পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪
স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ফেরিতে করে ম্যানহাটন ফিরে এলাম। আসার পথে আর স্ট্যাচুর ওইপাশে দাঁড়াইনি। অন্যদিকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। এদিকে একদমই ভিড় নেই। স্ট্যাচুর ঐদিকে সবাই ভিড় জমালেও এদিকে ছাড়া ছাড়া ভাবে ঘুরছে, বেঞ্চিতে বসে আছে, অলস দৃষ্টিতে নদী দেখছে। তার উপর ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ে আবহাওয়াকে করে তুলেছে রহস্যময়। নদীর বুকে কখনো বৃষ্টি দেখেছেন? কুয়াশার মত একটা অবয়ব তৈরি করে। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখা যায়। আমি রেলিং ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া এসে শরীরে বাড়ি মারতে লাগলো। প্রিন্স ফেরির ভিতরে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। আমি একাকী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এত ভালো লাগছে! হঠাৎ খেয়াল হল পা ব্যথা করছে। গিয়ে বসলাম একটা বেঞ্চিতে। আমার পাশে এশিয়ান এক দম্পতি বসা। মাঝবয়সী। উনারাও সাবওয়ে স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন। একটু দূরে এক তামিল বা তেলুগু দম্পতি বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছিল। মানে বউ আর পুত্রের ছবি তুলে দিচ্ছিল জামাই। পুত্রকে যখনই বলা হচ্ছে “রেডি?”, পুত্র তখনই গম্ভীর মুখে বিশাল এক হাসি ফুটিয়ে ফেলছে। ছবি তোলার সাথে সাথে হাসি দূর হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে খেলায়। আমি একা বসে আছি দেখে জামাইটা এগিয়ে এসে বলল, “আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন?” হাসিমুখে মোবাইলটা হাতে নিলাম। তিনজন মিলে পোজ দিলো। ছবি তুলে বললাম, “পছন্দ হয়েছে? নাহলে আরও কয়েকটা তুলে দিই।” জামাই বলল, “সুন্দর হয়েছে, ধন্যবাদ!” কিন্তু বৌটা বলল, “অর্ধেক ছবি ভালো লাগে না। পুরোটা তুলে দিন।” ওদের সাথে আমার দূরত্ব খুব বেশি নয়। এখান থেকে পুরো ছবি তুললে আকৃতি বেঢপ আসবে। তারপরও মেঝেতে বসে, কাৎ হয়ে চেষ্টা করলাম ভালো একটা ছবি তোলার। জামাই বউ খুশি হয়ে চলে গেলো।
আটাশ মিনিটের মাথায় হোয়াইটহল টার্মিনালে এসে গেলাম। ফেরি থেকে নামার সময় দেখি আমাদের মত আরও শ’খানেক মানুষ ফেরিতে উঠার জন্য অপেক্ষা করছে। ফ্রি ফেরি রাইড বলে কথা। একটা ভ্লগে দেখেছিলাম ভণ্ডরা এই ফেরির টিকেট বিক্রি করে। পর্যটকদের মদন পেয়ে গছিয়ে দিতে চায়। ভুলেও টিকেট কিনবেন না। এটা নিউ ইয়র্ক সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে পরিচালনা করা হয়। টার্মিনাল থেকে বের হতে হতে বৃষ্টি ধরে গেল। আমাদের এবারের গন্তব্য ব্রুকলিন ব্রিজ। এখান থেকে হেঁটে যেতে বিশ মিনিট লাগবে। এক মাইলের রাস্তা। ধরলাম হাঁটা। যখন ব্রিজের গোঁড়ায় এলাম, প্রিন্সকে বললাম ব্রিজটা হেঁটে পার হতে চাই। ১.১ মাইল লম্বা পথ, আধা ঘণ্টার মত লাগবে। ওর পা ব্যথা করছিলো। সেটা কি কমেছে? প্রিন্স কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “এই মুহূর্তে আরও এক মাইল হাঁটার মত অবস্থা নেই।” বলতে বলতে আবারও বৃষ্টি নামল। ব্যাগে রাখা পনচো বের করে দুজনে পরে নিলাম। তারপর ব্রিজ থেকে বের হয়ে পাশে একটা পার্ক মতন জায়গায় গেলাম। বেঞ্চিতে বসে পা দুটোকে বিশ্রাম দিতে লাগলাম। বেঞ্চিটা গাছের নিচে হলেও পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। বড় মনোহর সে অনুভূতি।
মিনিট পনেরো বসে থেকে প্রিন্সের মনে হল পা ব্যথা একটু কমেছে। আবার হাঁটা ধরলাম ব্রিজের উদ্দেশ্যে। আবার ব্রিজের গোঁড়ায় গেলাম। সেখানে দেখলাম অদ্ভুত এক দৃশ্য। নিউমার্কেটের ব্রিজের উপর যেভাবে হকাররা পসরা সাজিয়ে বসে, সেভাবে পসরা সাজিয়েছে আমেরিকার হকাররা। পানির বোতল, পনচো, পেইন্টিং, টর্চ ইত্যাদির দোকান। সব হকার এশিয়ান। কেউ চেঁচাচ্ছে পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে, কেউ স্পিকার ছেড়ে রেখেছে। সেখানে চলছে, “ওয়ান্ডোলার ওয়ান্ডোলার!” প্রথমে আমি ভাবলাম ওয়ান্ডারল্যান্ড বলছে। পরে ভাবলাম গন্ডোলা বলছে। পরে যখন প্রিন্সও নকল করতে লাগলো, “এএএ… ওয়াটার ওয়ান্ডোলার…”, তখন বুঝলাম বলছে ওয়ান ডলার। সারাদিনে পানি দুই ডলার, তিন ডলার এমনকি চার ডলারেও কিনে খেয়েছি। এখানে এক ডলার? কিনে ফেললাম একটা বরফ ঠাণ্ডা বোতল। তারপর মানুষের স্রোতের সাথে মিশে সামনে এগিয়ে গেলাম।
এই বৃষ্টির মধ্যেও ব্রিজ দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী এসেছে। মোবাইল ক্যামেরায় ক্লিক পড়ছে অনবরত। কেউ কেউ সিনেমাটিক পোজ দিচ্ছে প্রেমিকাকে নিয়ে। হুলুস্থুল কাণ্ড। ব্রিজের প্রথম সাসপেনশন টাওয়ারের সামনে এসে স্মৃতি সব মাথায় বাড়ি দিতে লাগলো। এই তাহলে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ব্রুকলিন ব্রিজ? কতবার, কতভাবেই না মনিটরের পর্দায় দেখেছি এই স্থাপত্য! কিন্তু কেন এই সেতু এত বিখ্যাত? কারণ একসময় এটাই ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাসপেনশন ব্রিজ। ১৮৮৩ সালে উদ্বোধিত সেতুটা ইস্ট রিভারের উপর নির্মিত প্রথম স্থায়ী যাতায়াত ব্যবস্থা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের একটা গর্ব আর প্রতীক হয়ে উঠেছিলো এই ব্রিজ। এজন্য এটাকে বারবার নিয়ে আসা হয়েছে চলচ্চিত্রে, গল্পে, উপন্যাসে। সেগুলোর কারণে মানুষের মধ্যেও এই সেতু নিয়ে তৈরি হয়েছে অমোঘ আকর্ষণ।
আমরা এখন আছি ম্যানহাটনের প্রান্তে। সেতুটা দিয়ে ম্যানহাটন থেকে ব্রুকলিনে যাওয়া যায়। ওদিকেই হাঁটছি। হাঁটার রাস্তা কিন্তু পাকা নয়, কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো। সে তক্তা আবার বৃষ্টিতে ভিজে কেমন পিছলা পিছলা মনে হচ্ছে। তাই সাবধানে হাঁটছি। রাতে এই সেতুতে অনেক বাতি জ্বলে বলে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগে। তাই সকাল এবং রাত, দুই বেলাতেই দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমাদের যে হাল, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না। পারলে আরেকদিন এসে রাতের আলোকোজ্জ্বল ব্রিজ দেখে যাবো। দ্বিতীয় সাসপেনশন টাওয়ারের সামনে এসে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে চটপট ছবি তুলে নিলাম। এটুকু আসতে আসতে বৃষ্টি থেমে গেছে। তাই পনচো ব্যাগে ঢুকিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে গেলাম। নিউ ইয়র্কে ছাতা বা পনচো বা রেইনকোট, কিছু একটা হাতের কাছে রাখতে হয়। নতুবা হুটহাট বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে তীর্থের কাকের মত বসে থাকতে হবে বৃষ্টি থামার জন্য।
ব্রিজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একটা হিস্পানিক হকার চুরো বিক্রি করছে। চার ডলার দিয়ে কিনলাম। কিন্তু সে কোনো গরম মশলা মাখিয়ে দিলো না। কামড় দিয়ে দেখি ভেতরে কোনো পুরও নেই। এটা কেমন হল? সকালে শ্বেতাঙ্গ হকার দিলো চরম এক জিনিস, বিকেলে হিস্পানিক হকার একই মূল্যে গছিয়ে দিলো ফালতু এক জিনিস। ওই ফালতু চুরো খেতে খেতে সেতু পার হলাম। হওয়ার পর আরও দশ মিনিট হাঁটলাম সেতু সংলগ্ন এলাকা থেকে বের হওয়ার জন্য। বের তো হলাম, এখন বাসায় আসবো কী করে? ধর সাবওয়ে। সেই স্টেশন আবার বরো হল নামের জায়গায় যেটা বিশ মিনিটের হাঁটা। উফ! নিউ ইয়র্কে এসে এত হাঁটতে হবে, বুঝিনি। হাঁটতে হাঁটতে বিশাল এক চত্বর পার হলাম, ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্যাঁচপ্যাঁচে রাস্তা পার হয়ে এলাম স্টেশনে। ততক্ষণে আমরা আধমরা। পা কাঁপছে, মাথা হালকা লাগছে। সারাদিন পেটে সলিড কিছু পড়েনি বলে ক্লান্ত লাগছে খুব।
ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পেলাম না। এত মানুষ আজকে! পা ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাঁচ, ছয় স্টেশন পর কামরা খালি হওয়া শুরু করলো। তখন বসার জায়গা পেলাম। প্রিন্সের কাঁধে মাথা দিয়ে প্রায় ঘুমিয়েই গেলাম। বারো মাইল রাস্তা যেতে হবে। তারপর নেমে ধরতে হবে বাস। সে বাস পৌঁছে দেবে বাসার কাছাকাছি। ট্রেনের ভেতর ইলেকট্রিক বোর্ডে দেখায় কোন স্টেশন পার হলেন আর কোন কোন স্টেশন বাকি আছে। যেগুলো পার হয়েছেন, সেগুলোর উপর থাকা বাতি নিভে যায়। একসময় দেখলাম আমাদের স্টেশন এসে পড়েছে। নামলাম ম্যানহাটনের মাউন্ট ইডেন স্টেশনে। রাত বাজে সাড়ে নয়টা। এখান থেকে কিছু কিনে নেওয়া দরকার খাওয়ার জন্য। কিন্তু আশেপাশে স্ট্রিট ফুডের কার্ট দেখলাম না। অগত্যা ওয়েন্ডিজ নামের চেইন রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। ওদের অফার চলছে দশ টাকা দিয়ে একটা বার্গার কিনলে আরেকটা ফ্রি। সেটা অর্ডার দিলাম। সাথে একটা লেমোনেড। এই গরমে লেমোনেডই জীবন বাঁচাবে। বিরাট কাপ থেকে লেমোনেডে চুমুক দিতে দিতে বাস স্টপেজ খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বাস এলো। ষোল মিনিটের যাত্রা শেষে যে স্টপেজে নামলাম, সেটা বাসা থেকে একটু দূরে। ওখান থেকে হেঁটে বাসায় এলাম। শেষ হল নিউ ইয়র্ক শহরে আমাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দিন।
(চলবে)