Read Time15 Minute, 44 Second
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়তে আসার পর প্রাথমিক পর্যায়ে কী কী করতে হবে, সে বিষয়ে একটা লেখা লিখে ফেললাম। যদি কোনো পয়েন্ট মিস করে থাকি, মন্তব্যে উল্লেখ করলে উপকৃত হব। যারা আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য আসবেন, আশা করি তাদের কাজে লাগবে এই পোস্ট। বলে রাখা দরকার, নিচের সব কাজ আপনাকে simultaneously করতে হবে। আজ এটা করি, সাতদিন পর ওটা করব ভাবলে পিছিয়ে পড়বেন এবং অনেক কাজ আটকে যাবে। চেষ্টা করবেন প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজগুলো সেরে ফেলতে। আবার সপ্তাহে দুইদিন থাকবে ছুটি। তাই গোছানো একটা পরিকল্পনা করে, মোবাইলে সেটা নোট করে ঘুরবেন। নোট না করলে একটা না একটা কাজ মাথা থেকে ফস্কে যাবেই। আরেকটা ব্যাপার। ভার্সিটিতে প্রচুর দরকারি সেমিনার, ওয়ার্কশপ হয়। ইমেইলের মাধ্যমে আপনাকে এগুলো সম্পর্কে জানানো হবে। প্রায়োরিটি বেসিসে এগুলোতে যাওয়ার প্ল্যানও আপনাকে স্কেজিউল করে ফেলতে হবে। নতুবা দেখা যাবে, দৈনন্দিন চাপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের কথা ভুলে গেছেন, মিস করে ফেলেছেন।
.
১) বাসা ঠিক করাঃ সবচেয়ে ভাল হয় দেশ থেকে বাসা ঠিক করে আসতে পারলে। সাধ্যের মধ্যে থাকলে ইউনিভার্সিটি হাউজিং ঠিক করে আসতে পারেন। অথবা গ্র্যাজুয়েট কোঅরডিনেটরকে বলতে পারেন আপনি অন্যদের সাথে শেয়ারে থাকতে চান। উনি আপনাকে অন্য গ্র্যাড স্টুডেন্টদের সাথে প্যাচ আপ করিয়ে দিতে পারেন। অথবা আপনার ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাঙালি ভাইবোনদের সাথে যোগাযোগ করলে উনারাও উপায় বাৎলে দিতে পারেন!
.
২) সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার সংগ্রহ করাঃ সকল গ্র্যাড স্টুডেন্ট যারা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট/টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট/গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি নিয়ে আসবেন, তাদের সবাইকে সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার (সংক্ষেপে এসএসএন) সংগ্রহ করতে হবে। আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন ঢুকার জন্য এই নাম্বার দরকার। কাগজে ছাপানো নয় ডিজিটের এই নাম্বার বাসা ভাড়া করা, ইলেকট্রিক বিলের একাউন্ট খোলার জন্যেও প্রয়োজন হবে।
.
৩) ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন করাঃ এখানে আপনি অটোমেটিক ক্লাসে রেজিস্টার্ড হয়ে যাবেন না, আপনাকেই অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। প্রথম সেমিস্টারে কী কী কোর্স আছে, কোন কোন কোর্সে রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে, কয় ক্রেডিটের টিউশন ফি মউকুফ পাবেন (যদি টিউশন ফি ওয়েভার পান আর কি) ইত্যাদি তথ্য ডিপার্টমেন্ট থেকে সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। যা খেয়াল রাখতে হবে তা হল, রেজিস্ট্রেশন করার ডেডলাইন।
.
৪) ইন্টারন্যাশনাল অফিসে দেখা করাঃ বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার পর ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অফিসে আপনার কিছু কাজ থাকবে যেগুলো ত্বরিত গতিতে করে ফেলাই বুদ্ধির পরিচয়। যেমনঃ ইমিগ্রেশন চেকইন, ওরিয়েন্টেশন সংক্রান্ত তথ্য জানা, ক্লাস এবং ডিপার্টমেন্টের তথ্য জানা, সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার সম্পর্কিত তথ্য জানা ইত্যাদি।
.
৫) গ্র্যাজুয়েট কোঅরডিনেটর এবং প্রফেসরের সাথে দেখা করাঃ যত দ্রুত সম্ভব উনাদের ইমেইল দিয়ে জানান যে আপনি এসেছেন। উনাদের সাথে দেখা করার জন্য ইমেইলের মাধ্যমে রিকোয়েস্ট করুন।
.
৬) ওরিয়েন্টেশনে যোগ দেওয়াঃ অনেক সময় ভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল ওরিয়েন্টেশনে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করে দেয়। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা দেশে থাকতেই স্পষ্টভাবে জেনে যাওয়া উচিৎ। এছাড়া ডিপার্টমেন্ট থেকেও আলাদা ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন করা হতে পারে। সেটা সম্পর্কেও জেনে তাতে অংশ নেওয়া উচিৎ। এসব ওরিয়েন্টেশনে ভার্সিটির বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, সংগঠন, ইভেন্ট সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানানো হয়।
.
৭) মোবাইলের সিম কেনাঃ সিম কেনা বেশ জরুরি একটা ব্যাপার। এখানে দুইভাবে সিম কেনা যায়ঃ অনলাইনে এবং সরাসরি দোকানে গিয়ে। Metro PCS -এর সিম আপনি দোকানে গেলে সাথে সাথে কিনতে পারবেন কিন্তু মাসিক খরচ হবে কমপক্ষে চল্লিশ ডলার। আবার Lyca কিংবা Mint সিম সস্তা হলেও এগুলো সাথে সাথে কেনা যায় না, অনলাইনে অর্ডার দিতে হয়। হাতে পৌঁছতে পৌঁছতে সাতদিনও লাগতে পারে। আবার ক্রিকেট নামের সিম কার্ড চারজন মিলে কিনলে বেস্ট প্যাকেজ (মাসিক ১০০ ডলারে চারটা একাউন্টে আনলিমিটেড ডাটা + কথা বলা) পাবেন, আর একজনের জন্য হলে ৫৫ ডলার যাবে। এরকম আরও সিম কোম্পানি আছে। এগুলোর মধ্যে তুলনা করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী কিনে ফেলবেন। আমি এসেই প্রথমে Metro PCS কিনেছিলাম। এক মাস চালিয়ে এরপর মিন্ট সিম কিনে সেটায় Metro PCS-এর নাম্বার সেট করে চালাচ্ছি।
.
৮) হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের সাথে যোগাযোগ করাঃ মাস শেষে ব্যাংক একাউন্টে আপনার স্যালারি জমা হওয়ার জন্য ভার্সিটির এইচআর ডিপার্টমেন্টের সাথে যোগাযোগ করা দরকার হতে পারে। সেখানে গিয়ে বেশ কিছু কাগজপত্র পূরণ করা লাগতে পারে। এ বিষয়ে এইচআর আপনাকে সরাসরি ইমেইল দিতে পারে। যদি ইমেইল না পান, তাহলে গ্র্যাড কোঅরডিনেটরকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন। এইচআর অফিসে গেলে আপনাকে ট্যাক্স ট্রিটির আওতাভুক্ত করা হয়েছে কিনা, সেটা জেনে নিতে পারেন।
.
৯) ল্যাপটপ না নিয়ে আসলে ল্যাপটপ কেনাঃ ল্যাপটপ কেনাটা জরুরি কারণ ভার্সিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে লগইন করার সিস্টেম ল্যাপটপে সেটআপ করে নিতে হবে। তাছাড়া প্রিন্টিং সার্ভিস, ভার্সিটির ইমেল একাউন্ট ইত্যাদিও সেটআপ করা প্রয়োজন।
.
১০) অ্যাসিস্ট্যান্টশিপে হেলথ ইন্সুরেন্স অন্তর্ভুক্ত থাকলে সেটা কীভাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াঃ যদি হেলথ ইন্সুরেন্স পেয়ে থাকেন, তাহলে দেশে থাকতে থাকতে গ্র্যাজুয়েট কোঅরডিনেটরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন যে, সেটা ভ্যাক্সিনেশন কাভার করে কিনা। করলে বাংলাদেশ থেকে ৭০০০/৮০০০ টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন না নিয়ে আসলেও চলে। এখানে এসে ভার্সিটি থেকে ভ্যাক্সিন নেবেন, আর খরচ আপনার হেলথ ইন্সুরেন্স কাভার করবে। হেলথ ইন্সুরেন্স সার্ভিস পাওয়ার জন্য সেটায় দ্রুত এনরোল করে ফেলবেন।
.
১১) এয়ারলাইন্সের মাইলেজ অ্যাড করাঃ যে এয়ারলাইন্সে আসবেন, তারা কীভাবে মাইলেজ অ্যাড করে সেটা জেনে নিন। আমি ইতিহাদে এসেছিলাম। ওদের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রথমে ইতিহাদ গেস্ট হিসেবে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। তারপর মাইলেজ ক্লেইম করতে হয়েছে। আবার টার্কিশ এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের সময় আমি তুরস্ক এয়ারপোর্টে নেমে কাস্টোমার সার্ভিসের কাছ থেকে মাইলেজ কার্ড করে নিয়েছিলাম। তাই আপনি যেটায় আসছেন, দেশে থাকতেই সেটা সম্পর্কে জেনে নিন। মাইলেজ যোগ করার সুবিধা অনেক। ওয়েবসাইট থেকে পড়ে নিতে পারেন। আর আমেরিকায় আসার পথে বিশাল পরিমাণ মাইলেজ পাবেন। সেটা হেলায় হারানো উচিৎ হবে না।
.
১২) ট্যাক্স ট্রিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাঃ আপনি যদি গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে থাকেন, তবে মাস শেষে বেতন পাবেন। প্রতি মাসের বেতন থেকে আমেরিকান সরকার ট্যাক্স কেটে রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ইউএস সরকারের ট্রিটি অনুযায়ী, বাংলাদেশি এফ১ ভিসাধারী চাকুরীজীবীদের প্রথম ৮০০০ ডলার বেতনের উপর ট্যাক্স মউকুফ করা হয়। আপনি এই সুবিধা পেতে যাচ্ছেন কিনা, সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন গ্র্যাড কোঅরডিনেটরের কাছ থেকে।
.
১৩) ব্যাংক একাউন্ট খোলা, চেক বই আর ডেবিট কার্ড, এবং ক্রেডিট কার্ডের মালিক হওয়াঃ যত দ্রুত পারেন, ব্যাংক একাউন্ট খুলে একটা ডেবিট কার্ড আর চেক বই নিয়ে নিন। এখানে বাসা ভাড়ার জন্য চেক বই লাগতে পারে। আবার, এখানে কেউ ক্যাশ নিয়ে চলাফেরা করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনাকে অনলাইনে পেমেন্ট করতে হবে (বাসার এপ্লিকেশন ফি দেওয়া, অনলাইনে জিনিসপত্র কেনাকাটা করা, ইলেকট্রিক বিল দেওয়া ইত্যাদি) যার জন্য কার্ড লাগবে। অথবা শপিংমলে বিল দেওয়ার সময় POS টার্মিনালে কার্ড সোয়াইপ করার জন্য কার্ড লাগবে।
দুই ধরনের কার্ডই আপনার প্রয়োজন। যে ব্যাংকে বেতন ঢুকার জন্য একাউন্ট খুলবেন, সেটা থেকে পাবেন ডেবিট কার্ড। আর সাথে কোনো ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি থেকে একটা ক্রেডিট কার্ডেরও আবেদন করে ফেলতে হবে। প্রথম আসার পর আপনার ক্রেডিট স্কোর যেহেতু একেবারে শূন্য থাকবে, সে অবস্থায় ঝাকানাকা কোনো ক্রেডিট কোম্পানি কার্ড ইস্যু করতে চায় না। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অপশন হল ডিস্কোভার ক্রেডিট কার্ড। ওরা ঝুঁকি নিয়ে হলেও শূন্য ক্রেডিটের লোকজনকে কার্ড দেয়। সমস্যা হল ওদের কাছ থেকে সুবিধা (যেমন, কিছু কিনলে সেটার বিপরীতে ক্যাশ ব্যাক) বেশি একটা পাবেন না। তবে প্রথমদিকের জন্য এটা তেমন গায়ে লাগে না। বছর খানেক পর মোটামুটি ক্রেডিট স্কোর দাঁড় করিয়ে মনের মত আরেকটা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নিতে পারেন।
.
