পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত
(১৮)
নতুন বাসার লিজ সাইন করলাম। এক বছরের জন্য। লিজ শেষ হলে হয় আমি নতুন লিজ সাইন করব, নয়তো মাসের ভাড়া মাসে দিয়ে থাকতে পারব। মাসিক ভাড়া দেওয়ার সুবিধা হল, ইচ্ছে না হলে যেকোনো সময় বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারব। কিন্তু তারপরও মানুষ লিজ নেয় কারণ লিজের মাঝখানে যদি ভাড়া বেড়ে যায়, তাহলে লিজ নেওয়া ব্যক্তিকে বেশি ভাড়া গুনতে হয় না। সে যে ভাড়া থাকতে লিজ নিয়েছে, সে ভাড়াই দেয়। কিন্তু যারা মাস প্রতি ভাড়া দিচ্ছে, তাদের উপর খড়গ নেমে আসে। তাদের নতুন ভাড়া গুনতে হয়। যা হোক, ম্যানেজার আমাদের স্বাগত জানালেন এক ঝুড়ি চকলেট আর বিস্কিট দিয়ে। ম্যানেজারের নাম ডেবি। ডেবরা থেকে ডেবি। বয়স ষাটের উপর। শরীরে বুড়ি কিন্তু মনে জোয়ান। প্রচুর রসিক। সারাক্ষণ সার্কাজম করছে। ফ্রেন্ডস সিরিজের চ্যান্ডলারের মত। খুব সম্ভবত বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগী কারণ হঠাৎ হঠাৎ মুড বদলে যায়। আমরা যখন অগ্রিম ভাড়া দিলাম, সিকিউরিটি মানি দিলাম, খুব হেসে জমা নিল। যেই বললাম বাসা পরিষ্কার করে দেওয়ার কথা, অমনি রেগে গেল। বিড়বিড় করে শাপশাপান্ত শুরু করল। মূর্তি নাকি বলেছে বাসা যেরকমভাবে ছেড়ে দিচ্ছে, সেভাবেই আমরা নিতে রাজি হয়েছি। তাহলে আবার বাসা পরিষ্কার করার কথা কেন উঠছে? আমরা হতভম্ব। নতুন ভাড়াটিয়া উঠলে বাসা পরিষ্কার করে দেবে না? বাংলাদেশে তো এটাই দেখে এসেছি। কিন্তু মূর্তি জানাল, এখানে নিয়ম অন্যরকম। লিজ শেষ করে কেউ চলে গেলে সেক্ষেত্রে ম্যানেজার নিজের খরচে বাসা পরিষ্কার করে দেবে। কিন্তু লিজ ভেঙে কেউ চলে গেলে সে নিজে হয় বাসা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে, নয় নতুন ভাড়াটিয়া এসে পরিষ্কার করবে। অথবা ম্যানেজার পরিষ্কার করে দেবে কিন্তু টাকা দিতে হবে লিজ ভঙ্গকারীকে। কী ফ্যাসাদ! আমরা চাই না মূর্তির টাকা খরচ হোক। তাই ডেবিকে বললাম, ‘তোমার পরিষ্কার করার দরকার নেই। আমরাই পরিষ্কার করে নেব।’ সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফিরে এল। এই মেঘ, এই রোদ্দুর।
নতুন বাসার এরিয়া খুব সুন্দর। সুইমিং পুল আছে একটা, আর আছে বারবিকিউ এরিয়া। দেশে থাকতে এসব বড়লোকদের ব্যাপার বলে জানতাম। তবে কি আমেরিকায় এসে বড়লোক হয়ে গেলাম? আমাদের নেইবারহুডটা বেশ শান্ত, সবুজ, খোলামেলা। বাংলায় যাকে পাড়া বলে, এখানে সেটাই নেইবারহুড। নেইবারহুডকে সবাই বেশ প্রাধান্য দেয় বাসা-বাড়ি খোঁজার সময়। আমাদের নেইবারহুড পুরো সেন্ট লুইস কাউন্টিতে খুব বিখ্যাত। এর নাম হচ্ছে সেন্ট্রাল ওয়েস্ট এন্ড। উইকিপিডিয়ায় একটা পেইজও আছে দেখলাম এটা নিয়ে। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা হচ্ছে সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। কারণ নেইবারহুডের একপাশে স্লু, আরেক পাশে ওয়াশইউ। এগুলো ভার্সিটির সংক্ষেপিত নাম। মানুষজন এসব নামেই ডাকে। কেউ পুরো নাম উচ্চারণ করার ঝামেলায় যায় না। বাসা থেকে বের হলেই দশ নাম্বার বাসের স্টপেজ। সেখান থেকে বাসে উঠে ভার্সিটির নর্থ ক্যাম্পাস পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর ওখান থেকে শাটলে চেপে আমার সাউথ ক্যাম্পাস। বাসার ঠিক বিপরীত দিকে পৃথিবী বিখ্যাত একটা ক্যাথেড্রাল অবস্থিত। নাম ‘ক্যাথেড্রাল ব্যাসিলিকা অফ সেন্ট লুইস’। একশো বছরের পুরানো গির্জাটা বিখ্যাত এর অভ্যন্তরীণ মোজাইক সংগ্রহের জন্য। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মোজাইক ধারণ করে আছে এই গির্জা। বাসা থেকে পশ্চিম দিকে হাঁটলে এক ব্লক পরেই পাবেন ইউক্লিড এভেনিউ। এটা সেন্ট্রাল ওয়েস্ট এন্ডের একটা খ্যাতনামা এভেনিউ। প্রচুর দেশী বিদেশী রেস্তোরাঁ দিয়ে ভর্তি। আরও আছে সেন্ট লুইসের গণ গ্রন্থাগারের একটা শাখা। আর আছে দাবা ক্লাব, যেটা বেশ বিখ্যাত। আছে মুভি থিয়েটার, কলেজ, ভার্সিটি, হাসপাতাল, রেল স্টেশন, বাসের ডিপো। খুব জমজমাট। সাথে ব্যয়বহুলও।
আজ আগস্ট মাসের বেতন উঠালাম। এখনো সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার পাইনি বলে ব্যাংকে সরাসরি বেতন জমা হওয়ার সুবিধা পাইনি। হিউম্যান রিসোর্স অফিস থেকে নগদ টাকা তুলে এনে ব্যাংকে গেলাম পে-চেক জমা দিতে। তরুণ অফিসার জিজ্ঞেস করল, “সারাদিন কেমন কাটল তোমার? এনিথিং এক্সাইটিং হ্যাপেন্ড?” উত্তর দিলাম, “না।” ফিরতি প্রশ্ন এল, “তিনদিনের ছুটি কীভাবে কাটাবে কিছু পরিকল্পনা করেছ?” জবাব দিলাম, “না। তুমি?” তরুণটি খলবলিয়ে উঠল, “ওহ ইয়েস! আমরা বন্ধুরা মিলে ক্যাম্পিংয়ে যাচ্ছি আজ রাতে। দারুণ এক্সাইটেড লাগছে!” উল্লেখ্য, এখানে শনি আর রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ। তার উপর সোমবারে পড়েছে লেবার ডে। টানা তিনদিন ছুটি। খুশিতে সবাই আগডুম বাগডুম করছে। আমি আর প্রিন্স এখনও ঠিক করিনি কোথাও ঘুরতে যাব কিনা। নতুন বাসা গুছিয়ে সময় পেলে হয়ত কাছাকাছি কোথাও ঢুঁ মারব। আমাদের গাড়ি নেই বলে কোনো পরিকল্পনা করার সময় হাজার বার চিন্তা করতে হয় কীভাবে যাব, কতক্ষণ থাকব, কীভাবে ফিরব। গাড়ি থাকলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায় মার্কিন মুল্লুকে। এখানে সবকিছু এত দূরে দূরে যে, সময় বাঁচানো আর কম পরিশ্রমে কাজ সারার জন্য প্রায় সবাই গাড়ি কিনে ফেলে। দেশে যেটা আমাদের জন্য বিলাসিতা, এখানে সেটা আবশ্যক। গাড়ি নেই মানে যখন তখন চাল ডাল কিনতে যেতে পারবেন না, কারণ সস্তা গ্রোসারি শপগুলো অনেক দূরে দূরে। যার গাড়ি আছে, তার সাথে গিয়ে সাপ্তাহিক বাজার সেরে ফেলাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ সমাধান। আবার গাড়ি নেই মানে যেখানে খুশি যাওয়া যাবে না, কারণ বাস আর ট্রেনের রুট সব জায়গা পর্যন্ত যায় না। সেক্ষেত্রে অনেক হাঁটতে হয়। হেঁটে হেঁটে ইতোমধ্যে দুই কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছি। ভাবছি একটা বাইসাইকেল কিনব। এত হাঁটা আর পোষায় না। এই সাইকেল কেনার জন্যও বহু ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে। একেবারে নতুন কেনার চেয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস কম দামে কেনার ইচ্ছে আছে। বিস্তর দেখাদেখি চলছে সস্তা ডিলের।
