1 0
Read Time13 Minute, 45 Second

আমার কাছে পুষ্টিবিজ্ঞানের বেশ কয়েকজন আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থী জানতে চেয়েছেন, ব্যাচেলরে পড়া অবস্থায় কীভাবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়। আমি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশ সম্পর্কে জানি না। তাই অভিজ্ঞতার আলোকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে আসার ব্যাপারে বলতে পারি।

১) আপনার চার বছরের প্রধান লক্ষ্য হবে ভাল সিজিপিএ তোলা। সিজিপিএ তিনের নিচে থাকলে অ্যাডমিশন হয় না, এটা যেমন ভুয়া কথা; আবার সিজিপিএ doesn’t matter, এটাও ভুয়া কথা। ভাল সিজিপিএ আপনাকে এগিয়ে রাখবে। বিশেষ করে কন্সেন্ট্রেশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাবজেক্টে ভাল জিপিএ থাকলে ম্যালা সুবিধা। কন্সেন্ট্রেশন কী বুঝার জন্য এই লেখা পড়তে পারেন। ধরুন আপনি Biochemical & Molecular Nutrition-এর উপর মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে চান। কিন্তু বিএসসিতে আপনি বায়োকেমিস্ট্রিতে পেয়েছেন জিপিএ ২.৫০। এতে অ্যাডমিশন কমিটির ধারণা হতে পারে বায়োকেমিস্ট্রিতে আপনার বেসিক ভাল না। আপনার সাথে যদি বায়োকেমিস্ট্রিতে ৩.০০ জিপিএ পাওয়া কেউ আবেদন করে, সে একটু হলেও এগিয়ে যাবে অ্যাপ্লিকেন্ট পুলে। তবে সিজিপিএই সবকিছু নয়। আপনার যদি দুর্বল সিজিপিএর সাথে উচ্চ জিআরই স্কোর থাকে, স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে যদি স্পষ্ট করে রিসার্চ ইন্টারেস্ট ব্যাখ্যা করতে পারেন, যদি গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে আপনিও শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারবেন। কিন্তু কথা হল, মাত্র ব্যাচেলর শেষ করেছে এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগেরই নজরকাড়া গবেষণা অভিজ্ঞতা থাকে না। রিসার্চ ইন্টারেস্ট সম্পর্কেও বেশীরভাগের স্পষ্ট ধারণা থাকে না। তাই তাদের প্রোফাইল ভারী করার জন্য সহজ দুটো উপায় হল শক্তিশালী সিজিপিএ আর শক্তিশালী জিআরই স্কোর।

২) যেসব কোর্স করছেন, সেগুলোর উপর ভাল দখল থাকতে হবে। ভাল সিজিপিএ তুলতে গেলে সাবজেক্টের উপর ভাল দখল থাকতে হয়। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত বেসিকও ঝরঝরে করবেন, গ্রেডও ভাল তুলবেন। স্ট্যাটিস্টিকস/বায়োস্ট্যাটিস্টিকস, এপিডেমিওলজির উপর ভাল দখল থাকতে হবে। সায়েন্টিফিক পেপার বুঝার জন্য এগুলো লাগবে। তাছাড়া পুষ্টি নিয়ে যখন গবেষণা করবেন, তখনও লাগবে।

৩) কিছু সফটওয়্যারের কাজ শিখে রাখতে পারেন। পুষ্টিবিজ্ঞানে SAS, R, SPSS – এই তিন সফটওয়্যারের চাহিদা অনেক। স্ট্যাটিস্টিকাল এনালাইসিস করতে গেলে এগুলোর যেকোনো একটা লাগবেই। তাই এগুলো শিখতে পারেন। প্রথমে ধরতে পারেন SPSS কারণ এটা সবচেয়ে সোজা। এরপর R আর SAS । যদি সত্যিকার অর্থে এগুলোর উপর আপনার দক্ষতা জন্মায়, তাহলে সিভিতে উল্লেখ করতে পারেন। প্রোফাইল ভারী হবে।

