1 0
Read Time15 Minute, 29 Second

ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম নিউ ইয়র্ক সিটি যাবো বলে। ইটপাথরের দালান কোটা দেখা আমার পছন্দের কিছু নয়। আমি প্রকৃতিই বেশি পছন্দ করি। তারপরও যে শহরকে ঘিরে ছোটবেলা থেকে আমার ফ্যান্টাসি, সে শহর দেখার জন্য খানিকটা উত্তেজনা হওয়াই স্বাভাবিক। ভেবেছিলাম নিউ ইয়র্ক বলে কথা! সেখানকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ক্রাইসলার বিল্ডিং, টাইমস স্কয়ার দেখতে দারুণ লাগবে আমার। কিন্তু বালাই ষাট। কী দিয়ে যে কী হয়ে গেলো… মজাই পেলাম না নিউ ইয়র্ক ঘুরে। কেন? সে কথায় আসছি ধীরে ধীরে। বিশাল এক মগে করে চা বা কফি নিন, অল্প অল্প চুমুক দিয়ে পানীয়ের স্বাদ বুঝার চেষ্টা করুন, আর বড় বড় চোখ করে পড়তে থাকুন সিরিজটা। পড়ুন আর আমাকে গালি দিন। বলুন, “বেটি ভাব ধরছে বেশি! মানুষ নিউ ইয়র্ক যেতে পায় না… আর উনি গিয়ে ভাব দোচাচ্ছেন, ‘ভালু লাগে না’ বলে।” আপনাদের আমি দোষ দেবো না। আমার নিজেরও কি ছাই ধারণা ছিল নিউ ইয়র্ক এভাবে হতাশ করবে?

আমাদের যাত্রাটাই শুরু হয়েছিল ফাতরাভাবে। জুলাইয়ের ১৪ তারিখ বিকেল চারটা বিশে হিউস্টন বিমানবন্দর থেকে ছিল আমাদের ফ্লাইট। বাসা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে গেলাম। বিমানবন্দরের পাশে ইকো পার্ক নামে একটা গাড়ি রাখার জায়গা আছে। ওখানে পাঁচদিন গাড়ি রাখবো বলে বুকিং দিয়েছিলাম। ইকো পার্কের সাথে বিমানবন্দরের যোগসাজশ আছে। কয়েক মিনিট পরপর মাইক্রোবাস দিয়ে পার্ক থেকে মানুষ তুলে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। আবার বিমানবন্দর থেকে মানুষ উঠিয়ে পার্কে তাদের গাড়ি যেখানে রাখা, সেখানে নিয়ে আসে। পার্কে গাড়ি রাখার জন্য ছায়াসহ (শেড) আর ছায়াহীন (নো শেড), দুই ধরনের জায়গা আছে। সস্তা বলে আমরা ছায়াহীন জায়গা বুক করেছিলাম। তো, পার্কে ঢুকার জন্য মূল গেট লাগোয়া স্ক্যানার মেশিনে বুকিং বারকোড স্ক্যান করতে হবে। তাহলে গেট খুলবে। আমাদের বারকোড স্ক্যান করা যাচ্ছে না। বারবার ভুল দেখাচ্ছে। কেমন লাগে? অথরিটিও মনে হয় জানে আমাদের মত অভাগাদের কথা। তাই স্ক্যানারের পাশে একটা টিকেট প্রিন্টার রাখা। প্রিন্স সেখান থেকে একটা টিকেট প্রিন্ট করলো পার্কে ঢুকার জন্য। এজন্য কোনো টাকা লাগে না। কিন্তু যখন আপনি গাড়ি নিয়ে পার্ক থেকে বের হবেন, তখন এই টিকেট স্ক্যান করতে হবে। সেটা থেকে যন্ত্র বুঝবে আপনি কতদিন পার্ক করেছিলেন। তখন আপনাকে যে বিল দেবে, সেটা পে করার পর আপনি বের হতে পারবেন।

