1 0
Read Time12 Minute, 35 Second

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব

পায়ে মোজা-কেডস গলিয়ে আমি আর প্রিন্স বের হলাম স্যান্ড ডিউন্সের উদ্দেশ্যে। অনেকে বলেছিলেন কেডস পরলে সেখানে বালি ঢুকে পায়ের তলা কিচকিচ করতে থাকে। কিন্তু বালির উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে মন চাইছিলো না। তাই কেডস পরেছি। সমস্যা যদি হয়, খুলে হাতে নিয়ে হাঁটব। ক্যাম্পসাইট থেকে এক মাইল দূরের একটা জায়গা দিয়ে স্যান্ড ডিউন্সে ঢুকতে হয়। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম হেঁটেই এক মাইল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ফেলবো। পরে মনে হল হাঁটতে গেলে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত লাগতে পারে। রাস্তাটা মসৃণ কিংবা সোজা নয়, কেমন এবড়ো থেবড়ো আর ঘোরালো। তাই গাড়িতে করেই রওনা দিলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছার পর দেখি দশ-বারোটা গাড়ি পার্ক করা। তারমানে আমাদের মত আরও পর্যটক এসেছে ঢিবি দেখতে। এক কাঁধে স্যান্ড বোর্ড আর আরেক কাঁধে ব্যাগপ্যাক নিয়ে আমরা ঢিবির দিকে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। পার্কিংলটের সামনে ঝোপঝাড় দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারছি ঝোপঝাড়ের অন্যপাশেই ঢিবি। কিন্তু পার্কিংলট থেকে কোন রাস্তা ধরে ঢিবিতে যেতে হয় বুঝতে পারছি না। ঝোপ ভেদ করেই যেতে হয় নাকি? ভালো কোনো রাস্তা নেই? এখানে আসতে আসতে সূর্য পাটে গেছে। ঝপ করে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। তাই সঠিক রাস্তা খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে। আশেপাশেই কোথাও কুলকুল করে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। নদী নাকি? ঢিবির ধারেকাছে নদী আছে বলে তো দেখিনি! আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি তো?

যখন মেজাজ গরম করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ঝোপঝাড় ভেদ করে ওইপাশে যাবো, তখন এক জোড়া তরুণ তরুণীকে দেখলাম ঝোপের অন্যপাশ থেকে বেরিয়ে পার্কিংলটে উঠলো। আমি দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বালির ঢিবিতে যাবো কীভাবে বলতে পারো?” ছেলেটা ঝোপের দিকে হাত ইঙ্গিত করে বলল, ‘”এদিক দিয়েও যেতে পারো, আবার সামনে এগুলে একটা ফটক মতন দেখবে। সেদিক দিয়েও যেতে পারো।” বললাম, “তাহলে আর সামনে যাওয়ার দরকার কী? এখান দিয়েই চলে যাই!” মেয়েটা বলল, “এদিক দিয়ে গেলে হাঁটু সমান পানি পার হতে হবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানি। কিন্তু ফটকের ওইদিকে গোড়ালি সমান পানি।” অগত্যা ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফটকের দিকেই রওনা দিলাম।একটা ল্যাম্পপোস্টও নেই যে মিশমিশে অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারবো। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মত থাকতে দেওয়ার এই হলো ফল। ব্যাপারটা আমি সমর্থন করি বলে রাগও করতে পারছি না। যা হোক, কিছুদূর এগুনোর পর দেখি দুটো গাছের গুঁড়ি ফেলে একটা জায়গায় ফটকের মত বানানো হয়েছে। এটার কথাই ছেলেটা বলছিল। সমস্ত ব্যাপারটাই ভীষণভাবে প্রাকৃতিক। একমাত্র পার্কিং লট ছাড়া আর কোথাও আধুনিক জীবনের চিহ্ন দেখছি না। একদল ভ্রমণকারী ঢিবি ঘোরা শেষে এদিকে ফিরছে। আমাদের হাতে স্যান্ড বোর্ড দেখে বলল, “তোমাদের তো ম্যালা সাহস! এই রাতে ঠাণ্ডার মধ্যে স্লাইড করতে যাচ্ছ।” আমার আর প্রিন্সের কোনো ধারণাই নেই কেন এটা সাহসের বিষয়। আমরা ভ্যাবলার মত হেসে মাথা ঝাঁকালাম। ওরা “উপভোগ করো!” বলে চলে গেলো।

ফটক পার হয়ে কিছুক্ষণ সামনে হাঁটার পর অন্ধকারটা চোখে সয়ে গেল। সামনের দৃশ্যগুলোও ধীরে ধীরে ফুটে উঠল। চাঁদ এখনও উঠেনি বলে সেটা থেকে সাহায্য পাওয়ার কোনো আশা নেই। রাত দশটায় উঠলে হয়তো ঢিবির আসল সৌন্দর্য বুঝতে পারবো। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা খাল। ঢিবিতে যাওয়ার পথে আড়াআড়ি চলে গেছে। মনে পড়ল এটার নাম Medano Creek। ক্রিক মানে তো ‘খাঁড়ি’! এতক্ষণ ধরে যে কুলকুল আওয়াজ শুনছিলাম, সেটার উৎস তাহলে এটাই। খাঁড়িতে পানির বেশ স্রোত আছে। বর্ষাকালে এটা নাকি পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠে। তবে এখন বেশ মরে আছে। তাতেই এই অবস্থা? বর্ষাকালে এলে তো সাঁতরে পার হতে হতো! যতোই খাঁড়ির দিকে যাচ্ছি, ততোই পায়ের নিচে ভেজা আর নরম বালি টের পাচ্ছি। এক পর্যায়ে আর কেডস পরে হাঁটা সম্ভব হল না। মোজা, কেডস দুটোই খুলে নরম বালির বুকে পা রাখলাম। সড়াৎ করে মেরুদণ্ড বেয়ে বরফ শীতল স্রোত বয়ে গেলো। ও মা গো, এতো ঠাণ্ডা! চপ্পলও আনিনি যে পরে নেবো। খালি পায়ে আমি তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাগলাম। প্রিন্স বলল এক দৌড়ে খাঁড়ি পার হয়ে যেতে। দৌড়ে পার হলে পায়ে অতোটা ঠাণ্ডা লাগবে না। কিন্তু হেঁটে পার হতে গেলে পা জমে যাওয়ার আশংকা আছে। আমি দৌড় দিলাম। কিন্তু নরম বালিতে দৌড়ানোও যাচ্ছে না। পা ডেবে যাচ্ছে। কোনোমতে খাঁড়ির কাছাকছি এসে একটা পাথরে বসে পড়লাম। প্রিন্স এখনও তিড়িং বিড়িং করে করে এগুচ্ছে। ও আসতে আসতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই।

প্রিন্স আসার পর দুজনে মিলে খাঁড়ির ঠাণ্ডা জলে পা রাখলাম। ঠাণ্ডা বালিতে হেঁটে পা অবশ হয়ে গেছে। তাই পানির ঠাণ্ডা খুব বেশি কাবু করতে পারলো না। পার্কিংলটের তরুণটা বলেছিল গোড়ালি সমান পানি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পানি গোড়ালি পার হয়ে আরও উঁচুতে উঠে গেছে। এজন্য প্যান্টটাও গুটাতে হল। বুঝতেই পারছেন দুই কাঁধে দুটো ভারী জিনিস আর দুই হাতে দু’পাটি জুতা নিয়ে ঠাণ্ডা পানি পার হতে কতো কসরত করতে হচ্ছে! একবার তো পা হড়কে পড়েই যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে ভারসাম্য ফিরে পেলাম। পড়ে গেলে আর রক্ষে ছিল না। একে হিমশীতল পানি, তার উপর ব্যাগের জিনিসপত্র ভিজলে অনেক টাকা লোকসান। মোবাইল, কার্ড, টাকাপয়সা, পাওয়ার ব্যাংক। একবার মনে হল “ধুর ছাই” বলে ক্যাম্পে ফেরত আসি। তারপর মনে হল এইটুকু কষ্ট নিতে না পারলে আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে আসা কেন? তাই দাঁত মুখ খিঁচে খাঁড়ি পার হলাম। পার হয়ে আরেক দফা ঠাণ্ডা-ভেজা বালির সামনে পড়লাম। সেটা পার হওয়ার পর অবশেষে “শুভ্র বালির সৈকতে, এলোমেলো বাতাসে গিটার হাতে…” দাঁড়ালাম। মানে, সাথে গিটার ছিল না। রাতের আঁধারে বালি শুভ্র নাকি গুইয়া রঙের, সেটা বুঝারও উপায় ছিল না। কিন্তু কষ্ট শেষ হওয়ার পর কিছুটা উদাস হয়ে গেলাম আর এই গান মাথায় এলো।

এতক্ষণ পানি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে সামনে কী আছে দেখার ফুরসত মেলেনি। শুকনো বালুতে পা দিয়ে প্রথমবারের মত ঠাণ্ডা মাথায় সামনের দিকে তাকালাম। দূর থেকে যেটাকে আবছা অবয়ব মনে হচ্ছিলো, সেটা আরেকটু স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু জিনিসটা কী বুঝলাম না। চোখ কচলে আবারও তাকালাম। আমার সামনে কি বিশাল একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে? আকাশে হাজার হাজার তারা ফুটে উঠেছে। আলোক দূষণ নেই বলে সেগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারার আলোয় বুঝতে পারছি আমার সামনে একটা দানব দাঁড়ানো। দিনের আলোয় দানবটার চেহারা বুঝা গেলে হয়ত ভয় কম লাগতো। কিন্তু এখন মেগালোম্যানিয়া ছেঁকে ধরতে চাইছে। মনে হচ্ছে বিশাল দানবটা আমাকে গিলে ফেলতে আসছে (ছবি ১)। আচমকা দুটো কালো বিন্দু চোখে পড়ল। বিন্দু দুটো নড়াচড়া করছে। দানবের গা বেয়ে নেমে আসছে আমাদের দিকেই। দেখে সাহস ফিরে পেলাম। ওহ! দানব তাহলে কাউকে খেয়ে ফেলছে না। এটার গায়ে তাহলে উঠা যায়।

বিন্দু দুটো নেমে আসছে আর আমরা উপরে উঠতে শুরু করেছি। আমাদের শখ ছিলো ৭৫০ ফুট উচ্চতার স্টার ডিউনে উঠব। কিন্তু রাতের বেলা ঠিকমত মালুম হচ্ছে না কোন রাস্তা ধরে হাঁটলে স্টার ডিউন পর্যন্ত যেতে পারবো। যে তারাটা স্টার ডিউনের মাথার উপর ছিল, সেটা লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগলাম। যদিও স্টার ডিউনকে লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করেছি, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর খেই হারিয়ে ফেললাম। সমতলভূমি থেকে উপরে উঠার পর সবগুলো চূড়াকে একই রকম লাগছে। তারাও খুব একটা সাহায্য করতে পারছে না। তাছাড়া তারা এক জায়গায় স্থির থাকে না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে তারাও এক দিক থেকে উঠে আরেক দিকে অস্ত যায়। তাই তারাটা তার জায়গা থেকে নড়ার আগেই স্টার ডিউনে পৌঁছার ইচ্ছে আমাদের। নিয়ত ভালো হলেও আমরা যেটা বুঝিনি সেটা হল, বালির মধ্যে হাঁটা প্রচণ্ড কষ্টকর। যতো দ্রুত হাঁটতে চাই, ততোই পা ডেবে যায়। ডেবে গিয়ে গিয়ে কেডসের ভেতর বালি ঢুকছে। হাঁটাকে করে তুলছে দ্বিগুণ যন্ত্রণার। তার উপর তারা অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি আমরা একটা স্তূপের চূড়া বরাবর উঠছি। চূড়ায় না উঠে দুই চূড়ার মাঝের খাদ দিয়ে পার হলে কষ্ট কম হতো। ঠিক করলাম এই চূড়া থেকে নেমে পরের পথটুকু খাদ দিয়ে দিয়ে হাঁটব। তো, এখানেই আসে স্যান্ড বোর্ডের খেল। চূড়ায় উঠে বোর্ডের সাহায্যে একটানে নেমে যেতে পারবেন। আমরা খুবই উত্তেজিত। ভালোমতো মোম ঘষে বোর্ডের পাছা লাল করে নিলাম। কিন্তু কে আগে পিছলা খাবে? দুজনের কারোরই অভিজ্ঞতা নেই এই ব্যাপারে। অভিজ্ঞতা বলতে শুধু অন্তর্জালে ভিডিও দেখা। শেষমেশ প্রিন্সই এগিয়ে এলো। ও কীভাবে পিছলা খায় দেখে এরপর আমি বোর্ডে চড়ব।

একাদশ পর্ব

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
50 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
50 %
Previous post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৯)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ১১)