[পূর্ব কথাঃ পিএইচডি ডিফেন্সের আগ দিয়ে আমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল, সেটা নিয়ে কয়েকটা লেখা পোস্ট করব, ভাবছি। লেখাগুলো খসড়া করে ফেলে রেখেছিলাম, প্রকাশ করিনি। চাইনি পিএইচডি সফলভাবে শেষ করার আগে পিএইচডি ডিফেন্স বা তার আশেপাশের অনুভূতিগুলো নিয়ে কথা বলতে। এখন যেহেতু পিএইচডি পাশ করেই ফেলেছি, লেখাগুলো প্রকাশ করা যায়।]
কী যে অদ্ভুত সময় পার করছিলাম পিএইচডি ডিফেন্সের আগে! এই মনে হত ইমোশনাল রোলার কোস্টারে উঠে বসে আছি, এই মনে হত “ইমোশনের খ্যাতা পুড়ি। আই ঢোন্ট খেয়ার এনিমোর।” পিএইচডির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষ সেমিস্টারেরও অর্ধেক (জানুয়ারির ১৩, ২০২৫) পার হয়ে যাওয়ার পর সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করলাম যে, মে মাসের ১৪ তারিখে ডিফেন্স দিলে কাটায় কাটায় আছে আর মাত্র চার মাস। কী ভয়ংকর! আমি পিএইচডি জার্নির প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলাম সময়মত শেষ করা নিয়ে। আমার অ্যাডভাইজর একদম শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, “Aim for 3 years.” আমি খানিকটা তর্ক করে বলেছিলাম, “তিন বছর অনেক কম সময়। তুমি পাঁচ বছর না দাও, চার বছর তো অন্তত দিবা!” অ্যাডভাইজর নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ফলে আমার শুরু হল দৌড়। প্রথম সেমিস্টার থেকেই গবেষণা। ওই সময় কাকতালীয়ভাবে এক ভাই (যিনি নিজেও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এবং যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী চাকরি করছেন) বললেন, “চার বছরের কম সময়ে পিএইচডি শেষ করে ফেলতে পার কিনা দেখ। যত তাড়াতাড়ি শেষ করবা, তত তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢুকবা, তত তাড়াতাড়ি টাকা কামানো শুরু করবা। আলটিমেটলি আমাদের লক্ষ্য তো টাকা কামানোই, নাকি?” উনার কথার মাহাত্ম্য তখন বুঝতে পারিনি। অন্য নবীন পিএইচডি শিক্ষার্থীর মত আমিও তখন ‘গবেষণাই জীবনের ধ্যান জ্ঞান। আমাকে মাসে দুই হাজার ডলার দিলেই আমি সারাজীবন গবেষণা করতে রাজী’ পর্যায়ে বাস করছি। পিএইচডিতে অ্যাডমিশন পাওয়ার খুশি তখনও কাটেনি। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, ততই উপলব্ধি করেছি ভাইয়ের বাস্তববাদী পরামর্শ। মাসে দুই হাজার ডলার দিয়ে কিছুই হয় না। এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এরপর খাওয়ার খরচ, বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেটের বিল, গাড়ির ইনস্যুরেন্স (সাথে নিয়মিত লুব্রিকেন্ট বদলানো, তেল ভরা)। কয়েকদিনের জন্য একটু আউট অফ স্টেট ঘুরতে যাবেন? টাকার টানাটানি। তাও যদি সাহস করে ঘুরে আসেন, সেই খামতি পূরণ হতে হতে আরও খরচ জমবে। অনেকের ক্রেডিট কার্ডে ঋণের বোঝা জমে যায়। যেমন আমার সহকর্মী সাহারের হয়েছে। ওরা ঋণ করে গাড়ি কিনেছে, বাসা সাজিয়েছে। এখন ঋণের চিন্তায় ঘুম হয় না। কিন্তু একটু বিলাসী জীবন যাপন করতে গেলে আপনার ঋণ নেওয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে? পিএইচডির