1 0
Read Time32 Minute, 29 Second

পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট

(২১)

নতুন বাসাটা আমাদের চরম পছন্দ হল। ভাড়া হয়ত আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে এক-দেড়শো ডলার বেশি, কিন্তু এই বাড়তি ভাড়ার খাতিরে যেসব বাড়তি সুবিধা আমরা পেলাম, সেগুলো অতুলনীয়। যেমন একটা ড্রেসিং টেবিল কাম কাবার্ড, দেওয়াল জুড়ে বিশাল আয়না, পারটেক্সের তৈরি বিরাট একটা ক্লজেট, কনভেকশন ওভেন। এছাড়া ফ্রিজ, বাথটাব, দেওয়ালের ভিতরে অবস্থিত ক্লজেট, রান্নাঘরের ডজন খানেক মিটসেফ ইত্যাদি সব বাসাতেই থাকে। আমরা বাড়তি পেলাম টয়লেটের ভেতরে আরেকটা ক্লজেট। গ্যারেজে সাইকেল রাখার ব্যবস্থা আছে কোনোরকম ফি ছাড়া। এদিক দিয়েও সুবিধা। লিফটের মেইন্টেনেন্স বা দালান পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য আলাদা ফি দিতে হয় না। সেগুলো ভাড়ার সাথেই অন্তর্ভুক্ত। একটা লেটার বক্স পেয়েছি যেখানে দুনিয়ার হাবিজাবি চিঠিপত্র এসে জমা হয়। আমেরিকানরা কাড়ি কাড়ি কাগজ খরচ করে এত ফালতু সব বিজ্ঞাপন পাঠায় যে, অবাক হয়ে যাই। কাগজ কি এতই সস্তা? আমি ইন্টারনেট আর ইলেকট্রিক বিলের নোটিফিকেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘পেপারলেস’ বা কাগজহীন সেবা বেছে নিয়েছি। কি দরকার ইন্টারনেটের যুগে অযথা কাগজের চিঠির মাধ্যমে বিল পাওয়ার? তার উপর চিঠির জন্য আলাদা ফি দিতে হবে। যতভাবে পারা যায় কাগজের আজেবাজে খরচ কমানোই সবার উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। আমাদের এক প্রফেসর আছেন যিনি ভার্সিটির ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় সব আর্টিকেল, ডকুমেন্ট আপলোড করে দেন। ক্লাসে পারতপক্ষে কিছু প্রিন্ট করে নিয়ে আসতে চান না শুধুমাত্র কাগজের অপচয় রোধ করার জন্য।

