1 0
Read Time11 Minute, 57 Second

যুক্তরাষ্ট্র নামক বিভূঁইয়ে হেমন্তকাল বা ফল শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমার খুশি খুশি লাগতে থাকে। অনেকবার বলেছি, বছরের এই সময়টা আমার সবচেয়ে প্রিয়। এখন একের পর এক তামাশা লেগেই থাকবে। ফল ব্রেক, হ্যালোউইন, থ্যাংকসগিভিং, বড়দিন, নতুন বছর… উফ! প্রতি বছর অক্টোবর শুরু হলেই আমি বাসা সাজাতে শুরু করি। বেশি কিছু না, এই ধরুন বড়দিন বৃক্ষের মরিচবাতি জ্বালিয়ে দিই, সাথে জানালায় হালকা মরিচবাতি দিয়ে সাজাই। সন্ধ্যার পর চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে মরিচবাতিগুলো যখন জ্বলে, দারুণ উৎসব উৎসব লাগে। এই বছর আরেক দফা রগড় করতে সুগন্ধি ছড়ানোর যন্তর কিনে এনেছি। দেশে মশা তাড়ানোর জন্য যে লিকুইড ভেপোরাইজার ব্যবহার করতাম, সেরকম যন্ত্রই। খালি এটা বাসায় সুগন্ধ বিলাবে, মশা তাড়াবে না। ওই গন্ধ বেশ একটা হলিডে হলিডে অনুভূতি দিচ্ছে। আপনি চাইলে লেবুর তাজা গন্ধ, ফুলের গন্ধ, দারুচিনির গন্ধও কিনতে পারেন। আমি কিনেছি হলিডে ধরনের গন্ধ। আবার ক’দিন আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টে হ্যালোউইন পার্টি হল। যে যার খুশিমত কুমড়োর গায়ে আঁকিবুঁকি করলাম। ভূত আঁকতে গিয়ে জোকার এঁকে ফেললাম। ভয় পাওয়ার বদলে একচোট হাসাহাসি হল। সে জোকার চেহারার ভূতুড়ে কুমড়োগুলো এখন শোভা পাচ্ছে আমার বড়দিন বৃক্ষের পায়ের তলে।

আর কীভাবে ঘর সাজানো যায় চিন্তা করতে করতে মাথায় এল পানীয়ের বোতলে আঁকাআঁকির কথা। বটল পেইন্টিং যাকে বলে। বাসায় বেশ কিছু ওয়াইনের বোতল জমেছে। ওগুলোর উপর কীভাবে আঁকা যায় সেটা নিয়ে ইউটিউবে হালকা ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার পর বসে পড়লাম কাজে। প্রথমে জেসো (gesso) দিয়ে বোতলের উপর পেইন্ট করে সবকিছু ঢাকলাম। এরপর শুরু হল আসল আঁকিবুঁকি। কালোর উপর সোনালী রঙের খেলা আমার সবসময় প্রিয়। তাই এই ঢঙে একটা করলাম। তারপর ভাবলাম অফ হোয়াইট রঙের একটা বোতল করি, সেটার উপর দড়ি দিয়ে নকশা করব। কিন্তু অফ হোয়াইট রঙটা আনতেই পারলাম না। হয়ে গেলো dusty pink, বাংলায় বললে হলদে গোলাপি। কিন্তু সে রঙই আমার ভালো লেগে গেল। এটার উপর শুধু দড়ি দিয়ে প্যাঁচালে মানাবে না। তাই দড়ি দিয়ে বেণী বানিয়ে সেটাকে রাঙালাম সোনালী রঙে। তারপর যা মনে এল, তাই নকশা করলাম। শেষে দেখি খুব একটা খারাপ হয়নি। প্রিন্স তো বোতলগুলো দেখে হতবাক! অবশ্য জামাই বলে কথা। একটু পক্ষপাতিত্ব থাকবেই আমার প্রতি। আপনাদের কেমন লাগছে, পাঠক?

