পর্ব এক
হাইওয়েতে সেডান, পিক-আপ ট্রাক, ইউহল (U-Haul), আঠারো চাকার ট্রাক (18 wheeler) সবই চলে। কিন্তু ছোট গাড়ি যেমন এক্সিট নিয়ে ফুড কোর্টে ঢুকে যেতে পারে, বিশাল বড় লরি তো সেটা পারে না। কিংবা সেডান নিয়ে আপনি রেস্ট এরিয়াতে চলে যেতে পারলেও লরি নিয়ে পারবেন না। কিন্তু লরি চালকদের কি বিশ্রামের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। সেজন্য বড় বড় ট্রাকের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ট্রাকের বিশ্রামস্থান হিসেবে পরিচিত। হঠাৎ হঠাৎ দেখবেন হাইওয়ের একপাশে অনেকগুলো লরি দাঁড়িয়ে আছে। বুঝবেন ওরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থেমেছে। আঠারো চাকার গাড়ির কথা যখন উঠলই, আরেকটা তথ্য দিই। শহরে ঢোকার আগে এদের এবং বড় বড় বাসের ওজন আর আকৃতি মাপতে হয়। নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে ঢুকছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করা হয়। আর উপরে যে রেস্ট এরিয়ার কথা বললাম, এটা মূলত গাড়ি থেকে নেমে হাত-পা ঝাড়াঝাড়ি করার বা টাট্টিখানায় যাওয়ার জায়গা। আপনি চাইলে গ্যাস স্টেশনে পেট খালি করতে যেতে পারেন, চাইলে এখানে। ওরা সব সুবিধা দিয়ে রেখেছে, আপনি গ্রহণ করে কৃতার্থ হোন। এক লেখায় পড়েছিলাম, চাইলে রেস্ট এরিয়াতে রাত্রিযাপনও করা যায়। মানে গাড়ি ওখানে পার্ক করে গাড়ির ভেতর শুয়ে রাত কাটানো যায়। এটা নিরাপদ কিনা, সে কথায় লেখক যাননি। তবে আমার মনে হয়েছে, ঠ্যাকায় পড়লে কাজ চালানোর জন্য ভাল বুদ্ধি। আবার ওয়ালমার্টের পার্কিং লটেও আপনি গাড়ি রেখে নিশিযাপন করতে পারবেন। আমরা যেদিন বাটলারে স্থানান্তরিত হলাম, সারারাত গাড়ি চালিয়েছিলাম বলে ঘুমে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। বাটলারে পৌঁছে সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত ওয়ালমার্টের পার্কিং লটে গাড়ির সিট হেলিয়ে ঘুম দিয়েছি। কেউ ডাকেনি, উঠিয়েও দেয়নি। দেবেও না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারস্টেট হাইওয়ের মধ্যে বেশ কিছু ভাগ আছে। পশ্চিমাঞ্চল আর পূর্বাঞ্চলের হাইওয়েতে ভিন্ন গতিসীমা দেখা যায়। আবার রুরাল হাইওয়ে (গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে গেছে) আর আর্বান হাইওয়ে (শহরের ভিতর দিয়ে গেছে) ভেদে গতিসীমা ভিন্ন হয়। হাইওয়েতে চার থেকে ছয় লেন পর্যন্ত দেখা যেতে পারে। সবার ডানে যে লেন থাকে, সেখানে আপনি সর্বনিম্ন সীমায় (গ্রামাঞ্চলে মূলত ৪০ মাইল/ঘণ্টা, শহরাঞ্চলে ৫৫) গাড়ি চালাতে পারবেন। এরপরের লেনগুলো সর্বোচ্চ গতির গাড়ির জন্য (গ্রামাঞ্চলে মূলত ৭০ মাইল/ঘণ্টা, শহরাঞ্চলে ৬৫)। তবে সর্ব বামে যে লেন থাকে, সেটা অন্য লেনের গাড়িকে ওভারটেক করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ওটায় আপনি একটানা গাড়ি চালাতে পারবেন না। অন্য গাড়িকে ওভারটেক করে ঐ গাড়ির লেনে চলে আসতে হবে। আমাদের সামনে লরি থাকলে আমরা সেটাকে ওভারটেক করে সামনে চলে যাই। লরির পেছন পেছন ছোটাকে অনিরাপদ লাগে। অনেক সময় দেখা যায় কারো খুব তাড়াহুড়ো। সে আমাদের পিছে ৭০ মাইলে চালিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। তখন গতি আরেকটু বাড়িয়ে সে ওভারটেক করে চলে যায়।
