Read Time10 Minute, 3 Second
গত পরশু (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১) যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেট (Marquette) বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক বাংলাদেশী পিএইচডি শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর দেখে চমকে উঠি। নিজের গবেষণাগারে উনার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। এটা কি গবেষণার চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা, নাকি সুপারভাইজরের দেওয়া চাপ সামলাতে না পেরে, নাকি পারিবারিক কারণে – এসব নিয়ে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিস্তর আলোচনা চলছে। সঠিক কারণ এখনো কেউ জানে না। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো উপসংহারও টানা উচিৎ হবে না। কিন্তু কেউ কেউ ছেলেটিকে কাপুরুষ, হেরে যাওয়া মানুষ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করে স্ট্যাটাসে লিখছে। বলছে, সে যেরকম সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে এবং এরপরও জীবিত আছে, ঐ শিক্ষার্থী কেন তা পারলেন না? আমার আপত্তি এসব তুলনা করা আর কাপুরুষ বলা নিয়ে।
.
আত্মহত্যা করলে কেউ কাপুরুষ হয় না। আমি খুব কাছ থেকে বিষণ্ণতায় (ডিপ্রেশন) ভোগা একজন মানুষকে দেখেছি। সে টানা কয়েক বছর আত্মহত্যা করার চিন্তাভাবনা করেছে। ভীরুতা বা কাপুরুষতার জন্য তার মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসেনি। বরং অপরাধবোধ আর ব্যর্থতার ভার সহ্য করতে না পেরে তার মাথায় এই চিন্তা এসেছে। শেষ পর্যন্ত সে সুইসাইড করেনি কারণ তার কথা শেয়ার করার জন্য সে একজন মানুষ পেয়েছিল। যেসব কারণে তার আত্মহত্যার চিন্তা এসেছিল, সেখান থেকে ধীরে ধীরে সে বেরিয়ে আসল। এখন দিব্যি জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সমাজে সবাই এই সহমর্মিতা পায় না। অনেকে মন খুলে কষ্টের কথা বলতে পারে না। অনেকে যদিও বা বলে, কিন্তু অন্যের কাছে হাসাহাসির পাত্র হয়। অনেকে সব শুনে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়, ‘তোমার কষ্ট কি আমাত্তে বেশি?’, ‘এগুলো কোনো কষ্ট হল?’, ‘এগুলো কোনো ব্যাপার?’ বলে। আমরা বুঝতে চাই না, একজন মানুষের কষ্ট তার কাছে অন্য সবার কষ্টের চেয়ে বেশি বলে মনে হয়।
হয়ত সে বিদেশে লেখাপড়া করতে চায় কিন্তু অ্যাডমিশন পাচ্ছে না। এজন্য সে যে কষ্টটা অনুভব করছে, সেটার সাথে আপনি যদি রাস্তায় ফুল বিক্রি করা একজন শিশুর কষ্টের তুলনা দিয়ে বলেন, ‘তুমি তো ওর চেয়ে ভাল আছ। ওর কষ্টের তুলনায় তোমার কষ্ট স্রেফ বিলাসিতা’, তাহলে কি ভাবছেন খুব স্মার্ট কিছু বলেছেন? নাহ, তাহলে বুঝা গেল আপনার কোনো ধারণা নেই কষ্টের ধরন সম্পর্কে।
.
আপনি যখন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করবেন, আপনার কষ্ট হবে একরকম। যখন মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করবেন, সে কষ্ট হবে আরেকরকম। যখন উচ্চবিত্ত হবেন, আরেক ধরনের কষ্ট চেপে ধরবে। একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, মধ্যবিত্ত জীবনে থাকা কেউ আপনাকে বলল, ‘আমার বেতন বাড়ছে না তিন বছর ধরে।’ আপনি বললেন, ‘বেতন বাড়ছে না তো কী হয়েছে? বস্তিতে থাকা হাজার হাজার মানুষ এই চাকরি পাওয়ার জন্য হা করে বসে আছে। তাদের প্রমোশন লাগবে না, বেতনও বাড়া লাগবে না। স্রেফ চাকরিটা পেলেই খুশি। সে জায়গায় তোমার দুঃখ বেতন বাড়ে না বলে? অদ্ভুত!’ জবাবটা কি উচিৎ জবাব হল?
.
