মে মাসে কলোরাডো যাবো বালির বিশাল স্তূপ আর রকি পর্বত দেখতে। গিয়ে ক্যাম্পিং করবো। দুই জায়গাতেই ক্যাম্পিংয়ের জায়গা বুকিং দেওয়া শেষ। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, রকি পর্বত জাতীয় উদ্যানে ছয় মাস আগে থেকে লোকজন ক্যাম্পসাইট বুকিং দেওয়া শুরু করে। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বসে থাকলে আর উদ্যানের ভেতর ক্যাম্পিং করা লাগবে না। আমরা সেটা জানতাম না। তাই দেড় মাস আগে ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। দেখি কোনো ক্যাম্পিং সাইটই খালি নেই। যেগুলো খালি, সেগুলো আগে গেলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়। এটা বিশাল ঝুঁকি হয়ে যাবে। বুকিং ছাড়া গিয়ে যদি দেখি একটা স্পটও খালি নেই, বিপাকে পড়তে হবে। তাই উদ্যানের আশেপাশে কোথায় ক্যাম্প করা যায় খুঁজতে খুঁজতে এস্টেস পার্ক নামের একটা জায়গা পেলাম। বেশ বিখ্যাত শহর। রকি পর্বতে ঢোকার বেসক্যাম্প হিসেবে কাজ করে। এখানে দুই রাতের জন্য ভাড়া করলাম একটা ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্যাম্প সাইট। এগুলোর ভাড়া সরকারী ক্যাম্প সাইটের চেয়ে খানিকটা বেশি। তবে আমাদের আরেক গন্তব্য ‘বালির স্তূপ জাতীয় উদ্যানে’ ক্যাম্পসাইট বুকিং দেওয়া শুরু করে এপ্রিল মাস থেকে। তাই আর ভুল করলাম না। তক্কে তক্কে রইলাম কখন এপ্রিল মাস আসবে আর বুকিং দিবো। এত সাবধানতার পরও খালি জায়গা পেতে হাগা ছুটে গেলো। আমাদের মতো সুযোগ সন্ধানী নিশ্চয় আরও ছিলো! এপ্রিল আসতেই সবাই বুকিং দিতে শুরু করেছে। আমরা তাঁবুর জন্য নির্ধারিত সাইট খালি পেলাম না। রিক্রিয়েশনাল ভিইকল বা আরভি রাখার সাইটকেই তাঁবুর সাইট হিসেবে বুক করতে হলো।
ক্যাম্পসাইট তো বুকিং দিলাম, কিন্তু ক্যাম্পিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। এখন? কলোরাডো গিয়ে যদি তাঁবু হাতে বেক্কলের মতো বসে থাকি, হবে না। শুধু তো তাঁবু খাটানো নয়, ক্যাম্পিংয়ের আরও অনেক নিয়ম আছে। হাগামুতার উপায় কী, ক্যাম্পফায়ার করা যাবে কিনা (কাঠ দিয়ে ক্যাম্পে আগুন জ্বালানো), নাওয়া খাওয়ার উপায় কী, বারবিকিউ করা যাবে নাকি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতে হবে, ইত্যাদি ফ্যাঁকড়া। তাই মনোযোগ দিয়ে ইউটিউব দেখা শুরু করলাম। ভিডিও দেখে আর বই পড়ে যতটা না বুঝা যায়, ‘এসো নিজে করি’ পদ্ধতিতে তারচেয়ে ভালো শেখা যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য কোথাও ক্যাম্পিংয়ে যেতে মন চাইছে না। এমনিতেই কলোরাডো ভ্রমণে বিশাল খরচ হবে। তার আগে আরেক জায়গায় ক্যাম্পিং করলে সেটা হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। তাই কলোরাডোর উত্তেজনা মাথায় সেট করে ক্লাস করি, পরীক্ষা দিই, আন্ডারগ্র্যাডের পোলাপান পড়াই, খাতা কাটি, গবেষণা করি। কলোরাডোর খরচের কথা মাথায় রেখে দেড় মাস কোথাও ঘুরতে যাই না, তেল খরচ বাঁচাই, টাকা জমাই। কিন্তু একদিন আর থাকতে না পেরে মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘ভাল্লাগে না কলেজ স্টেশন। প্রতিদিন এক রাস্তা, এক দালান দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে গেছি।’ এই যে একবার নিজের মুখ খুললাম, আর তো বন্ধ করতে পারি না! এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার প্রিন্সের কাছে ঘ্যানঘ্যান করি, ‘ভাল্লাগে না। ভাল্লাগে না।’ বেচারা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে এক সপ্তাহের জন্য। তারপর যেই লাউ, সেই কদু। আমি ধরেই নিয়েছি কলোরাডো যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার ঘ্যানঘ্যানানি চলতে থাকবে আর প্রিন্স আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকবে। দিতে দিতে কোনোমতে মে’র তৃতীয় সপ্তাহ চলে আসবে। কিন্তু…
গেলো শুক্রবার রাতে প্রিন্স জিজ্ঞেস করলো, ‘সোমবারে কি তোমার কোনো কাজ আছে?’ প্রিন্স এই কথা জিজ্ঞেস করা মানে তার কোনো পরিকল্পনা আছে। সোমবারে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট আয়োজিত একটা ডিনার আছে। এছাড়া বাকি কাজ বাংক মারা যাবে। উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘কেনো?’ প্রিন্স বললো, ‘বাসা থেকে এক ঘণ্টা দূরে স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্য আছে। সেখানে ক্যাম্পিং করতে যাবা? রবিবারে যাবো, রাতে থাকবো, সোমবার দুপুর নাগাদ চলে আসবো।’ আমার লোভী চোখ চকচক করে উঠলো। কিন্তু আমরা না টাকা বাঁচাতে চাচ্ছি? প্রিন্স বললো, ‘টাকা বাঁচাতে গিয়ে মন খারাপ করে থাকলে তো ভালো লাগে না। তাছাড়া এটা কাছে, তেমন গ্যাস খরচ হবে না যেতে। ক্যাম্পসাইটের ভাড়াও মাত্র তিরিশ ডলার।’ থাক, আর বলতে হবে না। নাচুনে বুড়ি আমি ইতোমধ্যে ঢোলের বাড়ি শুনে ফেলেছি। তাই তাকধিনাধিন করতে করতে ক্যাম্পিংয়ের জিনিসপাতি গুছাতে লাগলাম। গত বছরের নভেম্বরে কিনেছিলাম এসব গিয়ার। এবারই প্রথম ব্যবহার করবো। খুশিতে বাঁচি না!
রবিবার সক্কাল সক্কাল বেরোনোর কথা থাকলেও গোছগাছ শেষ করতে করতে বেজে গেলো সাড়ে এগারোটা। রওনা দেওয়ার আগে একটা সেলফি তুলে পোস্ট করে দিলাম মুখবইয়ে, তারপর সাঁই করে বের হয়ে গেলাম। ব্রায়ান-কলেজ স্টেশন মেট্রোপলিটান এলাকা পার হওয়ার পর মনে হলো, আহ, শান্তি! আমরা থাকি টেক্সাসের পূর্ব-মধ্য অঞ্চলে। এখানে হালকা সবুজের ছোঁয়া আছে। কিন্তু যতই পশ্চিমে যাবেন, ততই গাছপালা কমতে থাকবে। একসময় বড় গাছ আর দেখবেন না। মাইলের পর মাইল ধরে মাটির সাথে লাগানো ছোটো ছোটো গাছ দেখলে বুঝবেন মরুভূমি শুরু হয়েছে। মরুভূমি বলতে আমি আরব দেশগুলোর বালুময় প্রান্তর বুঝতাম যেখানে শুধু ধু ধু বালুচর। যুক্তরাষ্ট্রে এসে আলাদা এক ধরনের মরুভূমি চিনেছি। এই মরুতে ঘাস জাতীয় গাছ পাবেন, পাবেন ইয়াকা আর চইয়া (yucca, cholla) নামের গুল্ম। আরও পাবেন ক্যাকটাস। গাছপালাহীন ধু ধু মরু চাইলে সেটাও পাবেন অ্যারিজোনা আর ইউটার কিছু জায়গায়। টেক্সাস থেকে ক্রমাগত পশ্চিমে যেতে থাকলে প্রথমে পড়বে নিউ মেক্সিকো, এরপর অ্যারিজোনা। এই দুটো অঙ্গরাজ্য হলো বিখ্যাত বুনো পশ্চিম বা ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট‘ টার্মের গর্বিত (?) ধারক। এরপর যেতে থাকলে পড়বে নেভাদা, ইউটা, ক্যালিফোর্নিয়া আর কলোরাডো। এগুলোকে কেউ বুনো পশ্চিমের অংশ ধরে, কেউ ধরে না। তবে টেক্সাসকে নাকি কেউই ওয়াইল্ড ওয়েস্ট বলে গণ্য করে না। আমি প্রথম প্রথম বেশ ভাব নিতাম ওয়েস্টার্ন উপন্যাসের পটভূমিতে এসে পড়েছি বলে। এখন আর সে ভাবের কিছুই বাকি নেই।
যা হোক, কথা বলছিলাম স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্য নিয়ে। সেখানে যাওয়ার পথে বড় বড় গাছযুক্ত কিছু ছায়াবীথি চোখে পড়লো। বসন্তে নতুন পাতা গজিয়ে ঝলমল করছে। একসময় গুগল জিপিএসের বেটি বললো, ‘টেক নেক্সট ফার্ম টু মার্কেট রোড।’ টেক্সাসে আসা ইস্তক ‘ফার্ম টু মার্কেট‘ রাস্তার নাম শুনছি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কৃষকদের সুবিধার জন্য এই রাস্তাগুলো বানিয়েছে। যেকোনো খামার থেকে যেন খাবার দাবার বিক্রি করার জন্য সহজে বাণিজ্যকেন্দ্র বা মার্কেটে নিয়ে আসা যায়, সেজন্য এসব রাস্তা। রাস্তাগুলো গ্রামীণ জনপদকে বিপণী কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করেছে। আমরা বেশ কয়েকটা ফার্ম টু মার্কেট রোড পার হয়ে এক ঘণ্টার ভিতর চলে এলাম কেগল ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। দুপুর দুটো থেকে চেক-ইন শুরু, কিন্তু দুটো বাজতে এখনো দেড় ঘণ্টা বাকি। প্রিন্স আগেই ভেবে রেখেছিলো এই সময়টুকু কীভাবে কাটানো যায়। তাই গাড়ি নিয়ে দৌড় দিলো আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট দূরের বিগ ক্রিক সিনিক এরিয়ায়। স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্যের একটা অংশ এই বিগ ক্রিক বা বড় খাঁড়ি। সিনিক এরিয়া বলতে যুক্তরাষ্ট্রে এমন জায়গা বুঝানো হয় যেখান থেকে আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিম এবং পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চল ঘুরার সময় দেখেছি সিনিক এরিয়াগুলো পাহাড়ের উঁচু কোনো স্থানে বানিয়ে রাখে, যেখান থেকে নিচের বনভূমি, নদী বা পাহাড়ি উপত্যকা দেখা যায়। তাই ভাবলাম বিগ ক্রিক বা বড় খাঁড়ির নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখার জন্যও নিশ্চয় উঁচু কোনো জায়গা আছে, যেখান থেকে পুরো খাঁড়ি দেখা যাবে বা খাঁড়ির বিশেষ কোনো অংশ।
সিনিক এরিয়ার পার্কিং স্পটে পৌঁছে দেখি আর মাত্র একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। আমি আর প্রিন্স গাড়ি পার্ক করে বনে ঢুকছি, এমন সময় ওই গাড়ির মালিক দুজন বন থেকে বের হয়ে এলো। বুঝা যাচ্ছে তাদের হাইকিং শেষ। অর্থাৎ এই এলাকায় আমরা একা হয়ে গেলাম। বুনো ভাল্লুকের আক্রমণে চিৎকার করে সাহায্য চাইলেও করার কেউ থাকবে না। যা হোক, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কীসের ভয়? তাছাড়া প্রতিটা বনে যেখানে ভাল্লুক বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর হাতে আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে নির্দেশনা দেওয়া থাকে কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যায়। আমরা সেসব নির্দেশ মুখস্ত করে রেখেছি, যদিও ভাল্লুকের সামনে পড়লে একটা নির্দেশও মনে থাকবে কিনা সন্দেহ। নির্ধারিত প্রবেশ পথ দিয়ে বনের ভিতর ঢুকলাম। নির্ধারিত এই কারণে যে, এখান দিয়ে হাঁটার জন্য পথ প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো চিপা দিয়ে ঢুকতে চাইলে সেখানে পথ পাবেন না, পাবেন ঝোপঝাড়। সেগুলো ডিঙ্গিয়ে হাইকিং করা ভীষণ ঝামেলার। তাছাড়া যে এলাকা দিয়ে পথ প্রস্তুত করা হয়, সেখানে বন্যপ্রাণীর উৎপাত তেমন থাকে না। কিন্তু আপনি যদি নিজের ইচ্ছেমতো হাঁটতে শুরু করেন, হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই, কেউ নিশ্চয়তাও দিতে পারবে না ওই অংশে বন্যপ্রাণীর আস্তানা আছে কিনা।
বনে ঢুকার পর প্রথমেই চোখ পড়লো একটা সাইনবোর্ডের দিকে। সেখানে চারটা ট্রেইলের কথা লেখা- লোন স্টার হাইকিং ট্রেইল, বিগ ক্রিক ট্রেইল, হোয়াইট ওক ট্রেইল আর পাইন ট্রেইল। লোন স্টার ছাড়া বাকি তিনটা ট্রেইলই খুব ছোটো। তাই লোন স্টার ধরে হাঁটবো ঠিক করলাম। ২০৬ কিলোমিটার লম্বা এই ট্রেইলের একটা অংশ পড়েছে বড় খাঁড়ি নৈসর্গিক এলাকার ভিতর। সেটার কিছু অংশ ধরে হাঁটবো। পার্কিং লট থেকে শুরু করে অর্ধবৃত্তাকার রাস্তায় হেঁটে পার্কিং লটেই ফিরে আসবো। অনেকে আছে যাদের অভ্যাস প্রতি বছর একবার করে এই ২০৬ কিলোমিটার ট্রেইল পাড়ি দেওয়া। এরকম আরেকটা কাহিনী দেখেছিলাম পেনসিলভেনিয়ায় চাকরি করার সময়। আমার অফিসের বস্ লিন্ডার পরিবারে এমন ঐতিহ্য ছিলো। তারা প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পার্কে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে হাঁটতো। লিন্ডার জামাই যখন ছোটো ছিলো, তখন তার পরিবার এই ঐতিহ্য চালু করে। সেটা সে নিজের পরিবারেও জারি রেখেছে। মজার ব্যাপার হলো, লিন্ডার দুই ছেলেমেয়ে তাদের আণ্ডাবাচ্চাসহ অন্যান্য স্টেট থেকে চলে আসে এই ঐতিহ্য পালন করতে। প্রতি বছর সবাই একত্রিত হয়ে ওই পার্কে যায়, দুইদিনের জন্য ক্যাম্পিং করে, আর ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হাইকিং করে। যা হোক, স্যাম হিউস্টন বনটা মোটামুটি সমতল। হাইকিং করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। উঁচুনিচু পথে হাইকিং করতে হলে হাতে একটা লাঠি থাকা জরুরী। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটলে কষ্ট কম লাগে। কিন্তু এখানে লাঠির দরকার নেই। তাই ঝাড়া হাত পা নিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। লক্ষ্য, সিনিক এরিয়ায় পৌঁছানো। বনের ভিতর হাঁটার সময় চোখ কান খোলা রাখতে হয় যেন বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সাবধান হওয়া যায়। কিন্তু আমার অতিরিক্ত সাবধানতা দেখে প্রিন্স বিরক্ত হয়ে ঘোষণা দিলো, আমার সাথে আর কোনো হাইকিং নয়। এটা কিছু হলো? এমনি এমনি কি প্রবাদ এসেছে, সাবধানের মার নেই? নাকি মন চেয়েছে আর জ্ঞানীগুণীরা বলেছেন, ‘Only the paranoid survive’? তারা অভিজ্ঞতা থেকে এসব প্রবচন দিয়েছেন। আর এই শর্মা সেগুলো পালন করলেই দোষ?