1 0
Read Time15 Minute, 3 Second

২০২৩ সালের জুন মাস চলে গিয়ে জুলাই চলে এলো। সামারের একমাস পূর্ণ হলো। ভেবেছিলাম এই সামারে কোথাও যাবো না। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, “আজ আমি কোথাও যাবো না।” উনি যাঁর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সেই নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, “আমি আজ কোথাও যাবো না।” বাক্য দুটোর পার্থক্য ধরতে পেরেছেন? না পারলে চেষ্টা করতে থাকুন আর আমি গল্প বলতে থাকি। ভেবেছিলাম সামারের তিন মাস হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে পিএইচডি আদ্দেক শেষ করে ফেলবো। প্রিন্সকে খুব ভাব নিয়ে বলেওছিলাম, “এই তিনমাস আমি দরজা আটকে পড়ে থাকবো। নো ডিস্টার্ব।” প্রিন্স মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়েছিলো। তবে অন্যদিকে ঘুরে একচোট হেসে নিয়েছিলো কিনা, জানি না। সে আমাকে ভালোমতোই চেনে। খুব ভালোমতো জানে, যার হয় না নয়ে, তার হয় না নব্বইয়ে। এর আগেও এইসব আলতু ফালতু পিতিজ্ঞে করে রাখতে পারিনি। এবারও নিশ্চয় ধরে নিয়েছিলো, পারবো না। হলোও তাই। একমাস হতে না হতেই মস্তিষ্কের ভিতর একটা পোকা পিনপিন করতে লাগলো, “এই শুভ্র! এই”, থুক্কু “অ্যাই, নির্ঝর অ্যাই! ঘুরতে যাবা না?” মিজাসটা কিমুন লাগে, বলেন? প্রথম ক’দিন পাত্তা দিইনি। কিন্তু পিনপিনানি থেকে পোকার কণ্ঠ তীব্রতর হতে লাগলো। একসময় শুনতে শুরু করলাম, “জীবন এতো ছোটো কেনে?” কিংবা “সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ” ইত্যাদি। না পারতে প্রিন্সকে গিয়ে বললাম, “ও কাকা, লও যাই গা।” তিশমার মত আংরেজি টান দিয়ে গাইতে পারলে জোশ হতো। কিন্তু আমার সরল অনুরোধেই বোধকরি প্রিন্স ভেতরে ভেতরে হেসে ফেললো। আমাকে বুঝতে না দিয়ে মাথা ঝাঁকালো, “কই যাবা?”

গত বছরের ডিসেম্বরে আমাদের নিউ ইয়র্ক সিটিতে বড়দিন করার কথা ছিলো। একটা লেখাও নামিয়ে ফেলেছিলাম সে উপলক্ষ্যে। কিন্তু জরুরী দরকারে পরিকল্পনাটায় পানি ঢেলে দেশে উড়াল মারতে হয়েছিলো। মারার আগে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট ক্যান্সেল করে টাকাটা এয়ারলাইন্সের একাউন্টে ক্রেডিট হিসেবে জমা রেখেছিলাম। ইকোনোমি ক্লাসের টিকেট কেটেছিলাম বলে নগদ টাকা ফেরত পাওয়ার অপশন ছিলো না। ওই ক্রেডিট আবার এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে খরচ করতে হবে, নতুবা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। তাই ভাবলাম শীতকালে না গিয়ে গ্রীষ্মকালেই নিউ ইয়র্ক শহরটা দেখে আসি। বড়দিনের সময় যদি প্রচণ্ড তুষারপাত হয়, তাহলে ঘোরাঘুরি কেঁচে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, এই কাণ্ড ঘটেছিলো ২০২২-এর ডিসেম্বরেই। রেকর্ড পরিমাণ তুষার ঝড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ছেয়ে