প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব, দশম পর্ব
স্যান্ড বোর্ডে বসার পদ্ধতিটা বেশ প্যাঁড়াদায়ক। বোর্ডের একদিকে নিতম্ব রেখে আরেকদিকে দুটো পা একসাথে রাখতে হবে। বালির উপর পা রাখা যাবে না। তাহলে বোর্ড পিছলাবে না। বোর্ডের দুই পাশে লাগানো দুটো বেল্টে ধরে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। প্রিন্স কাঁধে ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে বোর্ডে চেপে বসলো। ব্যাগের ভারে ঠিকমত ভারসাম্য রাখা যাচ্ছে না। যেখানে আমাদের সামনের দিকে ঝুঁকে বসার কথা, সেখানে প্রিন্স পেছন দিকে হেলে যাচ্ছে। এই অবস্থায়ই পা দিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে বোর্ডটা কিছুদূর এগিয়ে নিলো যেন ভরবেগ তৈরি হয়। ওই মোমেন্টাম ব্যবহার করেই বোর্ডটা পিছলাবে। ঢালু রাস্তায় একটুখানি পিছলে বোর্ডটা থেমে গেলো। কাহিনী কী? এটার তো সুড়ুত করে নেমে যাওয়ার কথা! আবারও হাঁচড়ে পাঁচড়ে বোর্ডটা হালকা এগিয়ে নিলো প্রিন্স। এবারও একটুখানি পিছলে সেটা থেমে গেলো। মনে হচ্ছে আরও মোম লাগবে। তাই আবারও মোম ঘষে বোর্ডে চড়লো ও। এবার হড়হড় করে দৌড় দিলো সেটা। কিন্তু সোজা না গিয়ে ত্যাড়া ব্যাঁকা ভাবে দৌড়ালো। সামাল দিতে গিয়ে প্রিন্স বাম আর ডান পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো। এই অবস্থা দেখে আমার উত্তেজনা একদম মিইয়ে গেলো। মজার বদলে ব্যাপারটা তো অত্যাচারের মত লাগছে! অবশ্য প্রিন্স যখন ঢিবির পাদদেশে পৌঁছালো, আমিও বোর্ডে চেপে বসলাম। ওর মত হুমড়ি খেতে খেতে পাদদেশে পৌঁছলাম। বুঝলাম ব্যাপারটা সোজা নয়। অনুশীলন করে করে দক্ষতা বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায় সেটা বুঝতে হবে।

স্যান্ড বোর্ডে চড়ে আর হেঁটে আমরা পাঁচশো ফিটের মত উচ্চতায় উঠলাম। উঠে জিভ বের হয়ে গেলো। আর উপরে উঠবো না ঠিক করলাম। পাহাড়ে উঠা আর বালির ঢিবিতে উঠা পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস। পাহাড়ে শক্ত মাটি থাকে যেখানে আপনার পা গেঁথে যাবে না। কিন্তু বালিতে পা গেঁথে যায় গোড়ালি পর্যন্ত। এভাবে হাঁটা অনেক কষ্টের। তারপরও উঠতে পারতাম যদি আজকেই পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে না আসতাম। যাত্রার কারণে শরীর ক্লান্ত হয়ে আছে। তার উপর আমরা বালিতে হাঁটার ঝামেলাটা বুঝতে পারিনি বলে ভারী ব্যাগপ্যাক নিয়ে চলে এসেছি। যারা বালির স্তুপে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য মুফতে একটা টিপ হলো যথাসম্ভব হালকা হয়ে যাবেন। একটা পানির বোতল আর একটা মোবাইল ফোন (ছবি তুলতে চাইলে), ব্যস। স্লাইডিং করতে চাইলে বোর্ড নিতে পারেন, কিন্তু সেটা ভারী। হাতে নিয়ে যদি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটেন, কষ্ট লাগবে (যদি না ভারী জিনিস বওয়ার অভ্যাস থাকে)। আমাদের দুজনেরও খুব ক্লান্ত লাগছে।

এই মুহূর্তে ঘড়িতে বাজে রাত দশটা। দূরে রকি পর্বতের কালো সারির পেছন থেকে ঘোলাটে আলোর আভাস পাচ্ছি। শুরু হয়েছে চাঁদ উঠা। গতকাল পূর্ণিমা গিয়েছে। আজকেও চাঁদ তাই ঝলমলে আলো নিয়ে উঠবে। চাঁদ উঠলে সেটার আলোয় আকাশে ফুটে থাকা তারামণ্ডলী ঢাকা পড়ে যাবে, আর আমাদের রাতের আকাশ দেখার বারোটা বাজবে। রাতের আকাশ দেখতে চাইলে সবচেয়ে ভালো সময় হলো অমাবশ্যা। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স দেখাও নাকি লাইফটাইম অভিজ্ঞতা। আমাদের তাই আফসোসের কিছু নেই। প্রিন্স চাইছে চাঁদের আলোয় দিগ্বিদিক ভেসে যাওয়ার আগে অনন্ত নক্ষত্রবীথিকে ক্যামেরায় বন্দী করতে। তাই অনবরত ছবি তুলে চলেছে (ছবি ১)। আর আমার করছে প্রচণ্ড পা ব্যথা। যতোটা না পরিশ্রমে, তারচেয়ে বেশি ঠাণ্ডায়। মরুভূমিতে যে রাতের বেলা এতো ঠাণ্ডা পড়ে, ধারণাই ছিল না। থাকলে শুধু ফ্লিস কাপড়ে বানানো সোয়েট শার্ট না, শেরপাটাই পরে আসতুম। এখন ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বোঝো ঠ্যালা!

