ধুঁকতে ধুঁকতে বাইরে বের হওয়ার গেটের সামনে এলাম। হঠাৎ প্রিন্সের চোখে পড়ল গেটের একপাশে ওষুধের ভেন্ডিং মেশিন রাখা। মেশিনের ভেতর বিভিন্ন ওষুধের জন্য বিভিন্ন সিরিয়াল নাম্বার দেওয়া। একদম কোমল পানীয় বা স্ন্যাক্সের ভেন্ডিং মেশিনের মতই। এসব ওষুধ কিনতে কোনো প্রেসক্রিপশন লাগে না। তাই এদেরকে বলে ‘ওভার দা কাউন্টার’ ওষুধ। মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে কিপ্যাডে সিরিয়াল নাম্বারটা টাইপ করলেই ওষুধ বের হয়ে কাউন্টারে পড়বে। মেশিনের বারো নাম্বার ওষুধটা টাইলেনল। জ্বর আর ব্যথানাশক ওষুধ। দেশে যেমন নাপা, এখানে তেমন টাইলেনল। ওটাই দরকার আমার। প্রিন্স তাড়াহুড়ার চোটে বারোর বদলে এগারো নাম্বার টাইপ করল। দশ ডলার কেটে নিল আর কাউন্টারে এল মিউসিনেক্স নামের ওষুধ। সান্ত্বনার ব্যাপার হল, এটা কাশির ওষুধ। কাশি বেশি ঝামেলা করলে এটা খাওয়া যাবে। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বারো নাম্বার টাইপ করা হল। চলে এল ৫০০ মিলিগ্রামের টাইলেনল। প্যারাসিটামল খালি পেটে খেতে মানা করে আলসারের ব্যথা উঠতে পারে বলে। তাই ওষুধটা এখন খাব কি খাব না, ভাবতে শুরু করলাম। পেট একদম খালি। খিদে তেমন টের পাচ্ছি না শরীর ভালো না বলে। কিন্তু শেষ নাস্তা খেয়েছি ঘণ্টা তিনেক আগে। সেটা এতক্ষণে হজম হয়ে পগারপার। আবার যে হারে কাঁপছি, তাতে এখনই ওষুধ না খেলে আমি দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারব কিনা সন্দেহ। খালি মনে হচ্ছে পপাত ধরণীতল হব। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে একটা বিছানা এনে দেয় না কেন?
যা থাকে ভবিষ্যতে ভেবে খেয়েই ফেললাম একটা ট্যাবলেট। আমার ডিওডেনাল আলসারের সমস্যা আছে। সেটারই ব্যথা উঠবে ভেবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। এরপর গেট দিয়ে বাইরে বের হলাম। হুট করে একগাদা ঠাণ্ডা বাতাস এসে ধাক্কা মারল। অন্যরা দেখি টি-শার্ট বা পাতলা সোয়েট শার্ট পরে রাস্তায় হাঁটছে। অথচ আমি ভেতরে সোয়েট শার্ট, বাইরে জ্যাকেট পরেও হু হু করে কাঁপছি। মোবাইলের ওয়েদার অ্যাপ থেকে ভেগাসের আবহাওয়া সম্পর্কে একটু ধারণা নিয়েছিলাম। এবার বাস্তবে মিলিয়ে দেখলাম। সেন্ট লুইসের চেয়ে উষ্ণ। মরুভূমির মধ্যে তৈরি শহর বলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও কম। বাতাস শুকনো। কিন্তু এত সুন্দর আবহাওয়া আমি উপভোগ করতে পারছি না। সবাই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। অথচ আমি চেষ্টা করছি জ্যাকেটটা গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়াতে। বেশ কিছু মানুষ আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছি তাদের মনোভাব। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা সবারই জানা। সবাই হয়ত ভাবছে আমি করোনায় আক্রান্ত। আমার কাঁপুনি আর কাশি তাদের সন্দেহকে উশকে দিচ্ছে। চাচ্ছি দ্রুত লিফটে উঠে গন্তব্যে পৌঁছাতে। কারো আতংকের কারণ হতে চাই না। কিন্তু বিধিবাম! আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা ট্যাক্সি স্টেশন। একের পর এক ট্যাক্সি এসে থামছে আর লোকজন উঠাচ্ছে। প্রায় দশ মিনিটের মত এদিক ওদিক ঘুরেও আমরা উবার বা লিফটের স্টেশন খুঁজে পেলাম না। এজন্যেই বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। চাচ্ছি তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে, অথচ হয়ে উঠছে না।
