0 0
Read Time20 Minute, 51 Second

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের মিসিসাগা শহর থেকে খানিক দূরে অবস্থিত একটা ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। যাবো নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। এই স্টেশনেরই কোনো এক চিপা থেকে নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে। আমি মাত্র ট্রেন থেকে নেমেছি। বাস খুঁজে পাওয়ার জন্য হাতে আছে আর পাঁচ মিনিট। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা একটা হলঘর। কিন্তু সেটার আশেপাশে কোনো বাস স্টেশন খুঁজে পাচ্ছি না। মাথার উপর নির্দেশনামূলক কোনো সাইনবোর্ডও দেখছি না। একটু দূরে কাঁচের দেওয়াল ঘেরা একটা খুপরির মধ্যে ইউনিফর্ম পরিহিত একজন অফিসার বসে আছেন। উনার কাছেই দৌড়ে গেলাম। “এক্সকিউজ মি! আমি নায়াগ্রা ফলসের বাস ধরতে চাচ্ছি। কোথা থেকে ছাড়ে বলতে পারেন?” অফিসার হাসি মুখে বললেন, “আপনার পেছনে যে গেট আছে, সেটা দিয়ে বের হলেই বাস স্টপেজ।” তাকিয়ে দেখি কয়েক পা দূরে একটা কাঁচের গেট। দেখে বুকে বল ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, “বাসের টিকেট কীভাবে কাটবো?” অফিসার বললেন, “বাসের ওয়েবসাইটে ঢুকে কাটতে হবে।” আমি মোবাইল দিয়ে খুপরির দেওয়ালে টাঙানো কিউআর কোড স্ক্যান করে ওয়েবসাইটে ঢুকতে চাইলাম, পারলাম না। আমেরিকান মিন্ট মোবাইলের নেটওয়ার্ক কানাডায় কাজ করছে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার আগে আমি পইপই করে খোঁজ নিয়েছিলাম। নিশ্চিত হয়ে এসেছিলাম যে, মিন্ট মোবাইল কানাডায় কাজ করে। নিউফাউন্ডল্যান্ড অ্যান্ড ল্যাব্রাডরের মতো প্রদেশে কাজ না করলেও অন্টারিওতে করে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে মুসিবতে পড়েছি। অফিসারকে প্রশ্ন করলাম, “এখানে কোনো বুথ নেই সরাসরি টিকেট কেনার?” অফিসার মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, “না।” বুকে যেটুকু বল ফিরে এসেছিলো, সুড়ুৎ করে চলে গেলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার প্রেস্তো কার্ড আছে। ওটা দিয়ে কাজ হবে?” অফিসার মাথা ঝাঁকালেন, “হ্যাঁ।” প্রেস্তো কার্ড হলো কানাডার গণপরিবহনে (বাস, ট্রেন) ভ্রমণের পাস। সব প্রদেশে কাজ করে কিনা জানি না। তবে অন্টারিওতে যে করে, এটুকু জানলেই আমার চলবে।

