দ্বিতীয় দিন (১৬ মে, ২০২২)
গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স জাতীয় উদ্যান, কলোরাডো
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব
নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত কাপুলিন আগ্নেয়গিরি থেকে রওনা দিয়ে সাড়ে চারটার মধ্যে আমরা কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের সীমানায় চলে এলাম। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোকে অনেকে একেকটা দেশের সাথে তুলনা করেন। এর যথেষ্ট কারণও আছে। একেকটা অঙ্গরাজ্য যে বিশাল আয়তনের, এদের ভূ-প্রাকৃতিক চেহারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। শুধু তাই না, এদের সরকার ব্যবস্থাও ভিন্ন হতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা আছে, তারপরও অঙ্গরাজ্যগুলোর নিজস্ব সরকার ব্যবস্থাও আছে। এদের বলে স্টেট গভর্নমেন্ট। এরা নিজেদের মত আইন কানুন জারি করতে পারে। এ কারণেই দেখা যায় ক্যালিফোর্নিয়ার মত স্বাধীনচেতা অঙ্গরাজ্যে সেই ২০০৮ সাল থেকে সমকামী বিবাহকে মেনে নেওয়া হলেও অ্যালাবামা, আরকান্সা, লুইসিয়ানা কিংবা কেন্টাকির মত রক্ষণশীল অঙ্গরাজ্যে সমকামী বিবাহকে মেনে নিতে মোটামুটি ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট) সমকামী বিবাহকে নাগরিকদের অধিকার বলে ঘোষণা দেয়। এরপর তো আর অঙ্গরাজ্যেগুলোর সমকামী বিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জো নেই!

যা হোক, কলোরাডোর শুরু যেখান থেকে, সেখানে একটা ছবি না তুললে চলে? তাই বেড়া ডিঙ্গিয়ে ঝটপট নেমে পড়লাম রাস্তার ওপাশে। প্রথমে দ্বিধায় ছিলাম বেড়া ডিঙ্গানো যাবে কিনা। পরে দেখি আরও কিছু পোলাপান এবং মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বেড়া ডিঙ্গোচ্ছে। আমার আর ভয় কী? ছবি দেখে নিশ্চয় ভাবছেন, এখনও প্রকৃতি এমন রুক্ষ কেন? কখন কলোরাডোর বিখ্যাত উঁচু উঁচু পর্বত আর সবুজে ঘেরা প্রকৃতি দেখতে পারবেন? বিশ্বাস করুন, আমিও তাই ভাবছি। এখনও পর্যন্ত মরুভূমি ধরনের অনুভূতি। মনে হচ্ছে গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স অবধি এমনই থাকবে। ছবি টবি তুলে আবার রওনা দিলাম। খানিক বাদে আশেপাশের চেহারা পাল্টে গেলো। যতো এগুচ্ছি, রাস্তার দুইপাশের পাহাড়গুলো কাছে সরে আসছে (ছবি ১)। আরে, এগুলো তো রকি মাউন্টেনের সারি! রকি মাউন্টেইন জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার আগেই যে পথে রকি পর্বত পড়বে, চিন্তা করিনি। ধীরে ধীরে চোখের সামনে উন্মুক্ত হতে লাগলো একের পর এক পাহাড় আর দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। কতো পড়েছি রকি মাউন্টেনের কথা! সমাজ বই থেকে হুমায়ূন আহমেদ, কোথায় বাদ ছিলো না এই মহান আশ্চর্য?

পাহাড়ের সারি দেখতে দেখতে স্যান্ড ডিউন্স জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার নির্দিষ্ট রাস্তায় উঠে পড়লাম। মূল হাইওয়ে থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে এই রাস্তায় ঢুকতে হলো। রাস্তাটা সোজা উদ্যানের ফটক পর্যন্ত চলে গেছে। আপনি চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালালেও একটানে চলে যেতে পারবেন। এই রাস্তায় ঢুকার পর একটা পর্বতের দিকে তাকিয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেলো। এতো বিশাল! ডানের ছবিটার দিকে তাকালেই বুঝবেন (ছবি ২)। ছবির মাঝখানে, পাহাড়ের পাদদেশে একটা সাদা বাড়ি দেখছেন? খালি চোখে খুঁজে না পেলে অণুবীক্ষণ যন্তর ব্যবহার করুন। ওই বাড়ির সাথে পাহাড়ের আকৃতির তুলনা দেওয়ার জন্যেই ছবিটা দিলাম। জানতে ইচ্ছে করছিলো বাড়িটায় থাকে কারা। এদের ভয় লাগে না পাহাড়ের দিকে তাকালে? আমার তো বিশাল আকৃতির জিনিসের প্রতি অমূলক ভয় আছে, যাকে বলে Megalomania । অবশ্য প্রিন্স বলে আমার নাকি দুনিয়ার সব জিনিসের প্রতিই অমূলক ভয় আছে। কথাটা সত্যি। আমার লেখার পাঁড় ভক্ত বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তারা ভালো জানবেন। বিভিন্ন লেখায় আমি এসব ফোবিয়ার কথা বলে থাকি। হেহে!

