এই প্রবচন শুনেছেন, ‘My way or highway’? আমেরিকান টিভি সিরিজ বা চলচ্চিত্রে অনেক সময় এই বাক্য বলে হুমকি দেওয়া হয়। মানে হল, আমার কথা মেনে নিতে পারলে থাক, না পারলে রাস্তা দেখ। মানে, হাইওয়ে ধরে বাড়ি চলে যাও। তোমাকে আর দরকার নেই। খাস বাংলায় যাকে বলে, ‘রাস্তা মাপ।’ এই কথা চাকরি জীবনে শুনতে ভয়ংকর লাগবে। কিন্তু আমেরিকায় কেউ যদি হাইওয়ে বাদ দিয়ে অলি গলি দিয়ে গাড়ি চালায়, আর আপনি গাঁইগুঁই করলে ‘My way or highway’ বলে হুমকি দেয়, তখন হাইওয়ে ধরাটাই শ্রেয়। ভাববেন, ‘বাঁচলাম! যাই, হাইওয়ে দিয়ে একটানে চলে যাই।’ আমেরিকার হাইওয়েগুলো এমনই। সময় আর টাকা বাঁচানোর জন্য এর বিকল্প নেই। অলি গলি দিয়ে চালালে প্রচুর ঘুরতে হয়, বারবার ব্রেক করার কারণে গ্যাসও বেশি খরচ হয়। কিন্তু হাইওয়েতে ক্ষণে ক্ষণে ব্রেক মারা ছাড়া দিব্যি চালানো যায় বলে সময় আর গ্যাস খরচ বাঁচে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতাম না। ভাবতাম, শহরের ভিতর দিয়ে চালালে গাড়ি অল্প গতিতে চলে, নিরাপদে থাকে। আর হাইওয়েতে কমপক্ষে ৬৫ মাইল বেগে চালাতে হয়, যেটা অনিরাপদ। পরে দেখি, হাইওয়েই বেশি নিরাপদ। শহরের ভিতরে আপনাকে প্রচুর সিগন্যাল আর সাইনের সামনে পড়তে হয়। সিগন্যাল মানে লাল-সবুজ বাতি আর সাইন হল হরেক রকম নিয়ম (শেষের ছবি দেখুন)। স্টপ নামে একটা সাইন আছে যেটা অলি, গলি, তস্য গলি, সব জায়গায় থাকে। আমার ধারণা, এক মাইল রাস্তায় দশটা স্টপ সাইন থাকে (যে হারে থামতে হয়!)। তো, বারবার সিগন্যাল আর স্টপ সাইনে পড়া মানে ব্রেক কষা, গাড়ি থামান, আবার গতি বাড়ান। অনেকে স্পিড লিমিট মানে না। যেখানে ঘণ্টায় ৩৫ মাইল চালানোর কথা, সেখানে ৪৫-এ টান দেয়। ফলে সারাক্ষণ মাথায় দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ঘুরতে হয়। প্রিন্স বলে, ‘রাস্তায় নামলে মনে করবা তুমি একাই সুস্থ, বাকি সবাই উন্মাদ। যে কেউ যেকোনো দিক দিয়ে এসে তোমার উপর গাড়ি উঠিয়ে দিতে পারে। তাই তোমাকে হতে হবে ঠাণ্ডা মাথার।‘ কথা সে ভুল বলে না। সেন্ট লুইসে থাকাকালে একবার এক ভাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন, হঠাৎ অপর পাশ থেকে গাড়ি এসে উঠে পড়ল তার উপর। যে পাশ থেকে গাড়ি এসেছিল, সে পাশে তখন লাল বাতি। অর্থাৎ তার থেমে থাকার কথা। এরকম প্রচুর উন্মাদ পাবেন আমেরিকার রাস্তাঘাটে। তাই খুব সাবধান থাকতে হয়। পরে সেই ভাই তার গাড়ির দামের চেয়েও বেশি টাকা জরিমানা আদায় করেছিলেন। সে টাকা দিয়ে আরও ভাল একটা গাড়ি কিনেছিলেন।