একটা মানুষ মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করছে। তার চিন্তাভাবনা মধ্যবিত্ত জীবন ঘিরেই আবর্তিত হবে। সে যেহেতু বস্তিতে থাকছে না, তাই বস্তির চেয়ে তার জীবনযাত্রা খরচ বেশি। বেতন না বাড়লে ঐ মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বস্তির সাপেক্ষে এই চাকরির ন্যূনতম বেতনই হয়ত অনেক বেশি। তাই যে মানুষ বস্তিতেই থাকার পরিকল্পনা করছে চাকরি পাওয়ার পর, তার হয়ত বেতন না বাড়লেও চলবে। কারণ তার খরচ সুন্দরমত পুষিয়ে যাবে ন্যূনতম বেতনে। কিন্তু আদৌ কি তাই হয়? বস্তিতে থাকা ব্যক্তিটা চাকরি পাওয়ার পর চেষ্টা করবে ভাল জায়গায় বাসা নেওয়ার, চেষ্টা করবে মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের। তখন তার কষ্টও হবে মধ্যবিত্ত পর্যায়ের। অর্থাৎ কষ্টের ধরন পাল্টায়। এবার দুজন মধ্যবিত্ত মানুষের কষ্ট চিন্তা করে দেখুন। একজনের বেতন বাড়ছে না, অন্যজনের চাকরি জীবন খারাপ boss-এর কারণে বিপর্যস্ত। আপনি কি একজনের সাথে আরেকজনের অবস্থার তুলনা দিয়ে কোনো “সাহায্য” করতে পারবেন? অবশ্যই না। দুজনের কাছেই নিজ নিজ সমস্যা বেশি গুরুতর। উপরন্তু, তুলনা করে কাজের কাজ কিছু হয় না। কম্পেয়ারিং খুবই টক্সিক জিনিস। জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই।
.
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের কষ্টের ধরন বদলায়। কিশোর বয়সে আমি হালকা ধমক খেলেই বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করতাম। মনে হত মা-বাবা আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। তরুণ বয়সে সে কষ্ট এল ব্যর্থ ভালবাসার কারণে। আরও বয়স্ক হওয়ার পর কষ্ট পেতে শুরু করলাম উচ্চশিক্ষায় সুযোগ না পাওয়ার কারণে। এখন কষ্ট পাই অনিশ্চিত চাকরি জীবন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অনিশ্চিত পিএইচডি অ্যাডমিশন ইত্যাদি নিয়ে। দেশে বসে যে শিক্ষার্থী এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সংগ্রাম চালাচ্ছে, সে যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, হয়ত আমি সে কষ্টের ভেতর নেই, কিন্তু যে নতুন ধরনের কষ্ট আমি পাচ্ছি, সেটা কি কষ্ট নয়? আপনি কি এখন আমাকে বিচার করতে বসবেন ঐ শিক্ষার্থীর কষ্টের সাথে? করলে ভুল করবেন। কারণ কী? উপরে ইতোমধ্যে বলে ফেলেছি।
.
আমাদের দেশে ইদানীং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারণা দেখতে পাই। তারপরও অনেক শিক্ষিত মানুষ একে ‘পাগল/ঢং করে/বেশি পাত্তা দিও না’ ধরনের কথা দিয়ে আটকে দেয়। বিদেশে এলে দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগ থাকে। কেন থাকে? কারণ এখানে মানসিক স্বাস্থ্যকে শরীরের মতই গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। শুধু কথা বলেই অনেকটা হালকা হওয়া যায়। দুঃখ ভাগাভাগি করলে মনের চাপ কমার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য আমি প্রিন্সের কাছে চিরঋণী। সে আমার ঘ্যানঘ্যান ধৈর্য ধরে শোনে। ওর সাথে সবকিছু শেয়ার না করলে আমিও হয়ত বিষণ্ণতায় ভুগতে পারতাম।
.
এতকিছু বলার কারণ হল, আত্মহত্যাকে কাপুরুষোচিত কাজ বা হেরে যাওয়া মানুষের কাজ না ভেবে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যাপার হিসেবে ভাবতে শিখুন। যে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে হয়ত অনেকদিন ধরে তার ভেতরে মানসিক চাপ অনুভব করেছে, কাউকে বলতে পারছে না, সমস্যার সমাধানও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত ভেবেছে, বেঁচে থাকলে যে অশান্তির মধ্য দিয়ে যাবে, সেটার চেয়ে মরে যাওয়া শান্তির। চিন্তা করে দেখুন, কারো পিঠ দেওয়ালে কতটা ঠেকে গেলে এভাবে চিন্তা করে!
.
আজকের পোস্ট অনেক বেশি আবেগী। হয়ত আমার যুক্তি ঠিকমত কাজ করেনি, হয়ত বিশেষজ্ঞরা প্রতি লাইনে ভুল ধরবেন। আমি কুযুক্তি এবং ভুল শুধরে নিতে রাজি। কিন্তু কথা একটাই। যারা বিষণ্ণতায় ভুগছে, বা ইতোমধ্যে আত্মহত্যা করে ফেলেছে, তাদেরকে নিজেদের আয়নায় না দেখে ওদের আয়নায় দেখুন। নিজের কষ্টের সাথে অন্যের কষ্টের তুলনা দেওয়া বাদ দিন। যার যার কাছে তার কষ্টই সবচেয়ে বড় কষ্ট। তুলনা দিলে সেটা কোনো সমাধান দিতে পারবে না। সেটা হবে পক্ষপাতদুষ্ট।
.