0 0
Read Time10 Minute, 30 Second

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব

গাড়ি থেকে মালসামান নামিয়ে কুটিরে রাখলাম। সেখানে চারটে চৌপায়া আর দুটো বাংক বিছানা, মানে দুইতলা খাট আছে। চারজন মানুষের শোয়ার ব্যবস্থা। এর বেশি মানুষ হলে মেঝেতে ঘুমানো লাগবে। বিছানাগুলো সিঙ্গেল বেড। এক বিছানায় কেবল একজন শোয়ার জায়গা। আমরা নিচের তলার দুটো বিছানায় চাদর, বালিশ, কম্বল পেতে ফেললাম। রাতের অন্ধকারে উপরের বিছানা থেকে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কে যায়, পুরো ক্যাম্পিং মাটি। এরপর শুরু হল চুলায় আগুন ধরানোর পালা। বারবিকিউ করার গ্রিলের সাথেই ফায়ার পিট বা আগুন জ্বালানোর গর্ত। অনেক জায়গায় গ্রিল আর ফায়ার পিট আলাদা থাকে। আমরা আগুন জ্বালানোর জন্য লাকড়ি, ফায়ার স্টার্টা‌র আর দাহ্য তরল এনেছি। দেশে যেমন মাটির চুলায় আগুন ধরানোর জন্য তুষ, শলার কাঠি, শুকনো গোবর বা পাতা দেওয়া হয়, এখানে তেমনি বিভিন্ন ধরনের ফায়ার স্টার্টা‌র পাওয়া যায়। লাকড়ির ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো গুঁজে রাখলে দ্রুত আগুন ধরে। ওগুলো ছাড়া শুধু লাকড়িতে আগুন ধরাতে অ-নে-ক সময় নেয়।

ভেবেছিলাম আগুন ধরানো খুবই সহজ। কিন্তু পনেরো মিনিট যায়, আধা ঘণ্টা যায়, গর্তে ধোঁয়া ছাড়া কিছু তৈরি হয় না। প্রিন্সের মেজাজ ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। আমি কীভাবে সাহায্য করব, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে উড চিপস বা কাঠের ছোট টুকরো না এনে ভুল করেছি। আমাদের ধারণা ছিল ফায়ার স্টার্টা‌র আর দাহ্য তরল দিয়েই আগুন ধরানো যাবে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। দাহ্য তরলটুকু জ্বলে শেষ হয়ে যায়, মূল লাকড়িতে আগুন ধরে না। কোথাও নিশ্চয় ভুল করছি। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর অগ্নি মহাশয়া রাজি হলেন মুখ দেখাতে। মিনিট বিশেক পর যখন শিকগুলো গরম হল, মেরিনেড করা মুরগী চড়িয়ে দিলাম। শিকের গরম আর আগুনের তাপে মুরগী কাবাব হবে। একপাশে চায়ের কেতলিও বসিয়ে দিলাম। পানি গরম হোক। ফ্লাস্কে ভরে রেখে দিলে আট ঘণ্টার মত গরম থাকবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খেতে ইচ্ছে হলে খাওয়া যাবে। এইবেলা বলে রাখি, বাংলাদেশে লম্বা শিকের মধ্যে আস্ত মুরগী ঢুকিয়ে আমরা ‘গ্রিল’ বলে যেটা চালাই, সেটা গ্রিল নয়। সেটা হল রোটিসেরি (rotisserie)। গ্রিলিং বলতে পাশের ছবির মত গ্রিল বা লোহার শিকের উপর মাছ, মাংস, সবজি চড়িয়ে সরাসরি আগুনের তাপে রান্না করাকে বুঝায়। আবার যদি কয়লার উত্তাপে আর ধোঁয়ার স্পর্শে খাবার পাকানো হয়, সেটা হবে বারবিকিউ। আমরা গ্রিল আর বারবিকিউ, দুই ধরনের পদ্ধতিতেই রান্না করেছি। প্রথমে ছিল গ্রিলিং, পরে আগুন নিভে যাওয়ায় কয়লার তাপে হয়েছে বারবিকিউ।

একটু দূরে যে একাকী নারীটি আছেন, তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হ্যামকে শুয়েই কাটিয়ে দিলেন। বিকেল পেরিয়ে যখন সন্ধ্যে হব হব করছে, তখন এসে চুলার পাড়ে বসলেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে আগুন ধরিয়ে ফেললেন। কিন্তু পাশে যে সাতজনের দল এসেছে, ওরাও আমাদের মত সংগ্রাম করছে। কেউ ফুঁ দিচ্ছে, কেউ কাঠ গুঁতাচ্ছে, কেউ ধুচ্ছাই বলে খ্যামা দিয়ে মোবাইল টিপছে। বোধহয় আমাদের মত ক্যাম্পিং ভার্জিন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগিয়ে আমরা গ্রিল স্ল্যাশ বারবিকিউ করলাম। প্রথম ব্যাচের মুরগীগুলো হালকা পুড়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাচটা ভাল হল। অভিজ্ঞতা বলে কথা। এক ফাঁকে প্রিন্স চা বানিয়ে খাওয়ালো। এত মজার লাল চা আগে কখনো খাইনি। উঁহু, অবশ্যই খেয়েছি। এরচেয়ে ভাল চা-ই খেয়েছি। কিন্তু পরিবেশের কারণে ওটাকে মনে হল স্বর্গসুধা। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। চারদিকে পোকামাকড়ের ডাক ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই। আকাশে একটা দুটো করে তারা ফুটে উঠছে। লোকালয় আর আলোক দূষণ থেকে অনেক দূরে আজ প্রাণ ভরে রাতের আকাশ দেখব। প্রস্তুতি হিসেবে রাত আটটার দিকে পরোটা-কাবাব খেয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেলাম। রাত যত গভীর হবে, তারা তত উজ্জ্বল হবে। তাই দশটা পর্যন্ত বাইরে বসে আড্ডা মারব। দশটার মধ্যে আকাশ ভরা তারা উঠার কথা। সেটা দেখে ঘুমাতে যাব। রান্না করার সময় আগুন নিয়ে যে নাটক হল, সেটার কারণে প্রিন্স আগুনের উপর চটে আছে। সে কারণে আজ রাতে ক্যাম্পফায়ার হবে না। তাছাড়া আমিও ক্লান্ত। একবার আগুন জ্বালালে পুরোটুকু কাঠ না পোড়া পর্যন্ত বসে থাকা বেশ কঠিন। তাই ঠিক করলাম আজ অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি করব, আগামীকাল ক্যাম্পফায়ার হবে।

ছবিঃ Saint John Astronomy Club

রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ আকাশ তারায় তারায় সয়লাব হয়ে গেল। প্রিন্স এক আমলে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোনদিক দিয়ে কখন উঠে কিংবা কখন অস্ত যায়, সব ওর নখদর্পণে ছিল। বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জও চিনত। ওর একটা দূরবীন ছিল গ্রহ-নক্ষত্র দেখার জন্য। বিদেশ আসার সময় সবকিছু ফেলে আসতে হয়েছে। আসার পর অনুশীলনের অভাবে অনেক তথ্যই মাথা থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু যা আছে, সেটাই আমাকে কালপুরুষ আর বৃষ নক্ষত্রপুঞ্জ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ভেগা নক্ষত্র, বিগ ডিপার চেনানোর জন্য যথেষ্ট। ও মাঝে মাঝে আমার পরীক্ষা নেয় কোনটা বৃহস্পতি গ্রহ আর কোনটা শুক্র, সেটার। আমি প্রতিবারই গুলিয়ে ফেলি। কতবার যে সে বলেছে শীতকালে সবচেয়ে বড় আর উজ্জ্বল যে তারাটা দেখা যায়, সেটা শুক্রগ্রহ! যা হোক, আজকেও আমাকে হাতে ধরে ধরে কালপুরুষ আর বৃষ দেখালো। কয়েকটা তারা থেকে কীভাবে প্রাচীন মানুষেরা একজন শিকারীকে কল্পনা করেছিল কিংবা একটা ষাঁড়কে, সেটা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। ডানের ছবিটা আপনাদের মুগ্ধ করার জন্য দিলাম। এই ছবি ছাড়া আমার নিজেরই কালপুরুষ আর বৃষের যুদ্ধ কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছিলো।

একটু পর আমরা রাতের আকাশের ছবি তোলার জন্য হ্রদের ধারে গেলাম। গিয়ে দেখি হ্রদের ঐ পাড়ে যারা তাবু খাটিয়েছিলো, তারা তাবু ঘিরে মরিচবাতি দিয়ে সাজিয়েছে। কয়েকটা গাছের গোঁড়াতেও লাইটিং করেছে। দুইদিন পর বড়দিন। উৎসবের ছোঁয়া এসে লেগেছে ক্যাম্পিঙয়েও। হঠাৎ কানে এলো, ‘ম্যায় উধার কিঁউ জাউ? তু ইধার আ।’ চোখ রগড়ে দেখি হ্রদের আরেক ধারে একটা কেবিনের বাইরে পাঁচ-ছয়জন ছেলেমেয়ের জটলা। আগুন ঘিরে বসে আছে। গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। ওদের হাসির দমকে হ্রদের পানিও যেন কেঁপে উঠছে। পাশের কেবিনে এক বুড়ো তার দুই নাতিকে নিয়ে এসেছে। নাতি দুটো এমন লাফালাফি আর চিৎকার করছে যে, একটু পরপর দাদু এসে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। তাতে তাদের থোড়াই কেয়ার! আমাদের কেবিনের সামনে ছোট্ট একটা খেলার জায়গা আছে। সেখানে বাচ্চাদের জন্য ঢেঁকি, ঘোড়া, রিং ইত্যাদি রাখা। ছেলে দুটো সেখানে এসে দৌড়াদৌড়ি করছে, আবার ফিরে যাচ্ছে দাদুর কাছে। খেলতে গিয়ে ছোটটা বড়টাকে বলছে, ‘ডোন্ট বি স্কেয়ার্ড, ইথান! আই অ্যাম এ প্রফেশনাল।’ বড়টা তবুও ভরসা পাচ্ছে না রিঙয়ে ঝুলাঝুলি খেলার। ওদের কারবার দেখে কিছুক্ষণ মজা নিলাম। তারপর টিপাইয়ে মোবাইলের ক্যামেরা সেট করে অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি শুরু করলাম। আজকের ব্লগ পোস্টের ফিচার্ড ইমেজটা এভাবেই তোলা। খুব একটা ভাল বুঝা যাচ্ছে না তারাগুলো। কিন্তু যাই দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে কল্পনা করে নিন কী অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা ছিল সেটা!

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
100 %
Previous post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ২)
Next post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ৪)