পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়
(১৬)
দেখতে দেখতে আগস্ট মাসের পঁচিশ তারিখ চলে এল। আমেরিকায় আসার পর সতের দিন পার করে ফেলেছি। আগস্টের সাতাশ তারিখ থেকে আমার ক্লাস শুরু হবে। সেই সাথে শুরু হবে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্টশিপ। আর মাত্র দুইদিন বাকি। কেমন যেন একটা আতংক কাজ করছে মনে। আমি কি পারব লেখাপড়ায় আবার মনোযোগ দিতে? পাঁচ বছর লেখাপড়ার বাইরে ছিলাম। অভ্যাস একেবারেই লুপ্ত হয়ে গেছে। লেখালেখি তো বলতে গেলে আসেই না হাতে। আগে যেখানে নতুন কলম চালু করে দেওয়া আমার প্রিয় কাজের একটা ছিল, এখন সেখানে চালু কলম দিয়ে লিখতে গেলেও হাত কাঁপে। অক্ষর হয়ে যায় কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং, লাইন হয়ে যায় আঁকাবাঁকা। কিন্তু হাতে জোর না থাকলেও মনে জোর আছে। সে জোরের চোটে রুল টানা খাতা যোগাড় করেছি। সাদা পাতা দেখে আত্মবিশ্বাস পাই না তো কী হয়েছে, বিকল্প পদ্ধতি আছে না? স্কুল, কলেজে টানা হাতের ইংরেজি লিখেছি। সে লেখার প্রচুর গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিল। কিন্তু এখন লেখা খাড়া খাড়া হয়ে গেছে। টানা লিখতে গেলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। তবে ইংরেজি লেখাটা যত না জাতের আছে, বাংলা এক্কেবারে রসাতলে গেছে। আমি ‘সুন্দর হাতের লেখা’ প্রতিযোগিতায় বাংলা এবং ইংরেজি দুটো বিভাগেই প্রথম পুরষ্কার বাগিয়েছিলাম। আজ আমার এ কী দশা?
রুল টানা খাতা যোগাড়ের কাহিনী বেশ মর্মান্তিক। দেশে থাকতে আমার প্রচুর ডায়েরি, রাইটিং প্যাড আর খাতা ছিল। বিভিন্ন সাপ্লায়ারের কাছ থেকে ডায়েরি আর কলম উপহার পেতাম। তারপরও আমার কলম কেনার বাতিক ছিল। রঙিন কালির কলম কিনে কলমদানি ভরিয়ে রাখতাম। কলম, রাবার, পেন্সিল, শার্প্নার, হাইলাইটার, সাইনপেন ইত্যাদি আমার খুব পছন্দের জিনিস। ব্যবহার করি বা না করি, এগুলো আমার টেবিলে থাকা চাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এতসব জিনিস আমি কিছুই আনতে পারিনি। জামাকাপড়ের ভারে ব্যাগের ওজন অ্যালাওয়েন্সের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় খাতাপত্র আনা সম্ভব না। তাছাড়া ডিপার্টমেন্ট থেকে নাকি কলম, পেন্সিল, খাতা দেয়। সুতরাং এসব ভরে ব্যাগের জায়গা দখল না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন আমেরিকাবাসী এক ভাই। তবুও হায়ার স্টাডি গ্রুপে একজনের পোস্ট দেখে কিছু কলম সাথে নিয়ে এসেছি। উনি বলেছিলেন আমেরিকান কলম দিয়ে লিখে শান্তি নেই। এদের নিবগুলো নাকি মোটা মোটা হয়। দেশের কলমগুলো দিয়ে লিখলে লেখা চিকন হয় কিন্তু আমেরিকান কলমে লেখা মোটা হয়। আমার চিকন লেখা পছন্দ। তাই বেশ কিছু ম্যাটাডোর বলপেন আমার সাথে অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে। কলম না হয় আছে, খাতা কোথায় পাই? ডিপার্টমেন্টে যেদিন গিয়েছি সেদিন খাতা, কলম কিছু দেয়নি। কিন্তু প্রথম ক্লাসে খাতা কলম ছাড়া গেলে ব্যাপারটা ভাল দেখায় না। ধরলাম আনজাম আর শাওন ভাইকে। জিজ্ঞেস করলাম উনাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে একটা খাতা এনে দিতে পারবেন কিনা। উনারা বললেন অবশ্যই পারবেন। পরেরদিন আনজাম ভাই একটা রুল টানা রাইটিং প্যাড এনে দিলেন। দুঃখের সাথে বললেন, মাসের শেষ বলে খাতা ছিল না। নতুন মাসে ডিপার্টমেন্টে খাতার সাপ্লাই আসবে। তখন এনে দিবেন। আমি খুব একটা দুঃখিত হলাম না। লেখার জন্য কিছু পেলেই হল। শাওন ভাই এসে বললেন, মাস শেষ দেখে ডিপার্টমেন্টে খাতা, প্যাড কিছু নেই। নতুন মাস এলে এনে দিবেন। কিন্তু আমার আর দরকার পড়ছে না বলে শাওন ভাইকে মানা করে দিলাম। নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকে খাতা যোগাড় করার আগ পর্যন্ত আনজাম ভাইয়ের আনা প্যাড দিয়ে কাজ চলে যাবে।
আগামীকাল প্রিন্সের জন্মদিন। স্বপ্নের দেশে প্রথম জন্মদিন কীভাবে পালন করা যায় ভাবতে লাগলাম। এতদিন পর্যন্ত কেবল কাজের খাতিরে ঘোরাঘুরি করেছি। বাইরে বের হলেই কোনো না কোনো কাজ। বাসা খুঁজতে গিয়ে সেন্ট লুইস শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে ফেলেছি। এত জায়গায় নাকি শাওন আর আনজাম ভাইও যাননি। যাওয়ার প্রয়োজনই পড়েনি। বাসা নিয়ে আমাদের মত ঝামেলায় শাওন, আনজাম বা সেতু, কাউকেই পড়তে হয়নি। তাই চিন্তা করলাম, আগামীকাল শুধু ঘোরার জন্য বের হব। কোনো কাজ নয়, কেবল ঘোরা আর উপভোগ। কিন্তু যাই কোথায়? আমরা যেখানে থাকি, তার থেকে সামান্য তফাতে অনেক বিখ্যাত জায়গা আছে। মিজৌরি হিস্টোরি মিউজিয়াম, সেন্ট লুইস যু, সেন্ট লুইস আর্ট মিউজিয়াম, সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টার। আরেকটু দূরে যেতে চাইলে আছে মিজৌরি বোটানিক্যাল গার্ডেন, গেটওয়ে আর্চ, ওল্ড কোর্ট হাউজ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, সিটি মিউজিয়াম ইত্যাদি। বিস্তর আলোচনার পর ঠিক হল সায়েন্স সেন্টারে যাব। আমেরিকার সায়েন্স সেন্টারগুলো সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা শুনেছি। এবার গিয়ে দেখে আসব ওরা কতটুকু প্রশংসার দাবীদার। এর মধ্যে এক কাহিনী হল। আমেরিকায় যদিও পঁচিশে আগস্ট দেখাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে তখন ছাব্বিশ তারিখ পড়ে গেছে। ফেসবুকে সবাই ধুমিয়ে প্রিন্সকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো শুরু করেছে। ব্যাপারটা আমাদের জন্য বেশ চমকপ্রদ। অনেকক্ষণ ধরে কেউই মানতে পারলাম না যে, জন্ম হওয়ার আগের দিনই শুভেচ্ছা পেয়ে যাচ্ছি। ঘণ্টাখানিক পর একটু অভ্যস্ত হলাম।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল আমার হোস্টেল জীবনের কথা। তখন আমি, জুলিয়েট, সোনিয়া আর ঝুমা’দি ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঝুমা’দি এক ক্লাস উপরে হলেও সেটা কোনো ব্যাপার ছিল না বন্ধুত্ব হওয়ার জন্য। জুলিয়েট বাদে আর কারো জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাত বারোটায় শুভেচ্ছা পাওয়ার বাতিক ছিল না। দিলে ভাল, না দিলেও যায় আসে না। কিন্তু জুলিয়েট এটা খুব পছন্দ করত। আমরাও তাই ওর জন্মদিনে চেষ্টা করতাম বারোটার দিকে শুভেচ্ছা জানাতে। একবার আমি ঘুমে পড়ে যাচ্ছি, কিছুতেই জেগে থাকতে পারছি না। তাই রাত এগারোটায়ই জুলিকে গিয়ে বললাম, “দোস্ত, হ্যাপি বার্থডে!” তারপর কিছু একটা উপহার দিলাম। বললাম, “সবার আগে উইশ করার জন্য এগারোটায় উইশ করলাম।” জুলি দেখি প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু ওর চোখ, মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। এই ইঙ্গিত আমাদের চেনা। জুলি রেগে গেছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। বললাম, “রাগ করেছিস নাকি আগে উইশ করেছি দেখে?” আমার বলতে দেরি, জুলি ফোঁস করে উঠল, “আমার এরকম আগেভাগে শুভেচ্ছা পেতে মোটেও ভাল লাগে না। আমার জন্ম কি আজকে হয়েছে নাকি? তুই কালকে দেরি করে উইশ করতি, কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ কালকে সারাদিন আমার জন্মদিন।” আপনারা ‘ফ্রেন্ডস’ টিভি সিরিজ দেখেছেন? ওখানে মনিকা গেলার যেরকম রাগ চাপা দিয়ে রাখতে গিয়ে প্রকাশ করে ফেলে, জুলিরও একই অবস্থা। আমি কোনোমতে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে এসেছিলাম। আরেকটু হলে যে ঘুমের জন্য আগেভাগে শুভেচ্ছা দিলাম, সেটাই চলে যেত। প্রিন্সের জন্মদিনের শুভেচ্ছাগুলো আগেভাগে পেয়ে জুলির ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আপনমনেই হাসলাম কিছুক্ষণ। হিস্টোরি রিপিটস ইটসেল্ফ।
