3 0
Read Time24 Minute, 43 Second

বড়দিন বৃক্ষ আমার খুবই পছন্দের একটা জিনিস। আপনারা হয়ত একে ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে চেনেন। বাংলায় এর কোনো নাম নেই। তাই আমি ডাকলাম ‘বড়দিন বৃক্ষ’ বলে। বড়দিনের গাছ বললে ছন্দ আসে না। ছোটবেলায় পশ্চিমা চলচ্চিত্র বা টিভি সিরিজগুলোতে দেখতাম বড়দিন এলে সবাই বড়দিন বৃক্ষ দিয়ে ঘরবাড়ি, গির্জা (চার্চ), রাস্তাঘাট সাজায়। অথচ আমাদের বাসায় এই গাছ দিয়ে সাজানো হত না। এমনকি গির্জায়ও এই জিনিস দেখতাম না। এত সুন্দর একটা জিনিস অথচ আমাদের দেশের বড়দিনে সেটা অনুপস্থিত। কেন? হালকা বড় হওয়ার পর বুঝলাম, এটা পশ্চিমা সংস্কৃতি। দেশীয় ঐতিহ্য নয়। তাই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে বড়দিন বৃক্ষের আনাগোনা ছিল না। কিন্তু এটার প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হল। সবসময় আফসোস হত, কেন এই ব্যাপারটা আমাদের উৎসবে ঢুকানো হচ্ছে না।

কিশোর বয়সে একদিন ইত্তেফাক পত্রিকায় দেখলাম, হোটেল সোনারগাঁ আর শেরাটনে বড়দিন উপলক্ষ্যে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য বড়দিনের দিন সান্তা ক্লজ আসবেন। ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার টিকেট মাথাপিছু পাঁচশো টাকা। দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! তবে কি দেশেও বড়দিন বৃক্ষের ঐতিহ্য চালু হয়েছে? পাঁচশো টাকার কারণে ঐ অনুষ্ঠানে যেতে পারব না বটে, কিন্তু যে শহরে বড়দিন বৃক্ষ চলে এসেছে, সেই ঢাকার তুলনায় মির্জাপুর নামের মফঃস্বলটা আর

তেজগাঁ গির্জার ভেতর সাজানো ছোট্ট বড়দিন বৃক্ষ

সহ্য হচ্ছে না। কবে ঢাকায় যাব? কবে দেখব মরিচবাতি আর রঙিন বল দিয়ে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি? একবার কি ‘চোখের দেখা’ দেখা যাবে না হোটেলের বাইরে থেকে?

এসএসসি পাশের পর ঢাকায় আসার অনুমতি মিলল। ভর্তি হলাম হলি ক্রস কলেজে। উঠলাম ফার্মগেটের এক ছাত্রীনিবাসে। ততদিনে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে ছোটবেলার পাগলামি আর নেই, কিন্তু অমোঘ আকর্ষণটা রয়ে গেছে। মির্জাপুর কিংবা গ্রামের বাড়ির তুলনায় ঢাকার বড়দিন অন্যরকম। এখানে সবাই আলাদা আলাদা বড়দিন করে। যদিও খ্রিস্টান পাড়াগুলোয় চাঁদা উঠিয়ে পুরো পাড়া সাজানো, ম্যাগাজিন বের করা, কীর্তন করা, ইত্যাদি চলে। কিন্তু গ্রামে যেমন সবাই সবাইকে চিনে, সবাই মিলে মজা করে, ঢাকায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। যা হোক, একটা জিনিস দেখে ঢাকার বড়দিনকে ভাল লেগে গেল। সেটা হল, বড়দিন বৃক্ষ।