অনেক সময় দেখবেন পুরো রাস্তায় আপনি একা। তখন যদি কোনো ট্রাফিক নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছে হয়, অনুরোধ থাকবে ইচ্ছেটা দমন করার। মনে হতে পারে, কেউ তো দেখছে না। ভাঙলে ক্ষতি কী? কিন্তু খেয়াল করুন, আপনার জায়গায় একজন আমেরিকান থাকলে এই নিয়ম ভাঙত না। সে ছোটবেলা থেকে এসব নিয়মকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। আমাদেরও উচিৎ যস্মিন দেশে যদাচার পালন করা। দেশে থাকতে লাল-সবুজ বাতির ফারাক মেনেছেন কি মানেননি, সেটা দেশেই জমা থাকুক। নিয়মের দেশে এসে নিয়ম পালন করতে শেখা খুব জরুরী। প্রথমদিকে আমিও ভাবতাম গভীর রাতে যখন রাস্তায় মাত্র একটা দুটো গাড়ি থাকে, তখন চালকেরা লাল বাতি না মানলেও তো পারে! যখন রাত জাগতাম, রাত দুটো তিনটের দিকে জানালা দিয়ে রাস্তায় দেখতাম কেউ নিয়ম ভাঙছে কিনা। কিন্তু প্রতিবারই আমাকে অবাক করে দিয়ে লাল বাতিতে চালকেরা থামত। পুরো রাস্তায় সে একা হলেও থামত। শুধু সিগন্যালে না, স্টপ সাইনেও থামত। তখন থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে ফেলেছি, আমাকেও এমন হতে হবে।

আনজাম ভাই যখন আমাদের গাড়ি চালানো শিখাচ্ছিলেন, তখন হাইওয়ে ড্রাইভিঙটা সবার শেষে শিখাবেন বলে রেখে দিয়েছিলেন। হাইওয়েতে অনেক গতিতে চালাতে হয় বলে প্রাথমিক ড্রাইভিঙয়ে হাত পাকিয়ে এরপর হাইওয়েতে উঠতে হয়। কিন্তু উনার আর শেখানো হল না। মাস্টার্স পাশ করে চাকরিতে ঢুকে গেলেন, সময় পেলেন না। প্রিন্স লাইসেন্স পাওয়ার পর সাহস করে একদিন হাইওয়েতে উঠে গেল একা একা। ওর মাথা অসম্ভব ঠাণ্ডা বলে উৎরে গেল। আমি হলে দুর্ঘটনা ঘটাতাম। যা হোক, মাত্র দুই তিনদিন বেচারা সময় পেল হাইওয়েতে অনুশীলন করার। এরপরই পেন্সিল্ভেনিয়ায় আমার চাকরি হয়ে গেল, বাসা খোঁজার জন্য যেতে হল সেখানে। এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক অঙ্গরাজ্যে যাওয়ার জন্য হাইওয়েতে উঠতে হবেই। প্রিন্স বড় একটা শ্বাস নিয়ে হাইওয়েতে উঠল। আমি জান হাতে নিয়ে বসে আছি। মাত্র তিনদিনের অনুশীলনে কতটুকুই বা দক্ষতা আসে? কিন্তু এ কী! আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রিন্স তেরো ঘণ্টা ড্রাইভিং করে ফেলল ঝামেলা ছাড়াই। আনজাম ভাইও শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সাথে গর্বিতও। আমরা ছিলাম উনার প্রথম শিক্ষার্থী। খুব যত্ন করে, সময় নিয়ে আমাদের শিখিয়েছিলেন। সে ফল হাতেনাতে পাচ্ছি।
