
এরপর পালা এলো ঘুমানোর কথা চিন্তা করার। আমরা এখনো ক্যাম্পিংয়ে অভ্যস্ত হতে পারিনি, ওস্তাদ হওয়া তো দূরের কথা। গত নভেম্বরে যখন তাড়াহুড়া করে ক্যাম্পিং গিয়ার (ক্যাম্প করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম) কিনেছিলাম, তখন স্লিপিং ব্যাগ কিনিনি। টাকার অভাবে কিনতে পারিনি। শুধু একটা কিং সাইজের এয়ার ম্যাট্রেস কিনেছিলাম। আমাদের ধারণা ছিলো ওটার উপর শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাবো। অর্থাভাবে বাতাস দিয়ে ফোলানো যায় এমন বালিশও কিনতে পারিনি। বাসায় যে বালিশ ব্যবহার করি, সেটা দিয়েই কাজ সারবো বলে পরিকল্পনা করেছিলাম। স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্যে গিয়ে ওই হাওয়াই তোষক আর ফোমের বালিশ দিয়ে কাজ হয়েছে বলে কলোরাডো গিয়েও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চাইলাম। কিন্তু কে জানতো এটা কাজ করবে না? অন্তত আমাদের সেটা বুঝার ক্ষমতা ছিলো না। যা হোক, সে কাহিনী ধীরে সুস্থে বলা হবে। আপাতত প্রস্তুতি পর্ব নিয়ে কথা কই। ভ্রমণে যাওয়ার কয়েকদিন আগে টের পেলাম হাওয়াই তোষকটা ফুটো হয়ে গেছে। কখন, কোনদিক দিয়ে কীসের সাথে গুঁতো খেয়েছে, কে জানে। অনেক পট্টি মেরেও ঠিক করা গেলো না। আবার হাওয়াই তোষক কিনলাম। এবার কিং সাইজ নয়, দুটো টুইন আকৃতির কিনলাম। কিং সাইজ ফোলাতেও সমস্যা, তাঁবুর ভিতর আঁটাতেও সমস্যা। আমরা তাঁবু কিনেছিলাম চারজন থাকার মতো সাইজের। তবুও কিং সাইজের তোষক সেখানে ঝামেলা করে। তবে তোষকটা সাথে নিয়ে নিলাম। রাতে মাটি থেকে ঠাণ্ডা উঠে আসে। তাঁবুর পাতলা আবরণ সে ঠাণ্ডা সামাল দিতে পারে না। তাই ফুটো হওয়া তোষকটা মাটিতে বিছিয়ে সেটার উপর সিঙ্গেল তোষকগুলো পাতলে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে পারবো। আমাদের একটা পাম্পার আছে যেটা দিয়ে ম্যানুয়ালি তোষক ফোলাতে হয়। দাম কম দেখে এটা কিনেছিলাম। কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে, ততো মনে হচ্ছে একটু দাম দিয়ে হলেও বৈদ্যুতিক পাম্পার কেনা ভালো। ম্যানুয়ালি ফোলাতে অনেক পরিশ্রম হয়ে যায়।

ঘুমানোর ইন্তেজাম করার পর বুঝলাম আমাদের প্রস্তুতির প্রথমার্ধ শেষ, দ্বিতীয়ার্ধের সময় চলে এসেছে। সে হিসেবে প্রথমেই ঠিক করতে হবে কোন কোন জায়গায় যাবো। অন্তর্জাল ঘেঁটে বুঝলাম রকি পর্বতমালা বিশাল ব্যাপার। একে মোট পাঁচটা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। একেক অঞ্চলের সৌন্দর্য একেক রকম, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন। ‘অঞ্চল এক’ অবস্থিত উদ্যানের পশ্চিম পাশে, গ্র্যান্ড লেক নামক শহরের কাছাকাছি। শহরটা পশ্চিম দিক দিয়ে উদ্যানে ঢুকার গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে। অঞ্চল এক বিখ্যাত পশুচারণভূমি হিসেবে। এখানে এলে প্রচুর তৃণভূমি বা গ্রাসল্যান্ড দেখতে পাবেন। সেখানে বিশাল বিশাল শিংওয়ালা হরিণ (এল্ক) ঘুরে বেড়ায়। ‘অঞ্চল দুই’ পরিচিত আলপাইন তুন্দ্রা নামে। যেসব অঞ্চলকে আলপাইন তুন্দ্রা বলে, সেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত। সেখানে সবসময় প্রচুর ঠাণ্ডা থাকে বলে বড় বড় গাছপালা জন্মাতে পারে না। এখানে দেখতে আসবেন বরফ, আর মাটির সাথে লেপটে থাকা ছোটো ঝোপঝাড়। তবে দমে যাবেন না। উইকিপিডিয়া বলছে, এখান থেকে নাকি রকি পর্বতের চরম সুন্দর কিছু দৃশ্য পাওয়া যায়!

‘অঞ্চল তিন’ হলো তেপান্তর বা wilderness, যেটা উদ্যানের উত্তর দিকে অবস্থিত। এস্টেস পার্ক নামের শহর দিয়ে অঞ্চলটায় প্রবেশ করা যায়। এই শহর রকি পর্বতের পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং পূব থেকে জাতীয় উদ্যানে ঢুকার গেটওয়ে বা বেসক্যাম্প হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এটা দিয়েই আপনাকে উত্তুরে অঞ্চলটায় ঢুকতে হবে। এই অঞ্চলে আছে প্রচুর হ্রদ আর পাহাড় চূড়া। হাইকিং করে হ্রদের পাড়ে যেতে পারেন বা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারেন। তারপর যাত্রা স্মরণীয় করে রাখতে ‘আমি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াতে পারি ঠাঁই’ গেয়ে মুখবইয়ে আপলোড করে দিন। এরপর চলে যান ‘অঞ্চল চারে’। এটা উদ্যানের মধ্যমণি বা হার্ট অফ দা পার্ক নামে পরিচিত। হাঁটাচলার জন্য সহজ সব ট্রেইল আছে এখানে। সহজে পৌঁছানো যায় এমন অনেকগুলো হ্রদও আছে। যারা প্রথমবারের মতো রকিতে আসে, তারা অধিকাংশই এ অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করে। এস্টেস পার্ক দিয়েই এখানে ঢুকতে হয়।
এবার আসুন ‘অঞ্চল পাঁচে’। এটা উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। প্রচুর ঝর্ণা পাবেন এখানে। আরও আছে উদ্যানের সর্বোচ্চ শিখর ‘লংস পিক’। যারা পর্বতারোহণ করতে ভালোবাসে, তারা লংস পিকে উঠার জন্য এই অঞ্চলে আসে। কীভাবে ঢুকবেন এই অঞ্চলে? এস্টেস পার্ক দিয়ে। এই অঞ্চল ‘ব্যাককান্ট্রি’ হিসেবেও সুপরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাককান্ট্রি বলতে বুঝায় আধুনিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো অনুন্নত এবং সহজে প্রবেশ করা যায় না এমন আদিম প্রাকৃতিক এলাকাকে। ব্যাককান্ট্রি ক্যাম্পিং বলেও একখানা চিজ আছে। সেখানে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম জিনিসপাতি পিঠের ব্যাগে ভরে আদিম এলাকাগুলোতে ঘুরতে যায়। যেহেতু ঐসব জায়গায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই, তাই পিঠের উপর ভারী ব্যাকপ্যাক নিয়ে বিশাল রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। সে ব্যাকপ্যাকও দেখার মতো জিনিস, মাইরি! যেহেতু এক ব্যাগের ভেতর আপনি তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, খাবার থেকে শুরু করে সব ধরনের সরঞ্জাম (গিয়ার) নিচ্ছেন, তাই ব্যাককান্ট্রি ক্যাম্পিংকে ব্যাকপ্যাকিংও বলে। যারা এটা করে, তাদের বলে ব্যাকপ্যাকার। জীবনে একবার হলেও আমাদের ব্যাকপ্যাকিং করার ইচ্ছে। তাই শুরু করেছি টেন্ট ক্যাম্পিং দিয়ে। এটায় অভ্যস্ত হলে, আর ক্যাম্পিংয়ের খুঁটিনাটি সব জানলে প্রস্তুতি নেবো ব্যাকপ্যাকিংয়ের। কীভাবে ব্যাকপ্যাক সাজাতে হয়, সে ব্যাপারে সুন্দর একটা ভিডিও পাবেন এখানে।

যা হোক, রকি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির পর মনে হলো প্রতিটা অঞ্চলে ঢুঁ মারা দরকার। ষোল ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে কলেজ স্টেশন থেকে রকি মাউন্টেইন যাবো। সে কষ্ট উসুল করতে হবে না? কিন্তু তালিকা বানাতে গিয়ে দেখি সব অঞ্চল কাভার করা যাচ্ছে না। মাত্র তিনদিন সময় আমাদের। এর মধ্যে যেকোনো তিনটা দিক কাভার করলে আরেকটা দিক দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক চিন্তার পর ঠিক করলাম এই সফরে উত্তর, পূর্ব আর পশ্চিম দিকে যেসব অঞ্চল পড়েছে, সেগুলো ঘুরবো। দক্ষিণ দিকের লংস পিক আরেকবার এসে কাভার করে যাবো। তখন শুধু লংস পিকে উঠার জন্যেই আসবো। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর একটা তালিকা বানালাম উত্তর, পূর্ব আর পশ্চিম দিকের বিভিন্ন জায়গার। প্রথমদিনের জন্য রাখলাম পূর্বদিকে অবস্থিত অঞ্চল চারের ছয়টা হ্রদঃ স্প্রেগ লেক, বিয়ার লেক, নিম্ফ লেক, ড্রিম লেক, এমারেল্ড লেক আর হাইয়াইয়া লেক। যদি এগুলোতে পরিব্রাজন করে শক্তি অবশিষ্ট থাকে, যাবো এই অঞ্চলেরই অন্যান্য আকর্ষণ, যেমন-অ্যালবার্টা ফলস, দা লক, টিম্বারলেইন ফলস, গ্লাস লেক এবং স্কাই পন্ডে। দ্বিতীয় দিনের জন্য রাখলাম উত্তরদিকে অবস্থিত অঞ্চল তিনের হর্সশু পার্ক আর ওল্ড ফল রিভার রোড। হর্সশু পার্ক থেকে এল্ক এবং বড় শিংওয়ালা ভেড়া (বিগ হর্ন শিপ) দেখা যায়। আর ওল্ড ফল রিভার রোড হলো কাঁকর বিছানো কাঁচা রাস্তা। এটা দিয়ে শুধু একদিকে চলাচল করা যায়। এই রাস্তা ধরে উঠে যাবো বারো হাজার ফুট উপরে, অঞ্চল দুইয়ে। এই অঞ্চলে আলপাইন ভিজিটর সেন্টার অবস্থিত। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যানগুলোর সব ভিজিটর সেন্টারের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু জায়গায় অবস্থিত। এখানে গিয়ে আলপাইন রিজ ট্রেইল ধরে হাঁটবো। আলপাইন তুন্দ্রা অঞ্চলকে উপভোগ করবো। এরপর ট্রেইল রিজ রোড ধরে গাড়ি চালাবো। ৭৭ কিলোমিটার লম্বা এই রোড খুবই বিখ্যাত। এটা উদ্যানের পূর্বদিককে সংযুক্ত করেছে পশ্চিম দিকের সাথে। আপনি এস্টেস পার্ক থেকে এই রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে গ্র্যান্ড লেক শহরে চলে আসতে পারবেন মাত্র দুই ঘণ্টায়। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, পুরো উত্তর আমেরিকার মধ্যে ট্রেইল রিজ রোডই একমাত্র পাকা রাস্তা যেটা বারো হাজার ফিট উচ্চতায় অবস্থিত হয়েও একটানা ৭৭ কিলোমিটার চলে গেছে। আর কোনো পাকা রাস্তা এতো উচ্চতায় নির্মিত হয়ে এতো লম্বা পথ একটানা চলে যায়নি। তাছাড়া পুরো রাস্তা জুড়ে অসাধারণ সব ওভারলুক বা দর্শনীয় স্থান আছে। আপনি শুধু এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়েই রকি পর্বতের বিভিন্ন এলাকার সৌন্দর্য দেখে ফেলতে পারবেন।

তো, আমাদের পরিকল্পনা হলো ট্রেইল রিজ রোড ধরে ড্রাইভ করে চলে আসবো মিলনার পাসে। এখান থেকে মহাদেশীয় জলবিভাজিকা দেখা যায়। মহাদেশীয় জলবিভাজিকা বা কন্টিনেন্টাল ডিভাইড হলো কোনো মহাদেশের উপর অবস্থিত একটা বিভাজক রেখা। ওই রেখার একপাশের জলস্রোত চলে যায় একটা সাগরের দিকে, অন্যপাশের জলস্রোত যায় আরেক সাগরের দিকে। সে হিসেবে মিলনার পাস থেকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের যে জলবিভাজিকা দেখা যায়, তার একপাশের পানির প্রবাহ চলে গেছে অতলান্তিক মহাসাগরের দিকে, আরেক পাশের প্রবাহ চলে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। মজার না? এখান থেকে যাবো উদ্যানের পশ্চিম দিকে, অঞ্চল এক-এ। এখানে এসে ইস্ট ইনলেট ট্রেইল ধরে পরিব্রাজন করবো, তৃণভূমি দেখবো। এরপর সমাপ্ত হবে আমাদের কলোরাডো ভ্রমণ।