ইয়েই!!! নায়াগ্রা ফলস যাচ্ছি এক সপ্তাহ পর।
সেই ছোটবেলা থেকে নায়াগ্রা ফলস শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে গেছে। এবার আর শোনা নয়, দর্শনও হবে। যাব নায়াগ্রা জলপ্রপাতে। কলকল ধ্বনির সাথে দেখব কুয়াশাচ্ছন্ন পানির স্রোত। ভিজব দশ হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক বিস্ময়ে। খুশিতে মরে যাচ্ছি। সুদূর ফ্লোরিডা থেকে আসবে ছোট বোন মিষ্টি। ওর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘুরে বেড়ানোর অনেক শখ ছিল। আমাদের দুজনেরই লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসার। সে লক্ষ্যে ২০১৫ সালে একসাথে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ব্যাটে বলে মিলেনি বলে মিষ্টি মাস্টার্স করতে যায় কানাডায়, আমি চলে আসি যুক্তরাষ্ট্রে। একদিন দেখি কানাডার ডিগ্রি শেষ করে মিষ্টি যুক্তরাষ্ট্রেও চলে এসেছে দ্বিতীয় মাস্টার্সের জন্য। অবশেষে দুই আত্মা এক হতে পারলাম। পূরণ হল আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে পা দেওয়ার স্বপ্ন। ২০১৫ সাল থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি রোড ট্রিপের, সেটা এবার বাস্তবায়ন করতে পারব। ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। তাই স্বপ্ন দেখনেওয়ালাদের বলি, হাল ছাড়বেন না। স্বপ্ন দেখলে সেটা পূরণ করার রাস্তাও বের করতে হবে আপনাকে।
বলছিলাম নায়াগ্রা ফলসের কথা। পরিকল্পনা করেছিলাম জুনের মাঝামাঝিতে চাকরিটা ছেড়ে দেব। পিএইচডি যেহেতু আগস্ট থেকে শুরু, জুনের মাঝ থেকে জুলাই পর্যন্ত দেড় মাস শুধু ঘোরাঘুরি করব। কিন্তু বিধিবাম! প্রফেসর এখনই আমাকে দুটো প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে ফেলেছেন। চাকরি ছাড়ার পরও তাই সকাল সন্ধ্যে ব্যস্ত থাকি। কাজগুলো পছন্দের বলে করতে খারাপ লাগে না। কিন্তু ভ্রমণ করতে না পারার আফসোসটা সবসময় অনুভব করি। আমার অবস্থা দেখে প্রিন্সের মায়া হয়। ও জানে কত আগ্রহ নিয়ে আমি চাকরি ছাড়ার জন্য বসে ছিলাম। তাই প্রস্তাব দিল, ‘চল, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে নায়াগ্রা থেকে ঘুরে আসি। তিনদিনের জন্য ছুটি নাও প্রফেসরকে বলে।’ কথাটা মনে ধরল। আমি ছুটি না চাইলে তো আর প্রফেসর বুঝবেন না যে, আমার ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা আছে। তাই প্রজেক্টের অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলে প্রথমে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম, এরপর প্রফেসরকে বললাম। উনার কোনো আপত্তি নেই। তাই ধুমধাম লেগে গেলাম নায়াগ্রা ভ্রমণের পরিকল্পনায়।
প্রথমেই কল করলাম মিষ্টিকে। ও চাকরি করে ফ্লোরিডার ট্যাম্পায়। জিজ্ঞেস করলাম, আগামী সপ্তাহান্তে নায়াগ্রা দেখতে যাবে কিনা। শুনে সে এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল। ঠিক হল, ট্যাম্পা থেকে বিমান ধরে মিষ্টি পিটসবার্গ আসবে। ওখান থেকে ওকে নিয়ে আসব বাটলারে আমাদের বাসায়। এখানে একরাত কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা দেব নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে। মিষ্টি চাইলে সরাসরি নিউইয়র্কের বাফেলো শহরেও ফ্লাই করতে পারত। ওখান থেকে ওকে নিয়ে আমরা নায়াগ্রা যেতে পারতাম। কিন্তু