আমরা দশ নাম্বার সারিতে একটা খালি জায়গা পেয়ে গাড়ি পার্ক করলাম। শেষবার যখন এসেছিলাম, তখন ছায়ায় পার্ক করেছিলাম। যেখানে পার্ক করেছিলাম সেখান থেকেই মাইক্রোবাস আমাদের উঠিয়ে নিয়েছিলো। তাই এবারও যেখানে পার্ক করেছি, সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু এই যে দাঁড়িয়ে আছি, কেউ নিতে আসছে না। ঘড়িতে বাজে সোয়া দুইটা। নিয়ম মাফিক এক ঘণ্টা আগে হাজিরা দিতে হবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য। তার মানে তিনটা বিশের মধ্যে আমাদের সিকিউরিটি পার হওয়ার ঝামেলা সেরে ফেলতে হবে। এখনই গাড়িতে উঠতে না পারলে ওদিকে দেরী হয়ে যাবে। কেন গাড়ি আসছে না বুঝার জন্য প্রিন্স বামদিকে এগিয়ে গেলো। আমি আগের যায়গায়ই দাঁড়িয়ে রইলাম কেউ আসলে ধরার জন্য। দশ মিনিট পর প্রিন্স কল করল, “উনিশ নাম্বার সারিতে আসো।” ওর কথা ঠিকমত শুনতে পেলাম না কারণ ভুউস করে একটা গাড়ি আমার দিকে এগিয়ে এলো। হাত নেড়ে ওটাকে থামালাম। প্রিন্সকে অপেক্ষায় রেখে চালককে জিজ্ঞেস করলাম টার্মিনাল সি’তে কীভাবে যাবো। চালক বলল, “তুমি ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। উনিশ নাম্বার সারিতে যাও। শুধু সেখান থেকেই যাত্রীদের উঠানো হচ্ছে।” ব্যাটাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রিন্সকে বললাম, “তুমি কোথায়? উনিশ নাম্বার সারিতে চলে আসো।” প্রিন্স থমথমে গলায় বলল, “আমি ওখানেই আছি। তুমি আসো।” পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলাম। জায়গামত পৌঁছাতেই দেখি একটা গাড়ি ছেড়ে দিলো। অল্পের জন্য মিস করলাম। প্রিন্স বলল, যারা ছায়ায় পার্ক করে, তাদেরকে পার্কিংয়ের জায়গা থেকে তোলা হয়। ছায়াহীন জায়গায় যারা পার্ক করে, তাদেরকে এই জায়গা থেকে তোলা হয়। আঃ মলো!

কিছুক্ষণ বাদে পরের গাড়ি চলে এলো। আমরাসহ আরও দশ বারোজনকে উঠিয়ে নিলো। টার্মিনাল সি’তে যখন পা দিলাম, তখন বাজে দুইটা চল্লিশ। এক দৌড়ে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের সেলফ চেকইন কাউন্টারে। যখন যন্ত্রে টাইপ করলাম আমাদের কোনো চেকইন ব্যাগ নেই, তখন আটকে দিলো। বলল, “অফিসারের জন্য অপেক্ষা কর। উনি এসে ব্যাগের ব্যাপারে নিশ্চিত করলে বোর্ডিং পাস প্রিন্ট করতে পারবে।” বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট দুয়েকের মাথায় একজন মঙ্গোলীয় চেহারার বান্দা এসে হাজির হল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছ?” বললাম, “নিউ ইয়র্ক।” বান্দা বিস্মিত হয়ে বলল, “শুধুমাত্র একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে নিউ ইয়র্ক চলে যাচ্ছ?” প্রশ্ন শুনে আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। বললাম, “কয়টা নেওয়ার নিয়ম?” ব্যাটা হেসে বলল, “তোমাদের যাত্রা উপভোগ্য হোক।” আমার মনে পড়ে গেল একটা ইউটিউব ভিডিওর কথা যেখানে উপস্থাপক বলছিল, “নিউ ইয়র্ক সিটিতে মানুষ তোমার পোশাক আর সাজগোজের দিকে অনেক নজর দেবে। তাই গ্রীষ্মে এলে রংচঙা জামা, শীতে এলে টার্টল নেক আর পুলওভার, বসন্তে এলে শিফন শার্ট নিয়ে আসবে…।” এই ব্যাটা নিশ্চয় সেই ঘরানার।

বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে আমরা দ্রুত টিএসএ বা Transportation Security Administration-এর লাইন ধরে দাঁড়ালাম। এই সেই বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) সিকিউরিটি চেকিং যেখানে আপনাকে কোমরবন্ধনী থেকে শুরু করে জুতা অবধি খুলতে হবে। জুতা কেন খুলতে হয় সেটা না জানলে পাশের মিমটা দেখুন। বাই দা ওয়ে, খাচ্চর ব্যাটার নাম রিচার্ড রেইড। আল কায়েদায় যোগ দিয়ে এই কাণ্ড ঘটাতে গিয়েছিলো।

আজকের লাইনটা বেশ ছোট লাগছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে যখন ওয়াশিংটন ডিসি গেলাম, তখন বিশাল লাইন ছিল। পার হতে ত্রিশ মিনিটের মত লেগেছিল। এবার ত্রিশ মিনিট লাগলো না। পনেরো মিনিটের মাথায় চেকিং পার হয়ে গেলাম। ঠিক তখন মোবাইলে মেসেজ এলো, “নিউ ইয়র্কে চলমান ঝড়বৃষ্টির জন্য ফ্লাইট ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরী হবে।” মেজাজটা বিলা হয় কিনা, বলেন। এক ঘণ্টা দেরী মানে নিউ ইয়র্কে নামবো রাত দশটায়। এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারবিএনবিতে যেতে লাগবে আরও এক ঘণ্টা। মানে রাত এগারোটা পর্যন্ত আমরা শুধু দৌড়াদৌড়ির উপরই থাকব।

চেকিং পার হয়ে সাবওয়ে রেস্তোরাঁ খুঁজতে লাগলাম। আমাদের পরিকল্পনা হল সাবওয়ে থেকে খাবার কিনে অর্ধেক খেয়ে প্লেনে উঠবো, বাকি অর্ধেক নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাবো। এয়ারবিএনবির আশেপাশে কোন রেস্তোরাঁ দেখিনি। তাই রাত দশটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর রেস্তোরাঁ খোঁজার ঝুঁকিতে না গিয়ে হিউস্টন থেকেই কিনে নেবো। জিজ্ঞেস করতে পারেন সাবওয়ে কেন। কারণ এখানকার খাবার খেলে পেট ভরে, দামেও সস্তা। চৌদ্দ ডলারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুর দিয়ে এক ফুট লম্বা স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়। দুজনে মিলে খেলেও পেটে শান্তি লাগে। কিন্তু বিধিবাম, এখানে কোনো সাবওয়ে পেলাম না। সস্তা বলতে পান্ডা এক্সপ্রেস দেখছি। চৈনিক খাবারের রেস্তোরাঁ। সেখানেই ঢুকলাম। তিনটা সাইড ডিশসহ চাওমিন কিনলাম এখানে বসে খাওয়ার জন্য, আর তিনটা সাইড ডিশসহ ফ্রাইড রাইস কিনলাম নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেনার পর বিল মিটিয়ে যখন বের হয়ে আসবো, ক্যাশিয়ার ডাক দিয়ে বলল, “তোমাদের কার্ড তো ট্রানজেকশন রিজেক্ট করেছে। আরেকবার সোয়াইপ করে যাও।” প্রিন্স আবার কার্ড সোয়াইপ করে এলো। একবার না, তিনবার। বারবার নাকি রিজেক্ট করছে। শেষবার অবশ্য কাজ হল। এরপর ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা গেটের দিকে এগুলাম। সেখানে বসে আরামসে চাওমিন খেতে লাগলাম আর পাঁচটা বিশ বাজার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কতই না স্বপ্ন দেখেছিলাম ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ দেখবো! এখন ওয়েদার অ্যাপ বলছে আমরা যে চারদিন থাকবো, তার দুইদিনই প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি হবে। ফাতরামি আর কাকে বলে। যা হোক, একসময় পাঁচটা বাজল আর আমাদের বোর্ডিং শুরু হল। এজেন্ট আমার আর প্রিন্সের আসন একসাথে, কিন্তু আলাদা জায়গায় দিয়েছে। মানে ডান আইলের একদম কিনারের সিট প্রিন্সের, আর বাম আইলের একদম কিনারের সিট আমার। দুইজন পাশাপাশি ঠিকই কিন্তু মাঝে হাঁটাহাঁটির রাস্তা। এজেন্ট কি রসিকতা করলো?

