1 0
Read Time12 Minute, 51 Second

পর্ব ১, পর্ব ২

সাবওয়ে আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো, ওখান থেকে তিন ব্লক দূরে সেন্ট্রাল পার্ক। মিনিট দশেক হাঁটার পর এলাম পার্কের একটা ফটকের সামনে। এই ফটকের সাথেই ‘জ্যাকুলিন কেনেডি ওনাসিস রিজার্ভয়ার’ অবস্থিত। আমাদের পরিকল্পনা হল পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে ক্লিওপেট্রা’স নিডল পর্যন্ত যাবো। সেখান থেকে হেঁটে শিপ মেডৌ পর্যন্ত। হাঁটা শুরুর আগে পেট ভর্তি করা জরুরী। তাই ফটকের সামনে একটা জুসের ভ্যান আর একটা নাস্তার ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলাম। প্রিন্স অর্ডার দিলো ‘সামার ফ্রুট কম্বো’ জুস আর আমি অর্ডার দিলাম হট ডগ। দাম কিন্তু সস্তা না। জুস নিলো দশ ডলার, হট ডগ আট ডলার। অনেক আগ্রহ নিয়ে প্রিন্স জুসে চুমুক দিলো আর আমি হট ডগে কামড় বসালাম। খাবার গেলার পর নিজেদের ভীষণ প্রতারিত মনে হল। এত বাজে স্বাদ! হট ডগ ভরিয়ে রেখেছে বিস্বাদ একটা সসেজ দিয়ে। এতগুলো করে দিয়েছে টমেটো সস আর মাস্টার্ড। জুস আরও এক কাঠি বাড়া। মিষ্টি নয়, পানসে; তার উপর বরফ দেয়নি। এই গরমে যে মানুষ বরফ ঠাণ্ডা জুস খেতে চাইবে, সেটাও বলে দিতে হবে নাকি?

মেজাজ খারাপ করে রিজার্ভয়ারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এটা আর কিছুই না, পার্কের মাঝে বিশাল এক জলাশয়। পাতা আর ধূলো পড়ে জলাশয়ের পানি নোংরা হয়ে আছে। এর একদিক দিয়ে হাঁটার রাস্তা। সেখানে আমাদের মত পর্যটকেরা ক্যামেরা হাতে হাঁটছে। অনেককে দেখলাম জগিং করতে এসেছে। জলাশয়ের অপরপাশে জোড়া লাগানো দুটো দালান দেখে পছন্দ হল। এদের নাম এল ডোরাডো। চটপট ছবি তুলে ফেললাম। এটাই নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে এসে আমার তোলা প্রথম ছবি। বেশ ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কী বলেন? এরপর রওনা দিলাম মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টের (সংক্ষেপে ‘মেট’) দিকে। ওখানেই ক্লিওপেট্রার সূঁচ স্থাপন করা হয়েছে। মেট নামটা কি চেনা চেনা ঠেকছে? যদি ‘মেটগালা’ নামের কোনো উৎসবের কথা শুনে থাকেন, তাহলে হ্যাঁ, সেটা এই মেট যাদুঘরেরই আয়োজিত উৎসব। প্রতি বছর অনুদান উত্তোলনের জন্য এরা যে গালা (অর্থাৎ ‘উৎসব’) আয়োজন করে, সেটাই মেটগালা নামে পরিচিত। এটাই সেই অনুষ্ঠান যেখানে প্রতি বছর তারকারা অদ্ভুত পোশাক পরে আসার মেলা লাগিয়ে দেন। ঠিক করেছি পরেরবার কখনো এলে মেট দেখবো। এবার সময় হচ্ছে না।

মেটের দিকে যেতে যেতে পানি পিপাসা পেয়ে গেলো। এক কোণায় পানীয়ের একটা ভ্যান দেখে এগিয়ে গেলাম। প্রিন্স বললো, “রিজার্ভয়ারের পানি এনে বিক্রি করছে কিনা কে জানে।” ভ্যানের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা কাকু বাংলা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা বাংলাদেশী?” আমি আর প্রিন্স পুরো হা। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম গলায় তুলসি মালা জড়ানো আর তেল ল্যাপটানো চুলের এক ব্যক্তি। বিস্ময় সামলে বললাম, “হ্যাঁ। আপনিও?” কাকু বললেন, “হ্যাঁ।” বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে এসেছেন সেটাও বললেন। আমরা একটা ঠাণ্ডা পানির বোতল কিনলাম। উনি তিন ডলারের বদলে দুই ডলার বিল রাখলেন। কিছুতেই পুরো টাকা নিলেন না। পরের ক্রেতা চলে আসায় আর কথা বলার সুযোগ পেলাম না। ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তা মাপলাম।

আজকে ভালোই গরম পড়েছে। বারবার তেষ্টা লাগছে। তার উপর নিউ ইয়র্কে আর্দ্রতা বেশি। গরমের সাথে সাথে ঘেমেও যাচ্ছি। টেক্সাসে ঘামার ঝামেলা নেই। আর্দ্রতার জন্য হাঁটা কষ্টকর লাগছে। একটু হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তারপরও মনের জোরে হাঁটছি। হাঁটা ছাড়া এখানে গতি নেই কারণ পাঁচ মাইল হাঁটতে যে সময় লাগে, গণ পরিবহনে করে ওই জায়গায় যেতেও একই সময় লাগে। এজন্য শরীর ফিট থাকলে হাঁটাই ভালো। আমরাও আধা মাইলের মত হেঁটে ক্লিওপেট্রার সূঁচের সামনে এলাম। এটা একটা অবিলিস্ক বা স্তম্ভ। গোঁড়া মোটা আগা চিকন আকৃতির। আগাটা সূঁচালো বলে নাম দিয়েছে সূঁচ। কিন্তু সূঁচের সাথে ক্লিওপেট্রার কী সম্পর্ক?

৩৭০০ বছর আগে মিশরের হেলিওপোলিসে মিশরীয় সূর্যদেবতা রা-এর মন্দিরের জন্য নির্মিত হয়েছিলো এই স্তম্ভ। আর মন্দিরটা নির্মাণ করেছিলেন মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রা। এজন্য এই স্তম্ভ পরিচিত ক্লিওপেট্রা’স নিডল নামে। নির্মাণের ৩২০০ বছর পর ১৮৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে স্তম্ভটা উপহার দেন পারস্যের এক নেতা। স্তম্ভের চার দেওয়ালেই হায়ারোগ্লিফিক আঁকা। নিচে গ্লিফের তর্জমাও করে দেওয়া। প্রাচীন মিশর বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু আগে। কিন্তু সে সময়কার খোদাই করা হায়ারোগ্লিফ রয়ে গেছে স্তম্ভের গায়ে। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন অবাস্তব এক অনুভূতি হল। আবার জীবনে একবার হলেও সিনেমা আর সাহিত্যের বাইরে ক্লিওপেট্রার স্মৃতি জড়ানো কিছু দেখে আমোদিতও হলাম।

বসার জন্য স্তম্ভের চারপাশে কয়েকটা বেঞ্চি রাখা। আমরা সেখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম ভেড়ার চারণভূমি বা sheep meadow-এর দিকে। চারণভূমিতে এখন মানুষ চরে বেড়ালেও এক সময় ভেড়া চড়ত। তাই নামটা রয়ে গেছে। চারণভূমিতে আসার কারণ হল সেন্ট্রাল পার্ক বলতে আমরা যে অংশের ছবি বা ভিডিও দেখি, সেটা আসলে এই চারণভূমি। মুভিতে বেশিরভাগ সময় এই জায়গাই দেখানো হয়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম, এটাই সেন্ট্রাল পার্ক। পরে দেখি এটা পার্কের একটা অংশ মাত্র। ওখানে যাওয়ার পথে ঠাণ্ডা পানি ফুরিয়ে গেলো। সামনে এক চাচার ভ্যান দেখে এগিয়ে গেলাম। ভ্যানের ভিতর বাংলা ভাষায় ওয়াজ চলছে। চাচা পানির পাশাপাশি আইসক্রিম বিক্রি করছেন। প্রিন্স বায়না ধরল গোলা খাবে। এখানে গোলা আইসক্রিমকে বলে পপসিকল। চাচার কাছ থেকে দুটো গোলা কিনে হাঁটা ধরলাম। বাঙালিরা মনে হয় সেন্ট্রাল পার্কে ভালোই ব্যবসা ফেঁদেছে।