তাতে তো আমার সাথে ওর রোড ট্রিপ হত না! আমাদের স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় রোড ট্রিপ দেওয়ার। সেটা পূরণ করতে হবে না? ব্যস, কাটা হয়ে গেল মিষ্টির টিকেট। এদিকে আমি এয়ার বিএনবি খুঁজে খুঁজে হয়রান। নায়াগ্রার যুক্তরাষ্ট্র অংশে ভাল কোনো বাসা পাচ্ছি না। কোভিড-১৯ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর মানুষ পাগলের মত দর্শনীয় স্থানগুলোতে দৌড়াচ্ছে। কয়দিন আগে খবরে দেখলাম, ন্যাশনাল পার্কগুলো নাকি মানুষে মানুষে ছয়লাব হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ নোংরা হচ্ছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। নায়াগ্রারও বোধহয় একই অবস্থা। গ্রীষ্মকাল বলে মানুষ ছুটছে ওখানে। ভাল রেটিংওয়ালা এয়ার বিএনবিগুলো বুকড হয়ে গেছে। বাকি আছে এক রেটিং পাওয়াগুলো বা যেগুলোর কোনো রেটিংই নেই। ভাল বাসা যেগুলো পাচ্ছি, সবই কানাডার অন্টারিও শহরে। মেজাজ গরম হয়ে গেল। শেষে মিষ্টি বুদ্ধি দিল হোটেল দেখার। হোটেল যদি এয়ার বিএনবির দামেই পাই, সমস্যা কী? তাই রেড রুফ ইন বাফেলো নামের একটা দুই তারকা হোটেলে তিনজন থাকার মত একটা রুম বুক করলাম। আলাদা দুই রুম নিলে ভাড়া অনেক বেশি আসে। এক রুমের ভাড়া ভাগাভাগি করলে মাথা পিছু পড়বে ৫৫ ডলার।
এরপরের কাজ নায়াগ্রা গিয়ে কী কী দেখব সেটার তালিকা তৈরি করা। কানাডায় থাকার সময় মিষ্টি একবার নায়াগ্রা দেখতে এসেছিল। সেবার দেখেছিল জলপ্রপাতের কানাডা অংশ। এবার দেখবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ। পুরো পরিকল্পনা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে ও বলল, ‘তোমার ইচ্ছেমত তালিকা বানাও। আমার কোনোকিছুতে না নেই।’ প্রিন্সেরও একই কথা। দুজনের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম অন্তর্জালে। যত কিছু আছে দেখার, সবগুলো খুঁজে বের করলাম। এরপর একদিনে যা যা দেখা সম্ভব, সেগুলো আলাদা করলাম। আমাদের ভ্রমণ মাত্র দেড় দিনের। যেদিন যাব, সেদিনই মূল ঘোরাঘুরি। পরদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টা হাতে থাকবে। তাই পরদিনের জন্য হালকা কিছু জমিয়ে রেখে আগেরদিনই মূল পরিকল্পনা করলাম। করতে গিয়ে দেখি নায়াগ্রা জলপ্রপাত আসলে তিনটা জলপ্রপাতের সমষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়েছে ফলসের দুটো অংশ – ব্রাইডাল ভেইল ফলস আর আমেরিকান ফলস; কানাডায় পড়েছে একটা অংশ – হর্সশু ফলস। এজন্য হর্সশু ফলসকে কানাডিয়ান ফলসও বলে। নতুন তথ্য জেনে আমোদিত হলাম। আগে ভাবতাম এটা মাত্র একটা জলপ্রপাত। আরও মজা হল, তিনটার মধ্যে হর্সশু ফলসটাই সবচেয়ে বড় আর তীব্র জলস্রোতবিশিষ্ট। নায়াগ্রা নামের যে নদী থেকে এই সামষ্টিক জলপ্রপাতের উৎপত্তি, সে নদীর ৯০ শতাংশ প্রবাহিত হচ্ছে হর্সশু ফলস দিয়ে। বাকি ১০ শতাংশ প্রবাহিত হয় বাকি দুটো দিয়ে।