আজ ছাব্বিশে আগস্ট, প্রিন্সের জন্মদিন। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করলাম, তারপর বারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সায়েন্স সেন্টারের উদ্দেশ্যে। জেট ল্যাগের কারণে আমাদের সকাল হচ্ছে দশটা এগারোটায়। শরীর চলছে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী। আমেরিকায় যখন দিন, তখন ঘুম পায় আর যখন রাত তখন জেগে বসে থাকি। তবে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি টাইম যোন চেঞ্জ সিন্ড্রোম। জেট ল্যাগের আরেক নাম এটা। সেন্টারে যেতে হলে দশ নাম্বার বাসে উঠতে হবে। বাসে উঠার জন্য যে স্টপেজে যেতে হবে, সেটা বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এই বাস আসে প্রতি ত্রিশ মিনিট অন্তর। তাই এখনেরটা মিস করলে অপেক্ষা করতে হবে আরও ত্রিশ মিনিট। দ্রুত পা চালিয়ে স্টপেজে এলাম। ধরে নিয়েছি সেন্টারে ঘুরতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। তাই কিছু কুকি আর পানি নিয়ে নিয়েছি। দুপুর বেলা খিদে পেলে খাওয়া যাবে। বাস এলে ছয় ডলার দিয়ে দুটো ট্রান্সফার টিকেট কিনলাম। এই টিকেটের মেয়াদ তিন ঘণ্টা। তিন ঘণ্টার ভিতর আপনি যতবার খুশি বাসে যাওয়া আসা করতে পারবেন, যতদূর খুশি যেতে পারবেন। মানে শহরের ভিতর বাস যতদূর যায় আর কি। আমাদের পরিকল্পনা যেহেতু তিন ঘণ্টার ভেতর দেখে শেষ করা, তাই চিন্তা করলাম ট্রান্সফার টিকেটেই যাওয়া আসা হয়ে যাবে। একই ট্রান্সফার টিকেট দিয়ে মেট্রো রেলেও চড়া যায়। ট্রান্সফার কিনতে না চাইলে দুই ডলার দিয়ে ওয়ান ওয়ে টিকেট কিনতে পারেন। পুরো একমাসের টিকেট কেনার সুযোগও আছে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউনিভার্সিটি অফ মিজৌরি-সেন্ট লুইস তাদের স্টুডেন্টদের জন্য সেন্ট লুইস শহরের ভিতর বিনামূল্যে বাসে চড়ার সুযোগ দেয়। কিন্তু সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয় এই সুযোগটা দেয় না। এরা শুধু ২১ বছরের নিচের আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্টদের বিনামূল্যে বাস ভ্রমণের সুবিধা দেয়। কী খারাপ!
এখানকার বাস সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। বড় বড় শহর যেমন নিউইয়র্ক, শিকাগোর বাস সার্ভিসের মত উচ্চমার্গের না হলেও সেন্ট লুইসের বাস সার্ভিস দেখে বাংলাদেশ থেকে আগত আমি মুগ্ধ। বিশাল বিশাল বাস। বাসের ভেতরে অনেকখানি করে জায়গা। সিটগুলো প্লাস্টিকের। প্রতিটা বাসে দুই ধরনের আসন বিন্যাস দেখা যায়। একদম সামনের দিকে ডান এবং বাম পাশে তিনটা করে মোট ছয়টা সিট থাকে যেগুলো শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি এবং গর্ভবতীদের জন্য বরাদ্দ। এগুলো আবার উঠিয়েও রাখা যায়। হুইল চেয়ারে করে কেউ এলে সিটগুলো উঠিয়ে হুইল চেয়ারের জন্য জায়গা করা হয়। বাকি সিটগুলো জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একদম শেষের সারিতে একসাথে ছয়টা সিট। বাসে আছে দুটো করে দরজা। একটা চালকের আসনের সাথে, আরেকটা বাসের মধ্যিখান বরাবর। স্বাভাবিক সময়ে বাসের সব জানালা বন্ধ থাকে বাসকে এয়ার টাইট করার জন্য। কারণ বাসের ভেতর গ্রীষ্মকালে এসি চলে, শীতকালে হিটার। কিন্তু প্রতিটা জানালায় ইমারজেন্সি হ্যান্ডেল আছে যেটা দিয়ে জরুরী অবস্থার সময় জানালা খুলে আপনি বাস থেকে বের হতে পারবেন।
যখন বাসে উঠবেন, সামনের দরজা দিয়ে উঠতে হবে। চালকের সামনে ডলার ঢুকানোর একটা মেশিন থাকে, যেখানে ডলার দিলে চালক আপনাকে ওয়ান ওয়ে বা ট্রান্সফার টিকেট দিবেন। যদি আগের বাসে ভ্রমণ করার সময় ট্রান্সফার টিকেট কেটে থাকেন, তাহলে পরের বাসে ভ্রমণের সময় সেটা চালককে দেখাতে হবে। চালক দেখবেন আপনার টিকেটের মেয়াদ আছে কিনা। না থাকলে নতুন করে টিকেট কাটতে হবে। একমাসের প্যাকেজ কিনলে একটা কার্ড পাওয়া যায় যেটা পাঞ্চ করতে হয় মেশিনে। করলে যদি সেটা মেশিন গ্রহণ করে, আপনি বাসে ভ্রমণ করতে পারবেন। অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ কার্ড দিয়ে মানুষ গুঁতোগুঁতি করে, লাভ হয় না। তখন নতুন করে টিকেট কিনতে হয়।
বের হওয়ার সময় সামনের বা মাঝের, দুটো দরজাই ব্যবহার করা যায়। সবসময় আগে নামতে দিন, পড়ে উঠুন নীতি। ঠেলাঠেলি বা হুজ্জত করে উঠার বালাই নেই। আগে এলে আগে উঠবেন নিয়ম মেনে উঠুন। প্রচুর মানুষ থাকলেও সবাই লাইন ধরে উঠে। হুইল চেয়ারে বসা যাত্রী, বৃদ্ধ, অসুস্থ, গর্ভবতী, লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করেন এমন কেউ যদি আপনার সাথে লাইনে দাঁড়ান, তাহলে অবশ্যই উনাদের আগে যেতে দিন। এটা সাধারণ ভদ্রতা। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। বেশিরভাগ আমেরিকান পুরুষ আমার আগে স্টপেজে এলেও আমাকেই আগে বাসে উঠতে দেয়। যেকোনো নারীর সাথেই এই ব্যাপার ঘটবে। লেডিস ফার্স্ট প্রবচনটায় মনে হয় এরা কঠোরভাবে বিশ্বাস করে। তবে আমি যেহেতু এই প্রবচনের বিরোধী, তাই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করি তাদের প্রস্তাব। সমস্যা হল তারা ব্যাপারটা বুঝে না। আমি না ঢুকা পর্যন্ত তারা দাঁড়িয়ে থাকে। বাস তো আর আমাদের জন্য অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকবে না। তাই আমি উঠি। আমার পিছে পিছে উঠে আমেরিকান পুরুষ।
বাসের ভেতর যাত্রীরা ভদ্রতা বজায় রাখে। যদি জোড়া সিট যদি খালি থাকে, তাহলে কেউ আরেকজনের পাশে এসে বসে না। যখন কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, তখনও সতর্ক থাকে অন্যের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে। এখন পর্যন্ত বাস বা রাস্তায় যৌন হেনস্তার শিকার হইনি যেটা বাংলাদেশের বাসে উঠলে বা রাস্তায় হাঁটলে হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঁচানব্বই ভাগ। বাসের ভিতর প্লাস্টিকের চেইন থাকে যেটা টান দিলে বাস থামবে। ট্রেনকে জরুরী ভিত্তিতে থামানোর যে পদ্ধতি বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়, সেই পদ্ধতি। যে স্টপেজে নামতে চান, তার ঠিক আগের স্টপেজ পার হওয়ার পরই চেইন টানতে হবে। নির্ধারিত স্টপেজের খুব কাছাকাছি এসে চেইন টানলে বিশাল সম্ভাবনা যে, বাস না থেমে পরবর্তী স্টপেজে চলে যাবে। কারণ বাসগুলো বেশ গতিতে চলে, হুটহাট থামানোর উপায় থাকে না। স্টপেজ থাকতে পারে এক, দুই, তিন, চার মিনিট পরপর। এদের ব্যাপার বুঝি না। অনেক জায়গায় স্টপেজ এত কাছাকাছি যে অবাক লাগে। আবার অনেক জায়গায় দুটো স্টপেজের মাঝে বিশাল ফারাক।