তেজগাঁ গির্জার সামনে ছোট ছোট ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি করছে। সবুজ কাগজ দিয়ে পাতার মত কেটে গাছ বানিয়েছে। কিন্তু দেখতে টিভিতে দেখা গাছগুলোর মত সুন্দর নয়। গির্জার ভিতরে কিছু পাইন গাছ আছে। সেগুলোকে মরিচবাতি দিয়ে সাজিয়েছে। ফলে বড়দিন বৃক্ষের আমেজ চলে এসেছে। কয়েকজনের বাসায়ও দেখলাম দুই বা তিন ফুট লম্বা ক্রিসমাস ট্রি। বিদেশের মত আকাশছোঁয়া উচ্চতা নয়, কিন্তু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। ভাবলাম, আমাদের বাসার জন্যও একটা কেনা যায় কিনা। দোকানদারকে যখন দাম জিজ্ঞেস করলাম, ঢোকের সাথে কেনার ইচ্ছেটাও গিলে ফেললাম। এইটুকুন একটা গাছের দাম বারো’শ, তেরো’শ টাকা। বলছি ২০০৫ সালের কথা। তখন আমার কলেজের বেতন ছিল তেরো’শর মত। অবশ্য বৃত্তি পেয়েছিলাম বলে রক্ষা। নতুবা আরও বেশি দিতে হত। তো, এরকম দামের কথা মধ্যবিত্ত বাপ-মাকে বলার সাহস আমার ছিল না।

এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হলাম আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। ফার্মগেটকে বিদায় জানাতে হল। চলে এলাম মোহাম্মদপুরের এক ছাত্রীনিবাসে। ফার্মগেটটার মত এটাও ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিনীদের দিয়ে পরিচালিত এক হোস্টেল। যারা আসাদ এভিনিউ চেনেন, তারা জানেন এখানে পরপর অনেকগুলো খ্রিস্টা

আমার প্রথম বড়দিন বৃক্ষ (কালাচাঁদপুর, ২০১৭)

ন প্রতিষ্ঠান আছে। মোহাম্মদপুর চার্চ, সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গ্রিন হেরাল্ড স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠান দেশীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ঘরানায়ও বড়দিন পালন করে। সে সুবাদে আমাদের হোস্টেলটাও দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে পশ্চিমা ঐতিহ্য মিলিয়ে বড়দিনের সাজসজ্জা করত। এখানে এসে প্রথমবারের মত আমি বড়দিন বৃক্ষ সাজিয়েছি। সেটা সাজানোর পাশাপাশি রঙিন কাগজের শিকল লাগানো হত দেওয়ালে। বেলুন দিয়ে সাজানো হত খাওয়ার ঘর। চ্যাপেলের (প্রার্থনা করার জায়গা) কথা নাই বা বললাম। কিন্তু এতকিছুর পরও সন্তুষ্টি আসছিল না। আমার নিজের যে একটা ক্রিসমাস ট্রি নেই!

আমি বড় হয়েছি এমন একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, যেখানে ঈদ-পূজা-বৌদ্ধ পূর্ণিমা-বড়দিন সব উৎসবই সবাই মিলে পালন করতাম। মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বন্ধুবান্ধবরা পূজায় প্রসাদ খেতে যেত হিন্দু বন্ধুদের বাসায়। ঈদে অন্য ধর্মের বন্ধুরা আসত মুসলিম বন্ধুদের বাসায়। এমন পরিবেশে থাকলে প্রতিটা ধর্মের উৎসব পালন করাটা মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত হয়। বাবা-মাকে দেখেছি ঈদের দিন বাসায় পোলাও আর ঝাল গরু রান্না করতে; পূজার সময় নিরামিষ খিচুড়ি, লাবড়া করতে। ফলে ধর্ম অন্যের হলেও উৎসব সবার দেখেই আমি বড় হয়েছি। যদিও কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বেড়াজালে আমাকে বাঁধা যাবে না, তবুও বিভিন্ন ধর্মের উৎসবে শামিল হতে আমার ভালো লাগে। ঈদের সময় দাওয়াত খাওয়ার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি, দুর্গা পূজার সময় লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে মণ্ডপে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে, পূজার প্রসাদ হিসেবে যে নিরামিষ খিচুড়ি-পায়েস-লাবড়া খেতে দেয়, সে অমৃত খাওয়ার জন্য লোভাতুর জিভ নিয়ে বসে থাকি। আবার বড়দিন এলে ঘর সাজাতে ইচ্ছে করে, ঐতিহ্যবাহী কেক বানাতে ইচ্ছে করে, ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে মন চায়। এতে আমি প্রচুর আনন্দ পাই। ধর্ম পালন করি না বলে ঐতিহ্যবাহী উৎসবেও অংশগ্রহণ করব না, এতটা কঠোর এখনো হতে পারিনি। সেজন্যেই একটা বড়দিন বৃক্ষের জন্য আমার আকুলতা।

ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাধ্য ছিল না ক্রিসমাস ট্রি কিনে দেওয়ার। যতদিনে তাদের মোটামুটি সাধ্য হল, ততদিনে আমি বড় হয়ে গিয়েছি। বুঝতে শিখেছি, এসব বিলাসিতা ঠিক যায় না আমাদের সাথে। এরপর আরেকটু সাধ্য বাড়ল, আর সাহস করে কিনতে গেলাম বিলাস দ্রব্য। নিউ মার্কেট, চকবাজার সব জায়গা ঘুরে ফেললাম সস্তা গাছের জন্য, পেলাম না। পুঁচকে গাছটার বিশাল দাম দেখে খালি হাতে ফেরত আসতে হল। বড়দিনের ঋতু ছাড়া এটা পাওয়া যায় না, আর এই ঋতুতে এর দাম হয়ে যায় উচ্চতা ভেদে দুই থেকে আট হাজার টাকা। দুই ফুট গাছের জন্য দুই হাজার টাকা বিলানোর মত সামর্থ্য নেই। তাই জিদের ঠ্যালায় কেনা হচ্ছিল না। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করলাম, শুরু হল নিজের সংসার। চিন্তা করলাম এই বড়দিনে একটা গাছ কিনেই ছাড়ব। সেদিন ছিল নভেম্বরের ২৭ তারিখ। কী যেন কেনার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়েছি। এই দোকান সেই দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল ছোট একটা দোকানে। সেখানে একটা ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখা। বুঝতে পারছিলাম না এটা বিক্রির জন্য, নাকি দোকানের সাজসজ্জা হিসেবে রাখা।

দোকানদারকে জিজ্ঞেস করার পর বললেন বিক্রির জন্য রাখা। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শুরু হল। জানতে চাইলাম দাম কত। দোকানদার

আসল দেবদারু গাছ (সেন্ট লুইস, ২০১৮)

বললেন, সব ডেকোরেশনসহ একদাম বারো’শ। আমি চোখ পিটপিট করলাম। চার ফুট গাছটার দাম বারো’শ, তাও আবার মরিচবাতি আর টুকিটাকি জিনিসসহ? এ তো পুরো উইন-উইন সিচুয়েশন! দরদামের ঝামেলায় না গিয়ে সাথে সাথে কিনে ফেললাম। কেনার পর যে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল সেটা করে ফেললাম, “আপনি এত সস্তায় ক্রিসমাস ট্রি দিচ্ছেন কীভাবে?” দোকানদার জানালেন, এটা গত বছরের লট। এই বছরের লট আসলে দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া এখনো ডিসেম্বর মাস শুরু হয়নি। ডিসেম্বরে সবাই কিনতে আসে বলে দাম বেড়ে যায়। নভেম্বর বলে আমরা বেঁচে গিয়েছি। কানের পাশ দিয়ে গুলি গিয়েছে।

এটাই ছিল আমার কেনা প্রথম বড়দিন বৃক্ষ। একদম নিজের ক্রিসমাস ট্রি। বাসায় এনে সাজানোর পর খুশিতে চোখে পানি এসে গেল। নভেম্বর শেষ না হতেই আমার বাসায় ক্রিসমাসের ছোঁয়া লেগেছে। অথচ পশ্চিমা রীতি অনুযায়ী, বড়দিনের আগের দিন নাকি এই বৃক্ষ সাজানোর কথা! আবার খুলে ফেলার কথা বড়দিন শেষ হওয়ার বারোদিন পর। কে শোনে এসব? আমি যতদিন দেশে ছিলাম, সবসময় জ্বালিয়ে রেখেছিলাম বড়দিন বৃক্ষ। এটা আমার কাছে বড়দিনের কোনো সজ্জা ছিল না, ছিল ছোটবেলা থেকে পালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আসার আগে বাবা-মায়ের কাছে জমা দিয়ে এসেছিলাম গাছটা। এখন উনারাই সাজান।

