1 0
Read Time11 Minute, 20 Second

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

আমাদের খসড়া পরিকল্পনা

ভ্রমণ সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর আমি সেটা মাইক্রোসফট এক্সেল শিটে বা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে নোট করে রাখি। কবে-কোথায় যাচ্ছি, জায়গাটা কতক্ষণ খোলা থাকে, টিকেটের মূল্য কেমন, কতো দূরত্ব পাড়ি দিচ্ছি, কতক্ষণ লাগছে যেতে, রাতে কোথায় উঠছি, কোন জায়গার পর কোন জায়গায় যাচ্ছি ইত্যাদি। এক ঝলক দেখলেই যেনো পুরো প্ল্যান পরিষ্কার হয়ে যায়। এতে ভ্রমণসঙ্গীদের বোঝাপড়ার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। তাছাড়া বিদেশ বিভূঁইয়ে যদি বাসা থেকে অনেক দূরে কোথাও কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যান, পরিবারের অন্যান্যদের পুরো প্ল্যান জানিয়ে রাখা উচিৎ। বলা যায় না কখন কোন বিপদ ঘটে। আপনি কবে কোথায় আছেন সেটা জানা থাকলে পরিবারের সদস্যরা পদক্ষেপ নিতে পারবেন। টেক্সাস এঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় কেউ যদি চাকুরি বা পড়াশোনা সংক্রান্ত কাজে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যায়, তাহলে তাকে একটা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেখানে সে বিদেশে গিয়ে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওখানেও একই কথা বলা হয়েছে। কাছের মানুষজনকে আপনার আইটিনেরারি বা ভ্রমণ পরিকল্পনা দিয়ে যান যেন আপনার কিছু হলে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। আমিও তাই আমার পরিকল্পনাকে যথাসম্ভব স্পষ্ট করে টুকে রাখি।

এবারও সবকিছু ঠিকঠাক করে আনন্দে পা দোলাচ্ছি, ওমা! রওনা দেওয়ার তিন চারদিন আগে প্রিন্স বললো, ‘অল ট্রেইল অ্যাপে রকি পর্বতের সাম্প্রতিক ছবি দেখেছো? পুরো পার্ক বরফে ছেয়ে আছে। হাইকিং করবো কীভাবে?’ শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কস কী, মুমিন? অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখি, ঠিকই। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত নাকি রকিতে তুষারপাত হয়, রাস্তাঘাট আর হ্রদগুলো ঢেকে থাকে বরফে। মে’র শেষের দিকে এসে বরফ গলে। তখন রাস্তাঘাট পরিষ্কার হয়, হ্রদে পানির দেখা মেলে। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো জানতে পারলাম, ট্রেইল রিজ রোড আর ওল্ড ফলস রিভার রোড মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে খারাপ আবহাওয়ার জন্য এ দুটো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয় আর মেমোরিয়াল ডে’র দিন খোলা হয়। মেমোরিয়াল ডে পড়ে মে’র শেষ সপ্তাহে। তার মানে আমরা যখন যাচ্ছি তখন হাইকিং তো হবেই না, পাকা রাস্তা ধরে গাড়ি চালানোও হবে না। তাহলে কী করতে যাচ্ছি ওখানে? মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বুঝলাম, ভুলটা আমারই। আমিই মে’তে রকি পর্বতের অবস্থা কেমন থাকে সেটা যাচাই বাছাই না করে পরিকল্পনা করে ফেলেছি।

তুষারাবৃত পান্না হ্রদ (এমারেল্ড লেক), ছবি – প্রিন্স

সবার আগে আমার দরকার ছিলো গুগলে ‘মে মাসে রকি পর্বতের আবহাওয়া কেমন থাকে?’ বা ‘কোন মাসটা রকিতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো?’ লিখে সার্চ দেওয়া। আমি সেটা করিনি। আমি মাতব্বরি করে একটাই সার্চ দিয়েছি – রকিতে গিয়ে কোথায় কোথায় ঘোরা যায়? এখন প্রতিদিন একবার করে অল ট্রেইল অ্যাপে ঢুঁ মারি আর ভাবি, এই বুঝি বরফ গলা হ্রদের ছবি দেখবো! কিন্তু কীসের কী? মে মাসের মাঝামাঝিতেও সব ট্রেইলে বরফ পড়ে আছে, সব হ্রদের পানি বরফ হয়ে আছে। সান্ত্বনা একটাই, হাইকাররা সেসব জায়গায় গিয়ে রিভিউ দিচ্ছে ‘অসাধারণ!’, সেই একখান দৃশ্য!’ ইত্যাদি বলে। তার মানে বরফ ছাওয়া হ্রদ আর রাস্তাও দেখার মতো একটা বিষয়? ঠিক করলাম, মন্দের ভালো হিসেবে বরফের মধ্যেই হাইকিং করবো। কখনো করিনি, তাতে কী? দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে মানুষ কতো কিছুই তো করে! আবার ভাবলাম সব বুকিং বাতিল করে জুন বা জুলাইয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু এখন বাতিল করলে মনে হচ্ছে সেই উত্তেজনা আর থাকবে না। সময়ও পাবো কিনা সন্দেহ। তাই কী আছে জীবনে? ভেবে আগের পরিকল্পনাতেই স্থির রইলাম।

হাঁটার রাস্তায় গোড়ালি সমান বরফ পড়ে আছে। কোনো কোনো জায়গায় হাঁটু অবধি ডুবে যায় বরফে। ছবি – প্রিন্স।

সঠিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান হওয়ার পর আমার রুটিন হলো একটু পর পর অন্তর্জালে ‘মে মাসে রকিতে গিয়ে কী করতে পারবো?’ লিখে সার্চ দেওয়া। অনেকে বলছে, মে মাসে রকিতে গেলে সেই মজা কারণ তখন লোকজনের ভিড় থাকে না। জুন শুরু হলেই দলবল নিয়ে সবাই হাজির হয় পাহাড়ে। ফলে গাড়ি পার্কিং করার জায়গা থাকে না, এক জায়গায় চেগিয়ে বসে মজা করে কিছু দেখার অবকাশ থাকে না। এসব পড়ে সান্ত্বনা নিই আর ভাবি, নিজের অজান্তেই মে মাসে প্ল্যান করে আই ভালা কিচ্চি। রওনা দেওয়ার একদিন আগ পর্যন্ত কোনো ধরনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলাম না। একদম সাম্প্রতিক অবস্থা দেখে ঠিক করা হবে কী করবো। আশা ছিলো মে’র চৌদ্দ তারিখ আসতে আসতে বরফ গলে যাবে। কিন্তু কীসের কী? ঐদিন যারা রকিতে ঘুরতে গেছে, অল ট্রেইলে তাদের আপলোড করা লেটেস্ট ছবি দেখে বুঝলাম আজকালের মধ্যে বরফ গলার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই যেসব জায়গায় ঘুরবো ভেবেছিলাম, সেগুলো কাটছাঁট করে লিস্টিটা চূড়ান্ত করলাম। বরফ ডিঙ্গিয়ে বেশি জায়গায় যাওয়ার শক্তি থাকবে না। তাই পূর্বপাশের ছয়টা হ্রদেই শুধু ঘুরবো। এরপর পশ্চিম পাশে যাবো, ইনলেট ট্রেইল ধরে হাঁটবো। ব্যস, আমাদের রকি পর্বত দেখা শেষ। আরেকবার শুধু ট্রেইল রিজ রোড ধরে গাড়ি চালানোর জন্য আর লংস পিকে উঠার জন্য আসতে হবে।

বালির ঢিবি জাতীয় উদ্যান (ছবি – প্রিন্স)

রকি নিয়ে মাতামাতি করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের প্রথম দর্শনীয় স্থান হবে গ্রেট স্যান্ড ডিউন জাতীয় উদ্যান। রওনা দেওয়ার আগের রাতে হঠাৎ মাথায় এলো, আমরা তো বালির ঢিবি নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই করিনি! ওখানে গিয়ে কী করবো, কীভাবে সময় কাটাবো, কোনোকিছুরই ঠিক নেই। সেই যে একবার ঘেঁটে দেখেছিলাম রাতের বেলা বালুরাশিতে হাঁটাহাঁটি করা ফরজ, ওই পর্যন্তই। তখন অবশ্য আরেকটা ব্যাপার জেনেছিলাম। পায়ে হেঁটে বালির স্তূপে উঠে সেখান থেকে পিছলা খেয়ে নিচে নামার ব্যাপারটা খুব মজার। তবে সরাসরি বালিতে নিতম্ব লাগিয়ে সেটা করা কঠিন। এর জন্য স্যান্ড বোর্ড বা স্যান্ড স্লেড নিয়ে আসতে হবে। ব্যাপারটা মনে পড়ার পর বসলাম বালির ঢিবি নিয়ে গবেষণা করতে। মে মাসের চৌদ্দ তারিখ পর্যন্ত লেখাপড়া আর গবেষণা নিয়ে এতো ব্যস্ততা গিয়েছে যে, অন্যবারের মতো এবার ভ্রমণ পরিকল্পনায় সময়ই দিতে পারিনি। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে ঘুম ঘুম চোখে গ্রেট স্যান্ড ডিউনের অফিসিয়াল পেইজে স্ক্রল করতে লাগলাম। চিন্তা করুন, কোথায় সুন্দর একটা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে তাজা শরীরে রওনা দেবো, তা না, রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে ল্যাপটপের পর্দায় তাকিয়ে আছি। সেখানে লেখা, বালুতে হাঁটাহাঁটি করার মোক্ষম সময় হলো সকালে আর বিকালে, যখন সূর্যের তেজ কম থাকে। সূর্য মাথার উপর উঠে গেলেই শেষ। গরমে বাপ-মায়ের নাম ভুলে যাবেন। তথ্যটা আমাদের বেশ সমস্যায় ফেলে দিলো কারণ এক্ষেত্রে ঘোরাঘুরির সময় সীমিত হয়ে যাচ্ছে। সকালে আর বিকেলেই যদি শুধু ঘুরতে হয়, সারা দুপুর কী করবো? আশেপাশে বনবাদাড় দেখাচ্ছে বটে, সেখানে হাইকিং করলে গরম লাগবে না? মরুভূমির বাতাস তো গরমই হওয়ার কথা। আচ্ছা যাক, ওখানে গিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো। আপাতত স্যান্ড স্লেড কোথা থেকে ভাড়া নেওয়া যায়, সেটা খুঁজি। উদ্যানের নিজস্ব কোনো দোকান নেই যেখান থেকে ভাড়া করতে পারবো। তবে উদ্যানের বাইরে ওয়েসিস নামের একটা দোকান দেখাচ্ছে। ট্রিপ অ্যাডভাইজরে বলছে, ওখান থেকেই সবাই ভাড়া করে। উদ্যানে ঢুকার মুখেই দোকানটা পড়ে। তাই ঠিক করলাম প্রথমে ওয়েসিস থেকে স্যান্ড স্লেড ভাড়া করবো, তারপর উদ্যানে ঢুকবো। একদিনের জন্য একটা স্লেড ভাড়া করতে বিশ ডলার লাগে। সমস্যা হওয়ার কথা না।

পর্ব পাঁচ

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৩)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৫)