বাসে হুইল চেয়ার উঠানোর নির্দিষ্ট ব্যবস্থা আছে। প্রথমদিন ব্যবস্থা দেখে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। এখানকার হুইল চেয়ারগুলো ব্যাটারি চালিত, কষ্ট করে হাত দিয়ে ঠেলতে হয় না। এই চেয়ারে করে শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারে। যখন বাসের গেটে কোনো হুইল চেয়ার এসে থামে, তখন চালক ব্রিজের মত একটা অংশ নামিয়ে দেন। বাস থেকে রাস্তা পর্যন্ত ব্রিজটা একটা ঢালু পথ তৈরি করে। সেটাতে করে হুইল চেয়ার ভেতরে ঢুকে। বাসে সাইকেল রাখারও ব্যবস্থা আছে। একটা বাসে সর্বোচ্চ দুটো সাইকেল রাখা যায়। বাসের সামনের দিকে দুটো স্ট্যান্ড আছে যেখানে সাইকেল রেখে লক করে দিতে হয়। যাত্রীদের সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার জন্যই প্রস্তুত বাসগুলো। বাসের ভিতর কিছু খাওয়া, পানি বা এলকোহল পান করা, ধূমপান করা নিষেধ। আমি যে রুটগুলোয় (এখানে রুটকে বলে রাউট) চলাচল করি, সেগুলোর বেশিরভাগ চালকই আফ্রিকান আমেরিকান। সবচেয়ে ভাল লাগে যে ব্যাপারটা সেটা হল, পুরুষ চালকদের সাথে নারীরাও সমান সংখ্যায় চালিয়ে যাচ্ছে। এত বড় বড় বাস নারীরা চালাচ্ছে দেখে ভীষণ ভাল লাগে। বাংলাদেশে তো বাস দূরে থাক, সামান্য সেডানও চালাতে দেখিনি নারীদের। একজন দুজন যাদের দেখেছি, তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। কী স্মার্ট লাগত! অথচ ব্যাপারটা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। পুরুষদের গাড়িচালক হিসেবে দেখতে যেরকম স্বাভাবিক লাগে, নারীদের দেখতেও স্বাভাবিক লাগার কথা ছিল। যা হোক, আমেরিকায় ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে কেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে না। কিন্তু আমি খ্যাঁত। আমি এখনো মুগ্ধ হয়ে বাস, ট্রাক, পিকআপের নারী চালকদের দেখি। আস্তে ধীরে সয়ে যাবে, কিন্তু ততদিন প্রাণভরে দেখে নিই।
বাসে হোয়াইট আমেরিকানদের খুব কম চড়তে দেখি। যারা চড়ে, তারা একটু গরীব ধাঁচের। বেশভূষা ছেঁড়া, নোংরা; চেহারা ময়লা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। কিছুটা বোহেমিয়ান গোত্রের আর কি। কদাচিৎ সুন্দর পোশাক পরা সাদা আমেরিকান উঠে। আর উঠে স্টুডেন্টরা। তাও সংখ্যায় অনেক কম। এখানকার স্টুডেন্টদেরও নিজস্ব গাড়ি আছে। শুধু আমাদের মত নিঃস্ব, দীনহীন স্টুডেন্টের কিছু নেই। আমরা মেট্রো রেল আর বাসের একনিষ্ঠ আরোহী। তবে সবার গাড়ি আছে মানেই যে গাড়ি পালা সস্তা, তা নয়। গাড়ি কেনা সস্তা, পালা বাংলাদেশের মতই খরুচে ব্যাপার। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এখানে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান বুঝাতে ‘হোয়াইট আমেরিকান’ আর কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান বুঝাতে ‘ব্ল্যাক’ বা ‘আফ্রিকান আমেরিকান’ বলা হয়। নিগ্রো, বা হাল আমলের ‘নিগ্গা’ শব্দগুলো ভয়াবহ রকমের অপমানজনক। মার খেয়ে বসতে পারেন যদি এসব শব্দ উচ্চারণ করেন। মজার ব্যাপার হল, কালোরা নিজেদের মধ্যে ‘নিগ্গা’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অন্য জাতির কেউ ব্যবহার করলে সেটা ওদের কাছে অপমানজনক মনে হয়। আবার নিগ্রো শব্দটা এখন কালোদের কাছে অপমানজনক হলেও সতের’শ শতাব্দীর দিকে এই শব্দ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের ডাকার জন্য সবচেয়ে ভদ্র আর নম্র বিশেষ্য। তখন ‘ব্ল্যাক’ শব্দটা ছিল অপমানজনক। ঊনবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে নিগ্রো শব্দটা হয়ে যায় কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের বুঝানোর জন্য বিশেষ টার্ম। এর ফলে নিগ্রো শব্দটার প্রতি কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষোভ জমতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ বক্তৃতায় কৃষ্ণাঙ্গ জাতি বুঝাতে নিগ্রো শব্দটাই ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত নিগ্রো শব্দের উপর খড়্গ নেমে আসেনি। কিন্তু একই সময় আরেক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ম্যাল্কম এক্স ‘নিগ্রো’ শব্দটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এই শব্দের সাথে যেহেতু দাসপ্রথার স্মৃতি, কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দমিয়ে রাখার ঘটনা ইত্যাদি জড়িত, তাই এ নামে কৃষ্ণাঙ্গদের ডাকা মানে তাদের অপমান করা। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের ‘ব্ল্যাক’ বলার পক্ষপাতী ছিলেন। অর্থাৎ তিনশো বছর আগে যে শব্দ ছিল অপমানজনক, কালের পরিক্রমায় সেটাই আজ ভদ্র শব্দ। উল্টোদিকে ভদ্র শব্দ ‘নিগ্রো’ হয়ে গেল খলনায়ক। সময়ের বিবেচনায় কীভাবে শব্দের বা ভাষার রূপ পাল্টায়, তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল নিগ্রো আর ব্ল্যাক শব্দ দুটো।
অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। ফিরে আসি সায়েন্স সেন্টারের গল্পে। সেন্ট লুইস শহরের বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থানই দর্শনার্থীদের জন্য ফ্রি। অন্যান্য শহরে যেখানে যাদুঘরে ঢুকার জন্য কমপক্ষে পাঁচ ডলারের টিকেট কাটতে হয়, সেখানে সেন্ট লুইসের বড় বড় দুটো জাদুঘর কিংবা চিড়িয়াখানা কিংবা সায়েন্স সেন্টার, সবকিছুই ফ্রি। ফ্রি বলে যে সবকিছু যথেচ্ছ বা কম জায়গা নিয়ে তৈরি, সেটা ভাবলে ভুল হবে। সেন্ট লুইস জুলজিক্যাল পার্ক (যাকে সাদা বাংলায় সেন্ট লুইস চিড়িয়াখানা বলে) প্রাণী সংরক্ষণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে পুরো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বিখ্যাত। সেন্ট লুইস আর্ট মিউজিয়াম তো ইউএস-এর অন্যতম প্রধান শিল্প জাদুঘর! সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টারও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ সায়েন্স সেন্টার। সেন্ট লুইস শহরেই ‘মিজৌরি বোটানিক্যাল গার্ডেন’ অবস্থিত। এখানে ঢুকতে অবশ্য ডলার খরচ করতে হয়। বারো বছরের ঊর্ধ্বে প্রবেশ মূল্য চৌদ্দ ডলার, বারো বছর পর্যন্ত ফ্রি। এটার একটা রেকর্ড আছে। এখানে যে ঐতিহ্যবাহী জাপানী বাগান গড়ে তোলা হয়েছে, সেটা উত্তর আমেরিকার সর্ববৃহৎ জাপানী ঘরানার বাগান। জাপানী বাগান বা Japanese garden হল যেকোনো প্রকার কৃত্রিম সাজসজ্জা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি বাগান। জাপানের দার্শনিক ভাবধারার সাথে জাপানী সৌন্দর্য বিদ্যার সমন্বয় ঘটিয়ে এই বাগানের নকশা করা হয়। আরেকটা রেকর্ড হল, পুরো উত্তর আমেরিকার মধ্যে মিজৌরি বোটানিক্যাল গার্ডেন হল দ্বিতীয় বৃহত্তম হার্বারিয়াম। প্রথম বৃহত্তম হল নিউ ইয়র্ক বোটানিক্যাল গার্ডেন। হার্বারিয়াম হল সেই জায়গা যেখানে গাছপালার নমুনা সংরক্ষণ করে রাখা হয়। নমুনার সাথে থাকে প্রয়োজনীয় বর্ণনা যাতে করে নমুনার উপর গবেষণা করা সম্ভব হয়। ছেষট্টি লাখেরও বেশি নমুনা মিজৌরি বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষিত আছে। হার্বারিয়াম শব্দটা এসেছে Herb এবং arium থেকে। Herb অর্থ গাছপালা, arium অর্থ নির্দিষ্ট জায়গা যেখানে কোনোকিছু রাখা হয়। বলুন তো, arium দিয়ে আর কোন শব্দটা আপনারা সচরাচর ব্যবহার করে থাকেন?
