1 0
Read Time14 Minute, 48 Second

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব শেষ হয়েছিলো পারফিউমের গন্ধ নিয়ে বকবক করতে করতে। সেখানে একটা মজার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। পারফিউমের গন্ধ দুইভাবে শরীরে সেট হতে পারে। সরলরৈখিকভাবে (linear) এবং একাধিক ধাপে (non-linear)। লিনিয়ার মানে হলো, পারফিউম স্প্রে করার পর প্রথমে যে গন্ধটা পাবেন, শেষ পর্যন্ত সেটাই বজায় থাকবে। কিন্তু একাধিক ধাপের গন্ধওয়ালা পারফিউমের বেলায় বিভিন্ন ধাপে গন্ধ বদলাতে থাকবে। অনেকে লিনিয়ার পছন্দ করে কারণ এতে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন সারাদিন ধরে আপনার গা থেকে কেমন গন্ধ বের হতে থাকবে। কিন্তু ধাপবিশিষ্ট পারফিউমের বেলায় খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকে। গায়ের মাখার পর গন্ধ বদলাতে থাকে। বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রথম পর্বে দেওয়া উদাহরণগুলো পড়ে আসতে পারেন। যেকোনো পারফিউম যখন প্রথম স্প্রে করবেন, তখন দেখবেন ঝাঁঝালো গন্ধ বের হয়। এলকোহলের কারণে এই ঝাঁঝালো গন্ধ আসে। এরপর কিছু সময় যেতে দিন। পারফিউম যখন আস্তে আস্তে খুঁটি গাড়ে আপনার জামায় বা চামড়ায়, তখন পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে। সেটা হতে পারে আপনার শরীর থেকে বের হওয়া ঘাম বা পরিবেশে থাকা আর্দ্রতা। বিক্রিয়ার পর গন্ধ হয়ে যায় অন্যরকম। যতো সময় যাবে, আপনি প্রথমে পাওয়া সেই গন্ধ আর খুঁজে পাবেন না। একসময় দেখবেন চিকন গন্ধ সরে গিয়ে ভোঁতা একটা গন্ধ বের হচ্ছে। সেটা আপনার কাছে সুন্দরও লাগতে পারে অথবা বাজে। অনেক পারফিউম গায়ে ঠিকমতো বসার পর ভীষণ সুন্দর গন্ধ দেয়। আবার কিছু সুগন্ধি আছে যেগুলো বসার পর আর ভালো লাগে না। প্রাথমিক গন্ধটাই সবচেয়ে সুন্দর লাগে। তাই পারফিউম কেনার সময় প্রাথমিক গন্ধ শুঁকেই কিনে ফেলা ঠিক নয়। দোকানে যান, টেস্টারে সুগন্ধি মাখিয়ে বা আপনার কব্জিতে (তালুর উল্টোদিকেও হতে পারে) মাখিয়ে সারাদিন থাকুন। প্রতি পদে পদে সুগন্ধির গন্ধ বদলে গিয়ে যে গন্ধ বের হচ্ছে, সেটা আপনার ভালো লাগছে কিনা খেয়াল করুন।

এই যে ধাপে ধাপে সুগন্ধির গন্ধ পাল্টাচ্ছে, এর পিছে কার হাত আছে জানেন? এদের বলে নোট (note)। বেশিরভাগ সুগন্ধির তিনটা নোট থাকেঃ টপ নোট, মিডল নোট আর বেইজ নোট। পারফিউম তৈরিতে কী কী উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে নোট তৈরি হয়। প্রাথমিকভাবে যে গন্ধ পাওয়া যায়, সেটাকে বলে টপ নোট। মানে একদম শুরুতে যে গন্ধ পাবেন। সেটা মিলিয়ে যাওয়ার পর মধ্যবর্তী সময়ে পাবেন মিডল নোটের গন্ধ। সবশেষে বেইজ নোট। নাম থেকে বুঝা যায় এটা সুগন্ধির ভিত্তিপ্রস্তর। এই নোটই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সুবাস বিলিয়ে থাকে। অনেকে পারফিউমের গন্ধ, নোট আর স্থায়িত্বের বাইরে গিয়ে আরও একটা জিনিস খোঁজেন। পারফিউম মাখার পর সেটা কতোখানি জায়গা জুড়ে গন্ধ ছড়ায়, সেটা। একে প্রোজেকশন বলে। আর কেউ যখন পারফিউম গায়ে মেখে হেঁটে যায় আর পিছে ফেলে যায় সে পারফিউমের গন্ধ, সেটাকে বলে ট্রেইল। এর আরেকটা নাম হলো সিয়াশ (sillage)। কিছু সুগন্ধির বেলায় দেখবেন শুধু যার গায়ে মাখা হয়েছে, সে-ই গন্ধ পাচ্ছে। আবার কিছু সুগন্ধির বেলায় আপনি যদি কারো অনেক কাছে যান (জড়িয়ে ধরেন বা মুখোমুখি দাঁড়ান), তাহলে গন্ধ পাবেন। কিছু আছে যেগুলোর গন্ধ কয়েক ফিট দূর থেকে পাওয়া যায়, আবার কিছু পারফিউমের বেলায় মানুষ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেখানে গন্ধের রেশ রয়ে যায়। অর্থাৎ একেক সুগন্ধির প্রোজেকশন এবং সিয়াশ একেক রকম। আপনার যেরকম পছন্দ, আপনি সেটাই কিনবেন।

ক্যাপ ছাড়া টেস্টার

প্রথম পর্বে আমি বিখ্যাত সব পারফিউমের ডুপ্লিকেট ভার্সন বা ডুপ নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম মেইজঁ ফঁসিস কুহ্‌কজঁ ব্র্যান্ডের বাক্কারা হুশ 540 পারফিউম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্দে বানিয়েছেন ‘ক্লাউড’ নামের পারফিউম। তাই ক্লাউড পরিচিত বাক্কারা হুশ 540-এর ডুপ হিসেবে। আরও কিছু কোম্পানি আছে যারা বিখ্যাত পারফিউমের ক্লোন বা ডুপ বানিয়ে থাকে। যেমন, ডসিয়ে (dossier), ওকচা (Oakcha), ALT কিংবা আরমাফ (Armaf)। বাক্কারা রুশ 540-এর ডুপ হিসেবে ডসিয়ে বানিয়েছে অ্যাম্বারি স্যাফ্রন, ওকচা বানিয়েছে সুইভেন (sweven), আরমাফ বানিয়েছে Club de Nuit Untold, আর ALT বানিয়েছে ক্রিস্টাল। অনেকে বলেন আল হারামা-ইন ব্র্যান্ডের (সংযুক্ত আরব আমিরাতের সুগন্ধি কোম্পানি) অ্যাম্বার অউদ (oud) নাকি বাক্কারা রুশ 540-এর সবচেয়ে ভালো ডুপ! যাক গে। আমার যেহেতু নিশ বা ডিজাইনার পারফিউম কেনার খ্যামতা নেই, তাই আমি ডসিয়ে থেকে বেশ কিছু (পড়ুন বারোটা) সুগন্ধি অর্ডার দিয়েছিলাম। কালো শুক্রবার উপলক্ষ্যে ওরা চল্লিশ পারসেন্ট ছাড় দিচ্ছিলো। যদি ওদের পারফিউম আমার পছন্দ না হয় এবং বোতলটা একদম নতুনের মত থাকে, তাহলে সেটা রিটার্ন দিতে পারব। পুরো টাকা (শিপিং ফি বাদে) ফেরতও পাব। যখন সুগন্ধিগুলো হাতে এলো, তিনটে বাদে আর কোনোটাই মনে ধরলো না। আমিই ধরার সময় দিইনি। একবার করে শুঁকে শুঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য আফসোস হয়েছে। দেখি, এই বছর আবার কালো শুক্রবারে ওরা ছাড় দেয় কিনা। দিলে অন্তত টম ফোর্ডের লস্ট চেরির ডুপটা কিনবো।

আপনি যদি ডুপ না কিনে আসল পারফিউমই কিনতে চান, তাহলে ফ্রেগ্রেন্সনেট বা ফ্রেগ্রেন্সএক্স নামের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দুটোয় ঢুঁ মারতে পারেন। এরা স্বল্প দামে মোড়ক ছাড়া (আনবক্সড) পারফিউম এবং টেস্টার পারফিউম বিক্রি করে। বিভিন্ন জায়গায় পড়ানেকা করে বুঝেছি ওরা লেজিট। মনে প্রশ্ন আসতে পারে, মোড়ক ছাড়া পারফিউম আর টেস্টার পারফিউম মানে কী? মোড়ক ছাড়া মানে যেসব পারফিউম বিভিন্ন কারণে প্যাকেট থেকে খুলে ফেলতে হয়েছে। হয়তো এগুলো দোকানের ডিসপ্লেতে রাখা ছিলো বা দোকানে আনার সময় মোড়ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এগুলো তো আর ফার্স্ট হ্যান্ড হিসেবে বিক্রি করা যাবে না! তাই ফ্রেগ্রেন্সনেটের মত কোম্পানিগুলো এসব অল্প দামে কিনে নেয়, অল্প দামে ছাড়ে। আর টেস্টার মানে হলো পারফিউমের ব্র্যান্ড থেকে যেসব পারফিউম শোরুমগুলোতে পাঠানো হয় ক্রেতার টেস্ট করার জন্য। অনেক সময় দেখা যায় সেগুলো মূল প্যাকেজিংসহ আসে না। অনেক সময় এগুলোর ক্যাপ বা মুখাও থাকে না। তাই অনলাইন শপগুলো সস্তায় এগুলো সংগ্রহ করে সস্তায় বিক্রি করতে পারে। তাই বলে মনে করবেন না ফ্রেগ্রেন্সনেট অর্ধেক শেষ হওয়া বোতল আপনার কাছে বিক্রি করবে। ওরা একদম ভর্তি পারফিউমই বিক্রি করে। আধা খাওয়া পারফিউম ওরা নিজেরাই কিনবে না শোরুম থেকে। এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে যখন মনে হলো আমি ওদের বিশ্বাস করতে পারি, তখন ফ্রেগ্রেন্সনেট থেকে দুটো টেস্টার কিনলাম। আরিয়ানা গ্রান্দের ক্লাউড আর জুসি কুটুওরের ভিভা লা জুসি নোয়ার। ফ্রেগ্রেন্সএক্স থেকে কিনলাম দুটো মোড়ক ছাড়া পারফিউম। সারাহ জেসিকা পার্কারের লাভলি আর মারায়া ক্যারির এম। চারটে পারফিউমই লেজিট। ব্যাচ নাম্বার টাম্বার সব ঠিক। গন্ধও থাকছে সারাদিন। নকল পারফিউমের মত এক ঘণ্টা পর গন্ধ গায়েব হয়ে যাচ্ছে না। তাই একান্ত সমস্যা না হলে টেস্টার বা আনবক্সড পারফিউম কেনাই ভালো। দামে কম, গুণেমানে একই। শুধু শুধু একশোর বেশি ডলার দিয়ে সুন্দর প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইট থেকে পারফিউম কেনার মানে হয় না। প্যাকেট খুলে তো ফেলেই দিই, নাকি?

লেখাটা এতদূর পড়ে যদি ভাবেন আপনার পারফিউম জার্নি শুরু করবেন কীভাবে, তাহলে আমি বলবো শুরু করুন গবেষণার মাধ্যমে। ঘাঁটাঘাঁটি করে। আমার লেখাটা তো পড়লেন, এবার অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখুন। বুঝতে চেষ্টা করুন আপনাকে টানছে কোন উপাদান বা বৈশিষ্ট্য। আপনি কি ফুলের গন্ধ পছন্দ করেন, নাকি তামাকের? কস্তূরীর, নাকি সাগরের? ফলের গন্ধ ভালো লাগে, নাকি মশলার? দেখুন বিভিন্ন জনপ্রিয় সুগন্ধির রিভিউ। ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে রিভিউয়াররা মানুষজনের কাছে জানতে চায় কোন সুগন্ধি তাদের পছন্দ, বা দুটো সুগন্ধি শুঁকে বিচার করতে বলে। এসব দেখলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় আপনার গায়ে মাখা সুগন্ধি অন্যরা কীভাবে অনুভব করে। চলে যান সুগন্ধির দোকানে। টেস্ট করে দেখুন কোন সুগন্ধিটা আপনার গায়ে ভালো লাগছে। মনে রাখবেন ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ নট দা লাস্ট ইম্প্রেশন। কয়েক ঘণ্টা পর সে সুগন্ধি কেমন গন্ধ দিচ্ছে, সেটাও বুঝার চেষ্টা করুন। অনেকে বলেন বয়স আর রুচির সাথে মিল রেখে পারফিউম কিনতে হয়। কিন্তু মানুষজনের কথাই চূড়ান্ত নয়। সুগন্ধির মূল ব্যাপার হলো নিজের ভালো লাগা। আমার যদি কোনো গন্ধ ভালো না লাগে অথচ দেখা গেলো মানুষের কাছে সেটা ব্যাপক জনপ্রিয়, আমি ওটা গায়ে মাখবো না। সবার প্রথমে আমার ভালো লাগা, আমার স্বস্তি। তাই আপনার যেটা ভালো লাগে, সেটাই কিনুন আর মাখুন। ঠিকমতো ক্যারি করতে পারলে ওটাই সবাই পছন্দ করবে।

আরেকটা ব্যাপার। অনেকে বলেন দুটো বা তিনটে পারফিউম একসাথে ব্যবহার করতে। একে বলে লেয়ারিং করা বা স্তরে স্তরে সুগন্ধি মাখা। ধরুন আপনি ভিভা লা জুসি-গোল্ড কুটুওর সুগন্ধি ব্যবহার করতে চান। এটা মূল ভিভা লা জুসি সুগন্ধির কড়া সংস্করণ। আপনি প্রথমে মূল ভিভা লা জুসি গায়ে মেখে পরে ভিভা লা জুসি-গোল্ড কুটুওরটা মাখতে পারেন। তাহলে গা থেকে একই সাথে হালকা আর কড়া ভাইব ছড়াবে। অনেকে শানেল মাদেমোইসেল (মূল) আর এর কড়া ডোজ ‘শানেল মাদেমোইসেল ইন্টেন্স’ একসাথে মাখতে পছন্দ করেন। এভাবে যেকোনো ব্র্যান্ডের একই লাইনের হালকা আর কড়া ভার্সন একসাথে মেখে বৈচিত্র্য আনা যায়। তাছাড়া আপনি দুটো ভিন্ন উষ্ণ সুগন্ধি বা দুটো ভিন্ন শীতল সুগন্ধিও একসাথে মাখতে পারেন। আমি যেমন আল্টা বিউটি নামের এক দোকানে পারফিউম কিনতে গিয়ে দুই হাতের কব্জিতে দুটো ভিন্ন পারফিউম লাগিয়ে সারাদিন ঘুরেছি, নিজের কাছেই ভালো লাগছিলো। বাম হাতে দিয়েছিলাম আরিয়ানা গ্রান্দের ক্লাউড, ডান হাতে ভিক্তর অ্যান্ড রালফের ফ্লাওয়ারবম্ব। দুটোই উষ্ণ সুগন্ধি, তাই পরস্পরকে সাপোর্ট দিচ্ছিলো সুন্দর।

Happy
Happy
60 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
40 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পারফিউম বা সুগন্ধিঃ বিস্ময়কর এক জগত (পর্ব ২)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৬)