টেক্সাসের ডাকনাম ‘দ্য লোন স্টার স্টেট’। নামটা এসেছে অঙ্গরাজ্যের পতাকা থেকে। এক আমলে টেক্সাস মেক্সিকোর অংশ ছিল। তখন টেক্সাস আর কোয়াউইলা নামের দুটো এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল কোয়াউইলা ই তেহাস (Coahuila y Tejas, অর্থ ‘কোয়াউইলা এবং টেক্সাস’) নামের অঞ্চল। মেক্সিকোর লাল, সাদা, সবুজ রঙা পতাকার মধ্যেখানে দুটো তারা বসিয়ে তৈরি হয়েছিল এই অঞ্চলের পতাকা। ১৮৩৫ সালে যখন টেক্সাস স্বাধীনতা লাভের জন্য মেক্সিকোর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আর ১৮৩৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন নীল রঙা জমিনে একটা মাত্র তারা বসিয়ে রিপাবলিক অফ টেক্সাস নামের সার্বভৌম রাষ্ট্রের পতাকা তৈরি হয়। ১৮৩৯ সালে এই নকশার সাথে সাদা আর লাল রঙ যোগ করে তৈরি করা হয় বর্তমান পতাকা। পতাকায় থাকা একটা তারার কারণে এর ডাক নাম হয়ে যায় ‘দ্য লোন স্টার ফ্ল্যাগ’, আর সেখান থেকে অঙ্গরাজ্যটা পরিচিতি পায় দ্য লোন স্টার স্টেট নামে। উল্লেখ্য, ১৮৪৫ সালে ইউনিয়নের ২৮-তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ দেয় রিপাবলিক অফ টেক্সাস। এই ইউনিয়নই পরে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আয়তনের দিক দিয়ে টেক্সাস যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য। প্রথমটা হল আলাস্কা। জনসংখ্যার দিক দিয়েও টেক্সাস দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। প্রথম স্থানে আছে ক্যালিফোর্নিয়া। টেক্সাসের সীমানা পেরোলেই মেক্সিকো। তাই এইবেলা মায়া আর অ্যাজটেক সভ্যতার দেশটা ঘুরে নেওয়া উচিৎ। টেক্সাসের বিখ্যাত কিছু শহরের নাম অনেকেই শুনেছেন। ডালাস, অস্টিন, এল পাসো, সান আন্তোনিও, হিউস্টন। অ্যাপোলো থার্টিনের নভোচারী জ্যাক সুইগার্ট হিউস্টনে অবস্থিত নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলেন, “হিউস্টন, উই হ্যাভ এ প্রব্লেম হিয়ার!” বলে রাখা ভালো, হিউস্টনের ইংরেজি বানান Houston হলেও উচ্চারণ হবে হিউস্টন। জানা না থাকলে অনেকে হাউস্টন বলে ফেলেন যেটা নিয়ে রসিকতাও হয়।
আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বে অবস্থিত পেন্সিল্ভেনিয়া থেকে দক্ষিণে অবস্থিত টেক্সাসে এসেছি। আসার পথে যেসব অঞ্চল পড়েছে, সেগুলোর ভৌগলিক অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে প্রকৃতিতেও ভিন্নতা দেখা গেছে। আগেই বলেছি কেন্টাকি আসতে আসতে পাহাড়ের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। পাহাড়গুলোর আকৃতিও ক্রমান্বয়ে ছোট হচ্ছিল। আরকান্সা আসতে আসতে পাহাড়ি এলাকা শেষ হয়ে গেল। গাছপালার ধরনও বদলাতে লাগল। পাহাড়ি বনের গাছগুলো ছিল বড় বড়। যখন আরকান্সা এলাম, বড় কোনো গাছ দেখলাম না। বদলে পেলাম প্রেইরি বা বৃক্ষহীন তৃণভূমি। গবাদি পশু চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। সাথে পেলাম প্রচুর শস্যক্ষেত। টেক্সাসে ঢুকার পর আবার