হ্যাঁ, অ্যাকুয়ারিয়াম! এখন বলুন Aquarium শব্দটা কীভাবে এসেছে।
(১৭)
ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া সব লেখকের অভ্যাস। এক কাহিনী বলতে গিয়ে লতায় পাতায় আরেক কাহিনী না বললে লেখা জম্পেশ হয় না। আমিও সায়েন্স সেন্টার ভ্রমণের কথা তুলে ঘুরে এলাম বাস, ব্ল্যাক পিপল আর বাগানের গল্পে। তবে আর অপেক্ষা নয়, এবার সত্যিই ঢুকব সায়েন্স সেন্টারে। এই সেন্টারে ঘোরাঘুরি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাগুলোর একটা। সে এক জগত বটে! এমনি এমনি আমেরিকার সায়েন্স সেন্টারগুলোর খ্যাতি আকাশ ছোঁয় না। বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সেন্টার। পথে পড়ে সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল। এটা শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য নির্মিত একটা নামকরা স্কুল। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ১৮১৮ সালে এই বিদ্যালয়ও নির্মাণ করেছিলেন জেজুইট সম্প্রদায়ের পাদ্রীগণ। স্কুল পার হয়ে আরেকটু হাঁটলে সেন্টারের গেট। রবিবার বলে অনেক মানুষ দেখলাম সেন্টারে প্রবেশ করছেন। বাবা-মাকে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। তরুণ তরুণীদের দেখলাম দলবল নিয়ে এসেছে। জমজমাট পরিবেশ। এক ফাঁকে আমরাও ঢুকে গেলাম।
ঢুকে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। বিশাল বড় একটা হলরুমে এসে পড়েছি। ডানে গেলে একটা সেকশন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলে আরেকটা, উপরে উঠলে আরেকটা। ঠিক করলাম প্রথমে ডানে যাব। গিয়ে প্রথমেই যে জিনিসটা দেখলাম সেটা একটা প্লাস্টিকের শরীর। এর বিশেষত্ব হল দেহের ভিতরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর শিরা-ধমনী দেখা যাচ্ছে। বর্ণনা পড়ে বুঝলাম আমি ঐতিহাসিক একটা নমুনার দিকে তাকিয়ে আছি। এর নাম ‘স্বচ্ছ মানবী’ বা ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান। ১৯৩০-এর দিকে জার্মানির কোলোন শহরে প্রথম এ ধরনের মডেল তৈরি করা হয়। ত্রিশ বছর গবেষণার পর শারীরবিদরা দেহাভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিক মাপে এবং অবস্থানে রেখে এই মডেল তৈরি করতে সক্ষম হন। মডেলটি নির্মাণ করতে ব্যবহৃত হয়েছে প্লেক্সিগ্লাস, যেটা দিয়ে স্বচ্ছতা আনা হয়েছে; অ্যালুমিনিয়াম ধাতু, যেটা দিয়ে কংকাল বানানো হয়েছে; কয়েক’শ ফুট লাইটিং তার যা দিয়ে শিরা-উপশিরা-ধমনী বানানো হয়েছে; ত্রিশটা ছোট বাতি যেগুলো দিয়ে দেহের অঙ্গ বুঝানো হয়; এবং বিশেষায়িত লাইটিং সিস্টেম যা সমন্বয় করা হয়েছিল একটা রেকর্ড করা বক্তৃতার সাথে যেন বক্তৃতায় নির্দিষ্ট অঙ্গের নাম বলার সাথে সাথে সেখানকার লাইট জ্বলে উঠে। দেহটির ছাঁচ বানানো হয়েছিল পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা এবং আঠাশ বছর বয়সী এক নাম না জানা তরুণীর দেহ হতে। আমরা তার নাম না জানি, কিন্তু সে চির অমর হয়ে রইল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে। মডেলটি শারীরবিদ্যা অনুযায়ী একদম সঠিক। অর্থাৎ এতে স্থাপিত অঙ্গ এবং রক্তনালীর রঙ, আকার-আকৃতি আর অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক। জার্মান শিক্ষাবিদরা শারীরবিদ্যা শেখানোর জন্য ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান মডেলটি ব্যবহার করতেন। সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টার ১৯৬০ সালে ট্রান্সপারেন্ট উওম্যানের একটা মডেল কেনে এবং প্রদর্শনীতে রাখে, যেটা আপনারা দেখছেন।
আজকালকার দিনে হয়ত ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান ব্যবহার করার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। শব ব্যবচ্ছেদ করেই এখন অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি পড়ানো হয়। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন পড়াশোনার জন্য শব ব্যবচ্ছেদকে পাপ বলে মনে করা হত। রেনেসাঁ আমলের শিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর নাম নিশ্চয় শুনেছেন। উনি যে সময় জীবিত ছিলেন, সে সময় মরদেহ কাটাকুটি করা অপরাধ ছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। মিকেলেঞ্জেলোও ধর্মগুরুদের মন জয় করে কাটাকুটির অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন। মন জয় করার জন্য তিনি যীশু খ্রিস্টের একটা কাঠের ভাস্কর্য তৈরি করে চার্চকে উপহার দেন। বুদ্ধিমান মানুষ। ঠিকই জানতেন কোথায় কেমন ঘুষ কাজে লাগে। আর টা ডা! পাদ্রী মশাই নিজের বাসস্থানের এক চিপায় মিকেলেঞ্জেলোকে লাশ ব্যবচ্ছেদ করে পড়াশোনা করার অনুমতি দেন। সেরকম গোঁড়া সময় হয়ত ১৯৩০ সালের দিকে ছিল না, কিন্তু শব ব্যবচ্ছেদ নিশ্চয় এমন সহজলভ্যও ছিল না, যে কারণে ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান তৈরি করতে হয়েছিল। নব্বই বছর আগের কথা চিন্তা করলে অবাকই লাগে। তখন এমন একটা আধুনিক জিনিস তৈরি করা, তাও আবার সম্পূর্ণ সঠিকভাবে, খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। চিন্তা করে দেখুন, সঠিক জ্ঞান বিতরণের জন্য যুগে যুগে মানুষ কত কষ্ট করেছে। আর এখন সমস্ত জ্ঞান সহজলভ্য হওয়ার পরও আমরা ভুল জ্ঞানকে আঁকড়ে ধরি। অন্তর্জাল থেকে ভুল জ্ঞান আহরণ করি, ভুল ব্যক্তিকে অনুসরণ করি। ঘোর কলিকাল!
এরপর দেখলাম কনুই, নিতম্ব আর হাঁটুর সংযোগস্থলের কার্যপ্রণালী। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হওয়া তিনটা যন্ত্রাংশ দিয়ে শরীরের তিনটা সংযোগের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কী চমৎকার! যেমন, হাঁটুর জয়েন্ট কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝানোর জন্য একটা hinge রাখা আছে। এটা কেবল একদিকে ভাঁজ হয়। আপনার হাঁটুও শুধু পেছন দিকে ভাঁজ হয়। তাই না? আবার কনুইয়ের সংযোগ কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝানোর জন্য একটা পিভট জয়েন্ট রাখা আছে। এই জয়েন্ট ঘুরিয়ে দেখলে বুঝা যায় আমাদের কনুইয়ের সংযোগস্থল কীভাবে কাজ করে। আমাদের কনুই তিনটা হাড়ের সংযোগে গঠিত। উপরের বাহুর হাড় যার নাম হিউমেরাস, যুক্ত হয় নিচের বাহুর দুটো হাড়ের সাথে যাদের নাম রেডিয়াস এবং আলনা। কনুইও হাঁটুর মত কেবল একদিকে ভাঁজ করা যায়। কেউ কি আছেন কনুই পিছনের দিকেও ভাঁজ করতে পারেন? এবার দুই হাত টান টান করে দু’পাশে ছড়িয়ে দিন। হাতের তালু যেন নিচের দিকে থাকে। এবার শুধু তালু ঘুরিয়ে উপরের দিকে উঠান। কী দেখলেন? উপরের বাহু না নড়িয়ে কেবল নিচের বাহুকে মুচড়ে আপনি তালু উপর-নিচ করতে পারছেন। এটাই পিভট জয়েন্টের কার্যপ্রণালী। এরপর দেখলাম নিতম্বের জারিজুরি। নিতম্বের সংযোগস্থলের গালভরা একটা নাম আছে – বল অ্যান্ড সকেট জয়েন্ট। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন কেন এমন নামকরণ। নিতম্বের হাড়ে একটা কাপ আকৃতির সকেট আছে (এর নাম অ্যাসেটাবুলাম), যেটার মধ্যে উরুর হাড়ের গোল মাথা প্রবেশ করে। এই হাড়ের নাম আপনাদের খুবই পরিচিত, ফিমার। প্রবেশ করার পর অ্যাসেটাবুলাম আর ফিমার মিলে একটা জয়েন্ট তৈরি করে। এরকম জয়েন্টের কারণে উরুর হাড় অনেকখানি বিস্তৃত হতে পারে। জিমন্যাস্টিকস দেখে থাকলে নিশ্চয় কল্পনা করে ফেলেছেন কীভাবে ওরা দুই পা মাটির সমান্তরালে ছড়িয়ে দেয়? এই বল অ্যান্ড সকেট জয়েন্টের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়।