আমরা অবশ্য সাঁই করে উদ্যানে চলে গেলাম না। আমাদের একটু ডাইনে বায়ে তাকাতাকি করতে হলো। আমরা পরিকল্পনা করেছি স্যান্ড ডিউন্সে (বাংলা করলে ‘বালির ঢিবি’) উঠে সেখান থেকে স্যান্ড বোর্ডের সাহায্যে পিছলে নামবো। ব্যাপারটা নাকি সেই মজার! এই কাহিনী না করলে নাকি ঢিবিতে আসা ব্যর্থ। আমাদের ভ্রমণ যেন ব্যর্থ না হয়, সেজন্য আগেভাগেই খোঁজ নিয়ে রেখেছিলাম কোথা থেকে স্যান্ড বোর্ড ভাড়া করা যায়। অন্তর্জালের একটা ভ্রমণ বিষয়ক ফোরাম থেকে জানতে পেরেছিলাম, উদ্যানে ঢুকার মিনিট পাঁচেক আগে ‘ওয়েসিস’ নামের একটা দোকান পড়ে। সেখান থেকে বিশ ডলারের মধ্যে বোর্ড ভাড়া করা যায়। আমরা তাই উদ্যানে যাওয়ার পথে ডানে বাঁক নিয়ে, নুড়ি ফেলানো রাস্তা ধরে ওয়েসিসে এলাম।এরা ঝানু ব্যবসায়ী। আমাদের হাবভাব দেখেই বুঝে ফেললো প্রথমবার এসেছি, অতশত বুঝি না। তাই খুব সাহায্য করছে ভাব ধরে বললো, “বোর্ডের ভাড়া দিন প্রতি চল্লিশ ডলার। কিন্তু তোমাদের জন্য বিশ ডলারে ছাড়তে রাজী আছি।” কিঞ্চিৎ সন্দেহের চোখে তাকালাম। ফোরামের তথ্য অনুযায়ী বিশ ডলারই হওয়ার কথা ভাড়া। এরা চল্লিশ ডলার বলছে কেন? প্রিন্স ফিসফিস করে বলল, “একচেটিয়া ব্যবসা করছে তো, চল্লিশ ডলার হলেও মানুষ নিবে।” কথা ঠিক। তবে বাঁচোয়া যে, এরা চল্লিশ ডলারে ফিক্সড থাকেনি। আমরা একটু মুলামুলি করলাম, “পনেরো ডলারে দিবা নাকি বল।” বেটি হাসতে হাসতে বললো, “ন্যাহ। তবে তোমরা যে বিশ ডলারে পাচ্ছ, এটা আর কাউকে বোলো না। আমাদেরও তো ব্যবসা করে বাঁচতে হবে, নাকি?” শুনেছিলাম পাঞ্জাবীরা ভালো ব্যবসায়ী। এই শ্বেতাঙ্গের শরীরে নির্ঘাত পাঞ্জাবী রক্ত বইছে।

আমরা কাষ্ঠ হেসে দুটো বোর্ড ভাড়া করলাম। বোর্ডের সাথে ছয় টুকরো সাদা রঙের মোম দিলো। এই মোম দিয়ে বোর্ডের পাছা ভালোমতো ঘষে তারপর সেটা দিয়ে বালির উপর স্লাইড করতে হবে। মোম না ঘষলে বালির উপর মসৃণভাবে বোর্ড চলবে না, সাথে বোর্ডের কাঠ ক্ষয়ে যাবে। দোকান থেকে যখন বের হলাম, তখন বাজে বিকেল সাড়ে সাতটা। রোদ পড়ে যেতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় চারদিক অদ্ভুত সুন্দর হয়ে আছে। মিনিট খানেক গাড়ি চালানোর পর চোখে পড়লো “গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স জাতীয় উদ্যান“-এর ফলক। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যেহেতু ফরজ, তাই চটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম (ছবি ৩)। ছবি তোলার উত্তেজনায় আশেপাশে তাকানোর কথা মনে ছিলো না। কিন্তু যখন তাকালাম, অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম (ছবি ৪)। জগত সংসারের অতি ক্ষুদ্র জীব আমি, আমার নশ্বর চোখের সামনে যা দেখছি, সেটাকে বর্ণনা করার মত বিদ্যে পেটে ধারণ করি না। তারপরও পাঠকদের স্বার্থে বলছি… পিছনে ধোঁয়াটে রকি, মাঝে বালির স্তূপ, আর সামনে মরুভূমির মাঝে ছোট্ট একটা গাছ… । এরচেয়ে স্বপ্নালু দৃশ্য আর কোথাও দেখেছেন? সটান রূপকথা থেকে মেরে দেওয়া একটা ছবি। হালের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে বানানো একটা ছবি বললেও ভুল হবে না। কিন্তু না, এটা একটা বাস্তব ছবি। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়াই। সাধে কি বলে, প্রকৃতিমাতাই সবচেয়ে বড় সম্পাদক? যা কারসাজি করার করে রেখেছেন। আমরা শুধু মোবাইলে ক্লিক করে যাই।

যে বালির ঢিবি আমরা দেখতে যাচ্ছি, সেটারই পেছন দিকটা ফুটে উঠেছে এই ছবিতে। রকি মাউন্টেনের একপাশে অল্প একটু জায়গা জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে এই জিনিস তৈরি হয়েছে। খুব বেশি নাম শুনিনি এই জায়গার। সত্যি বলতে কি, রকি ভ্রমণের পরিকল্পনা করার আগে জানতামই না গ্রেট স্যান্ড ডিউন্স নামে একটা জাতীয় উদ্যান আছে যুক্তরাষ্ট্রে। যখন রকি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি, তখন এটার নাম জানতে পারলাম। একটু পড়ালেখা করে বুঝলাম এই উদ্যানে আছে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় বালির ঢিবি। স্টার ডিউন নামের সে ঢিবির উচ্চতা ৭৫০ ফিট। পর্বত জয়ের মত অনেকে এই ঢিবি জয় করতে আসে। আমরাও ভাবলাম ঢুঁ মেরে যাই যেহেতু রকিতে যাওয়ার পথেই পড়ছে। ইয়ে মানে, ঠিক পথে না। পাঁচ ঘণ্টার একটা ডিটুর করতে হয়েছে এখানে আসার জন্য। তবে সেটা ব্যাপার না। আমাদের এমনিতেই সবগুলো জাতীয় উদ্যান দেখার ইচ্ছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ এলে সেটা হাতছাড়া করা উচিৎ নয়। যা হোক, উদ্যানে প্রবেশ করতে করতে সন্ধ্যে আটটা বেজে গেলো। সন্ধ্যে বলছি কারণ তখনও রাত নামেনি। সূর্যের আলো তখনও মৃদু উত্তাপ ছড়াচ্ছিলো। সে উত্তাপ থাকতে থাকতেই আমরা তাঁবু গেঁড়ে ফেললাম (ছবি ৫)। তাবুর বামে যে লোহার বাক্সটা দেখছেন, এটা ভাল্লুকের হাত থেকে খাবার রক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে। খেয়ে দেয়ে অতিরিক্ত খাবার এখানে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেবেন। বাইরে খাবার রাখলে ভাল্লুক এসে হামলা করতে পারে।
আমরা এক সপ্তাহ আগে উদ্যানের ওয়েবসাইট থেকে আমাদের জন্য ক্যাম্পসাইট বরাদ্দ করে রেখেছিলাম। যেহেতু এই উদ্যান তেমন জনপ্রিয় নয়, তাই এক সপ্তাহ আগেও ক্যাম্পসাইট খালি পেয়েছিলাম। অথচ রকি পর্বত জাতীয় উদ্যানে এক সপ্তাহ আগে কোনো ক্যাম্পসাইট খালি পাইনি। পরে জেনেছি জনপ্রিয় জায়গাগুলোতে নাকি তিন থেকে ছয় মাস আগে ক্যাম্পসাইট বুকিং দিতে হয়। তো, তাঁবু গেঁড়ে খাওয়া সারতে সারতে সন্ধ্যে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। সূর্য তখনও ডুবেনি। তাই ভাবলাম বালির ঢিবির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিই। ইচ্ছে আছে রাত বারোটা পর্যন্ত সেখানে থাকবো। যেহেতু গতকাল পূর্ণিমা গিয়েছে, আজও চাঁদ ফকফকা জ্যোৎস্না দেবে। সে জ্যোৎস্নায় মরুভূমি দেখার অভিজ্ঞতা অপার্থিব হওয়ার কথা!