হাসিমুখো অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে এক দৌড়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম। উনার হাসিমুখ দেখে বড় ভালো লেগেছে। প্রতি কথায় হাসি। গেটের বাইরে এসে দেখি বড়সড় লাইন তৈরি হয়েছে নায়াগ্রার বাসের জন্য। কোনো ধাক্কাধাক্কি নেই, কে কার আগে যাবে সে নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই। যারা নতুন আসছে,  পটাপট লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমিও গেলাম। লাইনের শেষে একটা তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। তরুণ না বলে কিশোর হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কৈশোর পার হয়ে সদ্য তারুণ্যে পা দিয়েছে, এমন। ভীষণ চিকন আর খাড়া খাড়া চুল বিশিষ্ট তরুণ। আমি নিশ্চিত ও ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এসেছে। চার বছরের আমেরিকান জীবনে প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় মানুষ দেখেছি। তাই ওই এলাকার মানুষ দেখলে হালকা ঠাহর করতে পারি। ছেলেটা এক মনে মোবাইল টিপছে। ওর সাথে কথা বলা যাবে কিনা বুঝতে পারলাম না। চোখাচোখি হলে চোখের ভাষা পড়তে পারতাম। অনেকের চোখে লেখা থাকে, “আমাকে বিরক্ত করিবেন না।” আবার অনেকে বন্ধুত্বপূর্ণ চাহনী দেয়। কিন্তু অতকিছু ভাবার সময় আমার নেই। আমি কুছ পরোয়া নেহি ভাব ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “কতক্ষণ ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছো?” ছেলেটা মোবাইল থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। খাঁটি ক্যানাডিয়ান টানে বললো, “এই তো, পাঁচ মিনিট।” খাইছে! এ তো সাহেব সুবো। আমার মতো ভাঙা ভাঙা ইংরেজি মারাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী? আমার যেহেতু ঠ্যাকা পড়েছে, ভাঙা ইংরেজি দিয়ে কথা বলতেও আপত্তি নেই। বললাম, “আমার জায়গাটা একটু ধরে রাখবে? আমি ওয়াশরুমে যাবো।” ছেলেটা হেসে ফেললো। এইরকম আবদার মনে হয় শুধু উপমহাদেরশের লোকজনই করে। হেসে মাথা ঝাঁকালো। আমি দৌড় দিয়ে আবার গেটের ভিতরে ঢুকলাম। অফিসারের খুপরির পাশেই গণ শৌচাগার। সেখানে গিয়ে দ্রুত কাজ সারার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষণ ধরে ছোটো বাথরুম আটকে রেখেছি। এখন না করলে আরও দেড় ঘণ্টা বাথরুম চেপে বসে থাকতে হবে বাসে।

কাজ সেরে আবার লাইনে এসে দাঁড়ালাম। এখনও বাস আসেনি। ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “বাস তো দুইটায় ছাড়ার কথা ছিলো। এখন বাজে দুইটা দশ।” ছেলেটা হালকা হাসলো, “হ্যাঁ। বাস আসতে দেরী হচ্ছে।” ওর হাসি দেখে জড়তা কিছুটা কাটলো। বললাম, “আমি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নায়াগ্রা ফলস দেখেছি। এবার দেখতে এসেছি কানাডারটা।” ছেলেটা বললো, “আমি কোনোটাই দেখিনি। এই প্রথম দেখতে যাচ্ছি কানাডারটা।” এরপর আমাদের কথা ফুরিয়ে গেলো। ছেলেটা মোবাইল টেপাটিপিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, আমি দেখতে লাগলাম লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে। দুটো মেয়ে নিজেদের মধ্যে হইহই করে কথা বলছে। মনে হয় অনেকদিন পর দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে। উচ্ছ্বাস চাপিয়ে রাখতে পারছে না। এক মা তার তিন কন্যাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটা মেয়েই পিচ্চি পিচ্চি। বড়টার বয়স ছয় বা সাত, মেঝোটার তিন বা চার আর ছোটোটার এক বা দুই। বড় মেয়েটা খবরদারি করছে ছোটো দুটোর উপর, মেঝোটা কথা বলে ব্যতিব্যস্ত রাখছে একদম পিচ্চিটাকে, আর মা চোখে চোখে রাখছে তিন মেয়েকে। ডিভিশন অফ লেবার। লাইনে চৈনিক, ভারতীয়, মার্কিনী, ক্যানাডিয়ান সব দেশের মানুষই আছে। সবাই দেখতে চায় মাইটি নায়াগ্রা। বাস যদি দুটোয় ছাড়তো, নায়াগ্রা যেতে যেতে বাজতো সাড়ে তিনটা। দুই ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে ফিরতি বাস ধরে রাত নয়টা নাগাদ মিসিসাগাতে চলে আসতে পারতাম। কিন্তু বাস এখনও এলো না। বাজে দুইটা পনেরো।

