0 1
Read Time11 Minute, 28 Second

আমার এখনও মনে পড়ে ২০১৪-১৫ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি অ্যাডমিশন পাওয়ার জন্য তখন ভীষণ চেষ্টা করছি। বেশ লম্বা আর জটিল সে প্রক্রিয়ার মাঝে একটু শ্বাস ফেলার সময় হলেই ইউটিউবে ঢুকতাম। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘ক্যাম্পাস টুর’ নামক ভিডিওগুলো দেখতাম। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ল্যাবরেটরি, ডাইনিং হল, ডরমিটরি, পাঠাগার, মাঠ ইত্যাদি দেখায়। অনেক সময় গ্রীষ্ম, হেমন্ত, বসন্ত কিংবা শীতে ক্যাম্পাসের চেহারা কেমন হয়, সেটাও দেখায়। এসব দেখতাম আর ভাবতাম, “কবে যে নিজের চোখে দেখতে পারবো গ্রীষ্মের সবুজ গাছপালা, বসন্তের চেরি ফুল, হেমন্তের লাল-হলুদ-কমলা পাতা আর শীতের বরফ!” সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে এসে জীবনে প্রথমবারের মত আমেরিকান গ্রীষ্মকাল বা সামার দেখেছি। বর্ষার ঝড়, হেমন্তের বা ফলের ‘ফোলিয়েজ’ আর বসন্তের বা স্প্রিংয়ের চেরি ব্লসোম দেখেছি। দেখেছি শীতের বা উইন্টারের তুষারপাত। মোট কথা, মিডওয়েস্টে থাকার সময় আমেরিকার ঋতুঘটিত সব কাজ কারবারই দেখা হয়েছে। কিন্তু চাকরির জন্য ইস্ট কোস্টের পেন্সিল্ভেনিয়ায় যাওয়ার পর বর্ষার ঝড় আর বসন্তের চেরি ব্লসোমটা দেখতে পাইনি। আমাদের এলাকায় চেরি গাছ ছিল না তেমন। থাকলেও চোখে পড়েনি। আর বৃষ্টি পড়তো ঠিকই, কিন্তু সেটা ঝড়ে রূপ নিতো না। সেন্ট লুইসে রীতিমতো কালবৈশাখী ঝড় দেখতাম। পেন্সিল্ভেনিয়ায় ঝড়ের দাপট না থাকলেও দাপট ছিল তুষারের। ওরে, সে কি অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের তুষার ঝড়! মুহূর্তেই এক ফুট তুষার জমে যেত। সেন্ট লুইসে কস্মিনকালে কেউ এত বেশি তুষার চিন্তা করতে পারতো না। ওখানে দুই, তিন ইঞ্চি তুষার জমলেই আমরা খুশি হয়ে যেতাম। আর ওখানকার মানুষজন তীব্র তুষার ঝড়ের সাথে পরিচিত নয় বলে পান থেকে চুন খসলেই ছুটি পেয়ে যেতাম। ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করতো আর আমরা পড়িমরি দৌড় দিতাম বাসার দিকে। পেন্সিল্ভেনিয়ায় গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুষার ঝড়ের জন্য তোমরা আপিস ছুটি দাও?”, প্রথম কয়েক মিনিট সহকর্মীরা কথাই বলতে পারছিলো না হাসির চোটে। অনেকক্ষণ পর একজন সামলে নিয়ে বলেছিল, “তুমি মিজৌরির কাহিনী মিজৌরিতেই ফেলে আসো, বাছা। এখানে বারো ফুট তুষার জমলে ছুটি চাইতে পারো, তার আগে না।” বুঝলাম তুষার ঝড় কিংবা ইঞ্চিকে ইঞ্চি তুষার এদের কাছে কিছুই না।

বিপদে পড়েছি টেক্সাসে এসে। এখানে এমন গরম! সাথে বৃষ্টি-বাদল-শীত, কিছুরই বালাই নেই। তুষারপাত বহুদূরের কথা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন টেক্সাসে তুষারপাত হয়েছিলো, টেক্সানরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। এরা তুষারপাতের সাথে পরিচিত নয়। তাই তুষারপাত সামাল দেওয়ার মত ব্যবস্থাও এদের ছিলো না। বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গিয়েছিলো, পানির পাইপ ফেটে সেখানে বরফ জমে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। চরম ঠাণ্ডায় মানুষ ঘরের ভিতর জবুথবু হয়ে দিন কাটিয়েছে। ভয়ংকর কাহিনী। সেসময় আমি টেক্সাসে ছিলাম না। জানতামই না টেক্সাস হবে আমার পরবর্তী গন্তব্য। কিন্তু নিয়মিত খবর দেখেছি। দেখে টেক্সানদের মত আমিও হতভম্ব হয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের মত আধুনিক দেশ যদি তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে এভাবে নাস্তানাবুদ হয়, সেটা হতভম্ব করে দেওয়ার মত বৈকি। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্ট মাসে টেক্সাসে পা দেওয়ার পর থেকে দুটো বছর কাটিয়ে ফেললাম, শীতকাল আর উপভোগ করতে পারলাম না। এখানকার শীত এমন ফালতু! এখানে বারো মাসের মধ্যে দশ মাসই গ্রীষ্মকাল, বাকি দুই মাস কোঁকাতে কোঁকাতে শীত। হেমন্ত আর বসন্ত কোনদিক দিয়ে আসে যায়, কেউ বলতে পারে না। বর্ষা তো নেই-ই। ওই গ্রীষ্মের মধ্যেই পেচ্ছাপের মত দুই তিন ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে, যেটা আবার গরম বাড়িয়ে দিয়ে যায়। বেল্লিকের দল ওটা নিয়েই খুব আমোদের সাথে ‘রেইনি ডে’, ‘রেইনি ডে’ বলে ক্যালায়। খালি চোখ পাকিয়ে তাকাতে পারি না বলে। নতুবা কবেই এরা ভস্ম হয়ে যেত!

ছবি ১

টেক্সাসের গ্রীষ্মের নমুনা দেখুন ছবি ১-এ। ক্ষেতের ভুট্টা ক্ষেতেই ফুটে পপকর্ন হয়ে যাবে, ওভেনে দিয়ে ফুটাতে হবে না। ক্ষেত থেকে তুলে দিব্যি খেয়ে নেবেন। তারপর রোদে পোড়া চামড়া নিয়ে বাসায় ফিরে স্নান করতে ঢুকবেন, কল দিয়ে গরম পানি পড়বে। রোদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পানি আপনাআপনি গরম হয়ে আছে। আর বিদ্যুৎ খরচ করে গিজার চালাতে হবে না। বিদ্যুৎ বিল কম আসবে। ওহ, দাঁড়ান! পোড়া চামড়ায় তো ঠাণ্ডা পানি লাগানোর কথা। তবে? আপনি অবিশ্বাসের সাথে আবারও ঠাণ্ডা পানির কল ঘুরাবেন। বের হবে ফুটন্ত গরম পানির আগের পর্যায়ের পানি। আপনি বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন শাওয়ারের নিচে। ভাববেন, এই গরম পানিতেই স্নান সারবেন কিনা। শেষমেশ স্নানের ইচ্ছাই জয়ী হবে। আপনার চামড়া দ্বিতীয় দফায় পুড়তে পুড়তে কয়লা হবে। আপনি স্নানঘর থেকে বের হয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ঠাণ্ডা হবেন। স্নান শুধু ঘাম পরিষ্কার করেছে, শরীর ঠাণ্ডা করেনি। সে কাজ করবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। এই যন্ত্র চালিয়ে আপনার বিদ্যুৎ বিল আসবে টেক্সাসের সমান। মু হা হা হা! বিলের চিন্তায় ঘামতে ঘামতে আপনি ভাববেন, টেক্সাসে এতো গরম ক্যানে? উত্তর ছবি ২-এ।

ছবি ২

বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যখন টেক্সাসের আবহাওয়া নিয়ে রসিকতা দেখি, ব্যাপক বিনোদিত হই। প্রচলিত সরলীকরণ (generalization) অনুযায়ী, টেক্সানরা বদমেজাজি, রসিকতা বুঝে না, আর কেউ ওদের নিয়ে রসিকতা করলে বন্দুক দিয়ে দৌড় দেয়। এজন্য বেশি মজা লাগে টেক্সাসকে পচাতে দেখলে। আমার বেশ কিছু খাস টেক্সান বন্ধু আছে। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা – সবই টেক্সাসে। এরা বৃষ্টি হলে বিরক্ত হয়, শীত পড়লে বিরক্ত হয়। এরা গরমের সাথে এত বেশি অভ্যস্ত যে, আমি গরম নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলে ‘হে হে’ টাইপ মুখ করে তাকায়। বুঝতে পারে না এত বিরক্তির কী আছে। যদি আমার মত মিডওয়েস্ট আর ইস্টে থেকে আসতো, বুঝতো।

ছবি ৩

ছবি ৩-এ দেখুন টেক্সাসের চারটা ঋতু। এত বড় সইত্য বলতে কলিজা লাগে। তাই বক্তাকে তীব্র সমর্থন জানালাম। এই বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী আমরা এখন ‘স্টিল সামারে’। চল্লিশ ডিগ্রির ভয়াবহ গরম নেই, কিন্তু তিরিশ-একতিরিশ ডিগ্রির গরম আছে। সকাল আর রাতে ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া শুরু করেছে কিন্তু মধ্য দুপুরে যেই কে সেই গরম। এই গরমে আর যাই হোক, ফল বা হেমন্ত বুঝা যায় না। টেক্সাস এতই অদ্ভুত যে, কলেজ স্টেশন নামের যে মফস্বলে আমরা থাকি, সেখানে গাছপালা থাকলেও সেগুলোর রঙ বদলায় না। সবুজ থেকে তীব্র দাবদাহে ভুগে একদিন শুকিয়ে খয়েরি হয়, তারপর টুপ করে ঝরে যায়। প্রথম বছর খুব অবাক হয়েছিলাম। এ কী কাণ্ড! দ্বিতীয় বছর আবার খেয়াল করলাম। এরপর থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিলাম। পাণ্ডব বর্জিত এই অঙ্গরাজ্যে কিছুই অসম্ভব নয়। সুখের কথা, টেক্সাসের সব এলাকা এরকম নয়। কিছু কিছু স্টেট পার্কে ফল ফোলিয়েজ দেখা যায়। ফোলিয়েজ হল পাতার সমষ্টি বা পর্ণরাজি। ফল ফোলিয়েজ হল হেমন্ত ঋতুতে পাতার রঙ বদলে যে লাল-হলুদ-সবুজ-খয়েরি-কমলা রঙের সমষ্টি দেখা যায়, সেটা। তবে কিনা, অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে যেখানে সেপ্টেম্বর থেকে পাতায় রঙ ধরা শুরু হয়, টেক্সাসে রঙ দেখতে চাইলে অপেক্ষা করতে হয় অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। তার উপর, আগে যেখানে বাসার সামনেই গাছপালায় রঙ বেরঙ দেখতে পেতাম, এখন সে রঙ দেখতে হলে ড্রাইভ করতে হয় চার-পাঁচ ঘণ্টা!

খুব করে চাইছি যেন পিএইচডি শেষেই টেক্সাস ত্যাগ করতে পারি। আশা কতটুকু পূরণ হবে জানি না। ক্যালিফোর্নিয়ার পর টেক্সাসই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ইকোনোমিক হাব হয়ে উঠেছে। চাকরি বাকরির সুযোগ বেশি। শেষে না এখানেই আমার চাকরি হয়ে যায়!

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
100 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ১৯ (নির্ঘুম রাত)
Next post দৈনন্দিন জীবন, হলিডে সিজন…