এবার চলুন দেখি যন্ত্রপাতির একাল সেকাল। দারুণ মজার একটা সেকশন এটা। প্রথমে আছে রেডিওর আদি রূপ। সিরিয়ালে একটু ওলট পালট আছে, তবে আমার লেখা অনুসরণ করলে সমস্যা হবে না। শুরুতে দেখুন এক নাম্বার ছবির পাঁচ নাম্বার যন্ত্রটা। এটা ১৯৩৫ সালের নির্মিত রেডিও রিসিভার। চার নাম্বার যন্ত্রটাও একটা রেডিও রিসিভার, তবে তৈরি হয়েছিল দুই বছর পর, ১৯৩৭ সালে। দুই আর তিন নাম্বার যন্ত্র দুইটাও রেডিও রিসিভার যেগুলো তৈরি হয়েছে যথাক্রমে ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে। এক নাম্বারে যে যন্ত্র আছে সেটা ১৯৬১ সালে তৈরি একটা রেডিও রিসিভার। তৈরি করেছিল মটোরোলা কোম্পানি। আট আর নয় নাম্বার যন্ত্রগুলো ১৯৬০-এর দশকে তৈরি ট্রানজিস্টর রেডিও। দশ নাম্বারটাও ট্রানজিস্টর রেডিও তবে ১৯৬২ সালে তৈরি। মুক্তিযুদ্ধের উপর বানানো চলচ্চিত্রগুলোয় এ ধরনের ট্রানজিস্টর রেডিও দিয়ে সংবাদ শোনার দৃশ্য দেখা যায়।
এখন দুই নাম্বার ছবির এগারো নাম্বার যন্ত্রটা দেখুন। এটা দেখতে টেলিভিশনের মত কারণ এটা ১৯৪৮ সালে নির্মিত একটা টেলিভিশনই বটে! চাপ দিয়ে অন-অফ করার বোতাম আছে এইটায়। কেসিং তৈরি হয়েছে কাঠ দিয়ে। বারো নাম্বারটা মেহগনি কাঠের আবরণ দিয়ে তৈরি রঙিন টিভি। নির্মাণকাল ১৯৫৮। এই টিভি দেখতে অনেকখানিই আধুনিক টিভির মত। ছয় নাম্বার টিভিটা দেখতে অনেক কিউট! কেমন খেলনা খেলনা ভাব। অথচ যারা বানিয়েছিল তাদের কাছে কতই না আশ্চর্যের ছিল এই যন্ত্র! আর যারা ওই আমলের মানুষ, তারা নিশ্চয় হাঁ হয়ে গিয়েছিল এমন অদ্ভুত পণ্য দেখে? আর আমাদের কাছে দূরদর্শন ব্যাপারটা খেলো হয়ে এখন গণনাযন্ত্র পর্যন্ত পুরনো হয়ে যেতে বসেছে। প্রযুক্তি এত দ্রুত ভোল পাল্টাচ্ছে যে, কিছুতেই আমরা আশ্চর্য হই না। স্যামসাং এস৯ ব্যবহার করে কুলাতে পারলাম না, চলে এল স্যামসাং এস১০। কী কাহিনী! যাক, দেখুন সাত নাম্বার টিভিটা। এটা ১৯৬৯ সালে প্যানাসনিক কোম্পানি তৈরি করেছিল। দেখে মনে হয় যেন এলিয়েনদের সসারের কোনো যন্তর। এর আকৃতিকে তাই বলে ইউএফও (আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবেজক্ট) শেইপ।
এরপর দেখলাম টেবিল ফ্যানের আদি ও বর্তমান রূপ। টিভির মত নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে বলা যায় না, তবে কিছু ব্যাপারে ভিন্নতা লক্ষণীয়। যেমন, বামপাশের টেবিল ফ্যানটা ১৯৫০-এর দশকে মিজৌরিতে তৈরি হয়েছিল। এর কোনো অন-অফ বাটন নেই। সরাসরি প্লাগ-ইন করে চালু করতে হয়। এটায় কোনো স্পিড বাটনও নেই। অর্থাৎ একটাই গতি। সাথে ঝাঁঝরি বা তারজালির ফাঁকা অংশগুলো অনেক বড়। দেখে আমার খুব ভয় লেগেছিল। বাচ্চারা তো বটেই, বড়রাও খামখেয়ালে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এত বড় ফাঁক দিয়ে। কিন্তু ডানপাশে ২০১০ সালের যে ফ্যানটা দেখা যাচ্ছে, সেটার সবকিছু উন্নতমানের। স্পিড বাটন, ছোট ফাঁকওয়ালা ঝাঁঝরি আর অন-অফ বাটন তো আছেই, আকারেও বড় হয়েছে। আরেকটা ভিন্নতা এসেছে দুটো ফ্যানের উপাদানে। বলুন তো কী? হ্যাঁ, প্রথম ফ্যানটা ধাতব, দ্বিতীয়টা প্লাস্টিকের।
এরপরের যন্ত্র একটা টোস্টার। ১৯২০-এর শুরুতে এ ধরনের টোস্টার ব্যবহার করা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বেশ সাধারণ ঘটনা ছিল। তবে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাউরুটির দুই পাশ টোস্ট করতে পারত না। হাত দিয়ে পাউরুটি ঘুরিয়ে দিতে হত। কয়েক বছর পর, ১৯২৫ সালে, সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় পপ-আপ টোস্টার তৈরি হয় যেটা রুটির দুইপাশই টোস্ট করতে পারত। মজার ব্যাপার হল, তখনও পর্যন্ত পাউরুটি ফালি ফালি করে কেটে, মোড়কজাত করে বাজারে ছাড়া শুরু হয়নি। অর্থাৎ মানুষের কাছে প্যাকেটকৃত পাউরুটি সহজলভ্য ছিল না। এর আগেই প্রযুক্তিবিদদের টোস্টার তৈরি করা শেষ! অবশ্য তাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯২৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে পাউরুটির প্যাকেট বিক্রি শুরু হয়। ফলে মানুষজনও টোস্টার ব্যবহার করার একটা অজুহাত পায়। ডানপাশে দেখুন ২০১০ সালের একটা আধুনিক টোস্টার। এই টোস্টারে স্লটের পরিধি ইচ্ছেমত ছোট-বড় করে মোটা মোটা বেগল আর পেস্ট্রিও টোস্ট করা যায়।
এরপর আছে বিশাল একটা রেডিও রিসিভারের ছবি, সাথে ছোট্ট একটা আইপড। আগে যেখানে কণ্ঠস্বর শোনার জন্য বিশাল এক যন্ত্র কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হত, এখন সেখানে হাতের তালুতে এঁটে যায় এমন আইপড নিয়ে ঘুরি। এরপর খুব মজার একটা জিনিস। ১৯৮০ সালে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সাথে ২০১০ সালের যন্ত্রপাতির গুণগত পার্থক্য দেখানো হয়েছে। আশি সালে কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে এক বছরে কত শক্তি খরচ হত আর কত ডলার বিদ্যুৎ বিল আসত, সেটার সাথে তুলনা করা হয়েছে ২০১০ সালে কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে এক বছরে কত শক্তি খরচ হত আর কত ডলার বিদ্যুৎ বিল আসত সেটার। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে টেলিভিশন আর রেফ্রিজারেটরের ক্ষেত্রে। আশি সালে টিভির বিল আসত পনেরো ডলার, ২০১০ সালে বিল বেড়ে হয়েছে পঁচিশ ডলার। আবার আশি সালে রেফ্রিজারেটরের বিল আসত ১৮১ ডলার, ২০১০ সালে কমে যেটা হয়েছে মাত্র ৮৯ ডলার। ডিশওয়াশারেও এখন আমরা অনেক ডলার বাঁচাতে পারি। আগে যেখানে বছরে ৬৮ ডলার খরচ হত, এখন হয় ২৯ ডলার। মোটামুটি সব পণ্যতেই এখন শক্তি আর খরচ বাঁচে, কেবল ঠকে গিয়েছি টেলিভিশনে।
বিংশ শতাব্দী হতে একবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে কিছু জিনিসের আকার ছোট হয়েছে, কিছু জিনিসের বড়। টেলিভিশন বাড়তে বাড়তে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত গড়িয়েছে, টেবিল ফ্যান আর টোস্টারের আকার বেড়েছে, কিন্তু রেডিও ছোট হতে হতে আইপডে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে আর কী দেখব, অপেক্ষায় আছি।
এরপর দেখতে গেলাম ফসিল বা জীবাশ্মের সেকশন। এখানে বিভিন্ন ধরনের জীবাশ্ম রাখা আছে। বই বা অন্তর্জাল থেকে জীবাশ্মের প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু সেটা ছিল শুধুই পুস্তকলব্ধ জ্ঞান। আজ নিজ চোখে দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলাম। কে না জানে, গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। তাই গ্রন্থের বিদ্যাকে মস্তিষ্কের ভেতর পুরে দেওয়ার জন্য দরকার ব্যবহারিক জ্ঞান। আর এ কাজের জন্য সায়েন্স সেন্টারটা কতখানি অসাধারণ, সেটা টের পাচ্ছি পদে পদে। মানুষকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে কিংবা মৌলিক (বেসিক) জ্ঞান দেওয়ার কত যে ব্যবস্থা এই সেন্টারে আছে! এত সহজ করে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আগে থেকে কিছু জানা না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ফসিল অনেকভাবে তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে অ্যাডপ্রেশন (adpression), কাস্ট অ্যান্ড মোল্ড (Casts and molds), পারমিনারেলাইযেশন (Permineralization), কার্বোনাইযেশন (Carbonization), রিপ্লেস্মেন্ট (Replacement) বা প্রতিস্থাপন, কঠিন অংশের সংরক্ষণ (Preservation of hard parts) ইত্যাদি প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। দুঃখিত যে সবগুলোর বাংলা নাম আমার জানা নেই। আপনাদের সামনে যে ছবিগুলো আছে সেখানে এ ছয় ধরনের প্রক্রিয়ায় পাওয়া জীবাশ্ম দেখা যাচ্ছে। চলুন দেখি কোনটা কী।
