযদা নাম থেকে মাযদা অংশটা ধার নেয়। তারা আহুরা মাযদাকে ‘আলোর দেবতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল। মাযদা নাম দেয়ার পিছে তাদের চিন্তাভাবনা ছিল এইরকম যে, এই নাম তাদের গাড়ির ইমেজকে সবার সামনে উজ্জ্বল করবে।
ফিরে আসি আমেরিকার গল্পে। একবার উবার ডাক দেওয়ার পর ভল্ভো ব্র্যান্ডের সেডান চলে এল। দেশে থাকতে ভল্ভো বাসে চড়েছি বটে, সেডান চোখে পড়েনি। এবার সেডানে চড়ার সুযোগ হল। আরেকবার চড়লাম শেভ্রোলেতে। নিজেরা না কিনতে পারি, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিতে আপত্তি কী? এখানকার আরেকটা সুন্দর ব্যাপার হল, আপনি যখন উবারে বা ট্যাক্সিতে উঠবেন, চালকেরা “হাই/হ্যালো! হাও ইউ ডুইং? হাও আর ইউ?” জিজ্ঞেস করবেই। নামার সময় “থ্যাংক ইউ, হ্যাভ এ নাইস ডে” বলবেই। মনে আছে আমাদের গাঞ্জা টানা ড্রাইভার ভাইটির কথা? সেও এই সৌজন্য দেখাতে ভোলেনি। ব্যাপারটা এত সুন্দর! প্রথমদিন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম বটে, পরে পাল্টা সৌজন্য দেখানোয় অভ্যস্ত করে ফেলেছি নিজেদের। একই ব্যাপার যেতে পারে পথচারীদের সাথেও। আপনার চোখে কারো চোখ পড়লে হাই/হ্যালো বলবে বা নিদেনপক্ষে একটা হাসি দেবে। কেউ কেউ আরেকটু সৌজন্য দেখিয়ে “হ্যাভ এ নাইস ডে/হেই! হাও আর ইউ ডুইং?”-ও বলে বসতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার উত্তর হবে পাল্টা সৌজন্য দেখানো। তবে এটাও ঠিক, এসব প্রশ্ন করে অনেকেই উত্তর শোনার জন্য দাঁড়াবে না। এত লম্বা প্রশ্ন করাটা ওদের কাছে ‘হাই/হ্যালো’ বলার মতই। উত্তরের আশা না করে শুধু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া। এতে আঘাত পাওয়ার কিছু নেই। যস্মিন দেশে যদাচার।
পর্ব সাত এখানে