0 0
Read Time11 Minute, 26 Second

পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩

ছবি ১

সেন্ট্রাল পার্ক থেকে বের হওয়ার সময় দেখেছিলাম আকাশ কালো হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে এবং চলবে রাত অবধি। এই বৃষ্টির মধ্যে ফেরিতে উঠবো কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু চারদিনের মধ্যে দুইদিনই যেহেতু বৃষ্টি হবে, বৃষ্টি মাথায়ই ঘুরা উচিৎ। না হলে অনেক কিছু অদেখা রেখে ফেরত যেতে হবে। তাই সাবওয়ে ধরে চলে এসেছি হোয়াইটহল টার্মিনালের কাছাকাছি। এই টার্মিনাল থেকে ফেরিটা ছাড়ে। সাবওয়ে থেকে টার্মিনালে আসতে দশ মিনিট লাগলো। এত ঘোরপ্যাঁচ! একই জায়গায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্রুজ টুর আর সরকারী ফেরির জেটি। দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যা হোক, প্রাইভেট জেটি পার হয়ে যখন ডানপাশের ছবির (ছবি ১) মত বিশাল সাইন খুঁজে পাবেন, বুঝবেন ঠিক জায়গায় এসেছেন। এই ফেরি শনি আর রবিবারে প্রতি ত্রিশ মিনিট অন্তর ছাড়ে। সোম থেকে শুক্র ছাড়ে পনেরো মিনিট অন্তর। আমরা টার্মিনালে পৌঁছার ঠিক কয়েক মিনিট আগে সাড়ে চারটার ফেরি ছেড়ে গেছে। এখন বসে থাকো আধা ঘণ্টা। না, বসে থাকার উপায় নেই। সব মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। সবার ইচ্ছা ফেরিতে উঠে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানোর। দৌড়ের একটা প্রতিযোগিতা হবে মনে হচ্ছে। কাছা বেঁধে ওদের সাথে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের পিছে দেখতে দেখতে আরও শ’খানেক লোক জুটে গেলো। এলাহি কারবার।

সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আধা ঘণ্টা। গেটের উপর একটা ঘড়ি আছে। সেটা দেখে সবাই কাউন্টডাউন করছে পাঁচটা বাজতে তিন মিনিট বাকি… দুই মিনিট… এক মিনিট…। এই তো পাঁচটা বেজে গেছে! এখনই গেট খুলবে। কিন্তু না। পাঁচটা পাঁচ বেজে গেলো, গেট খুলল না। কাহিনী কী? একটু পর দেখি ফেরি থেকে যাত্রীরা নামছে। অন্যপাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছে। বুঝলাম ওরা নামলে আমরা উঠবো। পাঁচটা দশের দিকে আমাদের জন্য গেট খুলে দেওয়া হল। দুদ্দাড় করে সবাই ঢুকতে শুরু করলো। আমি মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রে এসে এই প্রথম মানুষকে কোনো লাইন ছাড়া দাঁড়াতে দেখলাম এবং দেশী মানুষজনের মত হামলে পড়ে ভিতরে ঢুকতে দেখলাম। হাহাহা!

ছবি ২

ফেরিতে ঢুকে ডানদিকের রেলিং ধরার জন্য দৌড়ালাম। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে স্ট্যাচুটা ওইদিকেই পড়বে। ইতোমধ্যে রেলিং ধরে সবার দাঁড়ানো শেষ। আমি খুঁজে পেতে চিপা একটা জায়গায় সেঁধিয়ে গেলাম। প্রিন্সের জন্য জায়গা করতে পারলাম না। ওর অবশ্য কিছু যায় আসে না। পুরো নিউ ইয়র্ক টুরেই ওর অনীহা ছিল। আর কোনোদিকে সুবিধা করতে না পেরে নিউ ইয়র্কে আসতে হয়েছে। প্রিন্সের ইচ্ছে ছিল চ্যানেল আইল্যান্ডসে যাবে। আইল্যান্ডস বলছি কারণ এটা পাঁচটা দ্বীপের সমাহার। ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের তেষট্টিটা জাতীয় উদ্যানের একটা। ভীষণ সুন্দর! কিন্তু ওখানে গিয়ে ক্যাম্পিং করাটা আমাদের বাজেটে কুলাচ্ছিল না। দ্বীপগুলো অনেক ছোটো বলে পর্যটকদের থাকার জন্য হোটেল, মোটেল নেই। ক্যাম্পিংই ভরসা। আবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গিয়ে গিয়ে দ্বীপগুলো দেখে আসাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দেখতে হলে ওখানে ক্যাম্পিং করে দেখাই যুক্তিযুক্ত। সব মিলিয়ে পরিকল্পনাটা বাদ দিতে হয়েছিলো। বদলে তালিকায় ঢুকেছিল নিউ ইয়র্ক সিটি। কোথায় আগরতলা আর কোথায় চৌকির তলা অবস্থা।

ফেরির রেলিং ধরে দাঁড়ালে দূরে পুতুলের মত স্ট্যাচু দেখা যায়, কিন্তু মন ভরে না। সবার মত আমিও অপেক্ষা করছি স্ট্যাচুর কাছে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে খেয়াল করলাম ফেরি থেকে শহরের স্কাইলাইনও খুব সুন্দর ফুটে উঠে। কালো আকাশের কারণে ছবিগুলো পরিষ্কার আসেনি, কিন্তু বুঝা যায় দানব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলোর অস্তিত্ব (ছবি ২)। এক ব্যক্তি দূরে দেখিয়ে বলল, “ওই যে চারটা মিনার দেখা যাচ্ছে, ওটা এলিস আইল্যান্ড।” অনেক নাম শুনেছি এই দ্বীপের, কিন্তু দেখতে যাওয়ার তালিকায় রাখিনি। ভালোই হল এক পশলা দেখতে পারলাম। একটু পর হর্ন বাজিয়ে ফেরি ছাড়ল। ধীরে ধীরে শহরের সীমানা থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। হাডসন নদীর নিস্তরঙ্গ বুক চিরে ফেরি চলতে লাগলো। ফেরির কারণেই একটু যা ঢেউ উথলে উঠছে। প্রিন্স জিজ্ঞেস করলো, “ছোটবেলায় ধুমসে মুখস্ত করেছি কোন দ্বীপে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি অবস্থিত। নামটা মনে আছে?” আমার মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। কিছুতেই মনে করতে পারছি না এরকম কোনো সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করেছিলাম কিনা। একটু পর প্রিন্সই উত্তর দিলো, “লিবার্টি আইল্যান্ড।” ওহ! তাই তো। এটা তো পড়তাম। এখন কি স্ট্যাচু দেখতে গিয়ে স্ট্যাচুর দ্বীপের নাম ভুলে খেয়ে গেছি দেখে জাতি আমায় মেনে নেবে না?

একটু পর ফেরিটা স্ট্যাচুর কাছে চলে এলো। সবার হাতে মোবাইল ক্যামেরা অন করা। আমিও পটাপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর চর্মচক্ষে উপভোগ করতে বসলাম। আমরা ছবি তুলতে গিয়ে বাস্তব অনুভূতি আস্বাদন করতে ভুলে যাই। আমি এটা চাই না বলে ছবিও তুলি, বাস্তবেও উপভোগ করি। ছোট্ট এক টুকরো স্থলভূমির উপর বসিয়ে রাখা বিশাল মূর্তিটা দেখে মনে হল, এই তাহলে সেই লেডি লিবার্টি? মায়ের পেট থেকে পড়ার পরই মনে হয় ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ নামটা শুনেছি। ফ্রান্স এটা যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দিয়েছিলো, যুক্তরাষ্ট্র এটাকে লিবার্টি আইল্যান্ডে নিয়ে রেখেছে, মাইকেল জ্যাক্সন ‘ব্ল্যাক ওর হোয়াইট’ গানে মূর্তির মশালে উঠে নেচেছে, আরও কতো কী! আমেরিকা মানেই একসময় আমার কাছে নিউ ইয়র্ক আর স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ছিল। সে নিউ ইয়র্ক শহর আর স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কোলে আমি বসে আছি। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হল! ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত কখনো চিন্তা করিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবো। উচ্চশিক্ষার জন্য আসার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কখনো ভাবিনি চেষ্টা সফল হবে। সেসব দিনের কথা চিন্তা করলে এখনও বিশ্বাস হয় না আমি যুক্তরাষ্ট্রে।

আমাদের পেছনে দাঁড়ানো একটা মেয়ে চেষ্টা করছিলো স্ট্যাচুর ছবি তোলার। সরে গিয়ে ওকে জায়গা দিলাম। আমরা তো অনেক দেখলাম, এবার মেয়েটা দেখুক। কৃতজ্ঞতায় বেচারা নুইয়ে গেলো। ছবি তুলছে আর ধন্যবাদ দিচ্ছে। আমার মত সেও ছবি তোলা শেষ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মূর্তির দিকে। চোখ জুড়ে মুগ্ধতা আর অবিশ্বাস। তারপর আরেক দফা ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো। আমি আবার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

ছবি ৩

স্ট্যাটেন আইল্যান্ড পৌঁছাতে পঁচিশ মিনিট লাগলো। পৌঁছার পর সবাইকে সেন্ট জর্জ ফেরি টার্মিনালে নামতে হল। ফেরিতে কেউ থাকতে পারবে না। নতুন করে ফেরিতে উঠে ম্যানহাটন ফিরতে হবে। আমরা টার্মিনালে নেমে খাওয়ার দোকান খুঁজতে লাগলাম। খিদে পেয়েছে খুব। একটা সাবওয়ের দোকান দেখে এগিয়ে গেলাম। দোকানে দুইজন বাংলাদেশী ব্যক্তি কাজ করছেন। উনারা নিজেদের মধ্যে বাংলায় বাৎচিত করছেন দেখে বুঝলাম বাংলাদেশী। বেচারা দুজন দেখলাম প্রচণ্ড দৌড়ের উপর আছেন। এত ক্রেতা! তার উপর কেউ কেউ আগে থেকে অর্ডার ঠিক করে রাখেননি। লাইনে দাঁড়িয়ে অন্যদের অপেক্ষায় রেখে ঠিক করছেন। এতে সময় নষ্ট হচ্ছে। ক্রেতা হারানোর ভয়ে বিক্রেতারা বিরক্ত হচ্ছেন। আমরা তাই ঝটপট ঠিক করে নিলাম কী অর্ডার দেবো। দেওয়ার দুই মিনিটের মাথায় অর্ডার বুঝে পেলাম। এক ফুট লম্বা সাবওয়ে স্যান্ডউইচ নিয়ে আমি আর প্রিন্স স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের পোতাশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে নদীর অপর পাশের দৃশ্য দেখতে দারুণ লাগছে। কালো আকাশ ভেদ করে সূর্যাস্তের দৃশ্য যে এত সুন্দর, কে জানতো (ছবি ৩)। হাতে সময় থাকলে আইল্যান্ডটা ঘুরে যেতাম। এখন আর বন্দর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। কয়েক মিনিট পর ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে ফেরি ছাড়বে। সেটা ধরবো।

(চলবে)

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ৩
Next post স্বপ্নের নিউ ইয়র্ক সিটি – পর্ব ৫