যা বলছিলাম। সবকিছু বিবেচনা করলে বলা যায় এপার্টমেন্টটা নিয়ে আমরা জিতেছি। এদের সমস্যা সমাধানের তৎপরতা এত বেশি যে, আমরা মুগ্ধ। বাসায় উঠার পরপরই দেখলাম জানালার তিনটা ব্লাইন্ডের মধ্যে একটা ভাঙ্গা। ডেবিকে জানাতেই পরদিন নতুন ব্লাইন্ড নিয়ে হাজির হলেন মেরামতকারী। উনি মনে হয় এই এপার্টমেন্টের স্থায়ী মেরামতকারী। সবসময় উনাকে উপর থেকে নিচ যাওয়া আসা করতে দেখি। খুবই ভদ্রলোক। দেখা হলেই হেসে কুশল বিনিময় করেন। দেশের মেরামতকারীদের সাথে মেলালে ভীষণ বিপদে পড়বেন। সকাল নয়টায় এসে যখন উনি দরজায় ঠকঠক করছেন, আমরা তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। ঘুম ভেঙে উঠে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম। উনি বললেন, আরেক মিনিট দেরি হলে উনি ‘মাস্টার কি’ দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা নিতেন। উনি ভেবেছেন আমরা কেউ বাসায় নেই। এ আরেক অদ্ভুত ব্যাপার। আপনার এপার্টমেন্টে যদি কোনো সার্ভিসের প্রয়োজন হয়, এবং সেবাদানকারী যদি এমন সময়ে আসেন যখন আপনি বাসায় নেই, তখন উনি ‘মাস্টার কি’ দিয়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকে উনার কাজ সেরে চলে যাবেন। কিচ্ছু হারাবে না, কোনো জিনিসের নড়বড় হবে না। প্রথম প্রথম আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, এমনটাও হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এত সহজে কাউকে বিশ্বাস করার ধাত নেই। তাই এমন সময়ে উনাদের আসতে বলতাম যখন আমি বাসায় আছি। কিন্তু প্রিন্স আশ্বস্ত করে বলল, এটা আমেরিকা। এখানে মানুষের নৈতিকতার লেভেল আমাদের কল্পনার বাইরে। যদি এমনই হত যে, বাসায় এসে উনারা চুরিচামারি করে বেড়ান, তাহলে এই পদ্ধতিরই সৃষ্টি হত না। ভেবে দেখলাম, কথা যুক্তিসঙ্গত। হোটেলেও তো একই ব্যবস্থা, তাই না? রুম সার্ভিস এসে রুম ঠিক করে দিয়ে যায় আপনার অনুপস্থিতিতে। সেখানেও তো জিনিস হারানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু আমার হারায়নি কখনো। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে বিশ্বাস করতেই হয়। বিপদ হওয়ার ঝুঁকি সবসময় থাকে। কিন্তু যেখানে ভাল মানুষের সংখ্যা বেশি, সেখানে মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘোরার দরকার নেই। এখন যখন আমাদের অনুপস্থিতিতে শাওয়ার কার্টেন ঠিক করে দিয়ে যায়, বা ঘরের চিপায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দিয়ে যায়, আমি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হই না।

আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম ক্লাসটা হল মেটাবোলিজম এন্ড ফিজিওলজির। আমি প্রফেসরকে দেখে মুগ্ধ। এত সুন্দর! পড়ানোর ধরনটাও দারুণ উনার। পুরো ক্লাসটা চলল সক্রেটীয় পদ্ধতিতে অর্থাৎ শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের আলাপচারিতার মাধ্যমে। প্রফেসর খানিকক্ষণ বর্ণনা দেন একটা বিষয়ের, এরপর প্রশ্ন করেন আমাদের। আমরা চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিই। এরপর আমরা প্রশ্ন করি উনাকে, উনি উত্তর দেন। খেয়াল করলাম, প্রশ্নের উত্তর দিতে কিংবা প্রশ্ন করতে কেউ ভয়ও পায় না, কারো লজ্জাও লাগে না। সবাই সহজভাবেই প্রফেসরের সাথে বাৎচিত করছে। মজার ব্যাপার হল, প্রফেসর ক্লাসের শুরুতেই আমাদের একটা ব্রশ্যুর ধরিয়ে দিয়েছেন যেখানে লেখা, উনার ক্লাসে টপিক সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন করা যাবে, যেকোনো উত্তর দেওয়া যাবে। সেগুলো যে সঠিক উত্তরই হতে হবে, এমনটা নয়। প্রশ্নটাও যে অনেক কঠিন হতে হবে, তা নয়। কেউ কিছু না জানলে, তা যত সাধারণ ব্যাপারই হোক না কেন, প্রশ্ন করা যাবে। আবার উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব যুক্তি মোতাবেক কিছু বলা যাবে। সেটা সঠিক না বেঠিক, ওই চিন্তায় যাওয়ার দরকার নেই। ক্রিটিক্যাল থিংকিং করে আপনি যদি একটা উত্তর দেন, তাহলে সেটাই লাভ। কারণ এভাবে মানুষ ভাবতে শেখে।

ক্লাসে বসে খাওয়া দাওয়া করা যায়। এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে পা তুলে দেওয়া যায়। শিক্ষকের অনুমতি না নিয়েই বাইরে যাওয়া যায়, ক্লাসে ঢুকা যায়। বেশিরভাগ স্টুডেন্ট ল্যাপটপ নিয়ে আসে। প্রফেসরের সাথে যে কথাবার্তা হচ্ছে, সেগুলো ধমাধম নোট করতে থাকে। এটা কীভাবে করে, আমি জানি না। আমি একই সাথে দুইদিকে মনোযোগ দিতে পারি না। মনে হচ্ছে এরা সবাই মাল্টিটাস্কে সিদ্ধহস্ত।

সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় অতি আধুনিক গবেষণাগার। পাঠাগার বলতে আমার চোখে ভেসে উঠে প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের দালান, যেখানে আলো-আঁধারিময় কক্ষে থরে থরে সাজানো আছে মোটা মোটা বই। কিন্তু আধুনিক যুগে পাঠাগারের চেহারা পাল্টে গেছে। এখন অতি আধুনিক দালানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে হাজির হয় বইপুস্তক। স্লুর পাঠাগারের নাম ‘পায়াস লাইব্রেরি’। ১৩ লাখেরও বেশি বই আছে এখানে। পাঠাগারের ভেতরেই ইনফরমেশন টেকনোলজির অফিস। আমার ল্যাপটপে এন্টি ভাইরাস, মাইক্রোসফট অফিস-সহ প্রয়োজনীয় কিছু সফটওয়্যার ইন্সটল করতে হবে। স্লুর স্টুডেন্ট হিসেবে বিনামূল্যে এসব সফটওয়্যার আমি ইন্সটল করতে পারব। বলে রাখা ভাল, আমেরিকায় পাইরেটেড সফটওয়্যার চালানো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ধরা পড়লে জেল, জরিমানা হয়। সবাই তাই কিনেই ব্যবহার করে। তাছাড়া এদের নৈতিকতা বোধ অনেক উপরে। এজন্যেও পাইরেসি আইন এত সফলভাবে টিকে আছে বলে আমার ধারণা। যা হোক, লাইব্রেরিতে ঢুকার মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজার সাথে লাগানো স্ক্যানারে আমার স্লু আইডি কার্ড স্ক্যান করতে হবে। তাহলে দরজা খুলবে। আমার এখনো আইডি কার্ড হয়নি। আজই কার্ড করব ভেবে রেখেছি। এখন কী করি? একজন মঙ্গোলীয় চেহারার মেয়ে এগিয়ে আসছে। সেও ঢুকবে লাইব্রেরিতে। ওর পিছু পিছু ঢুকে গেলাম। ঢুকে পড়লাম দ্বিতীয় দফা সিকিউরিটিতে। এখানেও কার্ড স্ক্যান করতে হবে। মেয়েটা ওর কার্ড দিয়ে সুন্দর ঢুকে গেল। কিন্তু ওর পিছু পিছু আমি ঢুকতে যেতেই স্ক্যানার ক্যা কো ক্যা কো শুরু করল। মানে একটা কার্ড দিয়ে শুধুমাত্র একজনই ঢুকতে পারবে। কী অবস্থা! ওয়ার্নিং শুনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন এগিয়ে এলেন। তাকে বললাম সমস্যার কথা। উনি বললেন, এবারের মত আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেন। কিন্তু আমি যেন দ্রুত কার্ড করে ফেলি। তা আর বলতে! মেয়েটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আইটি অফিসের দিকে।

যেতে যেতে চারপাশে দেখলাম। বিশাল একটা হলরুম। পুরো রুম জুড়ে বিভিন্ন ধরনের সোফা সাজানো। গোল করে, লম্বা করে বা চারকোণা করে। সাথে আছে গোল বা লম্বা টেবিল। কিছু সোফা দেখলাম একাকী পড়ে আছে। এগুলোতে আধশোয়া হওয়া যায়। সোফার পায়ার কাছে নরম গদির মত রাখা। সোফায় আধশোয়া হয়ে গদির উপর পা তুলে পোলাপান আয়েশ করছে। হাতে একটা বই ধরা। সামনের টেবিলে রাখা কফির মগ। আমার চোয়াল ঝুলে গেল। করেছে কী এরা! বই পড়াকে এত আরামদায়ক বানিয়ে ফেলেছে? আমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়েছি খাড়া চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে। এখানে দেখছি সমুদ্র সৈকতের আবহাওয়া। আরেকটু দূরে দেখলাম সারি সারি কিউবিকল দাঁড়ানো। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা কিউবিকলগুলোয় কেউ দলবেঁধে পড়ছে, কেউ কাউকে পড়াচ্ছে। যে পড়াচ্ছে, সে হোয়াইট বোর্ডে আঁকিবুঁকি করছে। মনে হল গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পড়াচ্ছে আন্ডার গ্র্যাডদের। একটা নোটিস বোর্ডে লেখা দেখলাম, লাইব্রেরির লাউঞ্জে প্রতি বুধবার প্রফেসরদের সাথে ঘরোয়া আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়। একেক বুধবারে একেক প্রফেসর আসেন একেক বিষয় নিয়ে কথা বলতে। উনাদের সাথে আলাপচারিতায় মেতে উঠতে পারবেন ফ্রি ক্রঁসা খেতে খেতে। অসাধারণ। একদম কোণার দিকে দেখলাম একটা ক্যাফে। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে কফি কিনে খেতে পারবেন। সাথে আছে হালকা নাস্তার ব্যবস্থা। মোট কথা, পড়া এখানে নিরানন্দ কিছু নয়। নয় বিরক্তিকর ব্যাপার। পড়াকে আনন্দদায়ক করে তুলতে অনেক উদ্যোগ নিয়ে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দেখে খালি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে পৌঁছে গেলাম আইটি অফিসে। এখানে মঙ্গোলীয় চেহারার একজন ছেলে বসা। কাহিনী কী? চৈনিকরা কি আমেরিকা দখল করে নিচ্ছে নাকি? ছেলেটা চাইনিজ নাকি জাপানিজ নাকি ভিয়েতনামিজ, আমি নিশ্চিত না। তবে চীনাদের আগ্রাসন সম্পর্কে জানি বলে সন্দেহ করলাম সে চীনাই হবে। তাকে বললাম কীজন্য এসেছি। সে চটপট ল্যাপটপে আউটলুক ইমেইল, এমএস অফিস, এন্টি ভাইরাস সেট করে দিল। ভার্সিটির ওয়াইফাইয়ের সাথে আমাকে যুক্ত করে দিল। কাজ শেষ। মূল পাঠাগারে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সময় নেই। এখন যেতে হবে আইডি কার্ড বানাতে। তাই ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। লাইব্রেরি থেকে বের হলে বিশাল লন। সেটা পার হয়ে যেতে হবে ডুবর্গ হলে। এই হল ছিল স্লুর নির্মিত প্রথম দালান। সেই ১৮১৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল এটা। আমি হলের ভেতর ঢুকে হারিয়ে গেলাম। কোনদিকে যেতে হবে ঠাহর করতে পারছি না। দিক নির্দেশনাও দেখছি না কোনো। একজন মহিলাকে আসতে দেখলাম করিডরের উল্টো মাথা থেকে। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আইডি কার্ডের অফিস কোথায় বলতে পারবেন কিনা। উনি ‘ডানে যাও, তারপর বামে, তারপর উপরে, নিচে, নৈঋত, ঈশান’ কী কী যে বললেন! উনাকে আর না ঘাঁটিয়ে আমি একা একা হাঁটতে লাগলাম। এটাও একটা অভিজ্ঞতা। নতুন জিনিস দেখার, জানার। হঠাৎ দেওয়ালে দিক নির্দেশনা পেলাম। রুম নাম্বার দিয়ে কীভাবে সেখানে যাওয়া যাবে, সেটা বলা। সে মোতাবেক আইডি অফিসে গেলাম। মধ্যবয়স্ক একজন লোক রিসেপশনে বসা। উনাকে বললাম আইডি কার্ড করতে চাই। উনি আমার ব্যানার আইডি জিজ্ঞেস করলেন। ব্যানার আইডি হল প্রত্যেক স্টুডেন্টের ইউনিক নাম্বার। এটা লিখে সার্চ দিলে ডাটাবেস থেকে ওই স্টুডেন্ট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। বললাম। উনি চেক করে দেখলেন আমার ব্যাপারে। এরপর জিজ্ঞেস করলেন আমি ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত কিনা। আমার অবস্থা রোদে পুড়ে ঘেমে শোচনীয়। তারপরও ঝামেলা শেষ করার জন্য বললাম, হ্যাঁ। লোকটা আমাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়ে ট্রাইপড নিয়ে এল। সেখানে ক্যামেরা রেখে ঝটপট ছবি তুলে ফেলল। তারপর কম্পিউটারে কিরিঞ্চি করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আইডি কার্ড বানিয়ে দিল। আমি হতভম্ব। কার্ডে আমার ছবি দেখে এবং এত দ্রুত কার্ড পেয়ে। একটাই সান্ত্বনা, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্রের চেয়ে সুন্দর এসেছে এই কার্ডের ছবি। কিন্তু এটা আমার আসল চেহারা নয়, সেটা হলফ করে বলতে পারি।

(২২)

স্যালাস সেন্টার। ইংরেজিতে বানান হল Salus. এটার উচ্চারণ সালুস না হয়ে স্যালাস হবে কেন? আশ্চর্য তো! তারপর মনে পড়ল, আমি পাঁচ বছর ইতালীয়দের সাথে কাজ করে এসেছি। ওরা যেকোনো শব্দ বানান অনুযায়ী উচ্চারণ করে। যেমন, Umbrella-কে ওরা বলবে উম্ব্রেল্লা, Multipurpose-কে বলবে মুল্তি‌পুর্পো‌স। ওদের সাথে থেকে অজান্তেই আমার মাথায় বানান অনুযায়ী উচ্চারণ রীতি ঢুকে গেছে। অচেনা শব্দ দেখলে তাই ওভাবে উচ্চারণ করে ফেলছি। এজন্যেই Salus হয়ে গেছে সালুস। কিন্তু আমেরিকান উচ্চারণে এটা স্যালাস।

স্যালাস সেন্টারে আছে পুষ্টি বিভাগের দুটো বড়সড় প্রজেক্ট। একটা হল ন্যাশনাল স্কুল লাঞ্চ প্রোগ্রাম। আমেরিকান সরকার সেই পঞ্চাশের দশকে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিল। স্কুলে স্কুলে পুষ্টিকর খাবার বিলানোর পদক্ষেপ। পারিবারিক আয় যদি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে হয়, তাহলে ঐসব পরিবারকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়, আর বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানকে বিনামূল্যে সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হয়। যারা দারিদ্রসীমার একটু উপরে আছে, তাদের জন্য আছে স্বল্পমূল্যে খাবারের ব্যবস্থা। এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল যেন ছোট বাচ্চারা, তাদের বাবাম্যের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন, পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের কিচেন থেকে এরকম তিনটা স্কুলে নাস্তা আর দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হয়। এই তিনটা স্কুল আমেরিকান সরকারের সাথে স্কুল লাঞ্চ প্রোগ্রামের চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী সরকার তাদের টাকা দেবে, আর স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের একটি ব্যালেন্সড ডায়েট দিবে, যেখানে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট আর প্রোটিন জাতীয় খাবার বয়স অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে আছে। এই বিষয় বুঝার জন্য পুষ্টি বিভাগের চেয়ে ভাল আর কে থাকতে পারে? তাই স্কুল তিনটা আমাদের কাছে এসেছে। আমাদের কিচেনের ম্যানেজার, যে কিনা একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটেশিয়ান, প্রতি মাসে স্কুলের সাথে আলোচনা করে মেনু ঠিক করে। সপ্তাহের পাঁচদিন পাঁচ রকম মেনু। যারা কিচেনে কাজ করে, তারা প্রতিদিন মেনু অনুযায়ী খাবার প্রস্তুত করে, প্যাকেটজাত করে স্কুলে পাঠায়, কিংবা প্রয়োজনমত রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করে।

আরেকটা প্রজেক্ট হল ক্যাফেটেরিয়া। স্যালাস সেন্টারে আছে সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের (SLU/স্লু) পাবলিক হেলথ বিভাগের অনেকগুলো অনুষদ, আছে চিকিৎসকদের গবেষণাগার, আছে অপরাধবিদ্যা বিভাগ। তাই প্রচুর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক আর কর্মজীবী মানুষের আসা যাওয়া চলে প্রতিদিন। তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে ক্যাফে ফ্রেশ নামের একটি ছোটখাট ক্যাফেটেরিয়া। এখানে প্রতিদিনকার খাবার প্রতিদিন তৈরি করে বিক্রি করা হয়। ক্যাফে আর কিচেন – এই দুই জায়গায় আমার কাজ পড়েছে। সপ্তাহে বারো ঘণ্টা এখানে কাজ করতে হবে। গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট হওয়ার শর্ত হল, প্রতি সপ্তাহে মোট বিশ ঘণ্টা আমাকে পুষ্টি বিভাগের অধীনে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হবে। সেসব কাজের মধ্যে ক্যাফে আর কিচেন দুইটা। এরপর আছে অনুষদের বাগানে কাজ, আর একজন প্রফেসরকে গবেষণায় সাহায্যের কাজ। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিশ ঘণ্টা কাজ মানে পার্ট-টাইম চাকরি, আর চল্লিশ ঘণ্টা কাজ মানে ফুল-টাইম। কোর্স চলাকালে স্টুডেন্টরা বিশ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পায়। কিন্তু যখন ছুটি চলে, হতে পারে সেটা সামার হলিডে বা উইন্টার, তখন ছাত্রছাত্রীরা চল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারে। এখানে একটা ‘’কিন্তু’ আছে। মার্কিন স্টুডেন্টরা ছুটির সময় অফ-ক্যাম্পাস চাকরি করার অনুমতি পেলেও আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টরা পায় না। তাদের যোগাড় করতে হয় অন-ক্যাম্পাস চাকরি। অর্থাৎ ক্যাম্পাসের ভিতর কাজ করা।

গতকাল ছিল স্যালাস সেন্টারের কিচেনে আমার প্রথম দিন। পুষ্টিগুণ ঠিক রেখে কীভাবে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর বৈকালিক নাস্তা প্রস্তুত করা হয়, সেটা হাতে কলমে শেখানো হবে এখানে। কিচেনে গিয়ে দেখা করলাম জ্যাকির সাথে। সে স্কুল লাঞ্চ প্রোগ্রামের ম্যানেজার। প্রোগ্রামটির রান্নাবান্না সব এই কিচেনে হয়ে থাকে। প্রথম দিন হিসেবে জ্যাকি আমাকে পুরো কিচেন আর ক্যাফে ঘুরিয়ে দেখাল। সমস্ত নিয়ম কানুন বলল। কিচেনে গিয়ে প্রথমেই আমাকে যা করতে হল, মাথায় হেয়ার নেট পরতে হল। এই সতর্কতার কারণ, খাবারে যেন চুল না পড়ে। তারপর জ্যাকির সাথে পুরো কিচেন ঘুরে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এত বিশাল কিচেন, আর এত তার তৈজসপত্তর! বিশাল দুটো রুমকে রেফ্রিজারেটর আর ফ্রিজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো ‘ওয়াক-ইন’ নামে পরিচিত কারণ রেফ্রিজারেটরের ভিতর ঢুকে আপনি হাঁটাচলা করতে পারবেন। রেফ্রিজারেটরে ঢুকে একদফা কাঁপাকাঁপি করলাম, আর ফ্রিজারে ঢুকে কাঠ হয়ে গেলাম। পরে জেনেছি ফ্রিজারে ঢুকার জন্য আলাদা জ্যাকেট আছে। ওটা পরে না ঢুকলে হাইপোথার্মিয়া হয়ে যেতে পারে।

বাসন কোসন ধোওয়ার সেকশনে গিয়ে আরেকবার আক্কেল গুড়ুম। দুই ধরনের প্রক্রিয়া আছে ধোওয়ার: মেশিনে এবং হাতে। মেশিনে দিলে যেহেতু দ্রুত কাজ হয় এবং কোনো কষ্ট নেই, তাই সবার নজর থাকে মেশিনের উপর। এই করতে গিয়ে বিশাল সিরিয়াল হয়ে যায়। তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় হাতে ধোয়ার বেসিন। এই প্রক্রিয়াও মুগ্ধ হবার মত। বিশাল বিশাল পাঁচটা বেসিন আছে। প্রথমটায় প্রেশার স্প্রে করে শক্ত ময়লা উঠানো হয়। এরপর চালান দেওয়া হয় দ্বিতীয় বেসিনে। সেখানে মেটালের মাজুনি দিয়ে ঘষাঘষি করা হয়। এরপর তৃতীয় বেসিনে সাবান মিশ্রিত গরম পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়। চতুর্থ বেসিনে পানি দিয়ে খলানো হয়। পঞ্চম বেসিনে স্যানিটাইজার মিশ্রিত পানির মধ্যে বাসনপত্র চুবানো হয়। এরপর পানি ঝরানোর জন্য তাকে উঠানো হয়। এসব কাণ্ড দেখে দেশের হোস্টেলে খালারা কীভাবে বাসন মাজত সেটা মনে পড়ে গেল। পুরো রান্নাবান্নার প্রক্রিয়ায় এই ধাপই ছিল সবচেয়ে নোংরা। চরম নোংরা একটা জায়গায়, তারচেয়েও চরম নোংরা মাজুনি দিয়ে হাঁড়িপাতিল ঘষা হত।

কোন স্কুলে সপ্তাহের কোনদিন কী খাবার যাবে, তার তালিকা দেখেও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। যখন স্কুলের সরবরাহ করা টিফিন খেতাম, যা দিত সেটা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতাম। অথচ এখানে দেখি বাচ্চাদের নানা বাহানা। একজন আনারস খেতে চায় না বলে তার জন্য আপেল পাঠাতে হচ্ছে, একজন বেগোল খেতে চায় না বলে তার জন্য পাউরুটি পাঠাতে হচ্ছে। কাদের কীসে এলার্জি আছে, সেটা হিসেব করে খাওয়ার মেনু ঠিক করতে হচ্ছে। দেশের জনসংখ্যা কম হওয়ার সুবিধা কত বেশি, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হল। এরপর আমাকে সবজি আর ফলমূল কীভাবে কাটতে হয় সেটা শেখানোর জায়গায় নিয়ে এল জ্যাকি। কাজ শুরু করার আগে আমাকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হল। বেসিনের সামনে একটা কাগজ সাঁটানো, ‘খাবার তৈরির আগে আপনার হাত সাবান আর উষ্ণ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন’। নির্দেশনা অনুযায়ী হাত ধুয়ে নিলাম। এবার গ্লাভস পরার পালা। খালি হাতে কাটাকাটি করা বারণ কারণ হাতের তালু ঘেমে যেতে পারে, তালুতে ময়লা লেগে থাকতে পারে। গ্লাভস সেসব থেকে সুরক্ষা দেবে।

এরপর চিনতে হল কাটিং বোর্ডের রঙ। চার রঙের কাটিং বোর্ড দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে সবুজ বোর্ড ব্যবহার করা হয় কাঁচা শাকসবজি আর ফলমূল কাটার জন্য। নীল বোর্ড রান্না করা মাংস, মাছের জন্য (রান্না করা মানে বেক, ফ্রাই, গ্রিল ইত্যাদি)। হলুদ বোর্ড কাজে লাগে কাঁচা মাছ বা মাংসের জন্য, সাদা বোর্ড ডেইরি প্রোডাক্টের জন্য। দেখে হাসি এল। এত কাহিনী করার কী দরকার? এক বোর্ডে সব কাটলে কী হয়? অনেক কিছুই হয় কারণ এটা আমেরিকা। এখানে খাওয়া দাওয়ার প্রতি খুব সতর্ক থাকা হয়। বিভিন্ন রঙের বোর্ড ব্যবহার করা হয় ফুড পয়জনিং এবং ক্রস কন্টামিনেশন এড়ানোর জন্য। যে বোর্ডে আপনি মুরগি কাটলেন, সেটাতেই সবজি কাটলে মুরগিতে থাকা জীবাণু সবজিতে ঢুকে পড়তে পারে। তাই এই সতর্কতা। এরপর এল ছুরি চেনার পালা। পাউরুটি কাটার জন্য এক ধরনের ছুরি, মাছ-মাংস-সবজির জন্য আরেক ধরনের। কেক কাটার জন্য আবার আরেকটা। সামান্য রান্নার আয়োজনকে এরা কই নিয়ে গেছে! হুলুস্থূল আয়োজন দেখে মনে পড়ল রান্না আসলে শিল্প। আমরাই ব্যাপারটাকে মামুলি আবহে মুড়ে রাখি। এজন্য এত আয়োজন আমাদের কাছে ভুংচুং লাগে।

জ্যাকির সাথে পুরো কিচেন ঘুরে গেলাম স্যালাস ক্যাফের ম্যানেজার শাও লিয়াংয়ের কাছে। এখন ওর সাথে কাজ করার পালা। শাও বলল পনেরো পিস চকলেট কুকি বেক করতে। আমি জীবনে কুকি বেক করিনি। জানি না কীভাবে করতে হয়। বললাম দেখিয়ে দিতে। শাও অবাক হয়ে তাকাল যেন কুকি বেক করতে না পারাটা অষ্টমাশ্চর্য কিছু। এই মেয়েকে আমার প্রথম থেকেই ভাল লাগছে না। কিচেনের ম্যানেজার জ্যাকি যেমন আমাকে সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়েছে, শাও পুরো উল্টো। সে আমাকে খালি এটা ওটা করতে বলে। আমি যে আমেরিকায় নতুন এসেছি, আমেরিকান রান্নাবান্নার কিছুই জানি না, এটা ওর মাথায়ই নেই। প্রতিবার আমাকে বুদ্ধুর মত বলতে হয় ‘আমি পারি না, দেখিয়ে দাও’, আর প্রতিবার শাও এমন চাহনি দেয় যেন আমি খুব বিরক্ত করছি ওকে। আমার মার্কিনী বন্ধুরা ফটাফট কাজ করে বলে শাও আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি কেন ওদের মত চটপট কাজ করতে পারি না? এক বন্ধু বলল, শাও নিজেও চাকরিতে নতুন ঢুকেছে। বুঝে উঠতে পারছে না কেমন আচরণ করা উচিৎ। কয়দিন যেতে দিলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে। শাও চৈনিক, জ্যাকি আমেরিকান। হতে পারে এটাও ওদের মধ্যে ভিন্নতা তৈরির জন্য দায়ী। যা হোক, শাওকে যখন বললাম কুকি বেক করা শিখিয়ে দিতে, বলল ও নিজেও এটা পারে না। দুজনে মিলে তখন জ্যাকির কাছে গেলাম। জ্যাকি পদ্ধতিটা বুঝিয়ে দিল। সে মোতাবেক দুজনে বেক করলাম। যে কুকি হওয়ার কথা দুই ইঞ্চি ব্যাসের, সেটা হয়ে গেল চার ইঞ্চির। এত বড় কুকি দেখে আমরা হতভম্ব। এই কুকি কিনবে কে? অনেক ভেবে ঠিক করলাম এটাকে জায়ান্ট কুকি হিসেবে বিক্রি করব। আমাদের ক্যাফের স্পেশাল আইটেম। মানুষজন যখন কুকি দেখল, অস্ফুট বিস্ময়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল। অনেকে এই আকৃতি দেখে ‘কিউট! কিউট’ করতে লাগল। অনেকে কিনলও। প্রথম বেকিং হিসেবে বিক্রিবাট্টা খারাপ গেল না। সারাদিন পর শাওয়ের মুখে একটু হাসি দেখা গেল।

পর্ব দশ এখানে

Happy
Happy
50 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
50 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর জীবনের দুই বছর (পর্ব ৮)
Next post যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর জীবনের দুই বছর (পর্ব ১০)