প্রথমেই আছে দুটো ফার্নের জীবাশ্ম, যেগুলো তৈরি হয়েছে কার্বোনাইযেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। এজন্য এগুলো কালো রঙের। তৃতীয় ছবিটা অ্যাডপ্রেশন পদ্ধতির উদাহরণ। এরপর আছে ট্রাইলোবাইট নামক অমেরুদণ্ডী সন্ধিপদী (arthropods) প্রাণীর জীবাশ্ম, যারা আজ থেকে ২৫২ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই জীবাশ্ম তৈরি হয়েছে কাস্ট অ্যান্ড মোল্ড পদ্ধতিতে। তবে এখানে শুধু কাস্ট দেখা যাচ্ছে। পঞ্চম ছবি থেকে পরপর পাঁচটা ছবিতে হাতে কলমে দেখানো হয়েছে কীভাবে কাস্ট অ্যান্ড মোল্ড পদ্ধতিতে ফসিল তৈরি হয়। এখানে একটা ঝিনুক আছে যা পলিমাটিতে আটকে গিয়েছিল। যুগ যুগ ধরে সেটার উপর পলি জমেছে। একসময় ঝিনুকের খোলস আর ভেতরের নরম দেহ নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু ততদিনে মাটির গায়ে ঝিনুকের ছাঁচ তৈরি হয়ে গেছে। একে বলে এক্সটার্নাল মোল্ড বা বাইরের ছাঁচ। আর ঝিনুকের খোলস যেখানে ছিল, সে ফাঁকা অংশে খনিজ পদার্থ জমতে জমতে একদম ঝিনুকের মত দেখতে যে খোলস তৈরি হয়েছে, সেটা হল কাস্ট। এক্সটার্নাল মোল্ড যেহেতু আছে, আমরা ধরে নিতে পারি ইন্টার্নাল মোল্ড বলেও কিছু আছে। ঝিনুকের খোলসের ভেতরে যে ফাঁপা জায়গা আছে (যেখানে নরম দেহটা থাকত), সেখানে খনিজ পদার্থ বা পলিমাটি জমতে জমতে তৈরি করেছে ইন্টার্নাল মোল্ড।
এরপর আছে প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া জীবাশ্মের ছবি। এটা একটা প্রস্তরীভূত কাঠের অংশ। প্রস্তর মানে পাথর। অর্থাৎ যে গাছ থেকে কাঠটা কাটা হয়েছে, সে গাছ পাথরে পরিণত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘আয়নাঘর’ উপন্যাসে আমি প্রথমবারের মত পেট্রিফায়েড ফরেস্টের নাম পড়েছিলাম। এরপর উনার ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ আত্মজীবনীতে পেট্রিফায়েড ফরেস্ট নামে একটা গল্প পড়েছিলাম। তখন থেকেই ব্যাপারটার প্রতি আমার গভীর আগ্রহ। এখনো প্রস্তরীভূত অরণ্য দেখার সুযোগ ঘটেনি বটে, সায়েন্স সেন্টার আমাকে সুযোগ করে দিল ওই বন কেমন হতে পারে তার একটা নমুনা দেখার। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আস্ত একটা গাছ পাথর হয়ে যায় কীভাবে? যখন নির্দিষ্ট পরিবেশে বছরের পর বছর ধরে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের উপর দিয়ে পানি বয়ে যায়, তখন ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের শক্ত অংশ ক্ষয়ে পানিতে মিশে যায়। আর পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ এসে জায়গা দখল করে শক্ত অংশের। অর্থাৎ খনিজ লবণ দিয়ে প্রকৃত উপাদানগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। ছবিতে যে কাঠ দেখা যাচ্ছে, সেটার কোষগুলো প্রতিস্থাপিত হয়েছে খনিজ লবণ দিয়ে। হয়ে এখন পুরোদস্তুর পাথরে পরিণত হয়েছে। এরপরের ছবিটা প্রবাল জীবাশ্মের। প্রবালটা কোনো এক খনিজ পদার্থ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। এরপর দেখছেন একটা খোলসযুক্ত নরমদেহের প্রাণীর (mollusk) জীবাশ্মের ছবি। এটার নরম অংশ পচে গেলেও খোলস পচে যায়নি, নষ্ট হয়নি। বরং সত্যিকারের খোলসটা এত বছর ধরে সংরক্ষিত আছে। এটা Preservation of hard parts প্রক্রিয়ার নমুনা।
সায়েন্স সেন্টার ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম এতকিছু মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দেখা সম্ভব না। টানা আড়াই ঘণ্টা দেখেও অনেক কিছু অদেখা রয়ে গেল। আরেকদিন আসতে হবে সকাল-সন্ধ্যা হাতে নিয়ে। সেন্টার থেকে বাসায় আসতে আসতে চিন্তা করলাম জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাইরের কিছু খেলে কেমন হয়? কিন্তু এখানকার ফাস্ট ফুড সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই। কোথা থেকে কী কিনলে সবার ভাল লাগবে, বুঝতে পারছি না। বিস্তর চিন্তাভাবনার পর ঠিক করলাম পিতজা হাট থেকে পিতজা নেব। এই জিনিস নিশ্চয় সবাই খায়। বাসায় যাওয়ার পথে লিন্ডেল মার্কেটপ্লেস বলে একখানা মার্কেট পড়ে। এখানে মুদির দোকান, জামাকাপড় আর জুতার দোকান, ফাস্ট ফুড শপ, চাইনিজ আর জাপানিজ রেস্তোরাঁ, গাড়ি ঠিক করার দোকান, চুল কাটার সেলুন (ছেলেমেয়ে এক সেলুনে কাটে), মোবাইলের দোকান ইত্যাদি আছে। চারকোণা বাক্স আকৃতির একতলা মার্কেট। মাঝেখানের বিশাল জায়গা জুড়ে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা। এই মার্কেটেরই এক কোণায় পিতজা হাটের ছোট্ট দোকান। সেখানে ঢুকে দেখি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। অর্ডার করে নিয়ে যেতে হবে। কাউন্টারে গিয়ে হাই হ্যালো সারার পর আফ্রিকান আমেরিকান তরুণী গেটো উচ্চারণে কিছু জিজ্ঞেস করল। ধরে নিলাম সে জিজ্ঞেস করছে কী খেতে চাই। বললাম শূকরের মাংস বাদে কী কী পিতজা আছে? মেয়েটা আবারও গেটো উচ্চারণে কী কী বলল। আমি আর প্রিন্স মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অবশেষে বললাম, আমরা আমেরিকায় নতুন এসেছি। তোমার কথা কিছু বুঝি না। আমাদের একটা বিফ আর আরেকটা চিকেন সসেজ পিতজা দাও। দোকানে ঢুকার আগে দেখেছিলাম দুটো পিতজা কিনলে কিছুটা ছাড় দিচ্ছ। আমরা ওই অফার নিতে চাই। মেয়েটা প্রশ্ন করল, “হোট ডু ওন্ট অন ঠ?” প্রিন্স এই পর্যায়ে পুরোপুরি হারিয়ে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল, ‘ইয়েস, ইয়েস!’ শোচনীয় অবস্থা। ইয়েস, নো, ভেরি গুডের চেয়েও খারাপ। মেয়েটা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে তৃতীয়বারের মত জানতে চাইল, “হোট ডু ওন্ট অন ঠ?” এবার আমার মাথায় তারাবাতি জ্বলে উঠল। ইউরেকা! আমি বুঝতে পেরেছি সে কী জিজ্ঞেস করছে। সে বলছে, “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট অন টপ?” প্রিন্সকে রেহাই দিয়ে বললাম, “দা বেস্ট টপিং।” কোন টপিংটা ভাল হবে, কোনো ধারণা নেই। তরুণীর কাছ থেকে গেটো উচ্চারণে ধারণা নিতেও চাচ্ছি না। তাই ওরা যা ভাল মনে করে, সেটা নেওয়াই উত্তম।
অর্ডার চূড়ান্ত হলে প্রিন্স বেরিয়ে গেল কোক কিনতে। মার্কেটপ্লেসে শ্নাক্স নামের যে মুদি দোকান আছে, সেখান থেকে কিনবে। মুদি দোকান বললেও এগুলো শুধু মুদি জিনিসপত্র বিক্রি করে না। এখানে ফলমূল, চাল-ডাল, শাকসবজি থেকে শুরু করে ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যায়। মদ চাইলে সেটাও পাবেন। তবে আমেরিকায় একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। একই পণ্য একেক দোকানে একেক মূল্যে বিক্রি করে। যদি শ্নাক্সে এক পাউন্ড পালং শাকের দাম সাড়ে তিন ডলার হয়, অল্ডি নামের আরেক মুদি দোকানে গেলে এক পাউন্ড পালং শাক পাবেন তিন ডলারে। বাংলাদেশে যেমন একই পণ্যের দাম এলাকাভেদে একই রকম থাকে, যেমন লাল শাকের আঁটি কালাচাঁদপুর বাজারে দশ টাকা হলে হাতিরপুল বাজারেও দশ টাকাই চাইবে, আমেরিকায় তেমন না। এজন্য আমরা আগে হিসেব করতে বসি কোন পণ্য কোথায় কম দামে দেয়। এরপর সে অনুযায়ী কিনতে যাই।
পনেরো মিনিট পর প্রিন্স ফিরল। ওর হাতে দুটো বোতল। একটা কালো কোকাকোলা, আরেকটা নীল ফান্টা। কালোটা চেরি ফ্লেভারের কোক, নীলটা ব্লুবেরি ফ্লেভারের ফান্টা। দেশে কখনো এক ফ্লেভারের বাইরে কোক, ফান্টা খাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই ফ্লেভারের রকমফের দেখে বেচারা না কিনে থাকতে পারেনি। আমারও প্রচণ্ড কৌতূহল হল স্বাদগুলো চেখে দেখার। একটু পর পিতজা ডেলিভারি দিল। কার্ড দিয়ে মূল্য চুকিয়ে আমরা বিশাল বড় দুটো পিতজার প্যাকেট হাতে করে বাসার দিকে রওনা দিলাম। মার্কেটপ্লেস থেকে বাসা দূরে নয়। মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা। কিন্তু এই বিশাল প্যাকেট আর চার লিটারের কোমল পানীয় নিয়ে হাঁটতে গিয়ে জিহ্বা যেন বেরিয়ে গেল। কোনোমতে বাসায় পৌঁছে শাওন ভাইকে ডাক দিলাম। বিকেল চারটা বাজে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। তার উপর পিতজার গন্ধে পাগল হয়ে যাচ্ছি। শাওন ভাই উনার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। খাবারের আয়োজন দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঘটনা কী। বললাম, প্রিন্সের জন্মদিন উপলক্ষ্যে হালকা পাতলা উদযাপন। শাওন ভাইয়ের মতে, দুটো পিতজা হালকা নয়, বেশ ভারীই। কিন্তু উনি মাত্র ভাত খেয়েছেন। পেটে এক ফোঁটা জায়গা নেই। আবার উনাকে ছাড়া জন্মদিনের আয়োজন খেতেও কেমন লাগছে আমাদের। অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে উনি এক টুকরো পিতজা হাতে নিলেন। আমি আর প্রিন্সও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
ফ্লেভার্ড ফান্টা আর কোক দেখে শাওন ভাই মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। বললাম, রঙ দেখে নিয়ে এসেছি। ভাই বললেন, এরকম এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে উনারা অনেকবার ধরা খেয়েছেন। তাই আর নিজের টাকায় এক্সপেরিমেন্ট করেন না। শুনে একটু ঘাবড়ে গেলাম। দ্রুত গ্লাসে কোক ঢেলে চুমুক দিলাম। সাথে সাথে রুচি সব চলে গেল। এত বিচ্ছিরি! এই বোতল শেষ করতে আমাদের তিন সপ্তাহ লেগেছিল। শাওন, আনজাম বা মারুফ ভাই, কেউই এটা খান না। সবাই আগেই ধরা খেয়েছেন এরকম নীল, লাল, বেগুনি রঙের ফান্টা খেয়ে। এবার আমরা ধরা খেলাম। ঠিক করলাম আর কখনো রঙবেরঙের কোমল পানীয় কিনব না। কালো রঙের পানীয়ই শ্রেষ্ঠ। সাথে কমলা রঙের ফান্টা। কিন্তু কথায় আছে না, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী! আমাদেরও ওই অবস্থা। পরেরবার দোকানে গিয়ে লাল ফান্টা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে কিনে এনেছি, আর ইয়াক! প্যারাসিটামলের সাথে ফেনারগান ওষুধ একসাথে মেশালে যে স্বাদ হবে, ঠিক সে স্বাদ। এরপর অবশ্য ফান্টার ধারে কাছে যাইনি। রঙবেরঙের পানীয় খেতে চাইলে কিনেছি বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস। হাওয়াইয়ান পাঞ্চ নামের একটা ব্র্যান্ড আছে যারা সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল, নীল, বেগুনি সব রঙের জুস বানায়। ওদের জুসগুলো খেয়েছি। খেয়ে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি, আমেরিকায় লাল রঙের জুস বা কোমল পানীয় মানেই প্যারাসিটামলের সাথে ফেনারগান ওষুধের মিশ্রণ। ক্র্যানবেরি নামের একটা ফল থেকে এই লাল রঙের জুস বা কোমল পানীয় বানানো হয়। খুব ইচ্ছে আমার, একদিন আস্ত ক্র্যানবেরি খেয়ে দেখব আসলেই এরকম বিশ্রী স্বাদ কিনা।
পিতজা খেয়ে আমি আর প্রিন্স আবারও বেরিয়ে পড়লাম ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে। এবারের গন্তব্য ডেলমার বুলেভার্দ। এই বুলেভার্দের একটা অংশের নাম ডেলমার লুপ। এটা আমেরিকার দশটা বিখ্যাত রাস্তার মধ্যে একটা। ডেলমারের আগের নাম ছিল মরগ্যান স্ট্রিট। কথিত আছে, মরগ্যান স্ট্রিটের দুই দিকে বাস করত ডেলাওয়ার (Delaware) আর মেরিল্যান্ড (Maryland) অঙ্গরাজ্য থেকে আগত দুই জমিদার। তারা তাদের শহরের নামের প্রথম তিন অক্ষর একত্র করে “ডেলমার” নামটা বানান আর মরগ্যান স্ট্রিটের নাম বদলে ডেলমার করে দেন। ডেলমার লুপে এলে নাকি সেন্ট লুইস শহরের চাঞ্চল্য আর তারুণ্য দেখা যায়। পাব, রেস্তোরাঁ, কফি শপ, শপিং মল, শো-রুম, সিনেমা কী নেই এখানে? এসব শুনে শুনে আমাদের কানের পোকা নড়ে গেছে। আজ ওখানে যাবই যাব। কিন্তু ত্রিশ মিনিট ধরে বাস স্টপে বসে আছি, বাস আসছে না। তখনও পর্যন্ত জানি না, বাসের আসা যাওয়া ট্র্যাক করার জন্য মোবাইল অ্যাপ আছে। তাই অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে ক্ষান্ত দিলাম। ঠিক করলাম লিন্ডেল মার্কেটপ্লেসে PayLess Shoe নামের যে জুতার দোকান আছে, সেখানে যাব। একটা কেডস কেনা দরকার আমার। এ দোকানে দেখলাম ক্লিয়ারেন্স সেল দিচ্ছে। দোকানটা নাকি দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। এখন ৫০% ছাড়ে সবকিছু বিক্রি করে আমেরিকা থেকে পাততাড়ি গুটাচ্ছে।
ফুটপাথ ধরে হাঁটছি আর আশেপাশে দেখছি কোনো বাসায় “ফর রেন্ট” লেখা আছে কিনা। হাঁটার মাঝপথে শাওন ভাইয়ের কল এল, “আপু, আপনারা কোথায়? আপনাদের জন্য একটা এপার্টমেন্টের অফার পেয়েছি।” আমি আর প্রিন্স লাফিয়ে উঠলাম। শাওন ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মূর্তি তার এপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। যদি আমরা এই এপার্টমেন্ট নিতে চাই, শাওন ভাই মূর্তির সাথে কথা বলতে পারেন। আমেরিকায় এক বেডরুম, দুই বেডরুম বা তিন বেডরুম এপার্টমেন্টের পাশাপাশি স্টুডিও নামের আরেক ধরনের এপার্টমেন্ট দেখা যায়। এখানে একটা রুমের ভিতরেই লিভিং রুম, বেডরুম, রান্নাঘর সবকিছু থাকে। এসব অংশ কোনো প্রকার দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা থাকে না। সাধারণত স্টুডেন্টরা এসব এপার্টমেন্টে থাকে যাদের বড় বড় এপার্টমেন্টের দরকার পড়ে না। তবে স্টুডিও এপার্টমেন্টও এক বেডরুমের মত বড় হতে পারে। আবার এক বেডরুম হতে পারে স্টুডিওর মত ছোট। মূর্তির বাসাটা ৫৬০ স্কয়ার ফিটের স্টুডিও এপার্টমেন্ট। আবার এক বেডরুমের একটা বাসা দেখেছি যেটা ৫০০ স্কয়ার ফিটের। অর্থাৎ স্টুডিও মানেই যে ছোট হবে, সেরকম নয়।
মূর্তি দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। ওর কাছে নাকি মনে হচ্ছে স্টুডিও হিসেবে ওর এপার্টমেন্টের ভাড়া অনেক বেশি। তাই ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় উঠতে চাচ্ছে যেটার ভাড়াও বেশি, আকারেও বড়। কিন্তু সমস্যা হল ও লিজ নিয়েছে এক বছরের জন্য। এই লিজ ভেঙে চলে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না নতুন ভাড়াটিয়া যোগাড় করে আনতে পারছে। আমেরিকায় এই এক সমস্যা। বাসাবাড়ি লিজ নিতে হয়। বাংলাদেশের মত একমাসের নোটিশে ছেড়ে দেওয়া যায় না। চুক্তি করতে হয় কয়েকমাস বা এক বছরের জন্য। সর্বনিম্ন লিজ দেখেছি তিনমাসের। এর কমে লিজ দেওয়া হয় না। আবার মূর্তি যাদের আনবে, তাদের এপার্টমেন্ট লিজ নিতে হবে যেমন আছে, তেমনভাবে। অর্থাৎ নতুন ভাড়াটিয়ার আসা উপলক্ষ্যে ম্যানেজমেন্ট কোনোপ্রকার ধোয়ামুছার ঝামেলায় যাবে না। মূর্তি ছাড়বে, নতুন পার্টি উঠবে। ছাড়ার আগে মূর্তি বাসা পরিষ্কার করবে নাকি বাসায় উঠে নতুন ভাড়াটে করবে, সেটা ওদের মধ্যকার ব্যাপার। আবার নতুন ভাড়াটেকে লিজ নিতে হবে এক বছরের জন্য। সব শুনে একটু খটকা লাগলেও এ মুহূর্তে আমাদের হাতে অন্য উপায় নেই। একমাস ধরে বাসা খুঁজছি, পাচ্ছি না। এই বাসা বাতিল করে দেওয়ার মত বিলাসিতা আমাদের মানায় না। শাওন ভাই বললেন, আপাতত একটু বেশি ভাড়া দিয়ে এটা নিয়ে ফেলতে। এরপর কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে। চিন্তা করে দেখলাম প্রস্তাবটা খারাপ নয়। একমাস হতে চলল শাওন ভাইদের বাসায় আস্তানা গেঁড়েছি। আর কত জ্বালাব উনাদের? ভাইকে বললাম, আমরা বাসাটা নিতে আগ্রহী। উনি যেন মূর্তির সাথে বাৎচিত করেন। এরপর এক ঝলক নেচে নিলাম। এরচেয়ে সুন্দর উপহার প্রিন্সের জন্মদিনে আর কী হতে পারে? আমি নাকি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হওয়া কিংবা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ পাওয়ার পরও এত খুশি হইনি, যতটা হয়েছি বাসা পাওয়ার সংবাদ শুনে। কথা সত্য। বাসা নিয়ে কম ভোগান্তিতে তো পড়িনি!
