2 0
Read Time8 Minute, 6 Second

প্রথম পর্ব 

কেন্টাকিতে পাহাড় থাকলেও পেন্সিল্ভেনিয়ার মত ঘন ঘন নেই, আকৃতিতেও তুলনামূলক ছোট। আর আরকান্সা আসতে আসতে পাহাড় পর্বতের খেল শেষ হয়ে গেল। শুরু হল সমতলভূমির গল্প। আরকান্সা আমার কাছে লাগল বাংলাদেশের গ্রামের মত। ক্ষেত জুড়ে ধানগাছের মত ছোট ছোট শস্য। ক্ষেতের পর ক্ষেত সবুজ শস্য দেখতে দেখতে নস্টালজিক হয়ে গেলাম। আমার মামাবাড়ি গাজীপুরের এক গ্রামে। বাস থেকে নেমে রিকশা বা ঠেটঠেরিতে করে মামাবাড়ি যেতে হয়। কাঁচা রাস্তা ধরে রিকশা যখন এগোতে থাকে, রাস্তার দুই ধারে কাঁচা ধানের ক্ষেত চোখে পড়ে। যতদূর চোখ যায় কেবল ধান গাছ। মাঝে মধ্যে দুই একটা শজনে বা পাট ক্ষেত চোখে পড়ে, কিন্তু বেশীরভাগই ধান। পুরো রাস্তা জুড়ে বড় বড় গাছের ছায়া রোদকে আড়াল করে রাখে। সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস এত মিষ্টি একটা অনুভূতি দেয়! যদিও গ্রামের বাসাবাড়ি এখন শহুরে কায়দায় রড, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হচ্ছে, কিন্তু এই পথটুকু যেন পিচ দিয়ে মোড়ানো না হয়। গাছগুলো যেন কাটা না হয়, ক্ষেতগুলোয় যেন ডেভেলপারের সাইনবোর্ড না বসে। যেভাবে আছে, সেভাবেই যেন থাকে। জানি, আমার চাওয়ায় কিছু আসবে যাবে না, তবুও মনের ইচ্ছাটুকু ব্যক্ত করে রাখলাম। আরকান্সায় একটাই বাঁচোয়া, ভুট্টা ক্ষেত নেই। মিজৌরি থেকে পেন্সিল্ভেনিয়া আসার পথে ইন্ডিয়ানা আর ইলিনয় আমাকে যে পরিমাণ ভুট্টা ক্ষেত দেখিয়েছে, এ জীবনে আর সে জিনিস মিস করার জো নেই।

বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) ইউএস প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আখড়া আরকান্সা। এখানেই জন্মেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এই অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন। এখানে এক রাত বিশ্রাম নেব। আমাদের মোটেল আরকান্সার রাজধানী লিটল রকে। এখানে ইউনিভার্সিটি অফ আরকান্সার দুটো ক্যাম্পাস আছে। অনেক বাংলাদেশীকে এই দুটো ক্যাম্পাসে পড়তে আসতে দেখেছি। যা হোক, বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ আমরা লিটল রকে পৌঁছলাম। মোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক করে বের হতেই শিরশির করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আক্ষরিক অর্থে গুসবাম্পস যাকে বলে। শীতকাল নয়, গ্রীষ্মের বিকেলে রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কাহিনী এটা। এতক্ষণ গাড়ির ভেতর বসে ঠাণ্ডা হাওয়া খাচ্ছিলাম। কিন্তু বের হওয়ার সাথে সাথে পড়লাম গরম তাওয়ার মধ্যে। ফলে আউলে গেল হরমোনগুলোর মাথা, রোম গেল দাঁড়িয়ে। বাটলারে ছিল আরামদায়ক গ্রীষ্মকাল। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হত ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দশ মাস থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ঐ গরমে। এখন আর্দ্রতাসহ গরমের ছোঁয়া পেয়ে শরীরের ভেতর ইয়াক ইয়াক শুরু হল। তিন বছর আগে বাংলাদেশের আর্দ্র গরম ছেড়ে এসেছিলাম মিডওয়েস্টের শুকনো গরমে। সেখানে ঘাম হত না, শুধু চামড়া পুড়ে যেত। দুই বছর চামড়া পুড়িয়ে মুভ করেছিলাম ইস্ট কোস্টের বাটলারে। সেখানে চরম ঠাণ্ডা কষ্ট দিয়েছে বটে, কিন্তু গরম ছিল আরামের। কিন্তু কারো জীবনে সুখ স্থায়ী হয় না। আমাদেরও মুভ করতে হল সাউথের গরমে। এখানে আরকান্সায় এসে পেলাম আর্দ্র গরম, টেক্সাসে শুষ্ক।

যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটা অঙ্গরাজ্যকে অনেকে পঞ্চাশটা দেশ বলে অভিহিত করে। এদের সরকার আলাদা, নিয়ম কানুন আলাদা, কোথাও গাঁজা বৈধ-কোথাও অবৈধ। আবহাওয়া, প্রাণী, উদ্ভিদ সবকিছুর মধ্যেই হালকা থেকে চরম মাত্রার ভিন্নতা। ভারতে যেমন মরুভূমি, বরফ, গরম, বৃষ্টি সবকিছু একসাথে পাওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্রেও সবকিছু পাবেন। সমস্যা একটাই। রাজ্যগুলো এত বড় বড় যে, ঘুরে বেড়ানো সহজ নয়। সে তুলনায় ভারতের বিভিন্ন অংশ ভ্রমণ সহজ কিনা, কেউ জানলে জানাবেন। আমার অনেক ইচ্ছা রাজস্থান, সিমলা, মানালি, কাশ্মীর, চেরাপুঞ্জি, কামরূপ-কামাখ্যা, খাজুরাহো ঘুরতে যাব। কারো কাছ থেকে পরামর্শ পেলে সুবিধাই হয়। যা হোক, বলছিলাম পাশাপাশি দুই স্টেটের গরমের কথা। আরকান্সার গরমটা আর্দ্র, বাতাসে জলীয় বাষ্প আছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমরা ঘেমে গেলাম। কিন্তু আগস্টের এক তারিখে যখন টেক্সাসে নামলাম, সেখানে জলীয় বাষ্পের বালাই নেই, সরাসরি আগুনের হলকা এসে গায়ে সূঁচ ফুটাতে লাগল। মাটির চুলার ধারেকাছে কখনো বসেছেন? গনগনে আগুন থেকে যে হলকা বের হয়, সেটাই আছড়ে পড়ছে আকাশ থেকে। বাতাসে আর্দ্রতা নেই বলে রোদে বের হলেই চামড়া পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে।

আরকান্সা থেকে টেক্সাসে ঢুকার মুখে বিভিন্ন বিলবোর্ডে টেক্সারকানা (Texarkana) নামটা দেখতে পাচ্ছিলাম। দুইয়ে দুইতে চার মিলিয়ে প্রিন্স বলল, “টেক্সাস আর আরকান্সা মিলিয়ে নাম নাকি?” গুগল করে দেখি, কথা অর্ধেক ঠিক। এটা টেক্সাসের একটা শহর, কিন্তু নাম হয়েছে টেক্সাস (Tex)-আরকান্সা (Ark)-লুইজিয়ানা (Ana) এই তিন অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে। এরা তিনটা মিলে আর্ক-লা-টেক্স নামের একটা অঞ্চলই গঠন করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে। যেহেতু টেক্সাস আর আরকান্সা দেখা শেষ, বাকি থাকল লুইজিয়ানা। লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স শহরে অনুষ্ঠিত মার্দি গ্রা (নাকি মা-দি গ্রা?) উৎসবে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা বহুদিনের। আগামী বছর অবশ্যই যাব। কলেজ স্টেশন থেকে মাত্র সাড়ে ছয় ঘণ্টার ড্রাইভিং। তো, টেক্সাস জীবনের প্রথমদিনই আমাদের দুজনের মুখ থেকে পা পর্যন্ত পুড়ে গেল। জামাকাপড় দিয়ে ঢাকা অংশে আসল রঙ, আর বাকি অংশে কালচে রঙ নিয়ে আমরা ঘুরতে বেড়াতে লাগলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, এখানকার শ্বেতাঙ্গরা পুড়ে খাক হচ্ছে না। এদের রঙ সাদাই আছে। অভিযোজনের কী সুন্দর উদাহরণ!

শেষ পর্ব

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
50 %
Surprise
Surprise
50 %
Previous post চলে এলাম টেক্সাস… দ্য লোন স্টার স্টেট! (১)
Next post চলে এলাম টেক্সাস… দ্য লোন স্টার স্টেট! (শেষ পর্ব)