ইশকুলে থাকতে সমাজ বইয়ে রকি পর্বতশ্রেণীর নাম পড়েননি, এমন পাঠক আছেন কি? থাকলে এইবেলা জেনে নিন, আমাদের সময়ে আমরা সমাজ বইয়ের ভূগোল অংশে বিভিন্ন পর্বতমালার বর্ণনা পড়তাম আর সেগুলো মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাশ করতাম। আন্দেজ পর্বতমালা, রকি, কিংবা আল্পস…। কতো যে স্বপ্ন দেখেছি এগুলোতে যাওয়ার! কাঠের বেঞ্চিতে বসে মিসেস সামাদের লেকচার শুনতে শুনতে ভাবতাম, সারাজীবন কি পড়েই যাবো? কখনো কি চক্ষু মেলিয়া দেখা হইবে না? জীবনের এই পর্যায়ে এসে কিশোরবেলার স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ মিলেছে। যাচ্ছি রকি পর্বত দেখতে। রকি পর্বতমালা কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে এটা যুক্তরাষ্ট্রেও আছে, কানাডায়ও আছে। কানাডারটা পরিচিত ‘কানাডিয়ান রকি’ নামে। যুক্তরাষ্ট্রেরটার মনে হয় কোনো ডাকনাম নেই। অনেকে ডাকে শুধু ‘রকি’ বলে। উই আর গোয়িং টু দা রকিস! আমরা যাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত রকি মাউন্টেইন ন্যাশনাল পার্কে। আগামীকাল অর্থাৎ মে মাসের পনেরো তারিখে রওনা দেবো টেক্সাসের কলেজ স্টেশন থেকে। রকিতে যাওয়ার জন্য মে মাসটা একটু ঝামেলার। কেন সেটা পরে বিস্তারিত বলছি। তবে মে মাসে পরিকল্পনা করার পেছনে কারণ হচ্ছে, সেমিস্টার শেষ হওয়ার সাথে সাথে টেক্সাস থেকে বের হওয়া। জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া স্প্রিং সেমিস্টারে খুব চাপ যাচ্ছিলো। ভালো লাগছিলো না কিছুই। শেষদিকে এসে মনে হচ্ছিলো, পালানো দরকার। এক মুহূর্তও পড়ালেখা কিংবা গবেষণার আশেপাশে নয়। তাই সেমিস্টার শেষ হওয়ার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ছি। গাড়ি চালিয়ে টেক্সাস থেকে কলোরাডো যেতে ষোল ঘণ্টা, আসতে ষোল ঘণ্টা। তাই এক সপ্তাহের একটা ভ্রমণ সাজিয়েছি।

প্রস্তুতিঃ একেকজনের প্রস্তুতির ধরন একেক রকম। আমাদের বেলায় কোথায় যাবো এটা বের করাই আসল ঝামেলা। বের করতে পারলে ভ্রমণের অর্ধেক কাজ খতম। প্রথমে ভেবেছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস শহর ঘুরতে যাবো। সেখানে হলিউড স্টুডিও, ডিজনিল্যান্ড আছে। পরে মনে হলো এত টাকা খরচ করে খালি একটা শহর দেখতে যাবো? এরচেয়ে ইওসেমিতি জাতীয় উদ্যান ঘুরে আসি না কেন? হিসেব কষে দেখলাম ইওসেমিতি ঘোরা ব্যয়বহুল। ওখানে যেতে হবে বিমানে। গিয়ে আবার গাড়ি ভাড়া করতে হবে যাতায়াতের জন্য। সেটায় প্রচুর খরচ। এরচেয়ে কম খরচে আমাদের স্বপ্নের আর কোনো জায়গায় যাওয়া যায় না? হঠাৎ প্রিন্স বললো, ‘চলো, রকি মাউন্টেইন যাই। ওখানে আমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে।’ ব্যস, পেয়ে গেলাম আমাদের গন্তব্য।
আমি মনে করি, ভ্রমণের একটা অতি জরুরী অংশ হল যেখানে যাচ্ছি সে জায়গা নিয়ে গবেষণা করা। কোথায় কোথায় না গেলে ঘুরাঘুরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটা বের করা। যত জায়গায় গিয়েছি, গবেষণা করে দর্শনীয় স্থানের তালিকা এবং সে সংক্রান্ত টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে গিয়েছি। যেকোনো জায়গায় গেলে উক্ত জায়গায় প্রবেশ মূল্য, হোটেল বা এয়ার বিএনবি ভাড়া থেকে দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার ভাড়া ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। নতুবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ বলুন, যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস বলুন কিংবা নায়াগ্রা – প্রতিটা ভ্রমণের আগে অন্তর্জাল ঘেঁটে নিজেকে প্রস্তুত করেছি যেন প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলো মিস না হয়। সেসব জায়গায় যেতে হলে কেমন সময় এবং পয়সা খরচ হবে, সে ধারণা যেন পাই। ছোটো ভাই অঝরের এক পরিচিতজন বালির উপর আমার করা গবেষণা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো। পরে যখন সে ঘুরতে গিয়েছিলো, আমার গবেষণাপত্র নিয়ে গিয়েছিলো। হেহে! এবারও রকি নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। কিন্তু সেমিস্টারের চাপে পুরোদমে ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছিলো না।

রকি যেহেতু পর্বতমালা অর্থাৎ অনেকগুলো পাহাড়ের সমষ্টি, তাই এখানে দেখার অনেকগুলো পয়েন্ট আছে। মাত্র তিনদিনের চ্যাগানো ভ্রমণে সবগুলো পয়েন্টে শান্তিমত ঘুরার অবকাশ নেই। তাই কোন পয়েন্ট দেখা বাধ্যতামূলক আর কোনগুলো বাদ দেওয়া যায়, সেটাই ছিলো আমার প্রথম হিসেব। দর্শনীয় স্থানের তালিকা বানানোর জন্য আমি সবসময় সাহায্য নিই ট্রিপ অ্যাডভাইজর ওয়েবসাইটের, উইকিপিডিয়ার, অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের, ইউটিউব ভিডিওর, অল ট্রেইল অ্যাপের আর ওই জায়গা নিয়ে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধের। ইন্টারনেটে ‘ট্রাভেল গাইড ক’ (ক-এর জায়গায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের নাম) লিখে সার্চ দিলে প্রচুর ম্যাগাজিন আর্টিকেল, পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত ব্লগ পোস্ট পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্য থেকে দুই তিনটা পোস্ট পড়ে দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। আমি সাধারণত কোনো উৎস থেকে পাওয়া জায়গার ব্যাপারে বাকি উৎসগুলোর সাথে ক্রসচেক করে নিই। কিছু জায়গা থাকে যেগুলোর কথা সব উৎসেই দেখবেন। ধরে নিবেন সেগুলো অবশ্য দর্শনীয়। কিছু জায়গা কমন পড়বে না। সেগুলো তালিকায় বাড়তি হিসেবে রাখতে পারেন। সময় পেলে যাবেন, নইলে না। তবে এখানেও কথা আছে। আপনি যদি মাছ ধরা পছন্দ করেন, তাহলে নিশ্চয় ট্রেইল ধরে হাঁটাহাঁটি করার জায়গা দেখে পোষাবে না। আবার যদি হাইকিং পছন্দ করেন, তাহলে নিশ্চয় বনের মধ্যে কাঠের কেবিনে দার্শনিক হয়ে বসে থাকা পছন্দ হবে না। তাই দিন শেষে নিজের ভালো লাগা অনুযায়ী তালিকা কাস্টোমাইজ করে নিতে হয়। বেশীরভাগ উৎসেই বলা হচ্ছে বিয়ার লেক, ড্রিম লেক, হাইয়াইয়া লেক, নিম্ফ লেক, এমারেল্ড লেক, ওল্ড ফল রিভার রোড, ট্রেইল রিজ রোড, লংস পিক, কাব লেক, মিলস লেক এবং লিলি লেকে যেতেই হবে।
এবার বের করতে বসলাম কম সময় এবং টাকা খরচ করে এসব পয়েন্টে যাওয়ার জন্য কোন এলাকায় থাকলে সুবিধা হয়। আমাদের প্রথম পছন্দ উদ্যানের ভেতর ক্যাম্পিং করা। বনের ভেতর তাবু খাটিয়ে থাকার খরচ সবচেয়ে কম। রকি মাউন্টেইন জাতীয় উদ্যানে পাঁচটা ক্যাম্পগ্রাউন্ড আছে। কিন্তু আমরা যে সময় যাবো, সে সময় চারটা ক্যাম্পগ্রাউন্ডই বন্ধ থাকবে। গ্রীষ্মকাল উপলক্ষ্যে সেগুলো খোলা হবে মে মাসের ত্রিশ তারিখে। কিন্তু আমরা ঘুরতে যাচ্ছি মে’র পনেরো তারিখে। যে ক্যাম্পগ্রাউন্ড খোলা থাকবে, সেটা আগে থেকে রিজার্ভ করার উপায় নেই। ওটা ‘আগে গেলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়। যেদিন আমরা যাবো, ঐদিন গিয়ে যদি দৈবক্রমে কোনো সাইট খালি থাকে, ক্যাম্প করতে পারবো। এতো ঝুঁকি নেওয়ার চাইতে উদ্যানের বাইরে কোনো ক্যাম্পগ্রাউন্ড আছে কিনা খুঁজতে লাগলাম। রকির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেই দুটো ক্যাম্পগ্রাউন্ডের কথা লেখা – এস্টেস পার্ক আর গ্র্যান্ড লেক। দুটোর ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে মনে ধরলো এস্টেস পার্ক। এখান থেকে উপরের গন্তব্যগুলোতে যাওয়া সহজ, আবার এটার ক্যাম্পসাইটগুলো গ্র্যান্ড লেকের চেয়ে সস্তা। তাই দুই রাতের জন্য সাইট বুক করে ফেললাম।
পরিকল্পনায় নতুন সংযোজনঃ টেক্সাস থেকে রকিতে যেতে হলে আরেকটা জাতীয় উদ্যানের পাশ ঘেঁষে যেতে হয়। গ্রেট স্যান্ড ডিউন জাতীয় উদ্যান। যারা ডিউন মুভিটা দেখেছেন, তারা নিশ্চয় পাশের ছবিটা দেখে চমকে উঠছেন? আমিও উঠেছিলাম। তাই সাথে সাথে ঠিক করে ফেললাম আমাকে এখানে যেতে হবে। ‘মশলা’ বা ‘শাই হুলুদ‘-এর দেখা পেলে বর্তে যাবো। তাছাড়া আমার যুক্তরাষ্ট্রের তেষট্টিটা জাতীয় উদ্যানে ঢুঁ মারার ইচ্ছা। বালির ঢিবিতে এক রাত কাটানোর সুযোগ এলে হাতছাড়া করা উচিৎ নয়। তাই ষোল তারিখ রাতের জন্য সেখানে ক্যাম্পসাইট ভাড়া নিয়ে নিলাম। এবার উদ্যানের ভেতরেই ক্যাম্প এরিয়া খালি পেয়েছি। পর্যটকদের বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে গভীর রাতে বালির ঢিবিতে হাঁটাহাঁটি না করলে জীবন ব্যর্থ। কাকতালীয়ভাবে, আমরা যেদিন থাকবো সেদিন পূর্ণিমা পড়েছে। চাঁদের আলোতে ধূ ধূ প্রান্তরে হাঁটার জন্য উদ্যানের ভেতরে ক্যাম্পিং করাটাই সুবিধাজনক। আপনি চাইলে বেশি ভাড়া দিয়ে পার্কের বাইরের কোনো ক্যাম্পগ্রাউন্ডে ক্যাম্পিং বা গ্ল্যাম্পিং করতে পারেন।
সব পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত, প্রিন্স বললো, সে রকির পশ্চিম পাশের গ্র্যান্ড লেক শহরে এক রাত কাটাতে চায়। এতদিন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, সবই রকির পূর্বদিকে অবস্থিত এস্টেস পার্ক ঘিরে। অথচ পশ্চিম পাশের জন্য কোনোকিছু নেই। প্রিন্সের মনে হচ্ছে, গ্র্যান্ড লেকে একবার ঢুঁ না মারলে রকি ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কথা ঠিক। তাই তালিকায় যোগ হলো আরেকটা নতুন গন্তব্য। দুইদিন এস্টেস পার্কে থেকে তৃতীয় দিন আমরা যাবো গ্র্যান্ড লেকে। সেখান থেকে হাইকিং করবো ইস্ট ইনলেট ট্রেইল ধরে। এরপর ফিরবো মরার কলেজ স্টেশনে।