নতুন বাসায় উঠার পরদিনই আবার যেতে হল শাওন ভাইদের এপার্টমেন্টে। কিছু জিনিস রেখে গিয়েছিলাম, নিতে হবে। শাওন ভাই দুপুরের খাওয়া না খাইয়ে ছাড়লেন না। মারুফ ভাই জিজ্ঞেস করলেন আমরা গ্রসারি শপিংয়ে যেতে চাই কিনা। কাঁচাবাজার তো কিছু করা নেই নতুন বাসায়। আমরা তীব্রভাবে মাথা নাড়লাম। অনেক করেছেন ভাইয়েরা। আর কত? কিন্তু মারফ ভাই নাছোড়বান্দা। উনার গাড়ি আছে। গাড়িতে করে কতক্ষণই বা লাগবে দোকানে যেতে? কতক্ষণই বা লাগবে কেনাকাটা করতে? উনার জিদের কারণে আমরা ঈদের চাঁদ হাতে পেলাম। এখানে গ্রসারি শপিং মানে ট্যুরে বের হওয়া। বাসে যাতায়াত করে এই ঝামেলা সামাল দেওয়া খুব কঠিন। কারণ একেক জিনিসের দোকান একেক জায়গায়। আছে সস্তা দোকান, দামী দোকান। দামী দোকান বাসার কাছে, কিন্তু সস্তা দোকান সেই ছয় মাইল দূরে। আবার সস্তা দোকানের আছে রকমফের। এক দোকানে চাল-ডাল সস্তা, আরেক দোকানে সবজি। এজন্য বাজার করতে বের হলে প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়। মারুফ ভাই যদি কষ্ট করে সদাই করতে নিয়ে যান, তাহলে বেঁচে যাই।
প্রথমে সিফুড নামক চৈনিক দোকানে গেলাম সস্তায় তাজা মাছ আর সবজি কেনার জন্য। এরপর গেলাম অল্ডি নামক দোকানে। কিনলাম ফলমূলসহ বাসাবাড়ির টুকটাক জিনিসপাতি। এরপর গেলাম আকবর নামের এক বাঙালি দোকানে। কিছু শুকনো মশলা কিনলাম। আর কিনলাম আদা, রসুনের পেস্ট। এসব মশলা ব্লেন্ড করার সময় নেই কারো। তাই ব্লেন্ড করে বিক্রি করা হয়। এখানে ‘হালাল’ মুরগীও পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের হালাল হারামের বালাই নেই। তাই দ্বিগুণ দাম দিয়ে মুরগী কেনার দরকার পড়ে না। হঠাৎ মনে পড়ল আমাদের বদনা দরকার। অনেক জায়গা খাবে বলে লাগেজে করে বদনা আনিনি। ভেবেছিলাম পানির বোতল দিয়ে কাজ চালিয়ে নেব। কিন্তু এটা ভীষণ ঝামেলার। বাঙালি দোকানে বদনা থাকলেও থাকতে পারে ভেবে জিজ্ঞেস করলাম চাচাকে। চাচা বললেন, বদনা শেষ হয়ে গেছে। আগামী মাসে চালান এলে যেন আমরা আসি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমেরিকায়ও এত মানুষ বদনা কেনে যে শেষই হয়ে গেছে? হঠাৎ চাচা বলে উঠলেন উনি একটু খুঁজে দেখতে চান। হয়ত কোণাকাঞ্চিতে একটা দুটো বদনা পড়ে থাকতে পারে। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর তিনটা বদনা পাওয়া গেল। আরএফএলের নীল রঙের প্লাস্টিকের বদনা। একদম মেইড ইন বাংলাদেশ। দেখে পরাণটা জুড়িয়ে গেল। আমেরিকা আসার পর এটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কেনাকাটা। দেশে যেটা পঞ্চাশ টাকায় পেতাম, এখানে সেটা চারশো টাকা দিয়ে কিনেছি। তবুও ঠকা মনে হল না আনন্দের ঠ্যালায়। অবশ্য বাসা ছাড়া আর কোথাও এটা ব্যবহার করার সুযোগ নেই। বাকি সব জায়গায় ওয়েট টিসু দিয়ে কাজ চালাতে হবে। যস্মিন দেশে যদাচার। কিন্তু এটাই বা কম কী?