বলে রাখা ভালো, গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স জাতীয় উদ্যানটা অনেকগুলো স্যান্ড ডিউন বা বালির ঢিবি (বা স্তূপ) নিয়ে গঠিত। আমরা যে ঢিবিতে খুঁটি গেড়েছি, তার আশেপাশে কেউ নেই। অনেক দূরের এক ঢিবিতে দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে (ছবি ২)। ওখান থেকে হয়তো ঢিবির বিশালত্ব বুঝতে পারবেন। প্রিন্সকে নির্বিঘ্নে ছবি তুলতে দিয়ে আমি স্যান্ড বোর্ডকে বিছানা বানিয়ে শুয়ে পড়লাম (ছবি ৩)। এভাবে যদি ক্লান্তি কমে! কিন্তু শোয়ার পর আরও বেশি ঠাণ্ডা অনুভব করতে লাগলাম। টিপ নাম্বার দুই, যদি রাতের বেলা ঢিবিতে উঠতে চান, মোটা মোটা গরম কাপড় নিয়ে যান। হঠাৎ আমাদের খুব কাছে কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো। সেই সাথে একটা ছেলে কণ্ঠ কিছু বলল। তারমানে আমরা একা নই। আশেপাশে আরেক জোড়া এসে ঘাঁটি গেড়েছে। একটু পর শুনি ছেলেমেয়ে দুটো ইংরেজি গান চালিয়ে দিলো। এই নীরব নিস্তব্ধ বালুচরে যান্ত্রিক সংগীত কেমন যেন বেসুরো লাগলো। নিজেরা গাইলেও হতো! কিন্তু কী আর করা? স্বাধীনতা বলে একটা বিমূর্ত ধারণা আছে। মানুষের স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না।

পাহাড়ের কোল থেকে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। প্রিন্স চাঁদকে সামনে রেখে আমার কিছু ছবি তুলতে চায়। তাই দুই হাত ছড়িয়ে আমার সিগনেচার পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম (ছবি ৪)। সত্যি করে বলুন তো, দেখে মনে না আমি চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে? নীল আর্মস্ট্রংয়ের এমন ছবি কতো দেখেছি! এবার নিজে এরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হলো যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে পুরো ডিউন জ্যোৎস্নায় ঝলমল করতে লাগলো। যেদিকে তাকাই, সফেদ আলো। একটু আগে যেখানে অন্ধকারের চোটে কিছু ঠাহর করতে পারছিলাম না, সেখানে এখন একশো ওয়াটের ফিলিপ্স বাত্তি জ্বলছে। ধূ ধূ মরুভূমির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা ঢিবিগুলো চাঁদের আলোয় একেকটা একেক চেহারা ধারণ করেছে। উঁচু ঢিবিগুলো চেহারা দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর কারণে নিচু ঢিবিগুলো ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ফলাফল, বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে আলোছায়ার খেলা। এতো অবর্ণনীয় একটা দৃশ্য!
রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ ডিউন্স খালি হয়ে গেলো। পাঁচ-ছয়জন পূর্ণিমা পাগল মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দূর থেকে অস্পষ্টভাবে তাদের কথা ভেসে আসছে। ওখান থেকে বুঝতে পারছি কেউ আছে। আমাদের পাশে যে জোড়াটা গান শুনছে আর ঠাট্টা তামাশায় খিলখিল করে হেসে উঠছে, একটু পর তারা গাঁজা ধরালো। গাঁজার নৌকা পাহাড়তলি যায়…। নৌকা থেকে সে গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো আমাদের নিরামিষ আস্তানায়। একবার মনে হলো বলি, “হেই গাইস! একা একা খেতে চাও? দরজা বন্ধ করে খাও। খোলা ময়দানে খেতে চাও? শেয়ার করে খাও।” কিন্তু বলা হলো না। দুই ক্লান্ত প্রাণ পথিক আমরা একজন আরেকজনের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে রইলাম প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টির বুকে। রাতের আঁধারে, হিমশীতল পরিবেশে, নীরব মরুভূমির কোলে।