১৪) খুচরো পয়সা এবং টাকা হাতে রাখাঃ যতদিন না আপনি দ্বিচক্রযান বা গাড়ি কিনছেন অথবা কেউ আপনাকে ভার্সিটি পর্যন্ত লিফট দিচ্ছে, ততদিন পাব্লিক বাসই ভরসা। ভার্সিটি যদি বাসা থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে হয়, তবে সোনায় সোহাগা। কিন্তু তা না হলে বাসে বা ট্রেনে চলাচল আবশ্যক। যদি আপনার শহরে বাইক বা স্কুটার ‘পে পার ইউজ’ করার অপশন থাকে, তাহলে প্লে স্টোর থেকে অ্যাপ নামিয়ে সেগুলোতে রেজিস্টার করে ফেলতে পারেন। এজন্যে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড লাগবে। যা হোক, কথা বলছিলাম বাস/ট্রেন নিয়ে। এগুলোর ভাড়া দেওয়ার জন্য এক ডলার, কোয়ার্টার ডলার হাতে রাখা উচিৎ। আমি বাস ভাড়া হিসেবে সত্তরটা এক ডলারের নোট নিয়ে রেখেছিলাম ব্যাংক থেকে, খুব কাজে দিয়েছে। এখানে দেশের মত জায়গায় জায়গায় দোকান পাবেন না যে ভাংতি করে ফেলবেন। তাই সাবধান থাকা ভাল। কোয়ার্টার ডলার এদেশে অনেক মূল্যবান। আমি যেখানে থাকি, সেখানে বেশিরভাগ ওয়াশিং মেশিন কোয়ার্টার ডলার ছাড়া নেয় না।
.
১৫) স্টেট আইডি নেওয়াঃ এসএসএন পাওয়ার পর আপনি এটার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এখানে সবসময় একটা ছবিসহ পরিচয়পত্র (পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি) নিয়ে ঘুরা নিরাপদ। বিভিন্ন সময় এটা লাগে। যেমন, ফেডেক্স অফিস থেকে ডেলিভারি ছুটাতে, ব্যাংক থেকে চেকের মাধ্যমে টাকা উঠাতে, দোকান থেকে এলকোহল কিনতে। যেহেতু প্রথমে এসেই আপনি ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করতে পারছেন না, তাই পাসপোর্টই আপনার ভরসা। কিন্তু এটাও এক পিস, হারালে পুরো ধরা! তাই নিরাপদ থাকার জন্য একটা স্টেট আইডি ইস্যু করে ফেলা ভাল। যেকোনো DMV (Department of Motor Vehicle) অফিসে গিয়ে আপনি এটা ইস্যু করতে পারবেন। তবে তার জন্য ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অফিস থেকে কোনো লেটার সংগ্রহ করতে হবে কিনা জেনে নেওয়া ভাল।
.
সবাইকে ধন্যবাদ!