আর মাত্র আড়াই মাস পর বড়দিন। দেখতে দেখতে বছরটা ফুরিয়ে গেল। ছোটবেলায় বড়দিন মানেই নতুন জামাকাপড় কেনার ধুম ছিল। বড় হতে হতে দেখি জামাকাপড় কিনতে আর উৎসব লাগছে না। যখন প্রয়োজন পড়ছে, তখনই কিনছি। এবারও কিছু জামা কেনার প্রয়োজন পড়ল। গেলাম রস নামের দোকানে। এটা একটা ডিস্কাউন্ট শপ, মানে কম দামে ব্র্যান্ডের জিনিস বিক্রি করে। আমার একটা ঢোলা জিন্সের প্যান্ট লাগবে। যেগুলো আছে, সব লেগিংস টাইপ, পায়ের সাথে এঁটে থাকে। শীতকালে এগুলো পরলে খুব ঠাণ্ডা লাগে। একটা ঢোলা প্যান্ট কিনলে তার ভেতরে লেগিংস পরে নিলে ঠাণ্ডা ঠেকান যাবে। আর প্রিন্সের পরিকল্পনা হল কয়েক জোড়া মোজা কেনার।

রসে যাওয়ার পর মাথা খারাপ হয়ে গেল। প্রতিবারই হয়। আমরা খুব হিসেব করে রসে যাই, কিন্তু সেখানে গিয়ে এটা সেটা দেখে মন তরল হয়ে যায়। প্যান্ট কিনতে গিয়ে আমি একটা জিন্সের জ্যাকেট আর একটা উইন্ড ব্রেকারও কিনে ফেললাম। এত সুন্দর দুটো জিনিস! এরপর মনে হল একটা চটি জুতো দরকার। কেডস সবসময় পরা যায় না। কিনে ফেললাম এক জোড়া জুতো। প্রিন্স ভেবেছিলো কয়েক জোড়া মোজা কিনে খালাস হয়ে যাবে। সেও দেখি একটা জিন্সের প্যান্ট আর একটা ভেস্ট কিনে ফেলল। ভেবেছিলাম বিশ ডলারের মধ্যে বাজার হয়ে যাবে, অথচ খরচ দাঁড়াল একশো ত্রিশ ডলারে। জামাকাপড়ের পিছে এতো টাকা নষ্ট করে দুইজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল। প্রিন্স বলল, সে তার প্যান্ট ফেরত দিয়ে টাকা রিফান্ড নিয়ে আসতে চায়। আমি তেড়ে উঠলাম। জিনিস আমি বেশি কিনেছি। ফেরত দিলে আমি দেব। তাতে প্রিন্স রাজী হয় না। আমার নাকি জিনিসপত্র বেশি দরকার, আর ওর না হলেও চলবে। অথচ ওর চেয়ে ওয়ারড্রোবে জামাকাপড় আমার বেশি। ফেরত দেওয়া আমারই মানায়। শেষ পর্যন্ত দফা রফা হল যে, কেউই ফেরত দেব না। বছরে একবার জামাকাপড়ের পিছে খরচ করাই যায়। এটাকে আমাদের হলিডে শপিং ধরে নিই, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

এদিকে আমার ইরানী বন্ধু সাহারের জীবনে ঘটেছে অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ওর কথা আগেও বলেছি। নয় মাস হল যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, এখনও কালচারাল শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ওর বাসায় যেদিন প্রথম গিয়েছিলাম, আমাকে চা খেতে দিয়েছিল। লাল চা, কিন্তু আমরা যে চা-পাতা দিয়ে বানাই (লিপ্টন বা সিলন), সেরকম স্বাদ নয়। কেমন যেন সবুজ চা বা ভেষজ চায়ের স্বাদ। জিজ্ঞেস করলাম এটা কি বিশেষ ধরনের কোনো চা-পাতা? সাহার মাথা নাড়ল। না, এটা ওদের দেশের স্বাভাবিক চা-পাতা দিয়ে বানান চা। বুঝলাম ইরানের সাথে বাংলাদেশের চা-পাতার স্বাদে বেশ পার্থক্য। আরও পার্থক্য চা খাওয়ার নিয়মে। ইরানীরা দুধ চা তেমন খায় না, লাল চায়েই অভ্যস্ত। আমাদের মত একগাদা চিনি আর কন্ডেন্সড মিল্ক দিয়ে বানান অমৃতসম চায়ের কথা শুনে সাহার আকাশ থেকে পড়ল। আর আমার জবান বন্ধ হয়ে গেল সাহারের চা খাওয়া দেখে। সে চা বানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঝুরা চিনি ব্যবহার করেনি। আলাদা পিরিচে চিনির কিউব রেখেছে যেন আমার প্রয়োজন হলে আমি সেখান থেকে নিই। ইংরেজদের মত। আমি তিনটা কিউব নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ফেলে চামচ দিয়ে নেড়ে সেগুলো গলালাম। তারপর চুমুক দিলাম। সাহার সেটা দেখল বিস্ময় নিয়ে। তারপর শুরু করল তার স্টাইলে চা খাওয়া। প্রথমে একটা কিউব নিয়ে মুখে পুরল। তারপর পেয়ালা থেকে গরম চায়ে চুমুক দিল। গরম চা মুখের ভেতর থাকা কিউবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিষ্টি স্বাদ তৈরি করবে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, অত কষ্ট করার কী দরকার? চায়ের পেয়ালায় কিউব ছেড়ে নেড়ে নিলেই হল! চা মিষ্টি হয়ে যাবে। শুনে সাহার আহত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি নিশ্চয় তাদের অভিজাত ইরানী কায়দায় পানি ঢেলে জংলী পরামর্শ দিয়ে ফেলেছি।

তো, অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা হল, সাহার কফি খাওয়া ধরেছে। ক’দিন আগেও কফির কথা বললে ওর নাকমুখ কুঁচকে যেত যেন কফির মত ফালতু পানীয় আর হয় না। বাংলাদেশের মত ইরানের মানুষও কফির চেয়ে চায়ে বেশি অভ্যস্ত। তাই আমি যখন বলেছিলাম, “এখন পাত্তা না দিলেও আমেরিকা তোমাকে বদলে দেবে। কফি ছাড়া বাঁচতে পারবে না”, সাহার হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, “কক্ষনো না। কফি আমার কাছে বিস্বাদ লাগে।” ওর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে আমি ধরে নিয়েছিলাম এই প্রথম একজনকে দেখব যে আমেরিকায় আসার পরও কফিখোর না হয়ে থাকতে পেরেছে। তারপরও কয়েকমাস পরপর ওকে জিজ্ঞেস করতাম, “কফি খাওয়া ধরেছ? নাকি এখনও চা দিয়েই চলছে?” সাহার ঠোঁট উল্টে বলত, “আমি জীবনেও কফির নেশা করব না। চা-ই বেস্ট।”

কয়েকদিন আগে কী নিয়ে আলাপচারিতার ফাঁকে সাহার বলল, “গতকাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।”

“কেন?”

“বিকেলে স্টারবাক্স থেকে এক মগ কফি খেয়েছিলাম।”

আমি সরু চোখে তাকালাম। সাহার সেটা দেখে বলল, “এই একবারই খেলাম। আর খাবো না। কফি খেলে ঘুম হয় না।”

আমি আর ঘাঁটালাম না। কয়েক সপ্তাহ পর যখন দুজনে মিলে মুদি দোকানে কেনাকাটা করতে যাচ্ছি, সাহার জিজ্ঞেস করল, “তুমি যেন কোন ব্র্যান্ডের গ্রাউন্ড কফি খাও?”

“কমিউনিটি। কেন?”

“এমনিই। যদি কখনো কফি কিনি, এজন্য।”

“তার মানে কফি কেনার প্ল্যান করছ?”

“আরে না…। যদি কখনো কিনি আর কি।”

পরেরবার যখন মুদি দোকানে যাচ্ছি, সাহার জিজ্ঞেস করল, “তোমার কফি মেকারটা কোন ব্র্যান্ডের? ওটা কি ওয়ালমার্ট থেকে কিনেছিলে?”

আমি চেহারা স্বাভাবিক রাখতে রাখতে বললাম, “হ্যাঁ। মাত্র পনেরো ডলার দাম। তুমি কিনবে নাকি?”

সাহার আমতা আমতা করে বলল, “একটা এস্প্রেসো মেশিন কিনেছি। কিন্তু ওটা দিয়ে কফি বানান ঝামেলার। যদি একটা মেকার কিনতে পারি, ভালোই হয়।”

“তাহলে কি কফি ধরেছ অবশেষে?”

সাহার হারু পার্টির মত চিমসানো মুখে বলল, “হ্যাঁ। রাত জেগে কাজ করার জন্য কফির বিকল্প পাচ্ছি না। চা দিয়ে কাজ হচ্ছে না।”

আমি খ্যাক খ্যাক করে হেসে ফেললাম। এই তো মাহতারমা লাইনে এসে পড়েছেন। জয়তু কফি!

Happy
Happy
50 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
50 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post চলে এলো আমেরিকার হেমন্তকাল (ফল ২০২৩)
Next post ইয়ো অ্যামট্রাক…উই আর খামিং!