সেবারই প্রথম হাইওয়ের সৌন্দর্য চোখে পড়ল। এর আগে আনজাম ভাই, শাওন চে, বা সেতু’দার গাড়িতে বসে হাইওয়ে পাড়ি দিয়েছি কিন্তু এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে যাইনি। সেবার তিনটা স্টেট পাড়ি দিয়ে চতুর্থ স্টেট পেন্সিল্ভেনিয়ায় প্রবেশ করেছিলাম বলে তিন স্টেটের তিন ধরনের সৌন্দর্য লক্ষ্য করেছি। মানচিত্র দেখে যুক্তরাষ্ট্রের বিশালতা বুঝা গেলেও সেটা উপলব্ধি করার জন্য এদেশে আসা প্রয়োজন। এত বড় একটা দেশ যে, এক একটা অঙ্গরাজ্য এক একটা দেশ হতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র মানে হল পঞ্চাশটা রাষ্ট্র যুক্ত হয়ে গঠিত একটা রাষ্ট্র। এই পঞ্চাশ রাষ্ট্র অবশ্য রাষ্ট্র নয়, অঙ্গরাজ্য বলে পরিচিত। এদের রাজ্য সরকার আলাদা, আইন কানুন আলাদা। ট্রাফিক আইনও কমবেশি হতে পারে। রাজ্যগুলোর ভৌগলিক অবস্থানভেদে সৌন্দর্য আলাদা, খাওয়ার সংস্কৃতি আলাদা, জীবন যাপন আলাদা, মানসিকতা আলাদা। একই রাজ্যের বিভিন্ন শহরে বৈচিত্র পাবেন। গ্রাম আর শহরের সংস্কৃতি আলাদা। গ্রামে বেশিরভাগ রক্ষণশীল মানুষজন, যেখানে শহরে মুক্তমনা। গ্রামে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী বেশি দেখা যায়, যেখানে শহরে থাকে বিভিন্ন দেশের মানুষ। এজন্যেই হাইওয়ে ধরে চললে একেক সময় একেক রকম প্রকৃতি দৃষ্টিগোচর হয়।
হাইওয়ের দুইপাশে বিশাল সব ক্ষেত দেখা যায়। বেশিরভাগই ভুট্টা ক্ষেত। ক্ষেতের একপাশে মাঝে মাঝে কৃষকদের বাড়ি দেখি। কিছু বাড়ি দেখে তাক লেগে যায়। এত জাঁকালো! হুট করে বাংলাদেশের গরীব কৃষকদের কথা মনে পড়ে। এত খারাপ লাগে! আবার কিছু বাড়ি গরিবী চালের। গরিবী হোক আর জাঁকালো, বাড়ির পাশে গোলাঘর থাকবেই। আরেকটা ঘর থাকবে ট্রাক্টর বা এই জাতীয় গাড়ি রাখার। এরা হাতে হাতে বাণিজ্যিক কৃষিকাজ করে না। সবকিছু হয় যন্ত্রে। শুধু বাড়ির উঠোনে কৃষিকাজ করলে সেটা হয় হাতে হাতে। প্রতিটা কৃষকের বাড়িতে পিকআপ ভ্যান দেখবেন। পেন্সিল্ভেনিয়ায় শুধু কৃষক নয়, বেশিরভাগ মানুষেরই পিকআপ গাড়ির প্রতি ভালবাসা আছে। বেশিরভাগ পরিবারে একটা সেডান থাকলে অন্যটা পিকআপ হবেই। এটা শুধু পেন্সিল্ভেনিয়ার ব্যাপার নাকি পুরো যুক্তরাষ্ট্র, বলতে পারি না।
হাইওয়েতে কিছুক্ষণ পরপর খাবার কেনা আর গ্যাস নেওয়ার জন্য এক্সিট (exit) থাকে। গ্যাস স্টেশনগুলোয় বিনামূল্যে বাথরুম সারা যায়। যদি গ্যাস না কেনেন, তবুও বাথরুম করতে পারবেন। তবে খাবারের দোকানে খাবার কেনা ছাড়া শুধু বাথরুম করতে কেউ ঢুকে কিনা, জানি না। এখানকার টয়লেটগুলো খুবই পরিষ্কার। গণ শৌচাগার বলতেই যেমন জঘন্য ছবি ভেসে উঠে, এখানে তা নয়। মুফতে একটা টিপ দিই। যেসব গ্যাস স্টেশন দেখতে আধুনিক, ওগুলোর শৌচাগার বেশি ভাল। ছেলেমেয়ে আলাদা আলাদা। কিছু স্টেশন আছে পুরনো আমলের। সেখানে একটাই টয়লেট। কিংবা আলাদা টয়লেট হলেও পুরনো আমলের বলে চকচকে ভাবটা নেই। কিন্তু হিসু-হাগু চাপলে আধুনিক আর পুরনো আবার কী?