আবার ঢুকলাম এয়ারপোর্টে। এবার আর হাঁটার শক্তি নেই। ধপ করে বসে পড়লাম একটা বেঞ্চে। প্রিন্স জিপিএস দিয়ে খুঁজে বের করল লিফটের স্টেশন। সেখানে যাওয়ার জন্য দুই তলায় উঠে এলিভেটর দিয়ে নামতে হবে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। আমাদের সামনে দুই তলায় উঠার সিঁড়ি। মনের সব শক্তি জড় করে উঠা শুরু করলাম। দুই তলায় উঠে খানিকক্ষণ হাঁটতে হল। একটা কাঁচের সেতু পার হলাম। তখন ভেগাস শহরের খানিকটা চোখে পড়ল। কোথা থেকে যেন ভাজা মুরগীর সুবাস আসছে। খিদে টের না পেলেও জিভে পানি চলে এল। প্রিন্স জিজ্ঞেস করল, সরাসরি এয়ার বিএনবিতে যাব নাকি যাওয়ার পথে কোনো রেস্তোরাঁয় থেমে খাবার কিনব? আমার শরীর এখন খাবারের চেয়েও বিশ্রাম বেশি চাচ্ছে। বললাম, আগে বাসায় যাই। ঘণ্টাখানিক শুয়ে থাকি। একটু সুস্থবোধ করলে খাবার খুঁজতে বের হব। প্রিন্স লিফটের অ্যাপে গিয়ে লিফট ডাকল। সেটা আসতে পনেরো মিনিট লাগবে। এত সময় কেন? আমি সমানে কাশছি আর বমির জন্য হাতে ধরে রেখেছি প্লাস্টিকের থলি। আমাকে কি তবে করোনা ভাইরাস ধরে ফেলল? হালকা ঝুঁকি নিয়ে ঘুরতে আসাটা কি ভুল হল? আমার ভ্রমণ কি এয়ার বিএনবিতে শুয়ে কাটবে? আমি কি ভেগাসে এসেও সেটা দেখতে পারব না? আগামীকালের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ কি বাতিল করতে হবে? বাতিল করলেও তো রিফান্ড পাব না। রিফান্ড পেতে হলে চব্বিশ ঘণ্টা আগে বাতিল করতে হয়। তারমানে ১৫৬ ডলার গিরিখাদে পড়বে।
অবশেষে এল আমাদের লিফট। ওটার ভিতরে ঢুকে হেলিয়ে পড়লাম প্রিন্সের ঘাড়ে। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মনে হল অতল গহ্বরে পড়ে যাচ্ছি। স্বপ্নে পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে গেলে যেমন লাগে, তেমন। পেটের ভিতর প্রজাপতি নেচে উঠল। সেই সাথে তীব্র বমির ভাব। প্রিন্স আমার মন অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য বলল, ‘দেখ, ভেগাস! আমরা কতবার ইউটিউবে এসব হোটেল দেখেছি।’ আমি অনেক কষ্টে চোখ মেলে চাইলাম। আসলেই তো। কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে সে জায়গা সম্পর্কে পড়াশোনা করে যাওয়াটা আমার অভ্যাস। ভেগাস সম্পর্কেও পড়ে এসেছি। এখন চোখের সামনে দেখে কেমন স্বপ্নালু লাগছে। রাতের ভেগাস। চারদিকে শুধু আলো আর আলো। হঠাৎ চোখে পড়ল নগ্ন মেয়েদের ছবিওয়ালা বিলবোর্ড। মেয়েগুলো হাত দিয়ে বুক আর যৌনাঙ্গ ঢেকে রেখেছে। বাকি শরীর খোলা। স্ট্রিপ ক্লাবের বিজ্ঞাপন। এসব সম্পর্কে কত পড়েছি হুমায়ূন আহমেদ বা অন্যান্য লেখকের লেখায়! পরপর কয়েকটা বিলবোর্ডে মেয়েদের বিজ্ঞাপন দেখে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। ছেলেদের ছবি কোথায়? যৌন চাহিদা কি শুধু পুরুষের আছে? মেয়েদের চাহিদা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন? ঠিক তখনই চোখে পড়ল ছেলেদের সিক্স প্যাকওয়ালা ছবি। এদের আবার নগ্ন করেনি। কোমর পর্যন্ত খোলা রেখে নিচে প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছে (ছবি দ্রষ্টব্য)। মুভিতে বা টিভি সিরিজে যেমন ইচ্ছেমত নারী শরীর দেখায় কিন্তু নর শরীর দেখানোর বেলায় আপত্তি, ভেগাসেও দেখি একই কাণ্ড। এই আধুনিক যুগেও পাপের শহরে মানুষ কী পরিমাণ লিঙ্গ বৈষম্য করে!