পথিমধ্যে একটা ওয়াটার ফাউন্টেন পেয়ে খালি বোতলটা ভরে নিলাম। কিছুক্ষণ পর একটা খোলা জায়গায় এলাম যেখানে প্রচুর মানুষ হট্টগোল করছে। আঁকিয়েরা দশ ডলারের বিনিময়ে পোর্ট্রেট করে দিচ্ছে, প্রচুর ভ্যান গাড়ি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে। উইকেন্ড বলেই কিনা কে জানে, পার্কে এত মানুষ, এত গান বাজনা! বৈশাখী মেলার কথা মনে পড়ে গেলো। এরপর এলাম বেথেসডা ফোয়ারা নামের এক চত্বরে। এখানেও প্রচুর মানুষ। বেথেসডা ফোয়ারা এবং তদসংলগ্ন টেরেস পার্কের একটা দর্শনীয় জায়গা। আমরাও টেরেসের ভিতর ঢুকে ঐতিহাসিক নকশাগুলো দেখলাম। ১৮৬০ সালে মোজাইক টাইলস দিয়ে নির্মিত হয়েছিলো দেওয়াল আর ছাদের নকশাগুলো। ওখান থেকে বের হয়ে দেখি দুইজন তরুণ তরুণী দুটো অজগর সাপ গলায় পেঁচিয়ে ঘুরছে। সাপ হাতে বা গলায় নিয়ে ছবি তুলতে চাইলে টাকা লাগবে। অত ইয়ে নেই বলে ওদিকে পা মাড়ালাম না।

আরেকটু হাঁটার পর চারণভূমির নাগাল পেলাম। গেট দিয়ে ঢুকতেই নস্টালজিক হয়ে গেলাম। এই তো সেই দৃশ্য! এই দৃশ্যই না কতবার দেখেছি বোকাবাক্সের পর্দায়। সবুজ মাঠ, আর শেষ প্রান্তে সারিবদ্ধ দালান। এই তো আমার সেন্ট্রাল পার্ক। ভালমত বুঝার জন্য পোস্টের কাভার ফটোর দিকে দেখুন। খোলা ময়দানে প্রচুর মানুষ অর্ধনগ্ন হয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সেটা পোষাল না। আমরা মাথায় রোদ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলেছি। এখনও প্রচুর হাঁটা বাকি। রৌদ্রস্নান করলে আর দেখা লাগবে না। অ্যাম্বুলেন্স এনে পার্ক থেকে বের করতে হবে। তাই গাছের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ফেরি ধরার জন্য। এই ফেরি দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের আরেকটা বরো ‘স্ট্যাটেন দ্বীপে’ যাবো। ফেরিটা নাকি স্ট্যাচু অফ লিবার্টির খুব কাছ দিয়ে যায়। ওটা দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। সত্যি বলতে, সেন্ট্রাল পার্ক আমার অতোটা ভালো লাগলো না। জায়গাটা সুন্দর তবে আহামরি কিছু নয়। একসময় হয়ত অনন্য ছিল, কিন্তু এরকম পার্ক ইতোমধ্যে দেখে ফেলায় খুব একটা আকর্ষণীয় লাগলো না। অনেকে সেন্ট্রাল পার্কে অবস্থিত zoo দেখতে আসে। আমাদের zoo ভালো লাগে না বলে তালিকায় রাখিনি।

পার্ক ছাড়ার আগে এক শ্বেতাঙ্গ চাচার দোকান থেকে চুরো (churro) কিনলাম। এই প্রথম কোনো সাদা দোকানদার দেখলাম। চার ডলার দিয়ে লম্বা একখানা চুরো কিনে হাঁটা ধরলাম সাবওয়ের দিকে। স্প্যানিশ এই খাবার আমার খুব পছন্দের। চাচা ভিতরে ভ্যানিলার পুর দিয়ে আর বাইরে গরম মশলার গুঁড়ো মাখিয়ে চুরোর স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছেন। চার ডলার উসুল হয়েছে। ফেরি ধরার জন্য সাবওয়ে ট্রেন দিয়ে প্রথমে গেলাম ইউনিয়ন স্কয়ারে। সেখান থেকে আরেকটা ট্রেন ধরে গেলাম হোয়াইটহল টার্মিনালের কাছাকাছি। মজার ব্যাপার হল, এরা সাবওয়েকেও ট্রেন বলে, রেলগাড়িকেও ট্রেন বলে। এজন্য আমরা মেট্রোকার্ড দিয়ে ট্রেনে উঠা যায় ভেবেছিলাম। মেট্রোকার্ডের ট্রেন যে সাবওয়ের ট্রেন, সেটা অফিসার বলার পর বুঝেছি। সুতরাং, সাধু সাবধান। নাম একই হলেও জিনিস আলাদা।

(চলবে)

Happy
Happy
33 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
67 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ২
Next post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ৪