বকবক করতে থাকা মেয়ে দুটো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, “ওই তো, বাস এসে গেছে!” ওদের কথা শুনে সবাই সামনে তাকালো। হ্যাঁ, নায়াগ্রা যাওয়ার বাসটাকে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে স্টেশনে। অপেক্ষা করতে করতে লাইনটা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। এখন নড়েচড়ে উঠলো। বাস এসে আমাদের সামনে দাঁড়াতেই সবাই উঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পেরেছে, অথচ এখন এক মিনিটও তর সইছে না। আমিও প্রেস্তো কার্ড চেপে বাসের ভিতরে ঢুকলাম। দুইতলা বাস। ঠিক করলাম উপরের তলায় বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাবো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দেখলাম ভারতীয় ছেলেটাও উঠছে। উপরে উঠে দেখি সামনের দিকের সব আসন দখল হয়ে গেছে। একদম সামনের সিটে বসলে সেই একটা ভিউ পাওয়া যায়। তাই ওই চারটা দখল হয়ে যায় সবার আগে। আমি মাঝের দিকে একটা সিট খুঁজতে লাগলাম। যেটা পছন্দ হলো, সেটায় বসতে গিয়ে দেখি আমার ঠিক পেছনের সিটে বসে আছে ছেলেটা। কানে হেডফোন গুঁজে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এখন যদি ভাবে আমি ওর পিছু পিছু এসে এই সিটে বসেছি, ব্যাপারটা ভালো হবে না। কিন্তু কী আর করা! ও কী ভাববে না ভাববে সেটা ভেবে তো আমি আমার পছন্দের আসন বিসর্জন দিতে পারি না। তাই জানালা লাগোয়া সিটে গিয়ে বসলাম। বাইরে বেশ গরম ছিলো। কিন্তু বাসের ভেতর হিম হয়ে আছে। ফুলহাতা একটা টিশার্ট পরে এসেছি। ওটা দিয়েই ঠাণ্ডা সামাল দিতে হবে।

বাস স্টেশন থেকে নায়াগ্রা দেড় ঘণ্টার রাস্তা। ভেবেছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ফুড়ুৎ করে সময় চলে যাবে। কিন্তু ঠাণ্ডার কারণে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি না। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আকাশ কালো হয়ে এসেছে। বৃষ্টি হলে বাসের ভেতর আরও ঠাণ্ডা লাগবে। আমার নায়াগ্রা ভ্রমণও কেঁচে যাবে। চিন্তাগুলো মাথায় আসতেই মন খারাপ হয়ে গেলো। তাই সেগুলো মাথা থেকে তাড়িয়ে বর্তমানকে উপভোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। বিশাল এক হ্রদ ঘেঁষে বাস চলছে। অন্টারিও হ্রদ। পাঁচটা গ্রেট লেকের একটা। এই পাঁচ হ্রদ দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি স্বাদু জল ধরে রেখেছে। পাঁচটাই অবস্থিত কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের ভিতর। এর আগে আমি আর প্রিন্স ইরি হ্রদ ভ্রমণ করেছি। এবার দেখছি অন্টারিও হ্রদ। বাকি থাকলো সুপিরিয়র, মিশিগান আর হিউরন। অন্টারিও হ্রদের তীর ঘেঁষে ভীষণ সুন্দর সব বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। লেক ইরির ধার ঘেঁষেও ছবির মতো সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখেছিলাম, আর দেখেছিলাম আঙুর ক্ষেত। বেশিরভাগ বাড়ির সাথেই কয়েকটা করে আঙুর ক্ষেত। দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম টাকাপয়সা হলে আমরাও ইরির পাদদেশে বাড়ি বানাবো, আঙুরের চাষ করবো। আহ, সেই স্মৃতি! রোমন্থন করতে করতে দেখি ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাইওয়ে ধরে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বাস চলছে। বৃষ্টির ছিটে পড়ে দুই পাশে থাকা সবুজ গাছ আর ঘাসগুলো আরও সবুজ হয়ে উঠেছে।