সামনে কোনো এক্সিট থাকলে সেটার বিজ্ঞাপন কমপক্ষে এক মাইল আগে দেওয়া থাকবে। বিজ্ঞাপন দেখে আপনি বুঝতে পারবেন কোন কোন খাবারের দোকান আর কোন কোম্পানির গ্যাস স্টেশন আছে ঐ এক্সিটে। আমরা সাধারণত ম্যাকডোনাল্ডস থাকলে এক্সিটে ঢুকি। ম্যাকডোনাল্ডস এখানে গরীবের বন্ধু। সবচেয়ে সস্তায় বার্গার দেয়। গ্যালন গ্যালন গ্যাস নেওয়ার পর আর পাঁচ ডলারের বেশি বার্গারে খরচ করতে ইচ্ছে করে না। আমরা তক্কে তক্কেও থাকি কোন স্টেশনে গ্যাস কমে দিচ্ছে। যেসব এক্সিটে গ্যাস স্টেশন আছে, সেসব স্টেশনের সামনে বিশাল বড় বড় ইলেক্ট্রনিক বোর্ড দাঁড়িয়ে থাকে। বোর্ডে লেখা থাকে গ্যাসের দাম। অনেক দূর থেকে সেই দাম দেখা যায়। চশমা পরা চোখ পিটপিট করে বুঝার চেষ্টা চালাই কত দাম লেখা। আবার গ্যাস বাডি নামে একটা মোবাইল অ্যাপ আছে। সেখানে পরোপকারী লোকজন গ্যাস কেনার পর বর্তমান দামটা আপডেট করে দেয়। ওখান থেকেও মাঝে মাঝে দেখি কাছের কোনো স্টেশনে সস্তায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে নাকি। পেলে ওখানে ঢুকি।
হাইওয়েতে উঠলে আঠারো চাকার ট্রাকের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের দেশে ট্রাক যেমন এক শহর থেকে আরেক শহরে মালপত্র আনা নেওয়া করে, এগুলোও তাই। তবে ভাব মানে এগুলোর কাছে গিয়ে হাই হ্যালো বলা নয়, ভাব মানে ওগুলো আপনার পাশে পাশে চলবে, আর আপনাকে ওগুলোর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে। বিশাল বিশাল ট্রাকগুলো দেখলে আগে আত্মা শুকিয়ে যেত। এখন অনেকটা সাহস বেড়েছে। কিন্তু তারপরও বুক ধকপক করে। ট্রাকের চাকা অনেক সময় ফেটে যায়। সেসব চাকা দেখবেন হাইওয়ের পাশে পড়ে আছে। প্রথমে বুঝতাম না এত চাকা ‘ফাইট্টা যাইত্তা মইরা’ আছে কেন। Quora-তে খুঁজে দেখি এই প্রশ্ন আরও অনেকেরই। সেখান থেকে জানলাম এগুলো গাড়ির ফেটে যাওয়া চাকা, বেশিরভাগই ট্রাকের।
চাকা ফেটে যাওয়ার পর সাধারণত হাইওয়ে পেট্রোল বা রোডসাইড অ্যাসিস্টেন্স এসে ট্রাকগুলোকে রাস্তার পাশে নিয়ে রাখতে সাহায্য করে, আর ফাটা চাকা রাস্তা থেকে সরিয়ে শোল্ডারের অন্যপাশে রাখে। কিন্তু একবার একটা চাকা রাস্তার উপর পড়ে ছিল। কাছাকাছি আসার আগে বুঝতেই পারিনি। যখন কাছে এসেছি, তখন গতি কমানোর বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মত সুযোগ ছিল না। ফলে আশিতে টানা গাড়ি নিয়ে উঠে পড়লাম চাকার উপর। কখনো দেখেছেন উড়ন্ত বিমানের উপর ছোট্ট একটা পাখি গোঁত্তা খেলে বিমানের ভারসাম্যের কী হয়? আমাদের হল সেই অবস্থা। গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে বাঁকা হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য মনে হল ছিটকে বাইরে চলে যাব। কিন্তু না, সাথে সাথে আবার সোজা হয়ে রাস্তায় পড়ল। এরপরের মুহূর্তগুলোয় প্রিন্সের ঠাণ্ডা মাথার কাজ দেখলাম। একবারের জন্যও ওর মুখের মাংশপেশি নড়েনি। আমি ট্রমাটাইজড অথচ ও ভাবলেশহীন মুখে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল।
এই ফাঁকে বলে রাখি, শোল্ডার জিনিসটাও দারুণ। আপনি লেনের বাইরে চলে যাচ্ছেন কিনা, সেটা বুঝতে সাহায্য করে শোল্ডার। লেনের দাগের ঠিক বাইরে রাস্তার উপর খাঁজ কেটে কেটে এগুলো বানানো হয়। গাড়ি এগুলোর উপর উঠলে কাঁপাকাঁপি লাগিয়ে দেয়। সাথে হয় ভয়ংকর ভোঁ ভোঁ শব্দ। তখন বুঝা যায় আপনি লেনের বাইরে চলে গেছেন। এবার ভালমানুষের মত লেনে চলে আসুন। (আসছে পর্ব দুই)