প্লেনে উঠার আগ পর্যন্ত আমার কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু যেই না জেটওয়ে দিয়ে লাউঞ্জ থেকে প্লেনের ভিতর ঢুকি, অমনি বমি পাওয়া শুরু হয়। বিচ্ছিরি এক আটকে থাকা বাতাসের গন্ধ আমার পেটের ভিতর সবকিছুকে পাঁক খাইয়ে দেয়। এই বিচ্ছিরি গন্ধের কারণে আমি এসি বাসে চড়তেও ভয় পাই। কিন্তু কী আর করা? সিটের পেছনে কাগজের যে ঠোঙা রাখে, সেটাই চোখের সামনে নিয়ে বসে থাকি। বমি এলে ওটাই ভরসা। এবারও ব্যতিক্রম হল না। ব্যাকপ্যাকটা মাথার উপরের বিনে রেখে সিটে বসতেই গা গুলিয়ে উঠলো। আমার পাশে একজন এশিয়ান মা আর তার ছেলে বসেছে। প্রিন্সের সিটের পাশে যে মিডল সিট, সেখানেও একজন এশিয়ান নারী বসেছে। ওদের উইন্ডো সিটের যাত্রী এখনও আসেনি। একটু পর প্রিন্স ডাকল। ওই নারীকে দেখিয়ে বলল, “তুমি উনার সাথে সিট বদলাবা? উনি তোমার সিটে যেতে আগ্রহী।” আমি তো এক পায়ে খাড়া! তাড়াতাড়ি সিট অদল বদল করে ফেললাম। বেটি মনে হয় দুই ব্যক্তির মাঝখানে বসতে চাচ্ছিল না। তো, প্রিন্সকে মাঝখানে বসিয়ে আমি ওর আইলের সিটে বসলাম। একটু পর এক ব্যাটা এসে উইন্ডো সিটের দখল নিলো। আমি বমিভাব কাটানোর জন্য মোবাইলে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভূতুড়ে সিরিজের একটা গল্প পড়তে শুরু করলাম।

একটু পর খেয়াল হল পাঁচটা বিশ পার হয়ে গেলেও প্লেন ছাড়ছে না। আমাদের পেছনের কয়েকটা সিটে বিশাল এক এশিয়ান পরিবার এসে কাপঝাপ লাগিয়ে দিয়েছে। এরা কীভাবে কীভাবে যেন উল্টাপাল্টা সিট নাম্বার পেয়েছে। ফলে অন্য যাত্রীদের সিটে বসে পড়েছে। এখন সে যাত্রীরা এসে বসার সুযোগ পাচ্ছে না। দুইজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট এসেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। অনেকক্ষণ ক্যাচালের পর পরিবারটাকে নতুন করে সিট বুঝিয়ে দেওয়া হল। উত্তপ্ত হয়ে এক অ্যাটেন্ডেন্ট বলল, “নিজেরা নিজেরা সিট বদলাবেন না। আমাদেরকে বলুন।” কিন্তু এই ফাঁকে সামনের সারির দুটো পরিবার নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে সিট পাল্টাপাল্টি করে ফেলেছে। অ্যাটেন্ডেন্টের কথা শুনে আমরাসহ ওই পরিবার দুটো একটু ঘাবড়ে গেলেও এমন ভাব করলাম যেন কিছুই করিনি। জনম জনম ধরে এগুলোই আমাদের আসন ছিল।

(চলবে)

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ইয়েই ভেইবে… যাচ্ছি নিউ ইয়র্ক সিটি
Next post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ২