প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব
পুষ্টিবিজ্ঞানের ফিল্ড ধীরে ধীরে ইন্টারডিপার্টমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্ট একা নয়, আরও কয়েকটা ডিপার্টমেন্ট মিলে নিউট্রিশন প্রোগ্রামে অংশ নেয়। যেমনঃ Purdue University পুষ্টির জগতে খুবই বিখ্যাত একটা প্রতিষ্ঠান। এখানকার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পাবলিক হেলথ, সামাজিক বিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট মিলেমিশে কাজ করে। আবার University of Nebraska-Lincoln-এর গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পাবলিক হেলথ আর পুষ্টিবিজ্ঞান অংশ নিচ্ছে। North Carolina State University-এর গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পুষ্টিবিজ্ঞানের পাশাপাশি পোল্ট্রি সায়েন্স, হর্টিকালচার, অ্যানিম্যাল সায়েন্স, বায়োকেমিস্ট্রি ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট অংশ নেয়। Iowa State University-তেও ইন্টারডিপার্টমেন্টাল নিউট্রিশন প্রোগ্রাম চালু আছে। এ তো গেল হাতেগোনা কিছু উদাহরণ। এরকম প্রচুর প্রোগ্রাম পাবেন পুষ্টিবিজ্ঞানে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে প্রতিটা ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু কোর্স নিতে হয়। বুঝতেই পারছেন, এসব প্রোগ্রাম শুধু পুষ্টিবিজ্ঞান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে না। আকর্ষণ করে চিকিৎসক, প্রাণরসায়নবিদ, গণস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ), ফার্মেসি ইত্যাদি বিষয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদেরও।
কিছু ভার্সিটি আবার দ্বৈত প্রোগ্রাম অফার করে। যেমন, Michigan State University-তে Ph.D Dual Major Program (Food Science and Human Nutrition/Environmental Toxicology) আছে। এক্ষেত্রে আপনি একই সাথে দুটো বিষয়ের উপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করবেন। আবার Saint Louis University-তে আছে Master of Public Health and Master of Science in Nutrition and Dietetics নামের Dual Degree Program। একই সাথে M.P.H./M.S. শেষ করতে পারবেন। এসব কারণে পুষ্টিবিজ্ঞান এখন পুষ্টি থেকে মেজর করে আসা শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় হিসেবেই শুধু আটকে নেই। এতে পড়তে আসছে অন্যান্য মেজর থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরাও। তাই আপনার প্রতিযোগিতা হবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীর সাথে।
এবার জেনে নিন অন্যরকম এক প্রতিযোগিতার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শিক্ষার্থী ব্যাচেলরে পুষ্টিবিজ্ঞানকে মেজর হিসেবে নেয়, তাদের অধিকাংশই ব্যাচেলর পাশের সাথে সাথে রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান (RD) হওয়ার কোর্সও শেষ করে। এরপর সরকারী নিবন্ধ পরীক্ষা দিয়ে RD হয়ে যায়। RD হওয়ার জন্য ওদের যে ইন্টার্নশিপ করতে হয়, তার মাধ্যমে ওরা ক্লিনিকেল আর কমিউনিটি নিউট্রিশন – এই দুটো ফিল্ডে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে যায়। এবার ধরুন, আপনি বাংলাদেশের কোনো পুষ্টিবিজ্ঞান প্রোগ্রাম থেকে পাশ করেছেন। পাশ করার জন্য আপনাকেও ইন্টার্নশিপ করতে হয়েছে। এরপর আপনি যুক্তরাষ্ট্রের এক ভার্সিটির মাস্টার্স/ পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করেছেন। আপনার সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাশ করা একজন RD-ও আবেদন করল। এক্ষেত্রে কে প্রাধান্য পাবে? যে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টার্নশিপ করেছে, সে; নাকি যে বাংলাদেশে ইন্টার্নশিপ করেছে, সে? এজন্যেই RD-রা একটু হলেও হিউম্যান এন্ড ক্লিনিকেল নিউট্রিশন বা কমিউনিটি নিউট্রিশন-ভিত্তিক প্রোগ্রামগুলোর প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে। আবার এসব প্রোগ্রামে যদি বাংলাদেশ থেকে কোনো চিকিৎসক আবেদন করেন, তাহলে পুষ্টিবিজ্ঞান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীর তুলনায় ঐ চিকিৎসক প্রাধান্য পাবেন কারণ তার ক্লিনিকেল এক্সপোজার বেশি। আপনার বদলে তাকে নিলে প্রোগ্রামের লাভ বেশি। কিন্তু তাই বলে কি পুষ্টিবিজ্ঞানের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সুযোগই নেই? অবশ্যই আছে! আমি নিজেই গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহাবিদ্যালয় থেকে পাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ফল ২০২১-এ পিএইচডিও শুরু করব টেক্সাস এঅ্যান্ডএমে। তাই হতাশ হবেন না। সঠিক পথে চেষ্টা চালিয়ে যান, সাফল্য পাবেন।
আজকের পোস্টের উদ্দেশ্য আপনাদের ভয় দেখানো নয়। পোস্টের উদ্দেশ্য হল আপনাদের সামনে বাস্তবতা তুলে ধরা। আপনারা যেন নিজেদের সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারেন। যখনই সিদ্ধান্ত নিবেন উচ্চশিক্ষার, তখনই নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন – কেন অন্য কাউকে বাদ দিয়ে ভার্সিটি আপনাকে বেছে নেবে? কী আছে আপনার ঝুলিতে? আপনাকে নিলে প্রোগ্রামের লাভ কী? একটা প্রোগ্রামে সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজেকে ইউনিক বা অনন্য হিসেবে প্রদর্শন করতে হয়। আপনার মধ্যে ইউনিক ব্যাপারগুলো কী কী?
নিজের জীবন থেকে কিছু উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ থেকে করে আসা নাম-কা-ওয়াস্তে একখানা ইন্টার্নশিপ ছাড়া আমার কোনো ক্লিনিকেল অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু তারপরও সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়াটেটিক্স প্রোগ্রামে মাস্টার্সের সুযোগ পেয়েছিলাম। কীভাবে? হয়ত আমার স্টেটমেন্ট ভাল লেগেছিল অ্যাডমিশন কমিটির। হয়ত আমার রিসার্চ অভিজ্ঞতাকে (কোনো পেপার ছিল না) তারা গোনায় ধরেছিল। হয়ত আমার রেজাল্ট খারাপ হওয়া, আবার সেটা থেকে ফিরে আসার সংগ্রামকে তারা পছন্দ করেছিল। এসব বলছি কারণ আমার ব্যাচে যারা অ্যাডমিশন পেয়েছিল, বেশীরভাগই ছিল RD। এমনকি সৌদি আরব-ব্রাজিল-চীন থেকে যারা এসেছিল, তারাও নিজ দেশে RD পাশ করেই এসেছিল। যাদের ঐ মুহূর্তে RD সার্টিফিকেট ছিল না, তারা RD হওয়ার জন্য ইন্টার্নশিপ করছিল। আর আমি ছিলাম একজন Non-RD শিক্ষার্থী। তাই বলে কি আমার অ্যাপ্লিকেশন বাতিল হয়ে গিয়েছিল? অবশ্যই না। এজন্যেই বলছি, নিজের প্রোফাইলকে শক্তিশালী করুন। আপনি নিশ্চয় কোনো না কোনোদিক দিয়ে অনন্য গুণের অধিকারী। সেটা খুঁজে বের করুন, ঝালাই করুন। প্রতিযোগিতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।
শেষ করি আরেকটা অভিজ্ঞতা দিয়ে। ফল ২০২১-এর জন্য সাহস নিয়ে আমি কর্নেলের পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করেছিলাম। ভেবেছিলাম একখানা ইউএস মাস্টার্স ডিগ্রি আর কিছু গবেষণা অভিজ্ঞতা আছে, আবেদন করাই যায়। এরপর কিছু প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করলাম। বেশীরভাগই নেতিবাচক উত্তর দিলেন। একজন শুধু স্কাইপ ইন্টার্ভিউ নিতে চাইলেন। কমসে কম এক ঘণ্টা কথা বললাম উনার সাথে। প্রশ্ন বেশিরভাগ আমিই করলাম উনার গবেষণা নিয়ে। উনার ল্যাবে গেলে আমি কী কী সুযোগ পাব, সেসব নিয়ে। মনে হল খুবই ভাল ইন্টার্ভিউ হয়েছে। কর্নেল আমাকে না নিয়ে পারেই না! কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, এক্সেপ্টেন্স লেটার আর আসে না। শেষে চার মাস পর ইমেইল এল, আমি সুযোগ পাইনি। মনটা বেশ খারাপ হল। কিন্তু একই সাথে আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটল। আমার এক ছোট বোন UIUC থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে। তার ব্যাচমেট ছিল রুয়ু নামের একটা মেয়ে। ছোট বোন জানাল, রুয়ু ফল ২০২১-এ কর্নেলে সুযোগ পেয়েছে। তারপর রুয়ুর লিংকডইন পোস্টটা আমাকে দেখাল। সেটাতে রুয়ুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ঐ প্রফেসর, যিনি আমার ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, “আমাদের ল্যাবে তোমাকে পেয়ে আমরা আনন্দিত!” অর্থাৎ আমার সাথে রুয়ুও ঐ প্রফেসরের ল্যাবে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু রুয়ুকে নেওয়া হল, আমাকে নয় কেন? আমার প্রোফাইল কোনদিক দিয়ে রুয়ুর চেয়ে কম? এখানেই আসল মজা। রুয়ু UIUC থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স করেছে। করার সময় নিজের রিসার্চের জন্য নিজেই ফান্ড (১০,০০০ ডলার) যোগাড় করেছে । তিনটা রিসার্চ প্রজেক্টের সাথে সে জড়িত ছিল। কাজ করেছে পার্ট টাইম টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। কর্নেলে আবেদন করার সময় সে নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করছিল। ওর প্রোফাইল দেখার পর আমি বুঝলাম কেন আমি সুযোগ পাইনি। মনে আর কোনো দুঃখও রইল না।
আগামী পর্বে আসবে কিছু টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স, যেগুলো অনুসরণ করলে একাডেমিক প্রোফাইল কিছুটা হলেও উন্নত হবে।