মাঝারি আকারের গাছপালা দেখতে পেলাম। সাথে তৃণভূমি। তবে শস্যক্ষেত পেলাম না কোনো। তৃণভূমিতে আরকান্সার তুলনায় অনেক বেশি গবাদি পশু চড়ছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সব র্যাঞ্চ। সেগুলোর ভেতর ঘোড়া হাঁটছে, ঘাস খাচ্ছে। কিন্তু র্যাঞ্চগুলোর চেহারা ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র বা উপন্যাসে যেভাবে চিত্রায়িত হয়, তার সাথে মিল নেই। ওরকম কিছু দেখার জন্য হয়ত টেক্সাসের আরও ভেতরে ঢুকতে হবে। টেক্সাস বলতে আমাদের মনে মরুভূমি বা গাছপালাহীন এলাকা ভেসে উঠে। কিন্তু টেক্সাসে মরুভূমির পরিমাণ দশ শতাংশেরও কম। তার উপর আমরা এসেছি টেক্সাসের গ্রিনার সাইড বা সবুজ অংশে। এখানে মরুভূমির মত কিছুই দেখলাম না। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। টেক্সাসের রাজপথে পিচ নেই তেমন। গরমে গলে যায় বলে? নাকি অন্য কারণ আছে?
নতুন বাসাটা অনলাইনে দেখে লিজ সাইন করেছিলাম। এসে দেখি রান্নাঘরের এক্সহস্ট ফ্যান কাজ করে না, বেশ কিছু সকেট নষ্ট, মেঝের কয়েকটা টাইলস নড়বড় করে। দুই বেডরুমের বাসা খুব সস্তায় পেয়ে লিজ নিয়েছিলাম। এখন দেখি সস্তার তিন অবস্থা। যা হোক, দুই বেডরুমের একটাকে আমার স্টাডি রুম বানিয়েছি। সেন্ট লুইসে মাস্টার্স করার সময় স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকতাম বলে আলাদা স্টাডি ছিল না। এক রুমের ভেতরেই বসার ঘর, রান্নাঘর, শোয়ার ঘর সবকিছু। এবার মনের মত করে বাসাটা সাজাতে গিয়ে তিনদিন দৌড়ের উপর ছিলাম। একে তো ভ্রমণের ক্লান্তি, তার উপর বাসা থেকে দোকান, দোকান থেকে বাসা। শরীর পুরো ধ্বসে গেল। আবার ব্যাংক একাউন্ট খোলো, ভার্সিটিতে যাও ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে, সুপারভাইজরের সাথে দেখা কর। সব মিলিয়ে প্রথম সপ্তাহটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। যে ব্যাংক অফিসার আমার একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, সে বেশ আলাপী। জিজ্ঞেস করল, “টেক্সাসের কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে?” বললাম, “মেক্সিকো উপসাগর আর হিউস্টনের নাসা সেন্টার।” মেয়েটা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি ভাবছ গ্যালভেস্টন থেকে যে সাগর দেখা যায় সেটা নীল রঙের, আর সৈকতটা সাদা বালুর?” আমার চোখও সরু হয়ে গেল, “এরকম নয়?” মেয়েটা মুচকি হেসে বলল, “নো ম্যাম! এখান থেকে তুমি ঘোলা পানি আর বাদামী রঙের সৈকত দেখতে পাবে। নীল পানি চাইলে যেতে হবে মেক্সিকোর অংশে। আর একটু কষ্ট করে যদি সাউথ পাদ্রে দ্বীপে যাও, তাহলে টেক্সাস থেকেই নীল পানি দেখতে পাবে।” মেয়েটা নিজেও নাকি ঠক খেয়ে এই জ্ঞান লাভ করেছে।
এরপর গেলাম সুপারভাইজরের সাথে দেখা করতে। উনার সাথে গত তিন মাস ধরে অনলাইন মিটিং করছি, প্রজেক্ট করছি। যেদিন প্রথম দেখা করতে গেলাম, আমি হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম, উনি জড়িয়ে ধরার জন্য দুই বাহু মেললেন। দুইজনই আবুলের মত হাসলাম। এরপর প্রফেসরও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর বললেন, “ধুত্তেরি ছাই! আই অ্যাম গনা গিভ ইউ অ্যা হাগ।” কোলাকুলির মত উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে আমার জড়তা কেটে গেল। এক ঘণ্টার মত উনার সাথে দর্শন, জীবন ইত্যাদি নিয়ে আলাপ হল। লেখাপড়া বা গবেষণার কথা উঠলই না। শুধু বিদায় নেওয়ার আগ দিয়ে বললেন, “আমি এর আগে বাংলাদেশের একজনের সাথে কাজ করেছি। ওর সাথে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, তোমাদের সমাজে এমন ধারণা প্রচলিত যে, প্রফেসররা সব জানেন। উনাদের ভুল হতে পারে না, বা উনাদের ঠিক করে দেওয়া স্টুডেন্টের দায়িত্ব নয়। ধারণাটা ঠিক নয়। প্রফেসররা সব জানেন না। হয়ত বেশিরভাগ সময়েই তোমার চেয়ে বেশি জানেন, কিন্তু সবসময় নয়। আমার ভুল হলে তুমি সেগুলো ধরিয়ে দিবে। আমার কোনো মতামত পছন্দ না হলে জানাবে। আমি কোনো বিষয়ের উপর আইডিয়া দিলেও সেটার উপর তোমার আইডিয়াও শেয়ার করবে। আমি মোটেও অফেন্ডেড হব না। ঠিক আছে?”
এরপর গেলাম জীবনের প্রথম আকাশগঙ্গা দেখতে। টেক্সাসের বায়ুমণ্ডলে মেঘের আনাগোনা কম। আকাশ পরিষ্কার থাকে। তাই হুট করে রাতের আকাশ দেখতে মন চাইল। পেন্সিল্ভেনিয়ায় যদিও পাহাড়ের উপর থাকতাম, কিন্তু বেশিরভাগ সময় আকাশ থাকত মেঘে ঢাকা। তাই নক্ষত্র বা ছায়াপথ দেখা দুষ্কর ছিল। টেক্সাসে যেহেতু এমন নয়, তাই রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। শহর থেকে বের হয়ে উঠলাম হাইওয়েতে। প্রথমে কিছুক্ষণ আলো থাকলেও এক পর্যায়ে আলোক দূষণ কমে এল। আধা ঘণ্টা ড্রাইভিংয়ের পর প্রিন্সের মনে হল জায়গাটা নিকষ কালো। তাই হাইওয়ের পাশে ঘাসের উপর গাড়ি পার্ক করে আমরা বের হলাম তারা দেখতে। আকাশে তাকিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল আবছা একটা রেখা। এটা কি আকাশগঙ্গা? মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি? প্রিন্স মাথা নাড়ল। আমি বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম আমি ছায়াপথটা দেখছি। কত ছবি দেখেছি এটার! তার সাথে নিজ চোখে দেখার তুলনাই হয় না। যদিও ছবির মত এত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, এত উজ্জ্বলও নয়, তারপরও এটা আমার নিজ চোখে দেখা। অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। সাথে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ কোটি নক্ষত্র তো আছেই! গাড়ির হুডে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, এই ছায়াপথ দেখেই প্রাচীন গ্রিসের মানুষেরা কত কি কল্পনা করেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল, দেবী হেরা শিশু হারকিউলিসকে স্তন্যপান করানোর এক পর্যায়ে রাগ করে হারকিউলিসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন বুক থেকে। ফলে দুধের ধারা ছিটকে পড়েছিল স্বর্গের সব জায়গায়। ওটাই এই আকাশগঙ্গা…