মূর্তি শাওন ভাইয়ের প্রাক্তন রুমমেট। আমেরিকায় রুমমেট মানে একই বাসায়, কিন্তু আলাদা বেডরুমে বসবাসকারী ব্যক্তি। এখানে এক রুমে দুইজন থাকে না কারণ পার্সোনাল স্পেসকে খুবই মূল্য দেওয়া হয়। যদি আমেরিকানরা বাংলাদেশী হলের গণরুমের কথা শোনে, নির্ঘাত হার্ট এটাক করবে। আমার ছোট ভাই অঝর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল, জগন্নাথ হলের গণরুমে ওর থাকার বন্দোবস্ত হল। আমি দেখতে গিয়েছিলাম একবার। গণরুম মানে মেঝেতে ঢালাও তোষক বিছিয়ে অনেক ছাত্রের শোয়ার ব্যবস্থা। চারিদিক অগোছালো, কাপড় চোপড় এখানে সেখানে ছড়ানো, দড়ি টাঙ্গিয়ে কাপড় রাখার ব্যবস্থা, ছারপোকা ভর্তি তোষক, সে এক এলাহি কারবার। এরকম পরিবেশ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকতে পারে, সেদিনের আগে জানতাম না। আমেরিকায় এসে রুমমেটের নতুন সংজ্ঞা শিখে ওই স্মৃতি বার বার মনে পড়ল। শাওন ভাই মূর্তির সাথে আমাদের এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দিলেন। মূর্তি এসে আমাদের নিয়ে যাবে তার এপার্টমেন্ট দেখাতে।
পরদিন সকালে মূর্তি তার নীল হোন্ডা সিভিক চালিয়ে আমাদের নিতে এল। একটাই দরজা। এটা দিয়েই পিছনের সিটে ঢুকতে হয়। এরকম গাড়ি এই প্রথম দেখলাম। মূর্তি এপার্টমেন্ট গুলশান, বনানীর মত অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। আমি আর প্রিন্স এই এলাকায় হাঁটতে আসতাম আর ভাবতাম, যদি একটা এপার্টমেন্ট পাওয়া যেত এখানে! কিন্তু সস্তা এলাকার এপার্টমেন্টই যেখানে ভাড়া পাচ্ছি না, সেখানে এই এলাকায় ভাড়া পাওয়া ‘স্রেফ মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যাঁয়’। অথচ ঠিক এখানেই আমাদের প্রথম এপার্টমেন্ট জুটল। সারা মাস জুড়ে কমদামী এপার্টমেন্ট খুঁজে অবশেষে উঠতে হচ্ছে এক দামী এপার্টমেন্টে। তবে এটা ঠিক, এপার্টমেন্টটা আমাদের চরম দুঃসময়ে স্বস্তির বাতাস নিয়ে এসেছে। ছুটি শেষ করে তিন ভাই-ই আমেরিকায় ফিরে এসেছেন। ফলে এক বাসায় ছয়জন মানুষের থাকা খুব করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় এই এপার্টমেন্টের দেখা পাওয়াটা অনেক আনন্দের একটা ঘটনা। বলে রাখা দরকার, চারজন ভাইয়ের প্রতিই আমাদের অসীম কৃতজ্ঞতা। তারা একমাস আমাদের থাকা খাওয়াসহ সবকিছুর যত্ন নিয়েছেন, আমেরিকার দোকানপাট আর জীবন যাপন পদ্ধতি চিনিয়েছেন। তারা এগিয়ে না এলে প্রাথমিক দিনগুলো যে কী কষ্টে কাটত, ভাবতেও ভয় হয়।
যা হোক, মূর্তির এপার্টমেন্টে ঢুকতেই ভক করে বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে এল। ও দুটো কুকুর পোষে। কুকুরের লোম পুরো কার্পেটে ছড়ানো, কুকুরের গন্ধে সারা বাসা ভর্তি। এছাড়া খুব সুন্দর স্টুডিওটা। বিছানা, সোফা, পড়ার টেবিল সবকিছুই এঁটে গেছে সুন্দরমত। বাসাটা পছন্দ হল খুব কিন্তু লোম আর গন্ধের কী হবে? এক মিনিটও আমি টিকতে পারলাম না বাসার ভেতর। ছিটকে বাইরে চলে এলাম। মূর্তি জানতে চাইল আমরা নিব কিনা। সম্মতি দিলাম। তারপর ম্যানেজারের কাছ থেকে এপ্লিকেশন ফর্ম নিয়ে এলাম। এটা পূরণ করে ওদেরকে দিলে ওরা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে সিদ্ধান্ত জানাবে। আমার আর প্রিন্সের কপালে হাত। সেই একই পদ্ধতি এখানেও? ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের ফাঁদে পড়ে এর আগে তিনটা বাসা হাতছাড়া হয়েছে। এটার বেলায় ভেবেছিলাম চেক ফেক কিছু হবে না, সরাসরি বাসা পেয়ে যাব। মূর্তিও চিন্তায় পড়ল। যদি চেকের পর আমাদের না করে দেয়, তাহলে ওরও বিপদ। ও আরেক জায়গায় কথা দিয়ে ফেলেছে বাসা নেবে বলে। ও-ও বুঝতে পারেনি ম্যানেজার এইভাবে আগাবে। ম্যানেজার নাকি ওকে বলেছিলেন, ‘তুমি নতুন ভাড়াটিয়া যোগাড় করে দাও, তাহলে লিজ ভেঙে চলে যেতে পারবে।’ সে অনুযায়ী মূর্তি আমাদেরকে যোগাড় করে এনেছে। এখন আবার কী কাহিনী?
আরেকবার রিজেক্টেড হওয়ার আশা নিয়ে ফর্ম পূরণ করলাম, জমা দিলাম। কিছু ডলার খরচ হল আবেদন করতে। ম্যানেজার বললেন, তিনদিনের ভেতর জানাবেন আমরা নির্বাচিত হয়েছি কিনা। এই তিনদিন বেশ দুশ্চিন্তায় কাটল। একবার ভাবলাম, রিজেক্টেড হলে ভালই হয়। গন্ধওয়ালা ওই বাসায় আমি থাকতে পারব না। প্রিন্স সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কুকুর চলে গেলে গন্ধও চলে যাবে। আগস্টের আটাশ তারিখে কল এল, আমরা বাসাটা লিজ নেওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছি। ইয়াহু! মূর্তিকে জানালাম। ভাইদেরকেও সুখবর দিলাম। নিজেদের বাসা, শুধু আমাদের দুইজনের। আনন্দের সীমা নেই। একটু একটু করে অনেক কিছুই কিনেছি সংসার শুরু করার জন্য। সেগুলো গোছগাছ শুরু করলাম। সেপ্টেম্বরের এক তারিখে জিনিসপত্র নিয়ে নতুন বাসায় এলাম। সেগুলো এক কোণায় রেখে আবার শাওন ভাইদের বাসায় চলে গেলাম রাত কাটানোর জন্য। কারণ মূর্তি এখনো ওর জিনিসপত্র সরায়নি। ও ছুটি কাটাতে গেছে নিউইয়র্কে। সেখান থেকে এসে চার তারিখে বাসা খালি করবে।
মূর্তি বাসা খালি করার পর আমি, প্রিন্স, শাওন ভাই আর আনজাম ভাই মিলে কুকুরের গন্ধ দূরীকরণ কার্যক্রমে নামলাম। বাসার একটা দারুণ বৈশিষ্ট্য হল, একপাশের পুরো দেওয়াল জুড়েই জানালা। এত বড় জানালা আমি এই এখানেই প্রথম দেখলাম। বিশাল সেই জানালা খুলে দেওয়া হল। যতটুকু গন্ধ বাইরে বের হতে পারে, ততটুকুই লাভ। এরপর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে তিন চারবার পুরো কার্পেট পরিষ্কার করা হল। প্রতিবারই লোম দিয়ে বাক্স ভর্তি হয়ে গেল। এত লোম কবে নাগাদ পরিষ্কার করা সম্ভব হবে, কেউ নিশ্চিত হতে পারলাম না। এরপর সুগন্ধি ছিটিয়ে দেওয়া হল কার্পেট জুড়ে। আমি সে সুগন্ধি টের পেলাম না। আমার নাকে এখনো কুকুরের গন্ধ আসছে।
পর্ব আট এখানে