গিয়েছিলো। সেখানকার বড়দিন কেঁচে গিয়েছিলো। তাই হুট করে আমাদের দেশে যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ সান্ত্বনাজনকই। দেশে মা-বাবার সাথে বড়দিন করেছি। নিউ ইয়র্কে গেলে তুষার ঝড়ে পড়ে এয়ারবিএনবিতেই আটকে থাকতে হতো। যা হোক, জমে থাকা ক্রেডিট ব্যবহার করে কেটে ফেললাম নিউ ইয়র্কের টিকিট। জেএফকে বিমানবন্দরের টিকিট বেশ দামী। তাই আরেকটু কম দামী বিমানবন্দর ‘লাগুয়ার্দিয়া’-তে টিকিট কাটলাম। এয়ারবিএনবিও ভাড়া নিয়ে ফেললাম পাঁচ রাতের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী দুই সপ্তাহের ভিতর রওনা দেবো স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটিতে।

আমি যেহেতু কোথাও যাওয়ার আগে হালকা গবেষণা করে বুঝার চেষ্টা করি কোন কোন জায়গায় না গেলেই নয়, এবারও খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম। NYC নিয়ে দুনিয়ার যতো ইউটিউব ভিডিও আছে, যতো ব্লগ আর ভ্লগ আছে, সব দেখা শুরু করলাম। নিউ ইয়র্ক শহর মোট পাঁচটা borough (বাংলায় কি পাড়া বলবো, নাকি এলাকা?) নিয়ে গঠিত। ম্যানহাটন, ব্রংক্স, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড, কুইন্স আর ব্রুকলিন। এগুলোর মধ্যে আমি পরিচিত ছিলাম শুধু ম্যানহাটন আর ব্রুকলিনের সাথে। এ দেশে আসার পর ব্রংক্স আর কুইন্স চিনেছি। কিন্তু স্ট্যাটেন আইল্যান্ড চিনতে আমার বহু বছর লেগেছে। তাও চিনতাম না যদি স্যাটার্ডে নাইট লাইভ না দেখতাম। ওখানে পিট ডেভিডসন নামে এক কাস্ট মেম্বার ছিল আর কলিন জোস্ট নামে এক কাস্ট মেম্বার আছে (স্কারলেট ইয়োহান্সেনের ভক্তরা ইনাকে ভালো চিনবেন। ভক্তদের দিল দুখায়া ইয়ে বজ্জাত ব্যাটা) যাদের বেড়ে উঠা স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। পিট ডেভিডসন তো নিজেকে ‘কিং অফ স্ট্যাটেন আইল্যান্ড’ হিসেবেই পরিচয় দেয়! ওরা দুজনই স্ট্যাটেন আইল্যান্ড নিয়ে নানা রংতামাশা করে থাকে। সে সুবাদে দ্বীপটাকে চেনা আর কি। বলে রাখা ভালো, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখার জন্য অনেকে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ফেরিতে উঠতে পরামর্শ দেয়। এটা নাকি ফ্রি এবং স্ট্যাচুর খুব কাছ দিয়ে যায়। তাই পয়সা খরচ করে কোনো ক্রুজে না উঠে এই ফেরিতে উঠলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবেন। আইল্যান্ডে যেতে পারবেন, আবার স্ট্যাচুও দেখতে পারবেন। আমাদেরও তাই ইচ্ছা। যদি সময়ে কুলায়, দ্বীপটাও ঘুরে আসবো।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি কুইন্সে। নিউ ইয়র্কের মত শহরে সস্তায় থাকতে হলে তিন মাস আগে থেকে এয়ারবিএনবি বুক করা লাগে। সেখানে আমি তিন সপ্তাহের নোটিশে বুক করেছি। এজন্য ম্যানহাটন, যেখানে বেশিরভাগ টুরিস্ট স্পট অবস্থিত, সেটার কাছেপিঠে কোনো সস্তা থাকার জায়গা পাইনি। যেখানে উঠবো, সেখান থেকে ম্যানহাটনের টুরিস্ট স্পটগুলোতে যেতে গণপরিবহনে (বাস এবং সাবওয়ে মিলিয়ে) এক ঘণ্টার মত লাগবে। তাই সই। আমাদের তো এয়ারবিএনবিতে ঘুমানো ছাড়া কোনো কাজ নেই। একবার স্পটে পৌঁছুলে সারাদিন ঘুরবো, রাতে বাসায় ফিরবো। তাই আসা যাওয়া মিলিয়ে দুই ঘণ্টা তেমন গায়ে লাগলো না। ম্যানহাটনে কোথায় কোথায় ঘুরবো, সেটার তালিকা করার জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির মানচিত্র খুললাম। ওমা! এ তো দেখি দ্বীপের মত খণ্ড একটা জায়গা। ইস্ট রিভার নামের নদী ম্যানহাটনকে কুইন্স আর ব্রুকলিন থেকে আলাদা করেছে। হার্লেম নদী করেছে ব্রংক্স থেকে আলাদা। আবার হাডসন নদী করেছে নিউ জার্সি থেকে আলাদা। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে ম্যানহাটনের চেহারা হয়েছে দ্বীপের মত। তো, ব্রুকলিন থেকে ম্যানহাটনে আসার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো বিখ্যাত ব্রুকলিন ব্রিজ এবং ম্যানহাটন ব্রিজ। নিন্দুকেরা বলে বলিউড পরিচালক করন জোহর নিউ ইয়র্কে তার সিনেমার শুটিং করলে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না সব অনুভূতির জন্যই কলাকুশলীদের ব্রুকলিন ব্রিজ পার্কে নিয়ে আসেন। সেখানকার বেঞ্চে বসে অভিনেতারা হয় কাঁদে, নয় প্রেম করে। বিশ্বাস না হলে কাল হো না হো কিংবা কাভি আলভিদা না কেহেনা চলচ্চিত্র দেখুন and thank me later.

ব্রিজ দুটোকে লিস্টিতে ঢুকিয়ে মনোযোগ দিলাম অন্য জায়গার প্রতি। প্রথমদিন আমাদের ম্যানহাটনে ঘোরার পরিকল্পনা। আমরা যদি সেন্ট্রাল পার্ক থেকে যাত্রা শুরু করি, তাহলে একটানা টপ অফ দা রক, টাইমস স্কয়ার, রকেফেলার সেন্টার, ফিফথ এভেনিউ, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ফ্ল্যাট আয়রন বিল্ডিং, গ্রিনিচ ভিলেজ, সোহো হয়ে ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক, লিটল ইতালি, চায়না টাউন, ব্যাটারি পার্ক এবং স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে পারবো। নাইন ইলেভেন মেমোরিয়াল দেখারও ইচ্ছে। যে ঘটনা পুরো বিশ্বের গতিপথ বদলে দিয়েছিলো, সে ঘটনার স্মৃতি জড়ানো জায়গায় যাওয়া উচিৎ বলেই মনে করি। তবে একদিনে এতগুলো জায়গা দেখা সম্ভব কি না, বুঝতে পারছি না। আপাতত পরিকল্পনা করি, পরে অবস্থা দেখে ব্যবস্থা। দ্বিতীয় দিন যাবো মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরিতে। এখানে ঘুরার জন্য আমরা অর্ধেক দিন জমিয়ে রেখেছি। এই যাদুঘর আমার স্বপ্নের যাদুঘর। কোন শ্রেণিতে পড়ার সময় এর কথা প্রথম জেনেছিলাম, মনে নেই। কিন্তু ছোটো থেকেই নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টোরির প্রতি আমার অবসেশন। টিকেটও কিনে ফেলেছি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তৃপ্তি মিটিয়ে এটা দেখার পর যাবো ব্রুকলিন ব্রিজ আর সেটার সাথে লাগোয়া ডাম্বো নামক এলাকায়। বন্ধু ফরহাদ পরামর্শ দিয়েছে বিকেলের দিকে যেতে। তাহলে দিনের আলোয় ব্রিজের সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি রাতের আঁধারেও দেখতে পারবো। চলচ্চিত্রে কতবার দেখেছি আলোয় ঝলমল করা ব্রুকলিন আর ম্যানহাটন ব্রিজ! এবার চর্মচক্ষে দেখবো। আহ! দেরী যেন সইছেই না।

তৃতীয় দিন ঘুরবো কুইন্সে আর ব্রুকলিনে। দুটো এলাকা পাশাপাশি বলে একদিনে ঘুরার পরিকল্পনা করেছি। বাংলাদেশীদের আড্ডাখানা হিসেবে পরিচিত জ্যাক্সন হাইটস অবস্থিত কুইন্সে। জ্যাক্সন হাইটসে একবার ঢুঁ মারার ইচ্ছে। মন চাইলে চড়া মূল্যের দেশী বিরিয়ানিও সাঁটাতে পারি। ফরহাদ বললো, “ওখানে দেখবি দেওয়ালে দেওয়ালে ওরস শরীফের বাংলা পোস্টার। টং দোকানে গিয়ে বলতে পারবি, ‘মামা, কড়ড়া লিকারের একটা চা দেন, সাথে সমুচা।’ দেখবি রাস্তাঘাটে পানের পিক আর থুথু ছিটানো।” এইসব বাঙালি কারবার না দেখে কি নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ পূর্ণ হবে, বলুন? তবে তৃতীয় দিনের পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত করিনি। কুইন্স আর ব্রুকলিনের কোথায় কোথায় যাওয়া ফরজ, ঘেঁটে দেখিনি। বাদ আছে চতুর্থ দিনের পরিকল্পনাও। আস্তে ধীরে সব গুছিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। যতদিন থাকবো, অন্তত দুইবেলা রাস্তার খাবারের রসাস্বাদন করবো। নিউ ইয়র্কের স্ট্রিট ফুড নাকি জগদ্বিখ্যাত। ওখানে নাকি সস্তায় বাংলাদেশী, ভারতীয়, মেক্সিকান – সব জাতির কুইজিন পাওয়া যায়। তাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড চেখে দেখা। বাকি একবেলা খাবো দোকানের খাবার। কয়েকটা দোকানের খাবার না চাখলে নাকি জীবন ব্যর্থ। যেমন, ব্লিকার স্ট্রিটের পিতসা, চায়না টাউনের রামেন, ‘লস টাকোস নুমেরো উনো’ নামক দোকানের টাকো কিংবা ‘বেস্ট বেগল অ্যান্ড কফি’ নামক দোকানের বেগল। ওহ! নিউ ইয়র্কের আরেকটা খাবার চাখতে হবে। হট ডগ। এটা নাকি সব পর্যটকের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। আমারও দেখার ইচ্ছা টেক্সাসের হট ডগের সাথে বিগ অ্যাপলের হট ডগের কী এমন পার্থক্য।

শেষমেশ যারা ভাবছেন “নির্মলেন্দু গুণ আবার কোন কবিতায় উপরের পঙক্তিটা বলেছিলেন?” তাদের বলছি, বরফ পড়ার দৃশ্য দেখে আবেগী হয়ে কবি লিখেছিলেনঃ
‘খুলে দাও বরফের আলপনা আঁকা
হোটেলের সমস্ত জানালা,
খুলে দাও আমার পোশাক।
আমাকে আবৃত করে আজ শুধু
বরফ ঝরুক সারাদিন।
আমি আজ কোথাও যাবো না,
আজ শুরু বরফের সাথে খেলা।’
Happy
Happy
100 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ১৮ (যেভাবে চলছে ২০২৩-এর গ্রীষ্মকালীন পিএইচডি)
Next post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ১