বাংলাদেশে থাকতে আমি রাঁধতে একদমই পছন্দ করতাম না। যে বাসায় সংসার পেতেছিলাম, সেটা চমৎকার ছিল। অনেক খোলামেলা দুটো বেডরুম, দুটো বাথরুম, আর একটা কমন স্পেস ছিল। কিন্তু রান্নাঘরটা ছিল একদম ছোট্ট। টাইলস দিয়ে বাঁধানো স্মার্ট রান্নাঘর, কিন্তু ছোট্ট। একজন রান্না করতে দাঁড়ালে আর কারো ঢুকার জো নেই। তাই আমি কমন স্পেসে বসে কাটাকুটি করে দিতাম, প্রিন্স রান্না করত। কালেভদ্রে আমি রান্না করতাম। রান্নাঘরের দেওয়ালে কোনো মিটসেফ ছিল না। মালিকের কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম মশলাপাতি রাখার জন্য মিটসেফ লাগানোর, পাইনি। বেসিনের পাশে অল্প যেটুকু জায়গা ছিল, সেটায় হলুদ, মরিচ, লবণ, তেল ইত্যাদি রাখতাম আর বাকি মশলা রাখতাম আরেক ঘরে। রান্না শুরুর আগে ঐ রুম থেকে সেগুলো আনতাম, রান্না শেষে রেখে আসতাম। ঝামেলার ব্যাপার। আবার টাকা বাঁচানোর জন্য রেফ্রিজারেটর কিনিনি বলে পচনশীল কোনো খাবার বাসায় থাকত না। মাছ, মাংস, শাকসবজি খেতে চাইলে টাটকা বাজার করে আনতে হত। সবকিছু মিলিয়ে রান্না করতে বড্ড আলসেমি লাগত আমার। রান্নার ক্যাঁড়া যদি উঠতও, বাজার করতে করতে সেটা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আমেরিকায় এত সুন্দর সুন্দর রান্নাঘর পেয়েছি যে, পুরোদস্তুর রাঁধুনি হয়ে উঠেছি। রান্নার ব্যাপারটা আগে ভয়াবহ লাগত। কতখানি মশলা দেয়, কত সময় ধরে জ্বাল দেয়, এসব নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামাতাম। এখন এমন আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেও রান্না মজা হয়।
এখানকার রান্নাঘরগুলো বসার ঘর বা শোবার ঘর থেকে ছোট হয়, কিন্তু তারপরও যথেষ্ট জায়গা থাকে। দেওয়াল জুড়ে মিটসেফ লাগানো থাকে অপচনশীল জিনিসপত্র রাখার জন্য। আমরা মশলাপাতির পাশাপাশি চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, বিস্কিট, চানাচুর, টিনজাত খাদ্য সবই মিটসেফে রাখি। মানে এক রান্নাঘরেই সমস্ত রান্নার জিনিস আঁটানো যায়। এত সুন্দর ব্যবস্থা থাকলে রাঁধার ব্যাপারটা সহজ না হয়ে যাবে কোথায়? এজন্য আমারও রাঁধতে খুব ভাল লাগে এখন। ক্যাঁড়া উঠলে গভীর রাতেও রাঁধতে বসে যাই। এখানকার এপার্টমেন্টগুলো শব্দ নিরোধক বলে রান্নার শব্দ আরেক এপার্টমেন্টে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার এক্সহস্ট ফ্যানের কল্যাণে রান্নার গন্ধ ছড়ানোরও ভয় থাকে না। এজন্য আপনি গভীর রাতে রাঁধলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে এশীয় মশলাগুলো পশ্চিমা মশলার তুলনায় তীব্র গন্ধযুক্ত। তাছাড়া আমাদের রান্নায় ফোঁড়ন, কষানো ইত্যাদি ধাপ আছে। এসব ধাপে রন্ধনকারীরই দফারফা হয়ে যায় মশলার গন্ধে। যদি কোনোক্রমে সেই গন্ধ আমেরিকানদের নাকে ঢুকে, নিশ্চিত নালিশ খাবেন।
এখানকার রান্নাঘরে রেফ্রিজারেটরও থাকে। বাই ডিফল্ট। তাই অনেক ধরনের পচনশীল খাবার এনে রাখতে পারি। শাকসবজি, মাছ, মাংস তো বটেই, টক দই-হুইপিং ক্রিম-ইওগার্ট-চিজ ইত্যাদিরও বড় বড় প্যাকেট কিনে আনি যেন যখন খুশি ব্যবহার করতে পারি। ফলে বারবার দৌড়ানো লাগে না মুদি দোকানে। এত এত সুবিধা যেখানে পাচ্ছি, সেখানে রান্না করতে ভাল না লেগে উপায় আছে? যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরই আমার মধ্যে দুনিয়ার কাপজাব রান্না করার খায়েশ জেগেছে। প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন দেশের রেসিপি অনুসরণ করে কিছু না কিছু রান্না করি। গিনিপিগ হয় প্রিন্স। অবশ্য বেশিরভাগ পদই খেতে মজা হয়। হবে নাই বা কেন? যা যা দিতে বলে, সবই এখানে পাওয়া যায়। দেশের মত কয়েকটা উপকরণ বাদ দিয়ে রাঁধা লাগে না। তাই অথেন্টিক স্বাদটাই উপভোগ করতে পারি।
ওহ আচ্ছা! এখানকার রান্নাঘরে বাই ডিফল্ট একখানা ওভেনও পাবেন। চুলার নিচে লাগানো থাকে সেই ওভেন। পুরো যন্ত্রটাকে একসাথে বলে রেঞ্জ (range)। শুধু চুলাকে ওরা বলে স্টোভ। যদিও আমাদের দেশে স্টোভ বলতে অন্য কিছু বুঝি, কিন্তু এখানে স্টোভ মানে চুলা। সে চুলা গ্যাস বা ইলেকট্রিক, যেকোনোটা দিয়ে চলতে পারে। অনেক চুলায় কয়েল থাকে, অনেক চুলা কয়েলবিহীন। তো, যেখানে আপনি ওভেনও পাচ্ছেন, সেখানে বেক-ব্রয়েলে দক্ষতা না এসে উপায় আছে?
সবাই একেকজন গর্ডন র্যামসে বা সিদ্দিকা কবির হয়ে উঠুন, এই কামনা।