শেষে গেলাম ডলার ট্রিতে। এখানে যাই কিনবেন, এক ডলার দাম। পাঁচটা মগ, পাঁচটা প্লেট কিনলাম। কাউকে দাওয়াত দিলে এগুলো লাগবে। এক ডলার দিয়ে এত সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায় যে, সব কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে। এটা একটা ফাঁদ। সস্তার ফাঁদে পড়ে আমরা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনছি। একসময় দেখলাম, গাড়িতে জায়গা হচ্ছে না জিনিস রাখার। বুঝলাম, ক্ষান্ত দেওয়া দরকার। চার ঘণ্টার শপিং শেষ করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলাম। আমাদের নামিয়ে মারুফ ভাই চলে গেলেন। বাসায় ঢুকে মনে পড়ল আজ এপার্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বার্ষিক পুল পার্টি হচ্ছে। পার্টি শুরু হওয়ার কথা বিকেল চারটায়। শেষ হবে সন্ধ্যা ছয়টায়। এখন বাজে সাড়ে ছয়টা। আমি আর প্রিন্স দ্বিধান্বিত যাব কি যাব না। এতক্ষণে পার্টি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই প্রথম আমেরিকান কোনো পার্টি দেখার সুযোগ হয়েছে। একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতেও মন চাচ্ছে না। একটু ঝুঁকি নিয়ে নিচে নামলাম। হাঁটা ধরলাম পুলের দিকে।
গিয়ে দেখি তেমন মানুষজন নেই। ম্যানেজার ডেবি, ওভারঅল পরা দুইজন পুরুষ, একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা আর দু’একজন বাসিন্দা এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছেন। ডেবি নির্দেশ দিচ্ছেন আর পুরুষ দুজন তেরপল গুটাচ্ছেন, ট্র্যাশ ক্যানে ময়লা ফেলছেন। ডেবি আমাদের দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এতক্ষণে তোমাদের আসার সময় হল? সব মজা শেষ। দেখ বারবিকিউ কিছু আছে কিনা!” আমরা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে খাবারের দিকে এগোলাম। বারবিকিউ এরিয়ায় এখনো ধোঁয়া উড়ছে। অনেকগুলো কাবাব ট্রেতে পড়ে আছে। পাশে কোমল পানীয়ের ভাণ্ডার। বিশ ত্রিশটা বোতল দাঁড়ানো। কোক, ফানটা, পেপসি, এনার্জি ড্রিংক কী চাই? আছে বিফ পেটিস, পাউরুটি, সালাদ, কেক, সস, চিপস, সসেজ। কেউ কি কিছু খায়নি নাকি? সব আমাদের জন্য রেখে গেছে? এ তো খালি মাঠে গোল দেওয়ার মত অবস্থা। ধীরেসুস্থে খেতে বসলাম। এত বড় আয়োজনের দুজন মাত্র খাদক। সব আইটেম কিছু কিছু করে নিলাম। কিন্তু এক বসায় এত খাওয়া যায় নাকি? একটু খেতেই পেট ভরে গেল। বাকি খাবার ফেলে না দিয়ে নিয়ে এলাম বাসায়। পরদিন ব্রেকফাস্ট করা যাবে। আসার সময় দুটো কফির মগ উপহার পেলাম। যারাই পার্টিতে এসেছে, তারাই উপহার পেয়েছে। আসতে আসতে দেখলাম প্রচুর পরিমাণে খাবার অবশিষ্ট আছে। হয়ত এগুলো গরীব মানুষের মাঝে বিলানো হবে!
পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম বেলা করে। একেবারে ব্রেকফাস্ট + লাঞ্চ = ব্রাঞ্চ সেরে ফেললাম। প্রিন্সের খুব ইচ্ছে হল পুলে নেমে দাপাদাপি করার। আমি সাঁতার পারি না বলে জলে নামতে ভয় পাই খুব। হাঁটু জল দেখলেও আমার বুক কাঁপে। কথায় আছে না, সাঁতার না জানা ব্যক্তি হাঁটু জলে ডুবে মরে? আমার মাথায় প্রবচনটা গভীরভাবে গেঁথে গেছে। খালি মনে হয় জলে নামলেই ডুবে মরব। মরতে আমার ভীষণ ভয়। রবি বাবুর মত ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ কিন্তু প্রিন্স খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে সাঁতার শেখাতে চাচ্ছে। বাসায় পুল থাকার পরও সাঁতার না শিখলে ও জানে না আর কীভাবে একজনকে সাঁতার শেখানো সম্ভব। কথাটা মনে ধরল। আসলেই তো! দেশে থাকতে টাকা খরচ করে সাঁতার শিখতে রাজি হয়েছিলাম, আর এখানে মাগনা পুল পেয়েও যদি সাঁতার না শিখি…! মনকে বুঝিয়ে সাহস সঞ্চয় করে পুল এরিয়ায় গেলাম। দেখি গতকালের খাবার ওইভাবেই পড়ে আছে। পেপসির একটা ক্যান খুলে খেয়ে দেখি সেটা রোদে পুড়ে চা হয়ে গেছে। পুলে এক আমেরিকান মধ্যবয়স্ক পুরুষ ছাড়া কেউ নেই। সে একটু সময় পানিতে থাকে, একটু সময় চেয়ারে শুয়ে চামড়া ট্যান করে। আমরা দুজন পুলে নামলাম। নামার জন্য সিঁড়ি আছে। কিন্তু যারা সাঁতার জানে তারা সিঁড়ির তোয়াক্কা করে না। ঝপ করে লাফ মারে পানিতে। আমি প্রথমে সিঁড়িতেই বসে রইলাম। কিছুতেই পানিতে নামার সাহস হয় না। নীল রঙের টলটলে পানি আমাকে আকর্ষণ করতে পারছে না। প্রিন্স আমার উপর থেকে হাল ছেড়ে সাঁতার কাটা শুরু করল।
প্রিন্সকে মজা করে সাঁতার কাটতে দেখে আমার সাহস হল। একদম কিনারে নামলাম যেখানে পানির উচ্চতা চার ফুট। ধীরে ধীরে এই উচ্চতা বেড়েছে। একদম বিপরীত দিকে সাড়ে নয় ফুট নেমে গেছে পুলের গভীরতা। শুরুর চার ফুট, মাঝের ছয় ফুট আর শেষের নয় ফুট গভীরতার ব্যাপারে উল্লেখ করা আছে পুলের দেওয়ালে। যারা যতটুকু গভীরতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তারা যেন ততটুকুতে থাকতে পারেন। হুট করে মনে পড়ল বালি দ্বীপের কথা। সেখানে কুটা নামের এক শহর আছে। আমরা কুটায় গিয়ে সুইমিংপুলওয়ালা এক হোটেলে উঠেছিলাম। ম্যানেজার বলেছিল পুল সারাদিন, সারারাত খোলা। শুধু দুই বা তিনতলা থেকে যেন আমরা ঝাঁপ মেরে পুলে না পড়ি। অনুরোধের মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝলাম না। আমাদের গোল গোল চোখ দেখে সে ব্যাখ্যা করল, রাশিয়ানরা নাকি ‘ক্রেইজি’ জাতি। এরা দুইতলা, তিনতলা থেকে ঝপাঝপ লাফ মারে পুলের পানিতে। ওরা কত তলা থেকে লাফ দিল, নাকি হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিল, তাতে ম্যানেজারের কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে ভীষণ শব্দ হয় তাতে অন্য বাসিন্দারা বিরক্ত হয়। আর যে পরিমাণ পানি ছলকে চারদিকে ছিটে, সেটা ম্যানেজারকেই পরিষ্কার করতে হয়। শুনে আমরা হাসতে হাসতে শেষ। বেচারাকে কথা দিয়েছিলাম, আমরা ভদ্রভাবেই পুলে নামব। পুলের পাড় থেকে ধীরে ধীরে পুলে নামব যেন শব্দ কম হয়, পানিও না ছলকায়।
আমেরিকান পুলের সিঁড়ি ধরে কিছুক্ষণ হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করলাম। যখন ভয় ভাঙল, সাঁতার শেখার চেষ্টা করলাম। প্রিন্স শেখাল পানি কেটে সামনে আগানোর জন্য কোন এঙ্গেলে হাত পা নাড়তে হয়। ও মেরিনে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সাঁতার শিখেছিল। প্রশিক্ষক ছিলেন একজন মেরিন অফিসার। তাই কায়দা কানুন ওর ভালই জানা। কিন্তু আমার মত ভীতু শ্রেণীর কাছে ওর কায়দা ঠিক কায়দা করে উঠতে পারছে না। প্রিন্স তাই বিকল্প পদক্ষেপ নিল। সোজা সাঁতার যেহেতু পারছি না, উল্টো সাঁতার শিখব। মানে উল্টো হয়ে ভেসে থেকে সাঁতার কাটা। দুজনের তোলপাড় দেখে আমেরিকান বুড়োটা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কী করছ, বল তো?’ বললাম, ‘সাঁতার শিখছি।’ বুড়ো বেশ আগ্রহ পেল আমার সাঁতার শেখায়। কোত্থেকে যেন একটা স্টাইরোফোম নিয়ে এল। বলল এটা ধরে ভেসে থাকা অনুশীলন করতে। এরপর এটার উপর ভর দিয়েই সাঁতার শিখতে। স্টাইরোফোম পেয়ে প্রিন্স হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমাকে শেখাতে গিয়ে ও একটুও উপভোগ করতে পারছে না সাঁতার কাটা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমিও। প্রিন্সের সাপোর্ট নিয়ে সাঁতার কাটার চেয়ে স্টাইরোফোমে ভর দিয়ে সাঁতার কাটাটা সহজ লাগছে। এটা কিছুতেই ডুবে না। কিন্তু প্রিন্স যখন আমাকে ধরে থাকে, তখন সারাক্ষণ ভয় লাগে এই বুঝি ছেড়ে দিল! আধা ঘণ্টা পর ফোমের সাহায্যে উল্টো সাঁতার শিখে ফেললাম। এর মধ্যে দুজন আমেরিকান তরুণী এল রৌদ্রস্নানে। তারাও জানল যে আমি সাঁতার শিখতে এসেছি। জেনে বেশ উৎসাহ দিল। তারপর বল নিয়ে পুলে লোফালুফি খেলতে লাগল। একটু পর এল একটা চৈনিক তরুণী আর দুইটা চৈনিক তরুণ। এসেই ঝপাঝপ ঝাঁপ দিল পানিতে। আমি আর প্রিন্স বাদে সবাই সুইমিং কস্টিউম পরা। ওদের দেখে মোটেও বিব্রত লাগছে না আমাদের। প্রায় দুই ঘণ্টা পুলে কাটিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। লোকজন বেশি হওয়ার পর আর ভাল লাগছে না দাপাদাপি করতে।
সন্ধ্যায় গেলাম সেন্ট লুইস ভার্সিটির একজন স্যারের বাসায়। উনি বাংলাদেশি এবং বছরের এই সময়টায় পার্টি দেন নতুন স্টুডেন্টদের সাথে পরিচিত হবার জন্য। ওখানে গিয়ে খুব ভালো লাগল। স্যার নিজে মিশুক মানুষ, যারা পার্টিতে এসেছিলেন, তারাও মিশুক। তবে পার্টিটা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল কেন, বুঝলাম না। এক ঘরে সব ছেলে, এক ঘরে সব মেয়ে। প্রথমে আমি ঠাহর করতে পারলাম না কোন রুমে বসা দরকার। কিন্তু মেয়েদের রুম থেকে একজন আমাকে ডাক দিল বলে সেখানে গেলাম। সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পর বসে বসে ঝিমুতে লাগলাম। অন্য মেয়েরা পরস্পরের সাথে আগে থেকেই পরিচিত। সবাই মিলে গল্প করছে। গল্পের সীমা “আপা আপনি তো অনেক চিকন হয়ে গেছেন!” থেকে “কী যে বলেন! আমার কাছে তো মোটাই লাগে” পর্যন্ত। এ ধরনের টপিকের বাইরে কেউ কিছু বলার পাচ্ছেন না। আমি পাঁচ মিনিট পর উঠে পড়লাম। এখানে বসে থাকা অসম্ভব। এরকম বিষয় নিয়ে গল্প করার চেয়ে একা বসে থাকা উত্তম। কিছুক্ষণ লিভিং রুমে পায়চারি করে চলে এলাম ছেলেদের রুমে। প্রিন্স আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, ‘টেনশনে ছিলাম তুমি কীভাবে ওই রুমে সময় কাটাচ্ছ ভেবে। মুখের উপর বেফাঁস কিছু বলে ফেলনি তো?’ বলিনি কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছিল। সংসারের বাইরে আলাপ করার কিছু নেই নাকি গৃহিণীদের?
ছেলেদের রুমে এসে এক দাদার সাথে পরিচয় হল। উনি ওয়াশিংটন ভার্সিটিতে পোস্ট ডক করছেন। উনি নাকি আমাদের ব্যাপারে শোনার পর থেকে আমাদের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। দাদা নাকি আমাকেই একমাত্র মেয়ে দেখলেন যে “বাংলা মিডিয়ামের কলেজ” থেকে অনার্স, মাস্টার্স করে আমেরিকায় পড়তে এসেছে, কোনো ভার্সিটি থেকে পাশ করে নয়। তারপর অনেক প্রশংসা করলেন। আমি নিজেও জানি, কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে বাইরের দেশে আসা একটু কঠিন। তাই এক্ষেত্রে অনেক কম মানুষ দেখা যায়। দাদার সাথে গবেষণা, পড়াশোনা, চাকরির সুযোগ নিয়ে অনেক কথা হল। উনার অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম। উনি বারো বছর ধরে আমেরিকায় পড়াশোনা করছেন। মনের মত চাকরি পাচ্ছেন না বলে পড়াশোনাটা ছাড়তে পারছেন না। তবে এবারকার পোস্ট ডক শেষ করে যে চাকরিই পাবেন, ঢুকে যাবেন। পড়তে আর ভাল লাগছে না উনার। একটু পর কয়েকজন বেসমেন্টে নেমে গেল টেবিল টেনিস খেলার জন্য। বিশাল বেসমেন্ট জুড়ে খেলার ব্যবস্থা। আমি আর প্রিন্স একটু চেষ্টা করলাম খেলতে। দেখে মনে হয় খুব সোজা খেলা। কিন্তু খেলতে নেমে বুঝলাম চরম কঠিন। র্যাকেট দিয়ে আরেক কোর্টে বল পাঠাতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে। তার উপর নিশানা রাখতে হবে ঠিক। ‘ধুর ছাই!’ বলে একটু পর ক্ষান্ত দিলাম।