ঠিক করলাম হোটেল থেকে সরাসরি প্রস্পেক্ট স্ট্রিটে চলে আসব। এখানকার পার্কিং লটে গাড়ি রেখে প্রস্পেক্ট পয়েন্টে যাব। ওখান থেকে আমেরিকান ফলসটা দেখা যায়। প্রস্পেক্ট পয়েন্ট থেকে যাব মেইড অফ দা মিস্ট বোট ট্যুরে। এই নৌকা আপনাকে নিয়ে যাবে জলপ্রপাতের সামনে। আমেরিকান আর কানাডিয়ান, দুটো ফলসের সামনেই নিয়ে যাবে। কিছু ভিডিও দেখে বুঝলাম, এই নৌকাভ্রমণ না হলে নায়াগ্রা দেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। বিশেষ করে হর্সশু ফলসের সামনে যাওয়ার পর জলপ্রপাত থেকে নেমে আসা তীব্র পানির স্রোত যে কুয়াশা তৈরি করে, সেখানে গা না ভেজালে নায়াগ্রার বিশালত্ব অনুভব করা যাবে না। এরপর যাব কাকের বাসায়। ক্রোও’স নেস্ট নামের একটা পয়েন্ট আছে ফলসের খুব কাছাকাছি। সেখানে গেলে পানির ছটায় কাকভেজা হতে হয়। এরপরের গন্তব্য হবে গোট আইল্যান্ড বা ছাগল দ্বীপ। এই দ্বীপ হর্সশু ফলসকে ব্রাইডাল ভেইল ফলস থেকে আলাদা করেছে। অদ্ভূতুড়ে নামগুলোর কাহিনী জানাব আগামী পর্বগুলোয়। ওখানে যাব গাড়ি চালিয়ে। ছাগল দ্বীপের পার্কিং লটে গাড়ি রেখে যাব টপ অফ দা ফলস রেস্তোরাঁয়। এখন পর্যন্ত ইচ্ছে আছে এই রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারার। তবে টাকাপয়সা নিয়ে টানাটানি হলে বার্গার কিংই ভরসা।

খাওয়া দাওয়া সেরে যাব মহান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার ভাস্কর্য দেখতে। গোট আইল্যান্ডের এক কোণায় স্থাপিত আছে এই ভাস্কর্য। নায়াগ্রায় টেসলা কী করেন, ভেবে পাইনি। আরেকটু ঘাঁটতে হবে ইতিহাস। এরপর যাব কেইভ অফ দা উইন্ডস বা বাতাসের গুহায়। এটা গুহার মত দেখতে ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। গুহার মত অংশটা ভেঙে গেছে। তবে নামটা রয়ে গেছে। এখানে গেলে জলপ্রপাতের ব্রাইডাল ভেইল অংশের একদম কাছাকাছি যাওয়া যায়। ব্রাইডাল ভেইল মানে বউয়ের মাথার ঘোমটা। খ্রিস্টান বধূরা বিয়ের সময় যে সাদা ঘোমটা মাথায় দেয়, সেটার মত দেখতে বলে এই অংশের নাম হয়েছে ব্রাইডাল ভেইল। বাতাসের গুহা নাম শুনেই বুঝা যায় প্রচণ্ড বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইবে আপনাকে। সাথে থাকবে পানির ছিটা। চরম একটা অনুভূতি! মনে পড়ে, বালি দ্বীপে এরকম একটা জায়গা ছিল। নুসা দুয়ায় অবস্থিত Waterblow। একটা খাঁড়িতে সাগরের পানি এসে ধাক্কা মারে। ধাক্কার চোটে সে পানি সাঁই সাঁই করে উঠে আসে অনেক উপরে। তারপর ছিটিয়ে পড়ে চারপাশে। সে ছিটা খাওয়ার জন্য মানুষ জড়ো হয় ডেকে। আমাদের বেলায় পানির স্রোত এত কম ছিল যে, আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেও পানির ছিটা খেতে পারিনি। অনেক দুঃখ ছিল সেটা নিয়ে। এবার হয়ত নায়াগ্রাতে গিয়ে সে দুঃখ ঘুচবে। এরপর যাব লুনা দ্বীপে। ছোট্ট এই দ্বীপ ব্রাইডাল ভেইল ফলস আর আমেরিকান ফলসকে ভাগ করেছে। এর বাম দিকে ব্রাইডাল ভেইল ফলস আর ডানদিকে আমেরিকান ফলস। এরপর হাঁটা ধরব টেরাপিন পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। কানাডিয়ান ফলস তথা হর্সশু জলপ্রপাত খুব কাছ থেকে দেখার জন্য মোক্ষম জায়গা। এরপর বাকি থাকবে রাতের জলপ্রপাত দর্শন। রাতের বেলা যে আলোকসজ্জা প্রদর্শিত হয়, সেটা দেখার জন্য বারবার করে বলেছে প্রাক্তন সহকর্মীরা। আমিও অধীর আগ্রহে বসে আছি।
পুরো ভ্রমণ হবে এগারো নাম্বার বাসে করে অর্থাৎ পায়ে হেঁটে। শরীর হয়ত ক্লান্ত হবে না, কিন্তু সময়ে কুলাতে পারব তো? না পারলে পরদিন খুব দ্রুত কিছু দেখার চেষ্টা নেওয়া যায়। কতটুকু সফল হব, কে জানে। একটাই সান্ত্বনা, গ্রীষ্মকাল বলে সবকিছুর সময় বাড়িয়ে রাত আটটা বা নয়টা করা হয়েছে। নতুবা কেইভ অফ দা উইন্ডস বা মেইড অফ দা মিস্ট বোট ট্যুরে যাওয়া সম্ভব হত না।
(চলবে)