৪) আপনার যদি ল্যাব বেইজড গবেষণায় আগ্রহ থাকে (কোষ/cell বা প্রাণী/animal model নিয়ে কাজ। একে বলে বেসিক নিউট্রিশন রিসার্চ), তাহলে ল্যাবের কাজগুলো খুব ভালমত শেখা উচিৎ। যারা যুক্তরাষ্ট্রে বেসিক নিউট্রিশন রিসার্চে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়, তাদের আগে থেকেই (ব্যাচেলর পর্যায়ে) কোষ বা প্রাণীর উপর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকে। তবে এ ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকলে যে এই বিষয়ে গবেষণার সুযোগ পাবেন না – এটাও বলা যায় না। যদি অ্যাডভাইজদের কনভিন্স করতে পারেন, উনারা বেসিক নিউট্রিশন রিসার্চে আপনাকে নিতেও পারেন। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ল্যাব বেইজড প্রফেসরদের নক দিলে উনারা উত্তর দিতেন না, বা নেতিবাচক উত্তর দিতেন, কারণ এই বিষয়ে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আমাকে নিলে সবকিছু একদম গোঁড়া থেকে শেখাতে হবে। কিন্তু অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী আছেন যারা বেসিক নিউট্রিশনে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, কারণ তাদের আগে থেকেই সেল বা অ্যানিম্যাল মডেল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা/দক্ষতা ছিল।

আপনার প্রতিষ্ঠানে যদি সেল বা অ্যানিম্যাল মডেলের উপর কাজ শেখার সুযোগ না থাকে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখুন। কোথাও যদি এসব শেখার সুযোগ থাকে, সেখানকার ল্যাবের সাথে যুক্ত হওয়া যায় কিনা দেখুন।

৫) আপনার যদি ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে (মানুষের উপর গবেষণায়) আগ্রহ থাকে, অন্তত একটা হলেও ক্লিনিক্যাল প্রজেক্টে যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুঁজুন। ব্যাচেলর থিসিস বা সার্ভে প্রজেক্টে কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক বেইজড কাজ করতে পারলে খুব ভাল। তবে করতে হবে বলে করা নয়, রিসার্চের প্রতিটা ধাপ বুঝতে হবে (কীভাবে রিসার্চ কোয়েশ্চেন তৈরি করছেন, কীভাবে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করছেন, মেথডোলোজি কীভাবে ঠিক করলেন, কীভাবে ডাটা সংগ্রহ এবং এনালাইসিস করলেন, ইত্যাদি)। থিসিস লেখার প্রতিটা ধাপ বুঝতে হবে (ইন্ট্রোডাকশন, লিটারেচার রিভিউ, মেথড, রেজাল্ট, ডিসকাশন)। পারলে থিসিস থেকে একটা পেপার পাব্লিশ করে ফেলতে হবে।

৬) আপনার যদি কমিউনিটি নিউট্রিশনে আগ্রহ থাকে, অন্তত একটা হলেও কমিউনিটি নিউট্রিশন প্রজেক্টে যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুঁজুন। যদি ব্যাচেলর থিসিস বা সার্ভে প্রজেক্টে কোনো কমিউনিটি বেইজড কাজ করতে পারেন, খুব ভাল। নতুবা আইসিডিডিআর,বি এবং বিখ্যাত এনজিওগুলোতে যুক্ত হতে পারেন (ইন্টার্নশিপ, ভলান্টিয়ার বা চাকরি)। এরা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উপর প্রচুর কমিউনিটি নিউট্রিশন ভিত্তিক কাজ করে।

৭) ব্যাচেলর পাশ করতে করতে ছোটখাট একটা রিভিউ পেপার (ক্রিটিকেল রিভিউ, আম্ব্রেলা রিভিউ) লিখে ফেলুন। চেষ্টা করুন পাব্লিশ করতে (অবশ্যই যেন সেটা প্রিডেটরি জার্নাল না হয়)। যদি একটা পেপারও পাব্লিশ করতে পারেন, প্রফেসররা ধরে নেবেন আপনার পেপার লেখা, ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরি করা, জার্নালে সাবমিশন করা, কিংবা রিভিউয়ারদের মোকাবেলা করার ব্যাপারে হালকা হলেও জ্ঞান আছে। সেক্ষেত্রে আপনার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। যদি আপনার ডিপার্টমেন্টে পেপার পাব্লিশের কালচার না থাকে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করুন।

বিভিন্ন ধরনের রিভিউঃ https://library.shu.edu/ReviewArticles/Types

৮) গবেষণা পেপার পড়ার অভ্যাস গড়তে পারেন। কীভাবে হেলথ রিলেটেড রিসার্চের পেপার পড়তে হয় সে বিষয়ে নেটে প্রচুর রিসোর্স পাবেন। সেগুলো পড়ে ধারণা নিন। রেজাল্ট, স্ট্যাটিস্টিকাল এনালাইসিস সবকিছু হয়ত পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না, কিন্তু মেথড, ব্যাকগ্রাউন্ড, ডিসকাশন, কনক্লুশন ইত্যাদি সেকশন বুঝার চেষ্টা করুন। সবসময় চেষ্টা করবেন পুষ্টি জগতের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো পড়তে। এতে করে আপনার আগ্রহ কীসের উপর, ভবিষ্যতে কোন বিষয়ের উপর গবেষণা করতে চান, সেটা বুঝা সহজ হবে। নিয়মিত বিভিন্ন জার্নালে ঢুঁ মারবেন নতুন পেপার দেখার জন্য।

পুষ্টির বিভিন্ন জার্নালঃ https://www.scimagojr.com/journalrank.php?category=2916

৯) টুইটার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর লিংকডইনে পুষ্টির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাউন্ট অনুসরণ করুন। এক যুক্তরাষ্ট্রেই পুষ্টি সংক্রান্ত বহু খ্যাতনামা সংস্থা আছে। এর বাইরে আছে কানাডা আর যুক্তরাজ্যের কিছু। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর অনেক সেমিনার আর কোর্সের আয়োজন করে। কয়েকটার রেজিস্ট্রেশন ফ্রি। সেগুলোতে অংশ নেবেন। নিলে বিশ্বখ্যাত পুষ্টিবিদদের গবেষণা সম্পর্কে জানতে পারবেন, তাদের বক্তৃতা শুনতে পারবেন। জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। একই সাথে পুষ্টির জগতের নামকরা গবেষকদেরও অনুসরণ করতে পারেন। যেমনঃ Walter C. Willett, Sharon M. Donovan, Naïma Moustaïd-Moussa, James Hill, Barbara Gower । শুরু করুন সবাইকে দিয়ে। ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারবেন আপনার আগ্রহ কোনদিকে, তখন ঐ সেক্টরের গবেষকদের অনুসরণ করতে পারেন।

১০) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কিছু অনলাইন কোর্স আছে যেগুলো করলে এখানকার পুষ্টি শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারবেন। কয়েকটা কোর্সে সার্টিফিকেটও দেয়। এগুলো সিভিতে উল্লেখ করতে পারবেন। যদিও নন-একাডেমিক অনলাইন কোর্সের মূল্য একাডেমিক কোর্সের চেয়ে কম, তারপরও সিভিতে একেবারেই কিছু না থাকার চেয়ে কোর্সগুলো থাকা ভাল। এগুলো দেখিয়ে বুঝাতে পারেন আপনার শেখার আগ্রহ আছে, সবসময়ই কিছু না কিছু শিখছেন। তবে সব কোর্সই যে আপনাকে করতে হবে, তা নয়। নিজের আগ্রহ আর পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিন।

  1. https://nutrition.tufts.edu/microcourse/signup
  2. https://extension.learn.usu.edu/browse/food-sense/courses/nncp (certificate course)
  3. https://usucourses.instructure.com/courses/111 (certificate course)
  4. https://extension.umn.edu/courses-and-events/learning-virtually-leading-actively-resources-community-leaders#week-6-%28may-4-8%29%3A-practicing-emotional-intelligence-during-a-community-crisis-experience-2084715
  5. https://www.grownjkids.gov/TrainingCalendar/Web (certificate course)
  6. https://agrilifelearn.tamu.edu/catalog?pagename=food-and-nutrition (certificate course)
  7. https://www.lsuagcenter.com/topics/food_health/education_resources/eatsmart/lessons
  8. https://workspace.oregonstate.edu/course/childhood-food-insecurity
  9. Developing a Food Bank Nutrition Policy
  10. https://www.nwcphp.org/training/life-course-nutrition-maternal-and-child-health-strategies-in-public-health (certificate course)

১১) সবশেষে, যদি দেশ থেকে মাস্টার্স শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে চান, থিসিস বেইজড মাস্টার্স করে আসার চেষ্টা করুন। নন-থিসিস মাস্টার্স করলে যুক্তরাষ্ট্রে সুযোগ পাবেন না, তা নয়। আমি নিজেই নন-থিসিস মাস্টার্স করে এসেছি। কিন্তু থিসিস বেইজড মাস্টার্স আপনাকে এগিয়ে দেবে। তাছাড়া ব্যাচেলর আর মাস্টার্স – দুই দফা গবেষণা করলে আপনারই লাভ। প্রোফাইলও ভারী হবে, গবেষণা করাও শিখতে পারবেন।

ধন্যবাদ সবাইকে!

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ৪ (এক মাস হল পার)
Next post যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর