প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব
দ্বিতীয় দিন (১৬ মে, ২০২২)
কাপুলিন আগ্নেয়গিরি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ, নিউ মেক্সিকো

আমরা যতোই ভাবি সকাল সকাল (পড়ুন ভোর ছয়টা বা বেশি গেলে সকাল আটটা) রওনা দেবো, কীভাবে যেন সেটা সকাল দশটা পর্যন্ত গড়ায়। ভোর ছয়টায় এলার্ম বাজলে অফ করে আবার ঘুমিয়ে যাই। কী আছে জীবনে যদি সকালের ঘুমটাই না দিতে পারি? আজকেও ঘুম থেকে উঠতে উঠতে নয়টা বেজে গেলো। তড়িঘড়ি প্রস্তুত হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বাসার মালিক ইতোমধ্যে আপিসে চলে গেছে। আমরা বাসাটা ঠিকমতো লক করে ব্যাটাকে পাঁচতারা রেটিং দিয়ে মেসেজ পাঠালাম। যতবার আমি এসব রেটিং দিই (উবার চালক বা এয়ারবিএনবির হোস্টকে), ততবার আমার ‘ব্ল্যাক মিরর’ টিভি সিরিজের ‘Nosedive’ পর্বের কথা মনে পড়ে। সেখানে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা দেখায়, যেখানে সবকিছু রেটিংয়ের উপর নির্ভর করে। একটা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করার আগে অন্যরা দেখে নেয় ওই ব্যক্তির রেটিং কেমন। পর্বটা দেখে ভয়াবহ লেগেছিল। কিন্তু এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠা কি অবাস্তব কিছু? আমরা তো একজন ট্যাক্সিচালকের রেটিং দেখেই তার উপর ভরসা করি, হোস্টের রেটিং দেখে এয়ারবিএনবি ভাড়া নিই। হে হে! যারা সিরিজটা দেখেননি তাদের জন্য বলছি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সাথে সামাজিক মূল্যবোধ, অবক্ষয় ইত্যাদি মিশিয়ে উপভোগ্য একটা জিনিস বানানো হয়েছে। দেখতে পারেন।

গাড়ি যখন হাইওয়েতে উঠলো, দুইপাশে আবার মরুভূমি শুরু হল। একদম মাটির সাথে লেপটে থাকা গাছড়া ছাড়া দেখার কিছু নেই। এগুলো দেখতে নাড়ু মাথায় গজানো খাড়া খাড়া চুল বা আফ্রিকান আমেরিকানদের মাথায় গজানো খাবলা খাবলা চুলের মত লাগে। নিরিবিলি হাইওয়ে ধরে ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালানোর পর প্রিন্স বললো, “দেখো তো, জিপিএসে কী একটা জাতীয় উদ্যান দেখাচ্ছে। স্যান্ড ডুন্সে যাওয়ার পথেই পড়বে।” বসে থাকতে থাকতে আমার ঝিমুনি আসছিল। প্রিন্সের কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। আরেকটা জাতীয় উদ্যান? কীভাবে সম্ভব? গুগল ম্যাপে তো এমন কিছু দেখিনি পরিকল্পনা করার সময়? আমাদেরকে বিস্মিত করে আসলেই একটা জাতীয় স্থান বের হল। তবে এটা জাতীয় উদ্যান নয়, জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ। একটা মৃত আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভটা। উদ্যান বা স্মৃতিস্তম্ভ, কী যায় আসে? জাতীয় হলেই হল। আমাদের কাছে ন্যাশনাল পার্কের এক বছর মেয়াদী এন্ট্রেন্স কার্ড আছে। এক বছরের মধ্যে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সব জাতীয় স্থানে এই কার্ড দেখিয়ে প্রবেশ করতে পারবো। ঠিক করলাম একটু ‘ডাইনে চাইপা’ স্মৃতিস্তম্ভটা দেখেই যাই। কখনো আগ্নেয়গিরি দেখিনি। জীবন্ত, মৃত যাই হোক, আগ্নেয়গিরি বলে কথা। কৌতূহল হচ্ছে ভীষণ।

আরও দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে পৌঁছলাম নিউ মেক্সিকোতে অবস্থিত কাপুলিন আগ্নেয়গিরি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভে। ইংরেজি নাম কাপুলিন ভলকানিক ন্যাশনাল মনুমেন্ট (Capulin Volcano National Monument)। এখানে মনুমেন্টের বাংলা যে কী হবে বুঝতে না পেরে স্মৃতিস্তম্ভ লিখছি। নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যটা টেক্সাসের সাথে লাগানো। আর নিউ মেক্সিকোর বর্ডার শুরুর কিছু পরেই এই স্মৃতিস্তম্ভ। মে মাস বলে হয়তো খুব একটা জনসমাগম নেই। আমাদেরটা নিয়ে মাত্র পাঁচ-ছয়টা গাড়ি পার্কিং লটে। কিন্তু কীভাবে আগ্নেয়গিরি দেখবো? রেঞ্জারের অফিসে ঢুকলাম জানার জন্য। এক নানী বা দাদীর বয়সী রেঞ্জার আমাদের আইডি দেখতে চাইলেন। দেখালাম। বললেন, “পার্কে প্রবেশের মূল্য গাড়ি প্রতি বিশ ডলার।” আমাদের আর পায় কে? চট করে হাতে ধরে রাখা পার্ক এন্ট্রেন্স কার্ড দেখালাম। উনি হাসিমুখে বললেন, “বেশ! পাহাড়ের কিনার ধরে গাড়ি চালিয়ে তেরশো ফিট উপরে চলে যাও। ওখানে পার্কিং লট আছে। পার্ক করে যদি চাও আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে নামতে পারো। হাইক করে পাহাড়ের চূড়ায়ও উঠতে পারো।” আমি আর প্রিন্স চোখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। পাহাড়ের গায়ে কোনো রেলিং দেখিনি। এরকম খাড়া পাহাড় বেয়ে গাড়ি চালাবো? যা হোক, বুড়ির হাসি দেখে বুকে বল আর মনে সাহস পেলাম। অফিস থেকে বের হয়ে আঁকাবাঁকা নুড়ি বিছানো পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে আগ্নেয়গিরির পাদদেশে এলাম। আমি যখন ভাবছি পাহাড়ে উঠার ব্যাপারে সেকেন্ড থট দেবো কিনা, তখন প্রিন্স এস্কেলেটরে চাপ দিয়ে পাহাড়ের সরু রাস্তায় উঠে পড়েছে।

রাস্তাটা বেশ steep বা খাড়া। রাস্তার বামদিকে পাহাড় আর ডানদিকে কিনার। কিনারে নেই কোনো বেড়া। গাড়ি হড়কালে গতি নেই মরণ ছাড়া। কিন্তু ডানপাশের দৃশ্যগুলো এত সুন্দর! যতো উপরে উঠছি, চারপাশের মরুভূমি ততোই দৃশ্যমান হচ্ছে। যখন সমতলভূমি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, তখন আই লেভেলে মরুভূমির সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছিলাম। এখন বার্ডস আই লেভেলে দেখছি। কী যে চমৎকার অনুভূতি! যতদূর চোখ যায়, ধূ ধূ মরুভূমি। উঁচু নিচু টিলা আর মাটিতে ল্যাপটানো গাছড়া ছাড়া এই মরুভূমিতে দেখার কিছু নেই। কিন্তু উপভোগ করতে জানলে এই নেংটু প্রকৃতিই উপভোগ্য। আমার শুধু ভয় লাগছে অন্যপাশ দিয়ে গাড়ি এলে আমরা জায়গা দিতে পারবো কিনা সেটা ভেবে। প্রিন্সের অবশ্য কোনো চিন্তা হচ্ছে না। সে জানে রাস্তাটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন দুটো নির্দিষ্ট মাপের গাড়ি ক্রস করতে পারে। আরে বাবা, সেটা কি আমিও জানি না? তারপরও তো অনর্থক আতংক বলে একটা জিনিস আছে। সেটাই আমাকে খাচ্ছে। যা হোক, প্রিন্সের পাশে বসে গলার মধ্যে আটকে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে আমি উপভোগ করতে চেষ্টা করলাম যাত্রাটা। একবার তো বলেই ফেললাম, “আরেকটু আস্তে চালাবা?” প্রিন্স ঠেলাগাড়ি স্টাইলে চালাচ্ছে। এরচেয়ে কমে চালালে গাড়ি উপরে উঠবে না। তারপরও আমার ভয় যায় না। ভয়ের আরেকটা কারণ হলো আমার উচ্চতাভীতি। যতবার নিচের দিকে তাকাই, ততবার পেটের মধ্যে পাঁক দিয়ে উঠে। প্রিন্স একটু আশেপাশে তাকালেই আমি আতংকে অস্থির হয়ে বলি, “তোমার কিছু দেখার দরকার নাই, তুমি চালাও। পরে ভিডিও দেইখো!” পাঠকেরাও চাইলে ঢুঁ মারতে পারেন ইউটিউবে রোমাঞ্চকর এই রাস্তার ভিডিও দেখতে।

এইবেলা কাপুলিন আগ্নেয়গিরির পরিচয়টা দিয়ে নিই। এটা পড়েছে র্যাটন-ক্লেয়টন আগ্নেয়ক্ষেত্রের (ভলকানিক ফিল্ড) ভিতর। আগ্নেয়ক্ষেত্রটা নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের উত্তর-পূর্ব দিকের মোটামুটি আট হাজার বর্গমাইল আয়তন নিয়ে অবস্থিত। বলা চলে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সমান। আজ থেকে নব্বই লক্ষ বছর আগে এই আগ্নেয়ক্ষেত্রে প্রথম অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। ত্রিশ লক্ষ বছর আগে অগ্নুৎপাতের প্রথম দশা শেষ হয়। এই দশার নাম র্যাটন দশা। তখন এই ক্ষেত্রের পশ্চিম দিকে অগ্ন্যুৎপাত হতো। এরপর শুরু হয় ক্লেয়টন দশা। এসময় ক্ষেত্রের পূর্বদিকে অগ্ন্যুৎপাত হতো। এই দশার শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয় বিশ লক্ষ বছর আগে। এরপর শুরু হয় কাপুলিন দশা। এটা শুরু হয়েছিলো সতেরো লক্ষ বছর আগে। দশার প্রথম অগ্ন্যুৎপাত ঘটে আজ থেকে ষাট হাজার বছর আগে এবং শেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটে ত্রিশ হাজার বছর আগে। এই দশায় অগ্ন্যুৎপাত হতো আগ্নেয়ক্ষেত্রটার মাঝ বরাবর। যে তথ্যটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে সেটা হলো, ষাট হাজার বছর আগে যখন প্রথম কাপুলিন দশার অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছিলো, তখন এই অঞ্চলে চড়ে বেড়াচ্ছিলো ম্যামথ আর দানব আকৃতির বাইসনের দল। আজ তারা বিলুপ্ত প্রজাতি, ঠিক যেমন কাপুলিন আগ্নেয়গিরিও আজ বিলুপ্ত। এখান থেকে আর কখনো অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে না। কিন্তু আশেপাশের আগ্নেয় ক্ষেত্র থেকে ঘটতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব, দশম পর্ব, একাদশ পর্ব