0 0
Read Time11 Minute, 0 Second

প্রথম পর্ব

ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ সকাল নয়টার মধ্যে আমাদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কেবিনে চেকইন শুরু হয় দুপুর তিনটা থেকে, তার আগে নয়। ভেবেছিলাম নয়টায় রওনা দিয়ে বারোটা নাগাদ স্টেট পার্কে পৌঁছে হালকা ঘোরাঘুরি করব। এরপর তিনটার দিকে চেকইন করতে পার্ক অফিসে যাব। কিন্তু আগের রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে গেল বলে সকাল সকাল উঠতে পারলাম না। উঠলাম দশটায়। এরপর নাস্তা করে জিনিসপত্র সব গাড়িতে উঠিয়ে রওনা দিতে দিতে বাজল সাড়ে এগারোটা। পার্কে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর। পুরানো কিছু শহরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। সেগুলোর বিধ্বস্ত আর চুন সড়কি খসে পড়া দালানকোটা আপনাকে এক লাফে নিয়ে যাবে বিশের দশকের আমেরিকায়। দুইদিন পর হয়ত পুরো শহর পরিত্যক্ত ঘোষিত হবে। সেন্ট লুইসে থাকতেও এমন অনেক পাড়া দেখেছি যেগুলোতে কেউ থাকত না। পুরনো বাড়িঘরগুলো ন্যাংটো দাঁড়িয়ে থাকত। কোনোটার হয়ত দরজা নেই, কোনোটার জানালা। কোনোটার ফাঁকফোকর হয়ত কাঠের তক্তা মেরে বন্ধ করে রেখেছে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য। টেক্সাসের শহরগুলো দেখেও অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হল। এখানকার মানুষজন কেমন? খুব গোঁড়া? নাকি রক্ষণশীল মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে? নাকি শহরের মত তারাও পুরনো মন মানসিকতা ধরে রেখেছে?

শহর থেকে বের হওয়ার পর শুরু হল র‍্যাঞ্চ। একের পর এক বিশাল সব র‍্যাঞ্চ। যারা কিশোর বয়সে সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন জঁ (genre) পড়েছেন, তাদের র‍্যাঞ্চের সাথে পরিচয় থাকার কথা। যারা পড়েননি, তারা অবশ্য বেশি কিছু মিস করেননি। আমি নিজেও মাত্র একটা ওয়েস্টার্ন পড়েছি। মারামারি, গোলাগুলি ভাল লাগে না বলে এই ঘরানার চলচ্চিত্রও দেখা হয়নি। তাই বলে আমেরিকার বিখ্যাত র‍্যাঞ্চের সাথে আমার পরিচয় থেমে থাকেনি। সেবা প্রকাশনীরই তিন গোয়েন্দা সিরিজের মাধ্যমে আমেরিকার খামার সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছিলাম। এখানকার কৃষকেরা একটু জেদি, বদরাগী হয়, সে ধারণা পেয়েছিলাম। তবে আমার কোনো আমেরিকান কৃষকের সাথে পরিচয় ঘটেনি। তাই বলতে পারব না আদৌ তারা কেমন কিসিমের মানুষ। তবে বিশাল র‍্যাঞ্চগুলো দেখলে মনে হয়, একটু রাফ অ্যান্ড টাফ না হলে এগুলো সামলানো মুশকিল। র‍্যাঞ্চগুলো দেখে মনে হল প্রতিটাই একটা নির্দিষ্ট নকশা মেনে বানানো। যতটুকু এলাকা জুড়ে র‍্যাঞ্চ, সে এলাকা ঘিরে কাঠ বা ধাতুর তৈরি বেড়া লাগানো। সে বেড়ার একটা অংশে বিশাল ফটক। ফটকটা রাজপথের দিকে মুখ করা যেন গাড়ি নিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়া যায়। সব ফটকই বন্ধ। বেশীরভাগ ফটকই খিলান আকৃতির। খিলানের মাথায় র‍্যাঞ্চের নাম লেখা। ফটক পার হলে মাটির রাস্তা শুরু। কয়েকটাতে দেখলাম নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে মাইলখানেক দূরে র‍্যাঞ্চারদের বাড়ি অব্দি। কোনো বাড়িই ফটকের কাছাকাছি অবস্থিত নয়। বাড়িগুলো দেখতেও জমকালো। বুঝা যায় র‍্যাঞ্চারদের কামাই ভাল। এরপর তাকালাম বিশাল এলাকা জুড়ে কী হচ্ছে সেদিকে। অসংখ্য গরু জাবর কাটছে। কেউ ঘাস খাচ্ছে, কেউ ঠ্যাং ভেঙে বসে আছে। সবগুলোর কানে দুলের মত ট্যাগ ঝুলছে। হয়ত ট্র্যাক করার পদ্ধতি। একেকটা খামারে একেক ধরনের গরু দেখলাম। কোনোটায় টেক্সাস লংহর্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোনোটায় শিং ছাড়া প্রজাতি। লংহর্ন প্রজাতিটা টেক্সাসের খুব বিখ্যাত একটা প্রজাতি। একেকটা গরুর প্রায় তিন থেকে চার ফুট লম্বা শিং থাকে। এই গরু আমেরিকায় এসেছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের হাত ধরে। টেক্সাসে আসার পর এখানে সেখানে কেন শুধু বিশাল শিংওয়ালা গরুর ছবি দেখছি, সেটা পরিষ্কার হল। কিছু র‍্যাঞ্চে দেখলাম ছাগল আর ঘোড়াও আছে।

দেখতে দেখতে ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে অথচ র‍্যাঞ্চবহুল এলাকা শেষ হচ্ছে না। আমার মূত্রথলি ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে। মূত্র বিসর্জন না দিলেই নয়। কোনো র‍্যাঞ্চে গিয়ে টাট্টিখানা ব্যবহারের অনুমতি চাইবো নাকি? কিন্তু টেক্সাসে যে হারে সবাই বন্দুক নিয়ে ঘুরে, আমাকে ফটকের কাছে আসতে দেখামাত্র গুলি করে বসতে পারে। এরা ‘প্রাইভেট প্রোপার্টি’ নিয়ে যে হারে কাউমাউ করে, তাতে বেড়ার কাছে গাড়ি থামাতে দেখলেই গুলি করে দেবে। এরপর হয়ত জানতে আসবে আমরা কে, কী চাই। তাই ঝুঁকি নিলাম না। কোনোমতে চেপে রাখলাম। আরও কিছুক্ষণ পর যখন বমি করে দেব দেব অবস্থা, তখন একটা গ্যাস স্টেশন পেলাম। প্রিন্সের পার্কিং করতে দেরি, আমি দরজা ভেঙে দৌড় দিলাম দোকানের ভেতর। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। দোকানের একমাত্র টয়লেটটা দখল হয়ে আছে। পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, কেউ বের হয় না। ইতোমধ্যে আরেকজন এসে আমাদের সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিরে গেছে। অবশেষে না পারতে যখন নক করতে যাব, তখনই বের হল এক মা আর তার পিচ্চি কন্যা। মেয়েকে হাগুমুতু করাতে গিয়েই হয়ত এত দেরি। আমি উড়াল দিয়ে বসলাম টয়লেটের সিটে। গোপাল ভাঁড় যে বলেছিল, ‘রাজাকে আমি হাগার পর যে আরাম, সেটার মত ভালবাসি’, সে উপমার মাজেজা আরেকবার উপলব্ধি করলাম। এরপর আধা ঘণ্টা চালিয়েই চলে এলাম পার্কে। কাটায় কাটায় তিনটা বাজে তখন। পার্ক রেঞ্জারের অফিসে সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে, কেবিনের চাবি বুঝে নিয়ে রওনা দিলাম কেবিনের দিকে। চেক আউটের সময় কেবিন আর গ্রিল পিট পরিষ্কার করে দিতে হবে। সবকিছু পরিষ্কার থাকলে এবং কোনোকিছু নষ্ট না করলে সিকিউরিটি মানি ফেরত পাব। বিদায় দেওয়ার সময় অফিসারটা বলল, ‘এনজয় ই’য়ল!’ টেক্সাসের মানুষজনের উচ্চারণ কিঞ্চিৎ অদ্ভুত। এরা ‘আই’ দিয়ে শেষ হওয়া শব্দের উচ্চারণে ‘আই’ বলে না, বলে ‘আ’। যেমন, cry, try, I ইত্যাদির উচ্চারণ এরা করে ক্রা, ট্রা, আ। অভিনেতা ম্যাথিউ ম্যাককোনাহের উচ্চারণ শুনলে কিছুটা বুঝা যায়। তাছাড়া ইয়ং শেলডন টিভি সিরিজ দেখে থাকলে বুঝতে পারবেন টেক্সাসের উচ্চারণ কেমন। আমার খুব মজা লাগে শুনতে। সবচেয়ে বেশি শোনা যায় ‘Y’all’ কথাটা। এর মানে হল ‘You all’।

মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়ে কেবিন খুঁজে পেলাম। কেবিন থেকে কয়েক পা দূরে পার্কিং লট। মোট বাইশটা কেবিন আছে এই পার্কে। প্রতিটা কেবিনের সাথে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। আমাদের ঠিক পাশেই যে কেবিন, সেখানে কেউ নেই। একটু দূরের দুটো কেবিনে দুই পার্টি এসেছে। একটায় দেখলাম সাতজনের একটা দল, আরেকটায় একজন মধ্যবয়স্ক নারী। নারীটি গাছের সাথে একটা হ্যামক টাঙিয়ে সেখানে শুয়ে বই পড়ছে। দেখেই আরাম লাগে। আর সাতজনের দলটা গ্রিল করার যন্ত্রের চারপাশে বসে আড্ডা মারছে। একটু পর রান্না করবে। আমরা কেবিনের চারপাশের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হ্রদের পাড়েই আমাদের ছোট্ট কুটির। হ্রদের ঐ পাড়ে দেখা যাচ্ছে মাঝারি আকৃতির একটা পাহাড়। বিকেলের সোনালী আলোয় হ্রদের পানি আর পাহাড়ের চূড়া গলা সোনার মত চকচক করছে। আরও কিছুদূরে কয়েকজন তাবু খাঁটিয়ে শোয়ার বন্দোবস্ত করছে। এখানে টেন্ট ক্যাম্পিং করার জায়গা আছে। সবচেয়ে সস্তা ক্যাম্পিং সেটাই। অবশ্য কেবিন ভাড়া নিলেও আশেপাশে একটা তাবু খাটানোর অনুমতি পাবেন। আমাদেরও তাবু আছে, কিন্তু খাটাব কিনা মনঃস্থির করতে পারিনি। তাবুর পাশাপাশি বেশ কিছু আরভি বা রিক্রিয়েশনাল ভিইকলও দেখা যাচ্ছে। আমেরিকানদের মধ্যে এই যানের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। একটা সংসার ঢুকিয়ে ফেলা যায় এই গাড়িতে। তারপর সেটা চালিয়ে যেখানে খুশি সেখানে চলে যাওয়া যায়। আমাদেরও ইচ্ছে আছে আরভি ভাড়া নিয়ে কোনো একদিন ইয়োসেমিটি জাতীয় উদ্যানে ক্যাম্পিং করতে যাব।

তৃতীয় পর্ব

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ১)
Next post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ৩)