মত চব্বিশ ঘণ্টা গবেষণার চাকরিতে আপনি বেতন পাচ্ছেন সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার, অথচ কাজ করছেন দিনে চব্বিশ ঘণ্টা। তাহলেই বলুন ওই বেতন দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানো ছাড়া আর কিছু হয়? আমি আর প্রিন্স প্রচণ্ড চেপে চলা মানুষ। আমাদের বাসায় খাট নেই, সোফা নেই, টেলিভিশন নেই। বসার ঘরে প্রিন্সের চেয়ার টেবিলের সেট আপ আর পড়ার ঘরে আমার চেয়ার টেবিলের সেট আপ। শোয়ার ঘরের মেঝেতে ফেলে রেখেছি তোষক। এটাই আমাদের বাসা। গত সাত বছর ধরে এভাবেই মিনিমালিস্টিক জীবন যাপন করছি কারণ কখনোই বেতন মাসে আড়াই হাজার ডলারের চেয়ে বেশি পাইনি।
তাই প্রথম বছর পার হওয়ার পর ভাইয়ের কথাটা ঘুরে ফিরে মনে পড়তে লাগল। ঠিক করে ফেললাম অ্যাডভাইজরের মর্জিমাফিক তিন বছরেই প্যাক আপ করব। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে শুরু করেছি। শেষ করব ২০২৪ সালের আগস্টে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। দুই বছর পরও যখন প্রোজেক্ট শেষ হচ্ছে না, তখন আরেক সেমিস্টার বাড়িয়ে লক্ষ্য ঠিক করলাম সাড়ে তিন বছর। মানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর। এরপরও যখন কাজ গুছাতে পারছিলাম না, এক্সটেনশনের জন্য বললাম। অ্যাডভাইজর জানিয়ে দিলেন, “আর এক সেমিস্টার বাড়াতে পারব। এরপর তোমাকে সেলফ ফান্ডে চলে যেতে হবে।” মানে উনার ফান্ড ধরে যা টানাটানি করার, করে ফেলেছি। আর উপায় নেই। এখন যেকোনো মূল্যে ২০২৫ সালের মে মাসের মধ্যে ডিফেন্স দিয়ে ফেলতে হবে। কী করা যায়? নিজেকে তাড়া দেওয়া যায়। তাড়া দেওয়ার জন্য ছয় মাস আগে, মানে ২০২৪-এর নভেম্বরে পিএইচডি কমিটি মেম্বারদের সাথে আলোচনা করে ডিফেন্সের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললাম। শুধু তাই না, ডিফেন্সের জন্য রুমও বুকিং দিয়ে ফেললাম। আমার কাণ্ড দেখে বাদবাকি পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জবান বন্ধ। যারা আমার সাথে ২০২৫ সালের স্প্রিং সেমিস্টারে ডিফেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তারা নাকি এখনও দিনই ঠিক করতে পারেনি, তায় রুম বুকিং! যা হোক, যার প্রেষণা যেভাবে আসে। আমি দিনক্ষণ দেখে প্রেষণা অনুভব করব বলেই আগে ভাগে সবকিছু ঠিক করে ফেলেছি।
কৌশলটা কাজে দিলো। আর মাত্র এক সেমিস্টার বাকি – ব্যাপারটা মাথায় সেট হওয়ার পর পাছায় আগুন লেগে গেলো। আমার প্রথম পিএইচডি প্রোজেক্ট ইতোমধ্যে গবেষণা প্রবন্ধ আকারে জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ওটা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টা এই জানুয়ারির শেষে একটা জার্নালে সাবমিট করার কথা। অ্যাডভাইজরের সাথে বেশ কয়েকমাস এটা নিয়ে ফুটবল খেলে (উনি আমাকে ফিডব্যাক দেন, আমি খসড়া পুনঃসম্পাদনা করে উনাকে পাঠাই, আবার উনি ফিডব্যাক দেন, আবার আমি পাঠাই…) শেষমেশ অনুমতি পেলাম কো-অথরদের কাছে পাঠানোর। বড়দিনের দুই সপ্তাহ আগে দিলাম পাঠিয়ে। আর তৃতীয় প্রোজেক্টের প্রাথমিক খসড়া লিখে পাঠিয়ে দিলাম অ্যাডভাইজরের