খাওয়ার জন্য ডাক পড়েছে। স্যারের রান্না করা ভাত, সবজি, খাসি, মুরগি, সালাদ আর ডাল দিয়ে জম্পেশ খাওয়া শুরু হল। আমার সবচেয়ে ভাল লাগল সালাদটা। বিভিন্ন ধরনের বিন (bean), লেটুস, সিরকা দিয়ে বানানো। টক মিষ্টি স্বাদ। খাওয়া শেষে ডেজার্ট হিসেবে কেক কাটা হল। প্রচুর খাওয়া বেঁচে গেল। একবার ভাবলাম স্যারকে বলি আমি সালাদটুকু নিতে চাই। পরে চক্ষুলজ্জার কারণে বলা হল না। রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। সবাই নীরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। টানা তিনদিন ছুটি পেয়েছিলাম। দ্বিতীয়দিন শেষ হল। আশা করি তৃতীয় দিনটাও মজায় কাটবে।
(১৯)
আজ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আট তারিখ। তারিখটা স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় করে রাখতে চাই। কারণ আজ আবিষ্কার করেছি অরিজিনাল বইয়ের সস্তা সম্ভার। এতদিন পর্যন্ত বদনা কিনে সেটাকে শ্রেষ্ঠ কেনাকাটা বলে ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু আজ অরিজিনাল বই কিনে বদনা কেনার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছি। এদেশে গুডউইল নামক একটা দাতব্য সংস্থা আছে, যেখানে মানুষ নিজের ব্যবহৃত জিনিসপাতি দান করে দেয়। গুডউইল কর্তৃপক্ষ নামমাত্র মূল্যে সেগুলো বিক্রি করে। আমাদের বাসার পাশে একটা গুডউইল আছে। সেখানে গিয়ে দানকৃত বইয়ের ভাণ্ড দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। আর দাম দেখে আমি মূর্ছা যাই প্রায়। সব অরিজিনাল কপি মাত্র এক ডলার (বড়দের বই), পঞ্চাশ সেন্ট (ছোটদের বই)। এ এক আজব দেশ। সুন্দর সুন্দর জিনিস মানুষ ফ্রিতে দিয়ে দেয়, ডাস্টবিনের পাশে ফেলে রাখে। প্রচুর চ্যারিটি শপ আছে যেখানে মানুষ তাদের ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র দান করে, আর যাদের দরকার তারা কম দামে কিনে নেয়। এমন দাতব্য প্রতিষ্ঠানও আছে যারা অভাবীদের বিনামূল্যে জিনিসপত্র সরবরাহ করে। ভাবছি এমন প্রতিষ্ঠানে সম্ভাব্য গ্রহীতা হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলব। আমরা তো গরীব মেধাবীই!
হাতে সময় ছিল না বলে মাত্র এক ঘণ্টা কাটাতে পারলাম গুডউইলে। যাই দেখি, লাগে ভাল। কিনতে ইচ্ছে হয় সবগুলো। হ্যারি পটার আর লর্ড অফ দা রিংসের অরিজিনাল বই দেখে লোল পড়ে গেল। কিন্তু প্রচণ্ড কষ্টে মনকে বুঝিয়ে মাত্র চারটা বই কিনলাম। এই বইগুলো যে কেউ নিজের সংগ্রহে না রেখে দিয়ে দিতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এর মধ্যে মিথলজির একটা পপআপ বই অসাধারণ লাগল। তাছাড়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ইলাস্ট্রেটেড বই, পুষ্টি বিষয়ক পাঠ্যবই আর ড্যান ব্রাউনের হার্ড কভার উপন্যাস কম কীসে? আস্তে ধীরে বাংলাদেশের মত এখানেও একটা পাঠাগার বানাব গুডউইল থেকে বই কিনে কিনে। দেশে প্রায় হাজার বই সম্বলিত যে পাঠাগার রেখে এসেছি, সেটার কথা মনে পড়লে বুক হু হু করে। এত বই কিনেছি অথচ পড়া হয়েছে হাতে গোনা। এখানেও একই কাহিনী ঘটবে। প্রচুর কেনা হবে, পড়া হবে যৎসামান্য। কিন্তু তাই বলে কি গ্রন্থাগার বানানো বাদ দিলে চলে?
(২০)
আমেরিকার ভার্সিটিগুলোতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইমিউনাইজেশন রিপোর্ট দেখাতে হয়। আপনি নির্দিষ্ট কিছু রোগের টিকা নিয়েছেন এবং নির্দিষ্ট কিছু রোগের জীবাণু আপনার দেহে নেই – এটা প্রমাণ করাই ইমিউনাইজেশন রিপোর্টের কাজ। এই কাজ দুটো উপায়ে করা যায়। এক, দেশ থেকে সাত/আট হাজার টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন দিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসবেন; দুই, ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনাকে হেলথ ইন্সুরেন্স দেওয়া হলে এবং ওই ইন্সুরেন্স আপনার ভ্যাক্সিনেশন ফি কাভার করলে আমেরিকায় এসে ভার্সিটির হেলথ সেন্টার থেকে আপনি ফ্রি ফ্রি ভ্যাক্সিনগুলো নিতে পারবেন। আমি শেষোক্ত দলের সদস্য, তাই আজ স্টুডেন্ট হেলথ সেন্টারে গিয়েছিলাম ভ্যাক্সিন নিতে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, “তোমার কি টিটেনাস, মিজেলস, রুবেলা, মাম্পস, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ আর টিউবারকিউলোসিসের টিকা দেওয়া আছে?” বললাম, রুবেলা বাদে সবগুলোর টিকা দেওয়া হয়েছে। অফিসার রিপোর্ট দেখতে চাইলেন। মর জ্বালা! এগুলোর আবার রিপোর্ট দেওয়া হত নাকি নব্বইয়ের দশকে? দিলেও কই হারিয়ে গেছে, কে জানে। বললাম, “দুঃখিত, রিপোর্ট টিপোর্ট হবে না।” অফিসার বললেন, বেশ! আবার তাহলে নিতে হবে টিটেনাস, হুপিং কফ আর ডিপথেরিয়ার টিকা। তারপর জানতে চাইলেন, কখনো চিকেন পক্স হয়েছে কিনা। বললাম, ক্লাস সিক্সে থাকতে হয়েছে। এর মানে আর চিকেন পক্সের টিকা নেওয়ার দরকার নেই। দেহে ইতোমধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে রোগটার বিরুদ্ধে।
অফিসার বললেন, “তুমি কি আজকে MMR (Measles, Mumps, Rubella)-এর ভ্যাক্সিন নিতে চাও? নাকি আগে রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে চাও এগুলোর বিরুদ্ধে তোমার ইমিউনিটি আছে কিনা?” মনে হল আগে রক্ত পরীক্ষা করাই যৌক্তিক। তাই এটার জন্য সিরিয়াল নিলাম। অফিসার আরও জানালেন, আজ আমি টিবি বা যক্ষ্মার জন্য স্কিন প্রিক টেস্ট দিতে পারব, টিটেনাস-হুপিং কফ-ডিপথেরিয়ার টিকা নিতে পারব, আর বোনাস হিসেবে ফ্লু শট মারতে পারব। ভাবলাম সব কাজ একদিনে সেরে যাই, বারবার এখানে আসাও ঝামেলা। তাই বীরের মত নার্সের চেম্বারে গিয়ে বসলাম। দারুণ সুন্দর একজন রেজিস্টার্ড নার্স আমার ডান হাতের বাহুতে ফ্লু শট মারলেন, বাম হাতে মারলেন তিন রোগের সম্মিলিত টিকা। এরপর টিবি পরীক্ষা করার জন্য কী একটা তরল যেন ইঞ্জেক্ট করলেন ডান হাতে। আমার দেহে যদি Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে, তাহলে এই তরলের উপস্থিতিতে সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তিনদিন পর আমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হবে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে কিনা। হলে টিবি ভ্যাক্সিন নিতে হবে, না হলে আরেকটা সুঁইয়ের গুঁতো থেকে বেঁচে যাব। চতুর্থ এবং শেষবারের মত নার্স বাম হাতে সিরিঞ্জ পুশ করে রক্তের নমুনা নিলেন।
আমি ড্যাবড্যাব করে সুঁই ফোটানো দেখছি বলে জিজ্ঞেস করলেন, “সুঁই ভয় পাও না? বেশিরভাগ স্টুডেন্ট এসে চোখ বন্ধ করে রাখে বা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।” উত্তর দিলাম, “না। সুঁইয়ের খোঁচা আমি ভয় পাই না, কিন্তু ব্যথার কারণে একটু আতংক অনুভব করি।” দেশে থাকতে রক্ত দিয়েছি বেশ ক’বার। অত বড় সুঁই যদি ভয় না পাই, এই পুঁচকে টিকা আর কী জিনিস? আজও ব্যথা পেয়েছি এবং বীরত্ব দেখানোর মাশুল গুনছি। দুই হাত টনটন করছে, সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। তবুও সাত হাজার টাকা বাঁচানোর আনন্দে ব্যথা একটু কম লাগছে। টাকা খরচ করলেও তো ব্যথা লাগতই! সন্ধ্যার দিকে হল আসল কাহিনী। জ্বর চলে এল ব্যথায়। সে কী ব্যথা! ডান হাত নাড়াতেই পারছি না। সুঁই ফোটানোর জায়গা ফুলে ঢোল। প্রিন্স ভয় পেয়ে গেল। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে কিনা, বুঝতে পারছে না। মাকে ফোন দিলাম। মা নিজেও নার্সিং পাশ করে পঁচিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। এখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। উনি বললেন দুশ্চিন্তা না করতে। এই ব্যথা দুইদিনের মধ্যে ভাল হয়ে যাবে। বেশি ব্যথা করলে প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ব্যথা হলে বুঝা যায় টিকার মাধ্যমে যে জীবাণু আমার শরীরে ঢুকানো হয়েছে, সেটার বিরুদ্ধে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরি করছে। এটা স্বাভাবিক ব্যথা। শুনে শান্তি লাগল। ব্যথানাশক খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পর্ব নয় এখানে