অনেক সময় রাস্তার ধারে বা দুইপাশের হাইওয়েকে ভাগ করেছে যে মধ্যবর্তী জায়গা (Median Strip), সেখানে পুলিশের গাড়ি বসে থাকে। এদের একটা গালভরা নাম আছে – স্পিড ট্র্যাপ। গতির ফাঁদ। লাগামহীনভাবে গাড়ি চালালে নির্ঘাত ধরা খাবেন এদের কাছে। তবে জিপিএস আপনাকে আগেই সাবধান করে দেবে ফাঁদের ব্যাপারে। আমরা সুকণ্ঠী আপার মুখে ‘দেয়ার ইজ এ স্পিড ট্র্যাপ অ্যাহেড’ শুনলেই গা ঝাড়া দিয়ে ভালমানুষ হয়ে যাই। সত্তরের উপর গাড়ি টানা কাকে বলে, জানিই না। এটা কি খায়, না মাথায় দেয়? অনেক অভাগাকে দেখেছি হাইওয়ের পাশে নিয়ে গেছে, স্পিড টিকেট দিচ্ছে। এক ভাইয়ের সাথেও এমনটা ঘটেছিল। গভীর রাতে শূন্য হাইওয়ে পেয়ে দিয়েছিলেন টান। একশো মাইল পার করে ফেলেছিলেন। সাথে সাথে প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ করতে করতে আমেরিকান কপ্স এসে হাজির। মনে হতে পারে, গতি বাড়ানোর দরকারটা কী? সত্তর নিজেই তো অনেক গতি। এরপরও কেন একশোতে টানতে হবে? আমার নিজেরও এমন মনে হত। কিন্তু হাইওয়েতে চালালে বুঝবেন সত্তরও কিছু লাগে না। আশেপাশের সবাই যখন সত্তরে ছুটছে, তখন আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে সত্তরকে লাগে স্থির অথবা দশ-বিশ মাইল/ঘণ্টা। তবে হ্যাঁ, Speed thrills but kills।
একটু পরপর রাস্তার ধারে হরিণ, পসাম, বেজি মরে থাকতে দেখবেন। যেসব জায়গায় হরিণের আনাগোনা আছে, সেসব জায়গায় হরিণের ছবি আঁকা সাইন দেওয়া থাকে। তবুও শেষ রক্ষা হয় না। এত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন, হুট করে একটা হরিণ এসে পড়লে কী করার আছে, বলুন? গাড়ির গোঁত্তা খেয়ে ওটার প্রাণনাশ, আর আপনি ট্রমায়। আমার এক সহকর্মীর গাড়ির সামনে হরিণ এসে পড়েছিল। উনি হরিণকে বাঁচানোর সুযোগ পেলেন না। ধড়াম করে ধাক্কা খেলেন হরিণের সাথে। হরিণ তো মরলই, উনার গাড়িও টাল সামলাতে না পেরে ঢুস খেল রাস্তার ধারের রেলিঙয়ে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সামনের কাঁচ, উনিও ট্রমায় ভুগে দুইদিন অফিসে আসলেন না। আমি অন্য এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, যে হরিণটা মরল, ওটা কি ওভাবেই পড়ে থাকবে? কেউ ওটাকে কবর দেবে না? উনি হাসতে লাগলেন। এখানে এত হরিণ মারা যায় যে, সবগুলোকে কবর দিতে গেলে আলাদা দল গঠন করতে হবে। ওগুলোকে মূল রাস্তা থেকে সরিয়ে শোল্ডারের অন্য পাশে ফেলে রাখা হয়। এটাই যথেষ্ট। বাকি কাজ করে পরিবেশ। পচিয়ে গলিয়ে উধাও করে দেয় অস্তিত্ব।
অনেকে বলেন হাইওয়ে ড্রাইভিং কষ্টকর, অনেকে বলেন সোজা। শেষদলের মতে, শহরের ভিতর ড্রাইভিং অনেক ঝামেলার কারণ কোনদিক থেকে কে নিয়ম না মেনে উল্টোপাল্টা ড্রাইভিং করে বসবে, বুঝা দায়। কিন্তু হাইওয়েতে এরকম হওয়ার সুযোগ খুব কম। তাই হাইওয়েতে গাড়ি চালানো বেশি নিরাপদ। আপনার কাছে কোনটা নিরাপদ আর উপভোগ্য, সেটা জানার অপেক্ষায় রইলাম। আমিও ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলে অনুভূতি জানিয়ে যাব। ততদিন পর্যন্ত প্রিন্স চালাক, আমি প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আরাম করি।