1 0
Read Time9 Minute, 3 Second

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব

শুকনো ক্যাকটাস

তের’শো ফিট উপরে উঠার পর পার্কিং লট দেখতে পেলাম। সেখানে গাড়ি রেখে বাইরে বের হতেই ঠাণ্ডা বাতাস এসে ধাক্কা মারলো। আমাদের ইচ্ছে হলো প্রথমে হাইকিং করে আগ্নেয়গিরির চূড়ায় উঠবো, সেখান থেকে নামবো জ্বালামুখে। ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য হালকা গরম জামা চাপিয়ে হাঁটা ধরলাম ট্রেইল ধরে। সরু একটা রাস্তা বানিয়ে রেখেছে শীর্ষে যাওয়ার জন্য। রাস্তার ধারে কোনো বেড়া নেই। তাই সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে ক্যাকটাস দিয়ে ভরা। ছোটো ছোটো ক্যাকটাস। জশুয়া জাতীয় উদ্যানের মত আট ফুট লম্বা ক্যাকটাস নয়। মে মাস বলে বেশিরভাগ গাছপালা শুকনো খটখটে। আর কিছুদিন পর হয়তো নতুন পাতা গজাতে শুরু করবে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এলে তরতাজা গাছ দেখতে পেতাম। যা হোক, এখন যা দেখছি তাতেও আমি সন্তুষ্ট। ‘একেক ঋতুর একেক সৌন্দর্য’ ধরে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

উপরে উঠার পথে বিভিন্ন জায়গায় থেমে ছবি তুলে নিচ্ছি। লিখে বুঝানো যাবে না কেমন অনুভূতি হচ্ছে। এর আগে যতবার পাহাড়ে চড়েছি, সবগুলোই ছিলো সবুজ পাহাড়। গাছপালায় ঘেরা। এই প্রথম নগ্ন একটা পাহাড়ে চড়ছি। পা হড়কে গেলে কোনো গাছ আমাকে সামাল দেবে না। সোজা পপাতধরণীতল। কিন্তু এই শিরশিরে অনুভূতিই পুরো হাইকিংকে অনন্য করে তুলেছে। সাধে কি আর মানুষ ‘মরতে পারি’ জেনেও অভিযানে বের হয়? হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি কাহিল হয়ে যান সেজন্য কিছুদূর বাদে বাদে বসার বেঞ্চি দিয়ে রেখেছে। আমি প্রতিটা বেঞ্চে বসে ফ্যা ফ্যা করে জিরিয়ে নিচ্ছি। আমার সাথে হাঁটতে গিয়ে প্রিন্সকে বারবার থামতে হচ্ছে। বললাম, “তুমি তোমার মত হাঁট, আমি আসছি।” ও সামনে এগুলো। আমি ধীরে সুস্থে হেঁটে পরের বেঞ্চি পর্যন্ত এলাম। দেখি সেটার এক কিনার ভাঙ্গা। ভাঙ্গা বেঞ্চি কেন পেতে রেখেছে? নষ্ট হয়ে গেলে সাধারণত দেখভাল করার লোকেরা সেগুলো বদলে ফেলে। আরেকটু খেয়াল করতে দেখলাম বেঞ্চির পাশে একটা ফলক রাখা। সেখানে যা লেখা তার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, তুমি কি বজ্রপাত দেখলে ভয় পাও? একে বলে অ্যাস্ট্রাফোবিয়া (astraphobia)। তোমার সামনে লোহার তৈরি যে বেঞ্চটা দেখছ, সেটা কীভাবে ভেঙ্গেছে জানো? বজ্রপাত হয়ে। হে হে! ভয় পাচ্ছ? এক দৌড়ে গাড়ির ভেতর গিয়ে বসো। আসলেই ভয় পেলাম। কিন্তু এখন যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে না, বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে না, তাই ভয়ের কিছু নেই ভেবে আবার হাঁটা ধরলাম।

বজ্রপাতে ভেঙ্গে গেছে লোহার বেঞ্চি

আর কিছু উপরে উঠলেই শীর্ষ। কিন্তু পা চলছে না। তার উপর পেয়েছে খিদে। প্রিন্স আমাকে ছাড়া শীর্ষে উঠতে চাইলো না। তাই দুইজনই নেমে এলাম পার্কিং লটে। প্রোটিন বার দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। নরনারীর জন্য আলাদা গণ শৌচাগারের ব্যবস্থা দেখে সেটার ইস্তেমাল করলাম। এরপর জ্বালামুখে নামার রাস্তায় পা রাখলাম। পার্কিং লটের একপাশ দিয়ে চূড়ায় উঠার রাস্তা, আরেক পাশ দিয়ে জ্বালামুখে নামার রাস্তা। আমরা যখন চূড়ায় উঠছিলাম, তখন একদল পর্যটক জ্বালামুখে নেমেছিলো। এখন আমরা ছাড়া কেউ নেই। যেহেতু মৃত আগ্নেয়গিরি, তাই জ্বালামুখ দিয়ে লাভা বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই জানি। কিন্তু এই পৃথিবীতে যেহেতু কোনোকিছু ঘটার ‘সম্ভাবনা’ বা প্রোবাবিলিটি কখনো শূন্য নয়, তাই কে জানে আজকেই যদি বিজ্ঞানীদের হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে অগ্নিগিরি জেগে উঠে? উঠলে উঠবে। এত ভয় পেলে চলে? কথায় বলে না, ডরাইলেই ডর? তাই অমূলক ডর পেছনে ফেলে আমি নামা শুরু করলাম অগ্নিগিরির পেটে। সে এক গা ছমছমে অনুভূতি! বারবার মনে হচ্ছে ‘যদি গর্তে নামার পর চারদিকের পাহাড় ধ্বসে পড়ে? যদি আমাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে?’ আমি ক্লস্ট্রোফোবিক না। তারপরও এমন লাগছে।

জ্বালামুখের কেন্দ্রে রাখা ফলকের সাথে আমি

উপরে উঠার চেয়ে নিচে নামা সহজ বলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা নেমে এলাম জ্বালামুখের কেন্দ্রে। অথচ একই পরিমাণ রাস্তা পার হয়ে শীর্ষে পৌঁছাতে গিয়ে আমার জিভ বেরিয়ে পড়েছিলো। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, যে জ্বালামুখ দিয়ে একসময় বিস্ফোরণ ঘটতো, দুদ্দাড় করে বেরিয়ে আসতো প্রচণ্ড গরম লাভা, সে জ্বালামুখে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে যে পাথরগুলো পড়ে আছে, সেগুলো তৈরি হয়েছে অগ্নিগিরি থেকে উদ্গিরিত লাভা দিয়ে। যে লাভা উদগীরণের কারণে কাপুলিন আগ্নেয়গিরি একসময় আতংকের কারণ ছিলো, সে লাভা দিয়ে তৈরি পাথরই আজ আগ্নেয়গিরির মুখ বন্ধ করে ফেলেছে। প্রকৃতির কী খেল! কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম দার্শনিক ভাবটা নিয়ে। তারপর মনে পড়লো সারাদিন এখানে কাটালে স্যান্ড ডুন্সে যাবো কখন? তাই দর্শনতত্ত্ব চাঙ্গে উঠিয়ে হাঁটা ধরলাম পার্কিং লটের দিকে। উপরে উঠার পথে আরেকবার তাকালাম বিশাল এই জ্বালামুখের দিকে। আবারও গা ছমছম করে উঠলো। কিন্তু সে ছমছমানি কেটে গেলো দুটো বাঁদরকে দেখে। এই মরুভূমির বুকে বাঁদর এলো কোথা থেকে? আশ্চর্যম! নেই গাছ, নেই কলা। বাঁদর বাঁচবে কীভাবে? প্রিন্সও দেখতে পাচ্ছে বাঁদরগুলোকে। তারমানে আমি ভুল দেখছি না।

পার্কিংলটে আমাদের গাড়ির ঠিক পাশে একটা ভ্যান রাখা। সেটার মালিক মনে হয় আমাদের মত যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো জাতীয় উদ্যানে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। গাড়ির পেছনে এখন পর্যন্ত যতগুলো উদ্যানে গেছেন, সবগুলোর স্টিকার মারা। আইডিয়াটা মনে ধরলো। ভাবলাম আমরাও এমনটা করবো। তাই রেঞ্জারের আপিস থেকে কাপুলিন আগ্নেয়গিরির ছবিসহ একটা স্টিকার কিনলাম। এরপর রওনা দিলাম কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের গ্রেট স্যান্ড ডিউনস জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে বাজে দুপুর আড়াইটা। স্যান্ড ডিউন্সে পৌঁছাতে লাগবে আড়াই ঘণ্টা। সেখানে পৌঁছে তাঁবু খাটানোর ব্যাপার আছে, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার আছে, আছে দিনের আলোয় বালির স্তূপ দেখার ব্যাপার। কিন্তু শেষেরটা সম্ভব হবে কিনা, বুঝতে পারছি না। মরুভূমিতে যেহেতু ঝপ করে সন্ধ্যা নামে, তাই আজকে চাঁদের আলোয় বালির রাজ্য দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হতে পারে।

নবম পর্ব, দশম পর্ব, একাদশ পর্ব

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৭)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৯)