প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব
উইচিতা ফলস থেকে যখন বের হলাম, দেখি দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন। আগে যাও একটু সবুজের দেখা পাচ্ছিলাম, এবারের হাইওয়ে পুরোই মরুভূমির উপর। আগের এক লেখায় বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর মরুভূমি নিয়ে আমার ভুল ধারণা ভেঙ্গেছে। আগে ভাবতাম শুধু ধূ ধূ বালুচরই বুঝি মরুভূমি! কিন্তু এখানে আসার পর বুঝেছি মরুভূমির অনেক রকমফের আছে। ধূ ধূ বালুচর বাদেও এক ধরনের মরুভূমি আছে যেখানে গাছপালা জন্মাতে পারে। যেমন, ক্যাকটাস। এরা অল্প পানি শোষণ করে বেঁচে থাকে। তাই মরুভূমি এদের জন্য বাসযোগ্য। তবে মরুর বুকে গাছপালার সংখ্যা কম, এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের গন্তব্য আমারিল্লো (অ্যামারিলো) শহর। যেতে লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। ভাবলাম এক টানে চলে যাই, গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই, কাল সকাল থেকে আবার দৌড় শুরু করবো। তো, আমারিল্লোতে আমরা একরাতের জন্য এয়ারবিএনবি ভাড়া নিয়েছি। সস্তা কিন্তু রেটিং ভালো দেখে ভাড়া নিয়েছিলাম। সস্তার তিন অবস্থা প্রমাণ করার জন্য বাসাটা ডাউনটাউন থেকে এমনই দূরে যে, পৌঁছাতে পৌঁছাতে মনে হচ্ছিলো জিপিএস আমাদের ভুল জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। বেশ বড় একখানা বাণিজ্যিক এলাকা (মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত) আর কিছু সাইলো পার হয়ে পৌঁছলাম এয়ারবিএনবিতে। যেহেতু বিকেল চারটে বাজে, ভাবলাম, মালিক মনে হয় বাসাতেই। তাই বেশ কয়েকবার কলিংবেল চাপলাম। দশ মিনিট হওয়ার পরও কেউ দরজা খুলল না। এবার এয়ারবিএনবি অ্যাপে ঢুকে মালিককে নক দিলাম। সে দরজার লক খোলার কম্বিনেশন দিলো ঠিকই, কিন্তু সেটা দিয়ে কীভাবে লক খুলে, বুঝলাম না। মালিক কী বলছে সেটাও বুঝছি না। কোনোভাবেই তালা খুলতে পারছি না। এদিকে আমাদের অবস্থা ভয়াবহ। হিসু যেমন পেয়েছে, ক্লান্তও লাগছে। কয়েকবার মনে হল এই বাসা বাতিল করে মোটেলে উঠে যাই। কিন্তু এখন ক্যান্সেল করলে টাকা ফেরত পাবো না। তাই চেষ্টা চালিয়ে গেলাম লক খোলার।
হঠাৎ ক্লিক শব্দ করে লক খুলে গেলো। বের করে ফেলেছি লকের পদ্ধতি, ইয়াহু! দুদ্দাড় বাসায় ঢুকে টয়লেটে গেলাম। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই বাসায়। একটু পর মালিকের মেসেজ এলো, “আমি খুব দুঃখিত যে তোমাদের শোবার ঘরটা গুছিয়ে রাখিনি। অফিস থেকে ফিরে গুছানোর পরিকল্পনা ছিল। যা হোক, বিছানার উপর ধোয়া চাদর, কম্বল আর বালিশের কাভার রাখা আছে।” ভুলটা আমাদেরই। অ্যালাওয়েন্স রেখে বলেছিলাম সাতটায় আসবো। কিন্তু তিন ঘণ্টা আগে চলে এসেছি। দ্রুত চাদর বিছিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আহ, শান্তি! যে গাড়ি চালায়, তার তো বটেই, যে পাশে বসে থাকে, তারও ক্লান্ত লাগে। কাঁহাতক আর কোমর বাঁকা করে বসে থাকা যায়?
বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে ঠিক করলাম খেতে যাবো। কোথায় যাওয়া যায় খুঁজতে খুঁজতে প্রিন্সের মনে পড়লো আজকে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। খাবার কিনে যদি কোনো আলোক দূষণমুক্ত জায়গায় চলে যাই, খেতে খেতে চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পারবো। ভাবনা অনুযায়ী লোকালয় থেকে হালকা দূরে একটা পার্ক খুঁজে বের করলাম। তারপর ম্যাকডোনাল্ডস থেকে দুটো বার্গার কিনে নিয়ে গেলাম ওই পার্কে। ঘড়িতে তখন রাত আটটা। যুক্তরাষ্ট্রের ছোটো শহরগুলোয় রাত আটটা মানে বিশাল রাত। সবাই খাওয়া শেষ করে ঝিম মেরে যায়। আমরাও তাই গিয়ে পার্ক জনশূন্য দেখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু না, আমাদের মত আরও কিছু পাগল পার্কে এসে বসে আছে। আরও আছে বাচ্চাকাচ্চাসহ কিছু হিস্পানিক বাবা-মা। এতো রাতে বাচ্চারা ঢেঁকি খেলছে, স্লাইড রাইডে চড়ছে দেখে অবাক হলাম। অবশ্য একটু পরই ওরা চলে গেলো। থেকে গেলো ক্যামেরা হাতে কিছু প্রাপ্তবয়স্ক। প্রিন্সও ক্যামেরা হাতে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি আপাতত গাড়ির ভিতর বসে আছি কারণ বাইরে ঠাণ্ডা। দিনের বেলায় চামড়া পুড়ে যাওয়া গরম, কিন্তু রাতে হু হু ঠাণ্ডা। একদম টিপিকেল মরুভূমির আবহাওয়া। একটু পর প্রিন্সের গলা শুনলাম, “তাড়াতাড়ি বাইরে আসো! চন্দ্রগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে।” আমাদের ইচ্ছে ছিল পুরো গ্রহণটা ক্যামেরাবন্দি করার। প্রতিটা ধাপ। ছবিও তুলেছিলাম ধমাধম। কিন্তু সবগুলো পরিষ্কার আসেনি। যেগুলো এসেছে, সেগুলো জোড়া লাগিয়ে পাঠকের জন্য একটা ছবি দিলাম। খারাপ কোয়ালিটির ছবি, তারপরও দেখে নিন!
আমি এই প্রথম পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখলাম। এর আগে খাবলা খাবলা করে চন্দ্র এবং সূর্য, দুই ধরনের গ্রহণই দেখা হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি দেখা এই প্রথম। প্রিন্স ছেলেটা না থাকলে হিম ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার পার্কে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা হতো কি? পাতলা সোয়েটার ভেদ করে কনকনে বাতাস ঢুকছে, খাড়া করে দিচ্ছে রোম। কিছু বাতাস কানের পর্দায় গিয়ে বাড়ি মারছে। আর আমি চেষ্টা করছি সবকিছু উপেক্ষা করে চন্দ্রগ্রহণ দেখতে। গ্রহণ শেষ হওয়ার পর একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটলো। পুরো চাঁদ লাল রঙ ধারণ করলো। আমি সারাজীবন হলুদ কিংবা সাদা চাঁদ দেখে এসেছি। আমার কাছে লাল চাঁদ মানে অপার্থিব কিছু। মনে হচ্ছে দুনিয়া ধ্বংসের সময় চলে এসেছে। চাঁদ লাল, সূর্য্যি বেগুনী হয়ে সে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে প্রিন্স আমাকে ধারাভাষ্য দিচ্ছে কখন চাঁদটা দেখতে কীরকম হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ওর আগ্রহ অপরিসীম। আমাকে শিখিয়েওছিল কোনটা কোন নক্ষত্র। আমি সেগুলো ভুল খেয়ে বসে থাকি। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে, “বল তো, ওই বড় তারাটা কী?”, আমি পাঁচ বছর ধরে প্রাপ্ত জ্ঞান ঘেঁটে ঘুঁটে উত্তর দিই। নব্বই শতাংশ সময়ে সেটা ভুল হয়। তখন প্রিন্সের চেয়েও আমার মনটা বেশি খারাপ লাগে।
যাক, এখন বাকেট লিস্ট থেকে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখার ব্যাপারটা কেটে দিতে পারি। কে জানতো রকি ভ্রমণে এসে এই ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে? চাঁদ যখন আবার ফুটে উঠতে শুরু করলো, আমরা এয়ারবিএনবির রাস্তা ধরলাম। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আগামীকাল সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বো। নতুবা স্যান্ড ডুন্স জাতীয় উদ্যানে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে। চারটার দিকে উদ্যানের বাইরে অবস্থিত সরঞ্জামাদির দোকানটা বন্ধ করে দেয়। ওখান থেকে যেহেতু বালিতে পিছলা খাওয়ার জন্য স্লাইড ভাড়া করবো, তাই চারটার আগেই পৌঁছাতে হবে।
(চলবে)