সেন্ট লুইসে এলাম ২০১৮ সালের আগস্টে। স্বপ্নের দেশে পা দেওয়ার একদিন পর দেশটা দেখতে বের হয়েছিলাম। মানে ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া পাড়া দেখিতে বাহির হইয়াছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল অতিকায় দেবদারু গাছ। ইংরেজিতে যাকে ফার (fir) ট্রি বলে। দেখে থমকে দাঁড়ালাম। আরে, এটাই তো টিভিতে দেখে আসা বড়দিন বৃক্ষ! একদম জীবন্ত ক্রিসমাস ট্রি! কাগজ বা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো নকল গাছ নয়, খাঁটি গাছ। চট করে ছবি তুলে ফেললাম। সারাজীবন যে গাছ হাতে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি, সেটাই এখন চোখের সামনে দেখে আনন্দ ধরে না।
.
ঠিক তিন মাস পরে, নভেম্বরে, আমাদের বাসার গ্যারেজে কে যেন ছয় ফুট লম্বা একটা বড়দিন বৃক্ষ ফেলে গেল। হয়ত বাসা বদল করছিল, এত বড় গাছ গাড়িতে না আঁটায় ফেলে দিতে হল। আমাদের গ্যারেজটা মাটির নিচে, অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ডে। আমরা তখনও গাড়ি কিনিনি। তাই গ্যারেজে খুব একটা যাওয়া হত না। মাসে একবার কাপড় ধুতাম। তখন গ্যারেজের ভিতর দিয়ে লন্ড্রি রুমে যেতে হত। কিন্তু ঐদিন গ্যারেজে কোনো কাজ ছিল না। কী কারণে যে ওখানে গিয়েছিলাম, মনে নেই। গিয়ে দেখি বিশাল একটা কার্টন ভর্তি বড়দিন বৃক্ষ পড়ে আছে। যে কৃত্রিম গাছগুলো আপনারা দেখেন, সেগুলো সাধারণত কয়েকটা অংশে ভাগ করা থাকে। সবগুলো অংশ জোড়া দি

ধন্যবাদ তাকে যিনি ফেলে গিয়েছিলেন এই গাছ

য়ে লম্বা গাছের রূপ দেওয়া হয়। ঐ কার্টনে পাঁচটা অংশ রাখা আছে। আমি চারপাশে তাকালাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না একটা আস্ত গাছ পেয়ে গেছি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কার্টনটা এত ভারী যে আলগাতে পারছি না। তাই ঠেলে ঠেলে ঘষটাতে ঘষটাতে এলিভেটরে উঠালাম। বাসায় এনে যখন জোড়া লাগালাম, ছয় ফুট লম্বা বড়দিন বৃক্ষ তৈরি হল। আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। কতটা বেপরোয়া হলে এই জিনিস কেউ ফেলে যায়?

.
দ্রুত গুডউইল থ্রিফ্ট স্টোর থেকে মরিচবাতি আর রঙিন বল কিনে আনলাম। গাছটাকে সাজালাম ইচ্ছেমত। দেশের ছোট্ট বৃক্ষকে যেভাবে পারিনি, সেভাবেই এটাকে সাজালাম। মরিচবাতিগুলো জ্বালিয়ে রাখতাম সারাদিন, সারারাত। না জ্বালালে কি আর হলিডে সিজনের আমেজ আসে? মাঝরাতে বাথরুম করতে উঠলে নিভিয়ে দিতাম। একদিন হল কি, ভার্সিটি যাওয়ার আগে গাছের বাতি জ্বালিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। বাসায় যখন ফিরলাম, বাইরে তখন অন্ধকার। দরজা খুলে ঢুকতেই দেখি বাসার ভেতরে টকটকে লাল আলো। আঁতকে উঠলাম! এ কীসের আলো? আগুন লেগেছে নাকি? পরমুহূর্তে মনে পড়ল, ওহ! ক্রিসমাস ট্রি।
.
বাটলারে আসার আগে বড়দিন বৃক্ষটা বেচে দিলাম পনেরো ডলারে। সাথে ফ্রি দিলাম ডেকোরেশনগুলো। বিক্রি করার আগে অনেকদিন ভেবেছি কোনোভাবে আনা যায় কিনা গাছটা। কিন্তু এটা গাড়িতে ঢুকালে প্রয়োজনীয় জিনিসের জায়গা হয় না। বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হল। যেদিন এক দম্পতি গাছটা নিতে এল, আমার মনে হল যেন কলিজা কেটে দিচ্ছি। এত খারাপ হল মনটা! সারা সপ্তাহ মনমরা হয়ে রইলাম। এত আবেগ দিয়ে সাজিয়েছিলাম যে, প্রিন্স পর্যন্ত আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পাচ্ছিল না।
.
বাটলারে এসে তক্কে তক্কে ছিলাম কেউ সস্তায় ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি করছে কিনা। কিন্তু এই জায়গা এমন গ্রামের গ্রাম যে, সস্তা বলে কিছু নেই। সেন্ট লুইস বিশাল শহর ছিল। ওখানে প্রচুর জিনিস বিনামূল্যে পাওয়া যেত। জিনিসের আধিক্য ছিল বলে সবাই কম দামে জিনিস ছেড়ে দিত। কিন্তু বাটলার ছোট গ্রাম। দুই ঘণ্টায় পুরো গ্রাম চক্কর মারতে পারবেন। এখানে জিনিসের ছড়াছড়ি নেই। তাই সস্তায় কেউ ছাড়ে না। খেয়াল করলাম অক্টোবরের শেষদিকে ফেসবুক মার্কেটপ্লেসে অনেকে বড়দিন বৃক্ষের বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেছে। পঞ্চাশ ডলার থেকে শুরু। কী একটা অবস্থা! আমি পঞ্চাশ ডলার দিয়ে প্লাস্টিকের গাছ কিনব না। প্রিন্স জানে আমার পাগলামির কথা। তাই একদিন তৈজসপত্র কিনতে গুডউইলে যাওয়ার পর যখন দেখলাম বড়দিন বৃক্ষের ডেকোরেশন দোকানে উঠেছে, বলল, “কিনে ফেল। গাছ যোগাড় হয়ে যাবে।” এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার উপর পড়ল ঢোলের বাড়ি। দ্রুত পাঁচ প্যাকেট রঙিন বল কিনে ফেললাম। গাছ কবে কিনব ঠিক নেই, ডেকোরেশন কিনে বসে আছি। গাছে মাত্র কাঁঠালের মুচি এসেছে, আর আমি গোঁফে তেল মাখাচ্ছি।
নয় ফুট লম্বা বড়দিন বৃক্ষ (বাটলার, ২০২০)
.
গত সপ্তাহের শনিবার, নভেম্বরের ১৪ তারিখ। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। শনি, রবি দুইদিনই মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। রাত দশটায় ফেসবুক মার্কেটপ্লেসের একটা বিজ্ঞাপনে চোখে আটকে গেল। আমাদের থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত এক পরিবার তাদের নয় ফুট লম্বা ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। গাছটা রাখা আছে তাদের বারান্দায়, যে প্রথমে আসবে সে পাবে। কারো জন্য গাছ hold করা হবে না। আপনি যদি বলতেন, “আমি আসছি রাত দশটার দিকে, আমার জন্য গাছটা রেখে দেবেন। অন্য কেউ এলে তাকে দেবেন না”, এবং ঐ পরিবার যদি রাজি হত, তাহলে তাকে হোল্ড করা বলত। কিন্তু ওরা বিজ্ঞাপনেই লিখে রেখেছে হোল্ড করবে না। কী মুশকিল! এই বিজ্ঞাপন দেখে না জানি কত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমি কি পারব গাছটা পেতে? দ্রুত পরিবারটাকে মেসেজ দিলাম ঠিকানা জানতে চেয়ে। সেই মেসেজ আর seen হয় না। সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নাকি গাছটা কেউ নিয়ে গেছে? নিয়ে গেলে তো বিজ্ঞাপনটা থাকার কথা না। যা হোক, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।
.
সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল গাছের চিন্তায়। মেসেঞ্জার খুলে দেখি উত্তর এসেছে। গাছটা এখনো আছে, আর বাসাটা অমুক জায়গায়। দ্রুত ম্যাপ খুলে দেখলাম কতক্ষণ লাগবে যেতে। পনেরো মিনিটের মত। পেন্সিল্ভেনিয়ার রাস্তাঘাট পাহাড়ি বলে তিন মাইল যেতে দশ থেকে পনেরো মিনিট লাগে। মিজৌরির মত সমতলভূমি হলে তিন থেকে চার মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যায়। ভয়ে ভয়ে প্রিন্সকে ডাকলাম। আমি এখনো গাড়ি চালানোর অনুমতি পাইনি। ওকেই চালাতে হবে। বেচারা ভোরের দিকে ঘুমাতে এসেছে। এখন ডাকলে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠতে হবে। কিন্তু না ডাকলেও চলছে না। যত দেরি করব, গাছ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। এত লম্বা গাছ ফ্রি পাওয়ার জন্য এটুকু কষ্ট করা যায় না কি? প্রিন্স আধো ঘুম আধো জাগরণে বলল, “নয় ফুট গাছ দিয়ে কী করবে তুমি? বাসায় আঁটবে?” রাগ হল। না যাওয়ার ফন্দি হিসেবে গাছের উচ্চতার দোহাই দিচ্ছে। বললাম, “থাক, যাওয়ার দরকার নেই।” প্রিন্স সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে বলল, “ঘুম চটে গেছে। চল, নিয়ে আসি।” আমি এক মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
.
পনেরো মিনিট ধরে উঁচু, নিচু ভয়ংকর রাস্তা পাড়ি দিয়ে, বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছলাম গন্তব্যে। ক্ষীণ আশা আছে যে, এরকম আবহাওয়ায় কেউ আসেনি গাছ নিতে। বারান্দায় উঠে দেখি, ঠিকই। পাঁচটা অংশ পড়ে আছে আমার জন্য। কী বিশাল আর ভারী একেকটা পার্ট! হাঁচড়ে পাঁচড়ে গাড়িতে এনে তুললাম। রওনা দেওয়ার সময় বাসা থেকে বের হয়ে এলেন এক নারী, সাথে দুটো কুকুর। বুঝলাম উনার সাথেই এতক্ষণ মেসেজ চালাচালি করেছি। অনেক ধন্যবাদ দিলাম ফ্রি গাছের জন্য। বললেন, এটা উনার পারিবারিক স্মৃতি। কিন্তু এত বড় গাছ সাজানো কিংবা এর যত্ন নেওয়া আর হয়ে উঠছে না। তাই দিয়ে দিচ্ছেন।
.
বাসায় এসে চারটা পার্ট লাগানোর পর দেখি গাছ ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। পাঁচ নাম্বার পার্ট লাগানোর জায়গাই নেই। কী অদ্ভুত লাগছে! এমন বড়দিন বৃক্ষ কেউ দেখেছে কোনোদিন? যাক গে, এটাকেই সাজালাম। এটা দিয়েই চলে যাবে এক বছর। পরের বছরের নভেম্বর মাসে কোথায় থাকি, কে জানে। তখন আরেকটা বড়দিন বৃক্ষের জন্য অভিযান শুরু হবে। বছরের এই সময়টুকু আমার ভীষণ ভাল লাগে। পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে খুশি খুশি ভাব। শপিংমল, বিশ্ববিদ্যালয়, শহর, অফিস, সবকিছু ক্রিসমাস ট্রি আর মরিচবাতি দিয়ে সাজানো। চেইনশপগুলোয় ছাড় দিচ্ছে, থ্যাংকসগিভিংয়ের ছুটির তোড়জোড় চলছে, এফএম রেডিওতে ক্রমাগত চলছে বড়দিনের গান…। আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের ভেতর এখানে বেশ কিছু ছুটি পাওয়া যায়। ফল ব্রেক, থ্যাংকসগিভিং, উইন্টার ব্রেক (বড়দিনের ছুটি)। আবার উৎসবেরও শেষ নেই। হ্যালোউইন, থ্যাংকসগিভিং, ব্ল্যাক ফ্রাইডে, বড়দিন, নববর্ষ। সবাই তাই চনমনে থাকে। আমিও। সাথে আমার বড়দিন বৃক্ষ।
Happy
Happy
20 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
80 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামের স্মৃতিঃ শেষ পর্ব
Next post হাইওয়েঃ আমেরিকান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ (১)