নিউ ইয়র্ক নামটা মনে হয় আমি যুক্তরাষ্ট্রের সকল অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার শুনেছি। ছোটবেলা, বড়বেলা যাই বলুন, নিউ ইয়র্ক শহরটাকেই সবসময় সব অঙ্গরাজ্যের চেয়ে এগিয়ে থাকতে দেখেছি বিভিন্ন মিডিয়ায় (পত্রপত্রিকা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মিরা নায়ারের ‘দা নেইমসেক’ মুভি বা হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনী ‘নিউ ইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’-এর কথা। বড় হতে হতে হয়তো লাস ভেগাস, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডা ইত্যাদি নামও শুনেছি, কিন্তু নিউ ইয়র্কের সাথে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না। আমার মাথায় ‘যুক্তরাষ্ট্র আমার স্বপ্নের দেশ’ ধারণা ঢুকার পেছনে নিউ ইয়র্কের অবদান আছে। বড়দিনে নিউ ইয়র্ক শহরের সাজসজ্জা দেখে মনে হতো, এখানে এসে নিজ চক্ষে লাল নীল মরিচবাতিগুলো দেখতে না পারলে আর কীসের জীবন? বিশেষ করে প্রিয়াংকা চোপড়া আর রণবীর কাপুর অভিনীত ‘আনজানা আনজানি’ দেখে নতুন করে নিউ ইয়র্কের প্রেমে পড়েছিলাম। এই মুভি নির্মিত হয়েছিলো ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারকে কেন্দ্র করে। এসময় নিউ ইয়র্কে কী ঘটে, এর অলিতে গলিতে কেমন মজা হয়, সেটা খুব আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। সেটা দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো, নিউ ইয়র্ক না দেখে মরা যাবে না। আহ! সে কী প্রেমের শহর। কিন্তু লাইফ যেহেতু সাক্স, তাই যুক্তরাষ্ট্রে আসার চার বছরের মধ্যেও নিউ ইয়র্ক শহরে যাওয়া হয়নি। ফাঁকতাল দিয়ে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ইথাকা শহরে ঘুরে এলাম, অথচ স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়া হলো না। ও হ্যাঁ, ‘নিউ ইয়র্ক নিউ ইয়র্ক’ বলে চেঁচালেও আমরা যাকে নিউ ইয়র্ক বলে চিনি, সেটা আসলে ‘নিউ ইয়র্ক সিটি’ বা সংক্ষেপে NYC. নিউ ইয়র্ক বললে পুরো অঙ্গরাজ্যকে বুঝায়। আমি অনেক বছর অবধি জানতাম না যে, নিউ ইয়র্ক আস্ত একটা অঙ্গরাজ্য আর নিউ ইয়র্ক সিটি সেই অঙ্গরাজ্যের একটা শহর মাত্র। হাহাহা!

যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিউ’ উপসর্গ যোগ করে যতো জায়গার নাম আছে, বেশিরভাগই মূলত ইউরোপের বিভিন্ন জায়গার নাম থেকে এসেছে। যেমন, ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহর থেকে এসেছে ‘নিউ ইয়র্ক’ নামটা। আবার ইংল্যান্ডেরই হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির নামানুসারে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের নাম। এইভাবে নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের নাম এসেছে ইংলিশ চ্যানেলে অবস্থিত জার্সি দ্বীপ থেকে। নিউ অরলিন্স অঙ্গরাজ্যের নাম হয়েছে ফ্রান্সের অরলিন্স শহরের নামানুসারে। তাই নিউ শব্দটা মূল জায়গার নামের আগে আলাদাভাবে লেখা হয়। তবে নিউ মেক্সিকো নামটা ব্যতিক্রম। এটা এসেছে মেক্সিকো থেকে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল একটা অংশকে ১৬১৬ সালে নিউ ইংল্যান্ড নাম দেওয়া হয়েছিলো। সে অঞ্চল পরে ছয়টা অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত হয়। কিন্তু এখনও নিউ ইংল্যান্ড বললে মানুষ কানেটিকাট, মেইন, ম্যাসাচুসেটস, নিউ হ্যাম্পশায়ার, রোড আইল্যান্ড আর ভারমন্ট নামের ছয়টা অঙ্গরাজ্যকে বুঝে।
মুফতে জ্ঞান দিয়ে বেশ পণ্ডিত পণ্ডিত লাগছে। এইবার মূল প্রসঙ্গে যাই। আপনারা তো জানেনই টানা কয়েকমাস বেড়াতে না গেলে আমার ছটফট লাগে, মনে হয় সময় চলে যাচ্ছে অথচ জীবনটা উপভোগ করা হচ্ছে না। তাই সবসময় ঘোরাঘুরির উপর থাকতে চাই। ভাবছেন টাকা কোত্থেকে পাই? আমরা দুজন অনেক চেপে চলি। আমাদের বাসায় কোনো খাট নেই, বোকাবাক্স নেই, ডিশের চ্যানেলের জন্য পয়সা দিতে হয় না, মদ সিগারেট খাই না, নাইট ক্লাবে যাই না, বাইরের খাবার কম খাই। মোট কথা, সম্ভাব্য সব জায়গায় টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করি। যখন বছরে পঞ্চাশ হাজার ডলার উপার্জন করবো, তখন নাইট ক্লাবে গিয়ে টেকিলা শট মারবো নে। আপাতত সে ইচ্ছা কফিনবন্দী করে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছি। অনুগ্রহ করে ভুল বুঝবেন না। যারা খাটে ঘুমিয়ে, ধূমপান এবং মদ্যপান করে, নাইট ক্লাবে গিয়ে জীবন উপভোগ করতে চান, তাদেরকে আমি কোনোমতেই অপমান করছি না। আমার কথা হলো, যে যেভাবে জীবনকে আনন্দময় করতে পারে। কেউ যদি ৩৬৫ দিন বাসায় বসে কম্পিউটারে গেইম খেলে জীবনকে সার্থক মনে করে, কেন নয়? তার কাছে ওটাই সর্বোচ্চ সুখ। তেমনি আমার কাছে সুখ মানে ঘুরে বেড়ানো আর মজার মজার খাবার খাওয়া। আমি পয়সা জমাই এগুলো করার জন্য। আপনার কাছে যদি নতুন মডেলের গাড়ি আর মোবাইল কেনা মানে জীবনকে উপভোগ করা হয়, আপনি সেটা কেনো করবেন না? যা হোক, বলছিলাম যে ঘোরাঘুরি করতে না পেরে আমার হাঁসফাঁস ধরে গেছে। আমাদের শেষ ভ্রমণ ছিলো এই বছরের মে মাসে, কলোরাডোতে। এক ধাক্কায় কাপুলিন আগ্নেয়গিরি, গ্রেট স্যান্ড ডুন আর রকি পর্বতমালা দেখে ফেলেছি। এরপর প্রায় চারমাস ঘরে বসে আছি। মানুষ ঘুরতে যায় যেন তাজা মন নিয়ে কাজে ফিরতে পারে। আমি ভ্রমণ থেকে ফেরার পরও কাজে মন দিতে পারি না। খালি ভাবতে থাকি “কেন ফিরে এলাম? কাজকর্ম ভালো লাগে না।” তাই পরবর্তী ভ্রমণের জায়গা ঠিক না করা পর্যন্ত আমার অসহ্য লাগতে থাকে। একটা গন্তব্য ঠিক করে সেটার লোভে লোভে আমি গবেষণা করি, ক্লাস করি, ক্লাস নিই, খাতা দেখি।

যুক্তরাষ্ট্রে ফল সিজন শুরু হলেই সবার বেশ খুশি লাগতে থাকে, কারণ আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের ভেতর বেশ কিছু ছুটি পাওয়া যায়। ফল ব্রেক, থ্যাংকসগিভিং ব্রেক, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার। বেশিরভাগ মানুষই এসব ছুটিতে কোথাও না কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তবে পিএইচডি শিক্ষার্থী হলে আলাদা কথা। তারা চিন্তা করে কীভাবে এই বিরতির মধ্যে পেপার লেখা যায়, লিটারেচার সার্চ করা যায়, গবেষণা আরেকটু এগিয়ে নেওয়া যায়, এসাইনমেন্ট শেষ করা যায়। এই যেমন অক্টোবরের দশ আর এগারো তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফল ব্রেক দেওয়া হয়েছে। শনি, রবি তো এমনিতেই ছুটি। কিন্তু এরপর সোম আর মঙ্গল মিলিয়ে টানা চারদিন ছুটি। সে ছুটির ভেতর কোয়ালিটেটিভ মেথডস কোর্সের অধ্যাপক বেশ কিছু এসাইনমেন্টের ডেডলাইন গছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সাথে সাথে এক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করে উঠলো, “না! ছুটিতে কোনো ডেডলাইন দেওয়া যাবে না। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ অফিসিয়াল ইমেইল দিয়েছে যে, এই ছুটি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য দেওয়া হয়েছে। ডেডলাইন থাকলে সবাই চাপের মধ্যে থাকবো, ছুটি দেওয়া কারণটা ব্যর্থ হবে।” ওই মেয়ের পর আরও অনেকেই প্রতিবাদ করে উঠলো। শেষে অধ্যাপক হার মানলেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেকগুলো ভালো দিকের একটা। শিক্ষক নিজের ইচ্ছেমত কিছু চাপিয়ে দিতে গেলে প্রতিবাদ করে সেটা পাল্টানোর সুযোগ আছে। যা হোক, পিএইচডি শিক্ষার্থী হয়েও আমি কাজে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কাজকর্মের গুষ্টি কিলিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যাই। কে যেন বলেছিলো, পিএইচডিতে যতো কাজ শেষ করবে, ততোই নতুন নতুন কাজ বের হবে। তাই কাজ চলা অবস্থায়ই নিজেকে বিনোদন দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে হবে। আমিও তাই করি।

এবারও ভাবছিলাম বড়দিনের ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়। প্রথমে ভাবলাম অ্যারিজোনা আর ইউটা থেকে ঘুরে আসি। এরপর ভাবলাম ক্যালিফোর্নিয়া যাই। তারপর ঠিক হলো ফ্লোরিডা। কিন্তু কোনোখানেই মনঃপুত হচ্ছে না। মানে ক্লিক করছে না। শেষে হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাবো। অনেক বছর ধরে নিউ ইয়র্কে ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার পালন করার স্বপ্ন দেখছি। নিউ ইয়ার ইভে টাইমস স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সেই বিখ্যাত বল ড্রপ দেখবো বলে ২০১৮ সাল থেকে লাফাচ্ছি। কিংবা রকেফেলার প্লাযার বিখ্যাত বড়দিন বৃক্ষ। কিংবা ব্রুকলিন ব্রিজ আর স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কতকিছু দেখার আছে! আরও আছে আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরি, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট, মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট। মাদাম তুসো জাদুঘরে যাওয়ার শখ আমার নেই। কিন্তু অনেকের কাছে ওটাও একটা আকর্ষণ। আমি আরও দেখতে চাই ফিফথ এভিনিউ আর সেন্ট্রাল পার্ক, করতে চাই উইন্ডো শপিং। আর যদি সুযোগ পাই তাহলে রকেফেলার সেন্টারে করতে চাই আইস স্কেটিং। খেতে চাই অথেনটিক বাংলাদেশী বিরিয়ানি, গরুর রেজালা আর সর্ষে ইলিশ।
আচ্ছা, এখন থামি। উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি কল্পনা করে। উত্তেজনার মাথায় আরও বেশি বকর বকর করার আগেই বিদায় নিই। পরিকল্পনা করতে থাকি কবে কোথায় যাবো।