দেড় ঘণ্টা ধরে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাস ভ্রমণ শেষ করলাম। নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে বেশ দূরের এক স্টপেজে এসে বাস থামলো। এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে না বলে বেঁচে গেলাম। বাস থেকে নেমে সবাই খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। সবাই ভেবেছিলো বাসটা একেবারে নায়াগ্রা পর্যন্ত যাবে। কিন্তু যেখানে নামালো, এখান থেকে কীভাবে নায়াগ্রা যেতে হবে কেউ বুঝতে পারছে না। কোনো দিক নির্দেশনা নেই। শুধু বাস নাম্বার সম্বলিত ছোট্ট একটা লিফলেট ঝুলছে ওয়েটিং এরিয়ায়। কতো নাম্বার বাস নায়াগ্রার কোন অংশে যায়, সেটা। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছি না কোন বাসটা মূল নায়াগ্রায় যায়। আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিনটা মঙ্গোলয়েড চেহারার মেয়েও ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছে। ওদের জিজ্ঞেস করলাম কিছু বুঝেছে কিনা। তিনজনই “নো নো” বলতে বলতে কই যেন চলে গেলো। কী যন্ত্রণা! এমন সময় ছেঁড়াফাটা জিন্স পরা আর দাড়িমোছের জঙ্গলওয়ালা এক লোক এগিয়ে এলো। সে হাতে দিয়ে একটা দ্বিচক্রযান ঠেলছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “নায়াগ্রা যেতে চাও?” আমি ধন্দে পড়ে গেলাম। এই লোককে কি বলা ঠিক হবে কোথায় যেতে চাই? যদি আমাকে অনুসরণ করে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়? দেখে তো উদ্বাস্তু মনে হচ্ছে। কিন্তু যে গ্যাঁড়াকলে পড়েছি, এখন আমার সাহায্য দরকার। লোকটা যদি উপায় বাৎলাতে পারে এই ভেবে বললাম, “হ্যাঁ। কিন্তু বুঝতে পারছি না কীভাবে যাবো।” লোকটা হাসলো। বললো, “হেঁটে যেতে পারো, কিন্তু তাতে এক ঘণ্টা লাগবে। ট্যাক্সি নিতে পারো, অনেক টাকা যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় সাইকেলে করে গেলে। আমিও সাইকেলেই যাই। কিন্তু একটু আগে চাকা পাংচার হয়ে গেছে।” আমিও হাসলাম।

আমাদের বাসের অনেকে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একসময় দেখি রাগে গজগজ করতে করতে ওই মা তার তিন কন্যাকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। একটা মেক্সিকান পরিবার উবার ডেকে সেটায় উঠে পড়লো। বাকিরা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর অমাবশ্যার চাঁদের মতো একটা বাস এলো। ওটা থামতেই সবাই হুড়মুড় করে দৌড়ে গেলাম। কিন্তু চালক বললো, “আমি নায়াগ্রায় যাই না। অমুক নাম্বার বাস ধরো।” সবাই আবার বিরস বদনে ওয়েটিং এরিয়ায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে আসার পর আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত নায়াগ্রায় যাওয়ার উপায়টাই বুঝলাম না। একটু পর ভারতীয় ছেলেটাকে চোখে পড়লো। কাদের সাথে যেন খুব গল্প জুড়ে দিয়েছে। ওকে দেখে শান্তি লাগলো। মনে হলো দূর পরবাসে আপনজনের দেখা পেয়েছি। এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে ছেলেটা হাত নাড়লো। তারপর আবার গল্পে ডুবে গেলো। অপর পক্ষ হচ্ছে এক জোড়া দম্পতি। ওরা বলছে, “আমরা প্রতি সপ্তাহে নায়াগ্রায় আসি জুয়া খেলার জন্য। অনেক ভালো ভালো ক্যাসিনো আছে এখানে।” ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, “এখান থেকে কোন বাসে করে নায়াগ্রা যাও?” নারীটা উত্তর দিলো। আমি আর নড়লাম না। ওই ছেলের সাথেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ছেলেটা যে বাসে উঠবে, আমিও সেটায় উঠবো। ওর বন্ধুরা নাকি অব্জারভেশন ডেকের সামনে অপেক্ষা করছে। ওকে সেখানে যেতে হবে। ঠিক করলাম ওর সাথে অব্জারভেশন ডেকে চলে যাবো। ওখান থেকে মূল ফলস খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ার কথা না।

একটু পর যে বাসটা এলো, সেটার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা। ছেলেটা দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক দৌড়ে বাসে উঠে পড়লো। ওর পিছু পিছু আমিও উঠলাম। পনেরো থেকে বিশ মিনিট পর বাস যেখানে থামলো, সেখানে হুড়মুড় করে অনেক যাত্রী নেমে পড়লো। আমি ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখছি। ও নামতেই আমিও নেমে পড়লাম। ছেলেটা আমাকে দেখে বললো, “তুমি আমার সাথে অব্জারভেশন ডেক পর্যন্ত যেতে চাও?” আমি মাথা ঝাঁকালাম। ছেলেটা হাসি মুখে বললো, “চলো।” তারপর ভিড়ের মধ্যে দুজন হাঁটা শুরু করলাম। বাস নামিয়ে দিয়েছে কোলাহলপূর্ণ এক এলাকায়। দঙ্গল দঙ্গল মানুষ হাঁটাচলা করছে। বুঝলাম নায়াগ্রা খুব কাছেই। একেবারে চুপ থাকলে অস্বস্তি লাগে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি টরোন্টোতে থাকো?” ছেলেটা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। আমি অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর করছি।” জানতে চাইলাম, “কতদিন ধরে আছো কানাডায়?” ছেলেটা বললো, “দুই বছর হলো। তুমি?” আমি আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলাম। তারপর জানতে চাইলাম, “এখানে আসার আগে কোথায় ছিলে?” ছেলেটা বললো, “ব্যাঙ্গালোরে। আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা ওখানেই।” মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। ওকে দক্ষিণ ভারতীয় ভেবে তাহলে ভুল করিনি। হঠাৎ ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিলো, “আমি আশীষ।” করমর্দন করে বললাম, “আমি নির্ঝর।”

হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখি অব্জারভেশন ডেকের সামনে চলে এসেছি। সাথে সাথে একটা ছেলে এসে হইহই করে জড়িয়ে ধরলো আশীষকে। প্রথমে বেচারা আমাকে খেয়াল করেনি। কিন্তু যখন দেখলো আশীষের পাশে আমি দাঁড়িয়ে, একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আশীষ ওর বন্ধুকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। বন্ধুটা একটু দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো মনে হয়। একবার আমার দিকে, আরেকবার আশীষের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো। খেয়াল করলাম কয়েক পা দূরে আরও দুটো ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। আশীষ কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললো, “নির্ঝরের সাথে পরিচয় হয়েছে নায়াগ্রায় আসার পথে। সে এক কাহিনী বটে!” বন্ধুটা “ও হো হো হো” করে ক্যাবলাকান্ত মার্কা একটা হাসি দিলো। তারপর পিছে তাকিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে ডাক দিলো। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে আশীষের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ওদের আজকের মোলাকাত। মেয়েটা লাজুক হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলো। আশীষও দেখলাম গলা খাঁকারি দিলো। নার্ভাস হয়ে গেছে বোধহয়। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি না হয়ে আশীষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলাম। হর্নব্লোয়ারে উঠার জন্য টিকেট কাটতে যাবো। এটা একটা ক্রুজ। আমাকে নিয়ে যাবে জলপ্রপাতের একদম কিনারে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে উঠেছিলাম মেইড অফ দা মিস্টে, ক্যানাডায় এসে উঠবো হর্নব্লোয়ারে।

টিকেট কাউন্টারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আশীষের সাথে মেয়েটার চোখাচোখি হওয়ার দৃশ্য মনে করে হেসে ফেললাম। দুটো মানুষের পরস্পরকে চেনাজানার সময়টুকু কতই না রোমাঞ্চকর, কতই না উপভোগ্য! আশা করি ওদের একটা সুন্দর সময় কাটবে। সম্পর্ক হোক বা না হোক, আজকের সময়টুকু অসাধারণ কাটুক ওদের।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ১৬ (ভিন্ন আঙ্গিকের কিছু কথা)
Next post পারফিউম বা সুগন্ধিঃ বিস্ময়কর এক জগত (পর্ব ১)