কাছে। অন্যদের কোর্টে বল পাঠিয়ে নিশ্চিন্তি মনে দুই সপ্তাহের জন্য ঘুরে এলাম কানাডা থেকে। বড়দিনের ছুটি। এই দুই সপ্তাহে আমি একবারের জন্যেও ল্যাপটপ খুলিনি, পিএইচডি সংক্রান্ত কোনো কাজ করিনি। টানা দেড় মাস দুটো প্রোজেক্ট নিয়ে পড়ে থাকার পর আমার স্রেফ মনে হচ্ছিলো, “গোল্লায় যাক সবকিছু। আর কাজ করতে পারবো না।” অ্যাডভাইজরও মনে হয় বুঝেছিলেন আমি পুড়ে কয়লা হয়ে গেছি (বার্ন্ট আউট)। তাই বেশি তামাশা করেননি ছুটির দিনগুলোতে। কিন্তু যেদিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এলাম, তার পরদিন থেকেই আবার শুরু করে দিলাম ম্যারাথন। এবার লক্ষ্য ডিজারটেশনের খসড়া লেখা। আমার ডিজারটেশন হবে স্যান্ডউইচ ডিজারটেশন। প্রথম ‘সূচনা’ অধ্যায়টা হবে আমার গবেষণার সাথে পাঠককে পরিচয় করানোর জন্য, মাঝের তিন অধ্যায় হবে তিন প্রোজেক্ট নিয়ে, আর শেষের ‘উপসংহার’ অধ্যায়টা হবে তিন প্রোজেক্টের উপর ভিত্তি করে একটা সাধারণীকৃত সারমর্ম, প্রোজেক্টগুলোর শক্তি-দুর্বলতা, আর ভবিষ্যতে কী কী করা যেতে পারে – সেগুলো বর্ণনা করে। বেশ সোজাসাপটা। কিন্তু লিখতে গেলে দেখা যায় একের পর এক রিভিশন আসতে থাকে। তখন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়। মনে হয় দিন দুনিয়াকে মধ্যমা দেখিয়ে সব ছেড়ে দিই।
যা হোক, ডিজারটেশন তো যা একটা হয় হবে, কিন্তু আমার চাকরি? ওটার কী হবে? আমি ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকেই চাকরি খোঁজা শুরু করে দিয়েছিলাম। ডিফেন্সের আগে হাতে একটা চাকরি থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা। অথচ মার্চ মাস পর্যন্তও কিছু ম্যানেজ করতে পারিনি। এরপর আছে OPT-এর জন্য আবেদন করা। চাকরি না পেলে কবে আবেদন করবো? প্রথমে ভেবেছিলাম নন-একাডেমিক চাকরিতে ঢুকব। অথচ কিছুই পাইনি। যেগুলোতে আবেদন করেছিলাম, সবগুলো থেকে প্রত্যাখ্যান এসেছে। বাধ্য হয়ে পোস্টডক্টরাল পজিশনের জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলাম। আমার আগ্রহ এমন এক বিষয়ে, যেটা নিয়ে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে না। হাতে গোনা যেগুলো করে, সেগুলোর মধ্যে সবগুলো আবার ফল ২০২৫ সেশনে পোস্টডক্টরাল রিসার্চার নিচ্ছেও না। যে কয়টা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়েছে, সবগুলোতে আবেদন করেছি। সে আবেদনের জন্য আমার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটা পজিশনের জন্য কাস্টমাইজড কভার লেটার আর সিভি তৈরি করা মুখের কথা নয়। তার উপর নিজের আগ্রহ জানিয়ে বিভিন্ন গবেষককে কাস্টমাইজড ইমেইল পাঠাতে হয়েছে। সব মিলিয়ে অবস্থা কেরোসিন হয়ে গিয়েছিল। ওই মুহূর্তে পিএইচডি গুছাব নাকি চাকরির জন্য সময় দেবো? তাছাড়া ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থী হিসেবে সব জায়গায় আবেদন করার যোগ্যতাও আমার নেই। আর গ্র্যাজুয়েশনের পর মাত্র দুই মাস সময় পাওয়া যায় চাকরি যোগাড় করার। নাহলে দেশে ফেরত। এত চিন্তা নিয়ে কীভাবে আমার সময় গিয়েছে, সেটা শুধু আমি (আর আমার মত ভুক্তভোগী) জানি।
(চলবে)